20 September 2017

বনবীথি পাত্র




ঝলসানো জীবন

অফিস না গেলেও কোথা থেকে যেন ঠিক কাজ এসে যায়। সব সেরে স্নান-খাওয়া সেরে উঠতে উঠতে দেখা যায় , ঘড়ির কাঁটা দুটো ছাড়িয়ে আড়াইটার দিকে ছুটছে। আজকেও ঠিক তেমনটাই হলো। অথচ নিজের লেখালিখির কিছু জরুরী কাজ সারতে হবে বলে অফিসটা কামাই করলো। আজ সন্ধ্যেবেলা টাউনহলে নারী দিবস উপলক্ষ্যে এক বিশাল অনুষ্ঠান হবে। উঠতি লেখক হিসাবে সেখানে আমন্ত্রণ আছে নবারুণের। কত বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিক আসবেন সেখানে, সেখানে যাওয়ার আগে একটু প্রস্তুতি তো লাগবে। একচিমটি ভাজা মশলা মুখে নিয়ে চিবতে চিবতে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে লেখার টেবিলে এসে বসে নবারুণ। পাশের ঘরে মেয়েটাকে নিয়ে পড়াতে বসেছে ঈশানী। দরজাটা না ভেজিয়ে দিলে মা-মেয়ের চিৎকারে নবারুণের ভাবনার দফারফা হয়ে যাবে।
অনেক গুণীমানুষ উপস্থিত থাকবে, বলা যায়না আজকের স্বরচিত সাহিত্যপাঠ থেকে কারত নজরে এসে যেতে পারে বা একটা বড় পুরষ্কারও জুটে যেতে পারে কপাল ভালো হলে। কিন্তু কি ঘটনা লিখলে তা শ্রোতার মনকে নাড়া দিয়ে যাবে , সেটাই ভাবার চেষ্টা করছে নবারুণ। কি লিখবে সবই তো বড্ড সাধারণ চেনা ঘটনা, একে সাহিত্যে রূপ দেবে কিভাবে!
তখনি কলিংবেলটা বেজে উঠল উচ্চস্বরে, পরপর দুবার।
উফ্ এই হয়েছে এক জ্বালা, নির্ঘাত সেলসগার্ল। আজকাল সারাটা দুপুর উৎপাত চালায় মেয়েগুলো। সাবান, শ্যাম্পু, ফিনাইল, ধূপকাঠি, জ্যাম-জেলি-আচার সবকিছুরই এখন ডোর-টু-ডোর সেলের হুজুগ উঠেছে যেন। বাঙালির দুপুরের ভাতঘুমের দফারফা এই মেয়েগুলোর জ্বালায়। ঈশানী উঠে গিয়ে দরজা খুলতে খুলতে আরো একবার বাজানো হয়ে যায় বেলটা । তারপরেই কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসে মৃদুস্বরে। এই মেয়েগুলোর সাথে ঈশানী এখন বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে , মাঝেমধ্যে এটা-সেটা জিনিস কেনেও ওদের থেকে।

একটা মেয়ে এতো সুন্দর আচার, বড়ি, পাঁপড় দিয়ে যেত, এখনো যেন স্বাদটা জিভে লেগে আছে। শুধু আচার, বড়ি, পাঁপড় কেন, মেয়েটাও চোখে লেগে আছে নবারুণের। দু-একবার ছুটির দুপুরে মেয়েটাকে দেখেছিল , ঈশানীর সাথে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে। কালো মুখেও চোখদুটো বড় উজ্জ্বল। কমদামী সুতির শাড়ি , ঘামে ভেজা জর্জেটের ব্লাউজ ভেদ করে মেয়েটার শরীর ছুঁয়ে যেত নবারুণের চোখ। ঈশানী যখন ওর সাথে কথা বলতো , কোন কাজের অছিলাতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দুচোখ ভরে মেয়েটার যৌবন পান করতো নবারুণ।

হঠাৎ করেই মেয়েটা আসা বন্ধ করে দিয়েছে। ঈশানীর কাছে মেয়েটার খোঁজ নেওয়ার সাহস হয়নি, তবে বড়ি-পাঁপড়ের খোঁজ নিয়ে জেনেছে মেয়েটা তিনচার মাস হলো আর আসছে না। কি কথা বোঝা না গেলেও ঈশানী বেশ জোরে জোরে কথা বলছে বোঝা যাচ্ছে। মৃদুস্বরে অন্য এক বামাকন্ঠও শুনতে পাচ্ছে। কি হলো কোন ঝামেলা নয় তো! লেখার আশা ছেড়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে উঠে যায় নবারুণ।
আরে এ তো সেই মেয়েটা, এতদিন পর! সালোয়ার কামিজে তাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। ওড়নাটা গলা-মাথা দিয়ে জড়ানো , মুখের কিছুটাও আড়াল হয়ে গেছে ওড়নায়। ওতো সুন্দর চোখ দুটোই আড়াল করে রেখেছে!
না দিদি এখন অল্প জ্বালা-যন্ত্রণা ছাড়া আর তেমন কোন অসুবিধা হয়না। চোখ দুটো অ্যাসিড থেকে বেঁচে গেছে তাই রক্ষে। আর কিছুদিন বিশ্রাম নিলেই তো পারতে। আর বসে থাকলে সংসার চলছিল না দিদি। বাড়িতে ছোট বোন আর অসুস্থ বাবা আছে। জমানো টাকা যা ছিল সব ডাক্তার আর ওষুধেই চলে গেল , তাছাড়াও বাজারে অনেক টাকা ধার ও হয়ে গেছে।

কতগুলো বড়ি আর পাঁপড়ের প্যাকেট সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে , ঈশানীর কাছে টাকা বুঝে নেয় মেয়েটা।
ভারী ব্যাগ দুটো নিয়ে দরজা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তখনি ঈশানী বলে ওঠে , এখন বাড়ি ফিরতে আর বেশি রাথ করো না। বলা তো যায়না ওরা আবার যদি কিছু অনিষ্ট করে। ওড়নার ফাঁক দিয়ে ঝলসানো মুখটা দেখে চমকে ওঠে নবারুণ। ঐ শয়তানগুলোর ভয়ে ঘরে লুকিয়ে বসে থাকলে চলবে গো দিদি? পেটের ক্ষিদে তো সে কথা মানবে না দিদি। চিন্তা কোরো না দিদি, এই পোড়া মুখেই জীবনের বাকি লড়াইটা ঠিক লড়ে যাবো।
মেয়েটাকে আজ প্রথমবার বড্ড শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করছে নবারুণের।



No comments:

Post a Comment