:::: এক ::::
একটানা পানি পড়ার আওয়াজ ভেসে
আসছে।
কেউ বুঝি বাথরুমের ট্যাপটা
ছেড়ে রেখেই চলে গিয়েছে। টিপটিপ টিপটিপ...ফোঁটাগুলো বেশ বড়বড়। ট্যাপের নীচে মনে হয়, স্যান্ডেল টাইপের কিছু একটা আছে। আওয়াজটা খুব তীক্ষ্ণ নয়, খানিক ভোঁতা। বাইরে
এতক্ষণ গাড়ির হুইসেল আর রিক্সা টেম্পুর প্যাঁ-পু-তে মাথা ধরে যাচ্ছিলো। সেসব আওয়াজ
কমে আসতেই এখন শুরু হয়েছে এই ট্যাপের পানি পড়ার আওয়াজ।
বেশ অনেকদিন আগে একটা কথা
শুনেছিলাম। যাচাই করে দেখার সময় অথবা সুযোগ কোনটাই হয়ে ওঠে নি আগে। শুনেছিলাম,
মানুষের একটা কোনো ইন্দ্রিয় অচল হয়ে গেলে নাকি অন্য ইন্দ্রিয়রা আরো বেশি মাত্রায়
সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। এক ইন্দ্রিয়ের অবসর গ্রহণের সুযোগে অন্য ইন্দ্রিয়গুলো দায়িত্ব
বেশ কয়েক দফা বেড়ে যায়। এখন তো হাতে সময়ের অভাব নেই। তাই প্রতিনিয়ত কথাটার সত্যতা
মেপে দেখার চেষ্টা করছি। আজ দু’বছর
হতে চললো এক দূর্ঘটনায় চোখ দুটো হারিয়ে আমি পুরোপুরি অন্ধ।
প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে বেশ
কষ্ট হয়েছে। এতদিনের অভ্যস্ত ছকে বাঁধা জীবনের নিয়ম ভেঙে আচমকাই সুর-তাল-লয় বিহীন
জীবনের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়া। চাইলেই কি আর এত সহজে মানিয়ে নেওয়া যায়?
এই দু’বছরে আমার আর আমার
আশেপাশের প্রত্যেকের জীবনেই অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রত্যেকেরই
দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক। এতদিন আমি ছিলাম সবকিছুর অগ্রভাগে। সবার মনোযোগের
কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রত্যেকের যাবতীয় প্রয়োজন, চাহিদা, ইচ্ছা অনিচ্ছা...সবকিছুই
পূর্ণতা পেয়েছে আমারই বেঁধে দেওয়া গণ্ডির সীমারেখাতেই। আজ সবাই মুক্ত...স্বাধীন। যার
যার প্রয়োজনমতো নিজেরাই টেনে নিয়ে চলেছে জীবনের চাকা। পেছনে ফেলে রাখা ব্যবহৃত
আসবাবের মতোই আমি পড়ে আছি। এতদিন অনেক প্রয়োজন মিটিয়ে আজ শরীরের কোনায় কোনায় জমে
গেছে ধুলোবালি আর নড়বড়ে জং।
মিলি খুব চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ই-মেইল চালাচালিও শুরু করে দিয়েছে। বিশ্বের বড় বড় আই
স্পেশালিস্টদের মতামত, পরামর্শ নিয়ে চলেছে নিয়মিত। তারা প্রত্যেকেই মিলির আহবানে
সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আমার আই টেস্টের রিপোর্টগুলো দেখে নিজেদের
মতামত জানাচ্ছেন। প্রতিদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে মিলি
সেই ইমেইল গুলো আমাকে পড়ে শোনায়। আমি আগ্রহ নিয়ে শুনি। কেউ পুরোপুরি হতাশার কথা
শোনায় না। প্রায় প্রত্যেকেই শতভাগ না হলেও চল্লিশ-পঞ্চাশভাগ আশার কথা বলেন। আমার
চোখের ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন শেষে তারা জানাতে পারবেন, কর্নিয়া প্রতিস্থাপন
সম্ভবপর হবে কী না। বিদেশে এই কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য যাওয়া খরচ সাধ্য তো বটেই,
তাছাড়া সেরে ওঠার সম্ভাবনাও একেবারে নিশ্চিত নয়। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে কিছু বাধাও
আছে। চোখের টিস্যুর সাথে প্রতিস্থাপিত কর্নিয়াটি পুরোপুরি খাপ না খেলে পুরো
অপারেশনটাই মাঠে মারা যাবে।
মিলি তবুও খোঁজ খবর নিয়েই
চলেছে। কোন দেশে গেলে বেশি ভালোভাবে কাজটি করা সম্ভব হবে, সম্ভাব্য খরচ, শতভাগ
সাফল্যের সম্ভাবনা, কৃত্রিম কর্নিয়া প্রতিস্থাপন সম্ভব কী না...ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি
মিলির কাছে কৃতজ্ঞ। অকেজো, অচল হয়ে পড়া এই অন্ধ আমাকে নিয়ে মিলির ভাবনার শেষ নেই।
সে যেন আমাকে আবার জীবনের ছন্দে ফিরিয়ে আনার দুরূহ পণ করে বসেছে। এই
পরম দুঃসময়ে মিলি আমার ব্যবসার হাল নিজের হাতে তুলে না নিলে সবকিছু এতদিনে শেষ হয়ে
যেত। কিছুই শেষ হয়নি...মিলি কিছুই শেষ হতে দেয়নি। সে নিপুণ দক্ষতায় ঘর আর বাহির
সামলে চলেছে। ওকে দেখে কে বলবে, দু’দিন আগেও সে ঘরদোর আগলে রাখা এক সামান্য কুলবধূ
ছিল? স্বামী, সন্তান আর সংসারের চার দেওয়ালের মাঝেই তার সবটুকু যাতায়াত সীমাবদ্ধ
ছিল! আমার ব্যবসার আধাআধি অংশের পার্টনার হারুণ আমার আরেকজন শুভাকাঙ্ক্ষী। এই
হারুণ না থাকলে আজ আমি কোথায় ভেসে যেতাম কে জানে! পার্টনারদের প্রতারণার কত কেচ্ছা কাহিনী শুনে এসেছি এতদিন! শতভাগ মালিকানা হাসিলের আশায় কত পার্টনার আরেকজনকে ধ্বংস
করতে পিছপা হয় না। ছলে বলে কৌশলে ছিনিয়ে নেয় পুরো
স্বত্ব। আমি সেদিক দিয়ে পরম ভাগ্যবান।
হারুণ আমার ভার্সিটি জীবনের বন্ধু।
ভার্সিটির হলে আমরা পাশাপাশি রুমে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। দুজন দুই ডিপার্টমেন্টের
হলেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। আমার মাথায় সেই সময় থেকেই ব্যবসার ফন্দি ঘুরে
বেড়াতো। নানারকম আইডিয়ার গল্প শোনাতাম হারুণকে।
ইচ্ছে ছিল ওকে দলে টানার। হারুণ অবশ্য ওতটা আগেভাগে ভাবতে শুরু করেনি। তার
ইচ্ছে ছিল, পাশ করে চাকরীবাকরির চেষ্টা করবে। প্রথমেই
ওসব ব্যবসার ধান্ধায় ঢোকার ইচ্ছে তার মোটেও ছিল না।কিন্তু পাশ করার এক বছর পরও যখন
বেকারের তকমা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে হলো, তখন সে নিজে থেকেই একদিন আমার দ্বারে টোকা
দিল। আমি তখন এক বছরেই বেশ গুছিয়ে নিয়েছি।
সফটওয়্যারের বিজনেস দিয়ে শুরু
করেছিলাম। দু’জন এসিস্টেন্টও জোগাড় করে ফেলেছি
যারা নামমাত্র বেতনে কাজ করছে। শুরুটা সামান্য মূলধনেই। তবে মাসশেষে লাভের অংকটা
আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। হারুণকে অংশীদার করে নিলাম। অল্পকিছু মূলধন আমাকে দিতে
পারলো হারুণ। আমি ওকে ফিফটি পার্সেন্টেরই পার্টনার বানিয়ে ফেললাম। জানের বন্ধু
আমার। সুখে দুঃখে এমন বন্ধুকে পাশে পাওয়া বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। দিনে দিনে আমাদের
ব্যবসা ডালপালা ছেড়েছে। সফটওয়্যার থেকে হার্ডওয়্যারের দিকে ঝুঁকেছি আমরা। আজ
আমাদের ‘কম্পিউটার সিটি’ দেশের পাঁচটি সেরা কোম্পানির একটি। শতশত মানুষ কাজ করছে
আজ আমাদের কোম্পানিতে। দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে আমরা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে
পেরেছি।
সেদিনের সেই সিদ্ধান্তটি ভুল
ছিল না আমার। আজ হারুণ ছিল বলেই শত প্রতিকূলতার পরেও এই দু’বছরেও আমাদের কোম্পানি
মুখ থুবড়ে পড়েনি। লাভের অঙ্ক থেকে এক কানাকড়িও আমাকে বঞ্চিত করে না হারুণ। মিলিকেও সে
নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে চলেছে। জীবনের কিছু কিছু বন্ধুত্বের জন্য
শতভাগ পার্টনারশিপের প্রয়োজন পড়ে না। ফিফটি পার্সেণ্টেও শতভাগ নিশ্চয়তা মিলে যায়। তবু
ঐ যে...ইন্দ্রিয়ের অধিকতর সংবেদনশীলতা! কীসের জন্য যেন ইন্দ্রিয়গুলো খুব বেশি সজাগ
হতে চায় ইদানীং। আমি পাত্তা দিতে চাই না। তবু কেন যেন তারা পিছ ছাড়তে চায় না আমার।
:::: দুই ::::
সেই দিনটিকে ভোলার জন্য অনেক
চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতিকে মন কেন যেন কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে
না। মেমরি সেলের কোনো এক সুরক্ষিত স্থানে তাদেরকে যত্ন করে ধরে রাখে। শত আঁচড়েও
কিছুমাত্র ক্ষতি হয় না তাদের। এক্সিডেন্টের স্মৃতিটাও তেমনই একটা কিছু। রোজকার
মতোই অফিসে যাচ্ছিলাম। তবে বনানীতে আমাদের নিয়মিত অফিসে নয়। উত্তরাতে আমরা নতুন যে
শাখা খুলেছি সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলাম সেদিন। হারুণ
আগের দিন রাতে ফোন করে জানিয়েছিল ন’টার আগে ভাগেই সেখানে পৌঁছে যেতে। বিদেশী কিছু
ডেলিগেটদের আসার কথা ছিল সেদিন। তাদের সাথে জরুরি মিটিংটা কিছুতেই যেন মিস না করি।
হারুণকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘তুই আবার কবে থেকে আমাকে তাড়া দিতে শুরু করলি?
এতদিন তো ঐ কাজটা আমিই করে এসেছি!’ সকালে নাস্তার টেবিলে মিলির সাথে দেখা হলো না।
আমাদের একমাত্র ছেলে
রুম্মানের স্কুল শুরু হয় সকাল সাড়ে আটটায়। ড্রাইভারকে নিয়ে মিলি সকাল সকাল স্কুলের
উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বহুদিনের পরিচিত ড্রাইভার। তবু এখনো তার হাতে রুম্মানকে
ছেড়ে দিতে সাহস পায় না মিলি। ড্রাইভারের আশায় বসে না থেকে অন্য গাড়ি নিয়ে নিজেই
বেরিয়ে পড়লাম। একসময় বেশ ভালোই ড্রাইভিং পারতাম
আমি। ড্রাইভার রাখার পর থেকে অভ্যাসের অভাবে আত্মবিশ্বাস কমে এসেছিল। গাড়িটাও কেন
যে এলোমেলো আচরণ করছিল সেদিন, আজো ভেবে তার কূলকিনারা পাই না! পেছন থেকে ক্রমাগত
হর্ণ বাজছিলো, তবু সাইড দিতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে গালিগালাজও ভেসে আসতে লাগলো।
গতিতেও যেন আমার নিজের কোনো
নিয়ন্ত্রণ ছিল না। দূরন্ত গতিতে ভয় পেয়ে গাড়িটা থামাতে চাইলাম, পারলাম না। ব্রেকে
পা-টা দিয়েই রেখেছিলাম, তবু কিছুতেই ব্রেক কষতে পারছিলাম না। আর হঠাৎ সামনে থেকে
ধেয়ে আসা একটা ট্রাকের ধাক্কায় এক ঝটকায় রাস্তা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম। প্রচণ্ড
জোরে একটা গাছের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। তারপরে...সব অন্ধকার! সেখান থেকে কীভাবে
হাসপাতালে পৌঁছেছি, কতক্ষণ অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম, মিলিকেই বা কে খবর
দিয়েছে...কিছুই আর জানা হয়নি আমার। যখন জ্ঞান ফিরেছে, শিয়রের কাছে খুব পরিচিত কারো
অস্তিত্ব টের পেয়েছি শুধু। মোটা ব্যাণ্ডেজের পরত গলিয়ে শত চেষ্টাতেও তাকে আর দেখতে
পারিনি। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত একজোড়া বন্ধু...যারা চিরদিন আমার পাশে থেকে সবকিছুকে
চিনিয়ে দিয়েছে তারা অনেক আগেই তখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার চোখের অপারেশন হলো।
আর তারপরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে আমি বাসায় ফিরে এলাম।
মিলি শক্ত হাতে সামলে নিলো
সবকিছু। আমি ভাবিইনি ও এতটা ধৈর্য আর সাহসের পরিচয় দিতে পারবে। কোনদিন চাকরি বাকরির রাস্তা
না মাড়িয়েও দিব্যি আমার ব্যবসার ভার কাঁধে তুলে নিলো। প্রতিদিন আমার কাছ থেকে
কাজের খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস জেনে নিতো। কীভাবে আমি আমার অংশটুকু দেখাশোনা করি,
হারুণের সাথে কী কী ব্যাপারে আলোচনা করি, ডেলিগেটদের বিষয়গুলো কে দেখাশোনা করে,
মার্কেটিং নিয়ে পরবর্তীতে কী ভাবছি, ব্যবসা নিয়ে ভবিষ্যত ভাবনাই বা কী...সবকিছু!
হারুণও তার সবরকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলো মিলির দিকে। এত নিখুঁতভাবে সে সবকিছু
সামলে নিলো যে, মাঝে মাঝে আমার মনে হতে লাগলো শুরু থেকে মিলিই বুঝি সবকিছু
দেখাশোনা করে আসছে। আমি যেন কখনো ছিলামই না!
আমি মিলির দক্ষতায় মুগ্ধ
হতাম, নৈপুণ্যে অবাক হয়ে যেতাম। ব্যবসা যেন ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে!
বহুদিন অবাক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস
করেছি, ‘তুমি তো আগে এসব কাজ কখনোই করনি! কীভাবে পারছো এসব?’
মিলি স্মিত মুখে প্রতিবার
এড়িয়ে গেছে আমার প্রশ্ন। উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করেছে,‘হারুণ ভাইকে তুমি একশোভাগ
বিশ্বাস কর তো?’
আমি অবাক হতাম এমন প্রশ্নে।
তাই পাল্টা জিজ্ঞেস করতাম, ‘কেন তুমি করছো না? সেই তো এখন গাইড করছে তোমাকে।’ মিলি
ইতঃস্তত গলায় বলতো,
-‘হুম তা করছে। তবে মার্কেটিং
এর অনেক ব্যাপারে উনার চিন্তাভাবনা ঠিক তোমার সাথে মেলে না।’
-‘ওহ্ এই কথা! তা তো মিলবেই
না! আমরা দুজনে দুটো সাইড দেখাশোনা করতাম। ওর দিক নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম না।
হারুণও আমার কাজে বাগড়া দিতো না।’ মিলি তর্ক জুড়ে দিত।
-‘কিন্তু একই কোম্পানির
দু’রকম মার্কেটিং পলিসি থাকে কীভাবে?’
আমি মিলিকে যতই দেখতাম, ততই
অবাক হতাম। এই মাত্র অল্প ক’দিনেই এত গুরুতর বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে মিলি! পরম
নিশ্চিন্ত মনে বলতাম, ‘আগে যা হয়েছে তা হয়েছে। এখন থেকে যেহেতু তুমিই দেখাশোনা
করছো, সবকিছু নিজের মতো করেই ম্যানেজ কর।’ মিলি তবু যেন আশ্বস্ত হতে পারতো না।
বারবার ঘুরে ঘুরে জিজ্ঞেস করতো, ‘বুঝে বলছো তো? দেখো, পরে আবার আমাকে দোষারোপ কর
না।’ আমার মুখের হাসি ম্লান হয়ে যেত।
পরে আর দোষারোপ করার সুযোগ
পেলে তো! সবকিছু মিলিকেই তো এখন বুঝে শুনে নিতে হবে। আমার যা কিছু অর্জন সব তো
ওদের দুজনের জন্যই...মিলি আর আমাদের একমাত্র ছেলে রুম্মান। আমি আরেকটু নির্ভার করে
দিতাম মিলিকে। বলতাম, ‘বেশ, তাহলে নমিনি পেপারটা
নিয়ে এসো। দেখো, সেখানে কী লেখা আছে। আমার অনুপস্থিতিতে আমার সবকিছুর অংশীদার হবে
তুমি। তাহলে দোষারোপের প্রশ্ন আসছে কেন?’ মিলি থামিয়ে দিত আমাকে। আবেগময় গলায়
বলতো, ‘কতদিন বলেছি এই এক কথা বলবে না কখনো।
তোমার চোখ আবার ভালো হয়ে যাবে। তুমি
আবার আগের মতো দেখতে পাবে সবকিছু। যত টাকা লাগুক, আমি তোমার চোখ সারিয়ে তুলবোই।’ আমি
শত সহস্রবার ধন্যবাদ জানিয়েছি সৃষ্টিকর্তাকে। স্ত্রীকে
নাকি চেনা যায় অসুস্থতায় আর আর্থিক সঙ্কটে। দু’চোখ
হারিয়ে অন্ধ হয়েছি ঠিকই, কিন্তু আমার চোখের জ্যোতি বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ! মিলি তো
আগেও আমার পাশেই ছিল। কিন্তু এমনভাবে যে কখনো তাকে সত্যি সত্যিই পাশে পাবো, সেটা
কি আগে ভাবতে পেরেছি?
:::: তিন
::::
মিলির নিবিড় পরিচর্যা, নিয়মিত
ডাক্তারদের পরামর্শমতো চলা, ঔষধ...সবকিছুকে ছাপিয়ে আমি ধীরে ধীরে আরো বেশি অসুস্থ
হয়ে পড়তে শুরু করলাম। আগে চোখে দেখতে পেতাম না, কিন্তু আর কোনো অসুস্থতা ছিল না
আমার। যতদিন যেতে লাগলো, আমার পা দুটোও কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়তে শুরু করলো। আগে
নিজের বাসা, বারান্দা, সামনের লন...সবজায়গায় একা অথবা কাউকে সাথে নিয়ে ঘুরে
বেড়াতাম। রুম্মানকে সাথে নিয়ে লনের সবুজ ঘাসে পায়চারি করে বেড়াতাম। বারান্দার
রেলিং এ দাঁড়িয়ে বাইরের কোলাহল অনুভব করতাম। কিন্তু এখন আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে
করে না আমার। প্রথমদিকে মনে হতো, হয়ত দূর্বলতার কারণে এমনটা হচ্ছে। মিলিকে বলতেই
সে আমার খাবারে দুধের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলো। রোজকার খাবারে আরো বেশি বেশি
পুষ্টিকর উপাদান যোগ হতে লাগলো। তবু কিছুতেই কিছু হলো না। এখন বুঝতে পারি,
দূর্বলতা নয়। আমার পা দুটো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। খুব আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে
যাচ্ছি আমি।
হারুণ প্রায় প্রতিদিন এসে
দেখে যেতে লাগলো আমাকে। ওর পরামর্শমতো ডাক্তার পালটানো হলো। নতুন ডাক্তার এসে আগের
ডাক্তারের সব ঔষধ পাল্টে দিল। ফিজিওথেরাপি নিতে শুরু করলাম। অফিসের সময়টুকু কমিয়ে
দিয়ে মিলি বাসাতেই থাকতে শুরু করলো বেশির ভাগ সময়। হারুণ রোজ সন্ধায় আমাকে দেখার
পাশাপাশি মিলিকে কাজকর্মের অগ্রগতি আর খবরাখবর জানিয়ে যেতে লাগলো। আমি অকেজো
জগদ্দল পাথরের মতো জীবনের সবরকম কোলাহল থেকে দূরে সরে যেতে লাগলাম। ভীষণ অনুশোচনা
হতো আমার। শুধু আমার জন্য কেন এভাবে নিজেকে শেষ করে দেবে মিলি?
ওর যৌবন সবে মধ্যগগনে। দেখে
আরো অল্পবয়সী মনে হয় মিলিকে। চোখে মুখে প্রচ্ছন্ন দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোয়।
অবশ্য... এ সবই তো অতীতের কথা! যখন আমার চোখদুটো ছিল...যে চোখ দিয়ে আমি দেখতাম
মিলিকে। সে কি আর সেই আগের রূপে আছে এখন? নিশ্চয়ই অনেক বুড়িয়ে গেছে মিলি। দিনরাত
ঘরে বাইরে এত পরিশ্রমের পরে কীভাবে আর এত সুন্দর থাকা সম্ভব? আমাকে বিশ্রামের
সুযোগ করে দিয়ে মিলি আর হারুণ চলে যেত বসার ঘরে। সেখানে বসে কাজের কথা বলতো ওরা। অন্ধ
আমি বিশ্রামের ছলে শুয়ে থাকতাম। আমার অন্য ইন্দ্রিয়গুলো হঠাৎ বড় বিরক্ত শুরু করে
দিতো আমাকে। অবিরাম ডেকে ডেকে বলতো শুধু, ‘শোন...ঐ শোন...শুনতে পাচ্ছো? চোখে তো
দেখ না! কানেও কি শুনতে পাও না?’ আমি বিরক্ত মুখে বলতাম,
‘কী শুনবো আমি?’
‘কেন শুনতে পাও না? শোন
শোন...তোমার শোককাতর পতিব্রতা স্ত্রীর হাসির আওয়াজ কানে আসে না তোমার?’
আমি শুনতাম। কান খাড়া করে
শুনতাম। মিলি হাসছে...খিলখিল ঝর্ণা ধারার মতো উচ্ছল হাসি। ঠিক আগে যেভাবে হাসতো
মিলি...অবিকল সেই একই ভঙ্গিতে!
আমি আমার সন্দেহপ্রবণ পঞ্চ
ইন্দ্রিয়ের সর্দারকে বলতাম,
‘হুম শুনেছি। হাসছে...তো কী
হয়েছে?’
হিসহিসে গলায় এবার উত্তর
আসতো,
‘কী হয়েছে? এখনো বোঝ না
তুমি...কী হয়েছে?
আমি জোর করে দু’হাতে কান চাপা
দিই। অন্ধ বুঁজে রাখা চোখ দুটোকে আরো শক্ত করে বন্ধ রাখি যেন কিছুতেই খুলে না আসে।
আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না।
কিচ্ছু জানতে চাই না। তবু আমার বাড়াবাড়ি রকমের দায়িত্ব পালন করে চলা ইন্দ্রিয়গুলো
সব কথা ফাঁস করে দেয়। খচ করে কিছু একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েই দুমদাম শব্দে পালিয়ে
যায় সবাই। আমার মনে পড়ে যায়...দু’বছর আগের একটা স্মৃতি। দূর্ঘটনার আগের দিন রাতে
খেতে বসার ঠিক আগে মিলি আমার হাতে গাড়ির চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চাবিটা রাখো।
কাল তো লাগবে তোমার।’ আমি স্বাভাবিকভাবেই চাবিটা নিয়েছিলাম। এটা নিয়ে কিছুই বলার
কথা মাথায় আসেনি আমার। পরক্ষণেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম অন্য আলাপে। আজ এতদিন
পরে সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখার অফুরান সময় এসেছে। আজ আমার হাতে সময়ই সময়। আজ
ভাবতে গিয়ে একটা হিসাব মেলাতে পারি না কিছুতেই।
হারুণের ফোনটা তার কিছুক্ষণ
আগেই এসেছিল। কিন্তু সেকথা মিলি জানলো কীভাবে? সে তো তখন ছিল রান্নাঘরে। আমিও তো
মিলিকে জানাইনি কিছু! আমার যে অন্য গাড়িটা সেদিন দরকার পড়বে, এটা তো মিলির জেনে
যাওয়ার কথা নয়!
আর গাড়িটা সেদিন ওমন অদ্ভূত
আচরণ করছিল কেন? গাড়িটা মিলি ব্যবহার করতো অন্য সময়। কোনো সমস্যা থাকলে মিলি আগেই
আমাকে জানাতো। মিলির বদলে সেদিন গাড়িতে আমি ঊঠেছিলাম, এটা কি গাড়িটা জানতে
পেরেছিল? আমাকে কি সেজন্য মেনে নিতে পারছিল না?
নীচ থেকে ধুপধাপ আওয়াজ উঠে
আসতে থাকে ওপরে। বুঝতে পারি ওরা এগিয়ে আসছে। আবার ঘুমন্ত মানুষের ভূমিকায় নেমে পড়ি
আমি। মটকা মেরে পড়ে থাকি বিছানায়। ওরা উঠে আসে। আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে
পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হারুণ খুব নীচু গলাতে জিজ্ঞেস করে,
‘ঔষধগুলো ঠিকঠাক দিচ্ছো তো?’
আমি চুপ করে থেকে ভাবি, হারুণ
কবে থেকে ‘তুমি’ করে বলে মিলিকে? আগে তো শুনিনি কখনো!
মিলির আওয়াজ ভেসে
আসে...একইরকম নীচু স্বরে,
‘যেভাবে যেভাবে বলছো সেভাবেই
দিচ্ছি। কিন্তু এত ধীরে কাজ করছে কেন?’
‘ধীরেই তো ভালো! বড্ড
তাড়াহুড়ো কর তুমি! কিছু কাজ ধীরে হলে দীর্ঘ মেয়াদে ভালো হয়, বুঝেছো? এখন নীচে এসো।
কিছু কাগজপত্র দেখিয়ে দিই। সেগুলোতে সই নিয়ে রেখো। সই দিতে না পারলে টিপসই...হাহ
হা...’
আওয়াজ সরে যেতে থাকে। আমি কান
খাড়া করে শুয়ে থাকি।
হারুণটা বরাবরই ছিল মুখচোরা।
অথচ মিলির প্রশংসা সবকিছুতে ঝরে ঝরে পড়তো যেন, ‘দোস্ত, কপাল একখান তোর! এমন বউ
জুটে ভাগ্যবানের! আমি বলতাম, ‘বিয়ে কর, তোরও এরচেয়ে ভালো বউ জুটে যাবে!’ ‘আরে দূর!
মুখে রোচে না কিছু!’
এত বয়স অব্দিও হারুণটা বিয়ে
করলো না আর। সংসারী হওয়ার রাস্তাও মাড়ালো না। শুধু কীসের যেন এক প্রতিযোগিতায় মেতে
থাকতো সবসময়। সবকিছুতে আমাকে পেছনে ফেলে দিতে চাইতো। আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধিরও
বেজায় তারিফ করতো সে। প্রশংসায় ভাসিয়ে দিয়ে বলতো, ‘দোস্ত, তুই তো বস! তবে একজন
কিন্তু তোরে ঠিকই হারাইবো, বুঝিস!’ আমি কাঁধ ঝাঁকাতাম। বলতাম, ‘আচ্ছা চেষ্টা করে
দেখ। পারিস কী না!’ হারুণ বলতো, ‘একদিন ঠিক হারাবোই তোকে!’
সময় গড়াতে থাকে...আমি ধীরে ধীরে ইন্দ্রিয়দের
ঘুম পাড়াই। অস্ফূট স্বরে বলি, ‘ঘুমাও...ঘুমাও...এত জেগে
থাকতে নেই! এবার ঘুমিয়ে পড়!’ ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে থাকি আমি...আর জেগে থাকে
আমার অন্ধ দু’চোখ!
No comments:
Post a Comment