08 May 2016

শ্যামল রঞ্জন দাস



১৯৪৯ সালের ৬ই জানুয়ারী মহর্ষি ভবনের একতলার শেষ ঘরটিতে অর্থাৎ ঠাকুর পরিবারের খাবার ঘরের নীচের ঘরে আমার জন্ম। জনসংযোগ আধিকারিকের অফিস হিসাবে পরিচিত ঘরের পরের ঘরটি থেকে উত্তর দিকের বাকি ঘর এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকের বারান্দা নিয়ে ছিল আমার মামাদাদু এবং ঠাকুর পরিবারের কলকাতার ম্যানেজার শ্রী ভোলানাথ দাসের বসবাস।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুর পরিবারের যাঁদের ১৯৪৯-১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন দেখেছি এবং মাঝেমধ্যে কথা বলেছি তাঁদের সরাসরি বংশপরিচয় সহযোগে নাম উল্লেখ করব। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী। সুতরাং ওনাকে প্রথম পুরুষ ধরে বংশপরিচয় সহযোগে নাম উল্লেখ করব :-
দ্বারকানাথ--দেবেন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠপুত্র)-দ্বিজেন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠপুত্র)-অরুণেন্দ্রনাথ(দ্বিতীয়পুত্র)-অজীন্দ্রনাথ(অজীনেন্দ্র) (জ্যেষ্ঠ পুত্র)+ অমিতা--অভীন্দ্রনাথ(হাবলু) পুত্র এবং স্মিতা (বুরু) কন্যা। আমরা বলতাম অজীন ঠাকুর, অমিতা বৌঠান, হাবলুদা এবং বুরুদি। দুই ভাই-বোনেরই বিয়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে হয়েছিল আমি দেখেছি। বুরুদিকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঠাকুর দালানে নাচতে দেখেছি।
দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রনাথ-সুধীন্দ্রনাথ (তৃতীয় পুত্র)-সৌমেন্দ্রনাথ (জ্যেষ্ঠ পুত্র)-শ্রীমতী। সৌমেন্দ্রনাথের ভাই স্বরীন্দ্রনাথ(নেপু) এবং বোন চিত্রা(বুজু) এবং তাঁদের মা (মা) থাকতেন জোড়াসাঁকোয় এবং সৌমেন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী থাকতেন ৪নং এলগিন রোডে শ্রীমতী ঠাকুরের বাড়িতে। সৌমেন্দ্রনাথ প্রায়ই আসতেন মা, ভাই, বোনের সাথে দেখা করতে। নেপু বাবু এবং বুজুদি কেউই বিয়ে করেননি।
দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ-সত্যেন্দ্রনাথ(মেজ)-সুরেন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠ)-মিহিরেন্দ্রনাথ (সেজ)-সুনন্দ(একমাত্র পুত্র) প্রণতি—সুপ্রভ। সুনন্দ ঠাকুরের সাথে আলাপ ১৯৯৭ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে "আলোক- ও -ধ্বনি" (son-et-lumiere) প্রকল্পের installation এর সময় খুবই ঘনিষ্ঠভাবে। সুপ্রভর সাথেও আলাপ হয়েছিল তখন ওর ৫/৬ বছর বয়স।
দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ-হেমেন্দ্রনাথ(সেজ)-হিতেন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠ)-হৃদিন্দ্রনাথ(একমাত্র পুত্র)+ অমিয়া হৈমেন্দ্রনাথ(একমাত্র পুত্র) (খোকা) + স্নিগ্ধা(একমাত্র কন্যা) (খুকি)-- হিমেন্দ্রনাথ (একমাত্র পুত্র)। খোকা এবং খুকি দুজন ভাই-বোন যাঁরা থাকতেন রাম ভবনে। খোকাদার বিয়ে আমার মনে আছে। কিন্তু খুকিদির বিয়ে আমার মনে নেই। খোকাদার পুত্র হিমেন্দ্রনাথ ২০০০ সাল নাগাদ একবার জোড়াসাঁকোয় এসেছিলেন এবং পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন ওনার দু'বছর বয়সে ওনারা এখান থেকে চলে যান। সেদিন ওনাদের পুরোনো বাসস্থান সঙ্গে আসা কোনও ব্যক্তিকে দেখাবার জন্য এসেছিলেন। খোকাদার মৃত্যুর পরে উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে খোকাদার মরদেহ ঠাকুরদালানের নাটমন্দিরে কিছুক্ষণের জন্য রাখা হয়েছিল। তখন উপাচার্য ছিলেন ডঃ ভারতী মুখোপাধ্যায়। খোকাদার মৃত্যু হয় লান্স ক্যানসারে।
দ্বারকানাথ--দেবেন্দ্রনাথ--হেমেন্দ্রনাথ-ক্ষিতীন্দ্রনাথ(মেজ)--ক্ষেমেন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠ)+ মেনকা (দিঠাই)। বর্তমানের K.N.Tagore ভবন ছিল ক্ষেমেন্দ্রনাথের অংশ। ক্ষেমেন্দ্রনাথের মৃত্যু আমি দেখেছি। ওনারা ছিলেন নিঃসন্তান। মেনকা ঠাকুর দিঠাই নামে সম্যক পরিচিত ছিলেন এবং বাচ্চাদের নিয়ে উনি রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটক পরিচালনা করতেন তাঁর পরিচালনায় "খাজাঞ্চির খাতা" নাটকে আমি একটা ছোট্ট রোলে অভিনয় করেছিলাম এবং আমার মাসতুতো দিদি "লক্ষ্মীর পরীক্ষা" নাটকে একটা ছোট্ট রোলে অভিনয় করেছিল। উনি জোড়াসাঁকো থেকে বিডন ষ্ট্রীটে চলে যান যখন ঠাকুরবাড়ি অধিগ্রহণ করা হয়। মেনকা ঠাকুর প্রতি বছর রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী ও মাঘোৎসবে জোড়াসাঁকোয় আসতেন এবং আমাকেই সবরকম সাহায্য চাইতেন ভোলাবাবুর নাতি হিসাবে যেহেতু আমি তখন জোড়াসাঁকোর দায়িত্বে ছিলাম।
দ্বারকানাথ-দেবেন্দ্রনাথ-হেমেন্দ্রনাথ-ঋতেন্দ্রনাথ(সেজ)-সিদ্ধীন্দ্রনাথ(সেজ)+পারুল। এই সিদ্ধীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার সহকর্মী । দ্বারকানাথ--দেবেন্দ্রনাথ--রবীন্দ্রনাথ (ত্রয়োদশ সন্তান)--রথীন্দ্রনাথ(জ্যেষ্ঠ পুত্র) + প্রতিমা দেবী এবং অতসীলতা (মীরা) রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী এবং মীরা দেবীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল খুব কাছ থেকে দিনের পর দিন কারণ ওনাদের একতলায় ছিল আমাদের বসবাস।
রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী পৃথকভাবে এসে মাঝেমধ্যে জোড়াসাঁকোয় থাকতেন ১০/১৫ দিনের জন্য। রথীন্দ্রনাথের সাথে আসতো খানসামা(নাম মনে নেই) কিন্তু প্রতিমা দেবীর সাথে আসতো তাঁর খানসামা (নাম মনে নেই), নার্স মায়াদি, কম্বাইন্ড হ্যান্ড ইন্দ্র। তাঁদের পালিতা কন্যা নন্দিনী(সবাই পুষু বলে ডাকতেন আমরা পুষুদি বলতাম), জামাই ডাঃ গিরিধারী লালা এবং নাতি সুন্দর। প্রতিমা দেবীর সাথে ঠাকুর পরিবারের অনেকে দেখা করতে আসতেন তাঁদের মধ্যে এনা রায় (সৌমেন্দ্রনাথের দিদি), হৃদিন্দ্রনাথের স্ত্রী অমিয়া ঠাকুর (খোকা-খুকির মা), অজীনেন্দ্রনাথের স্ত্রী অমিতা বৌঠান এবং আরও অনেকে যাঁদের নাম মনে নেই।
১৯৬১ সালের ৮ই মে কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকীর পরেই ৩রা জুন, ১৯৬১ সালে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় দেরাদুনে তাঁর নিজস্ব বাসভবনে। সত্যেন্দ্রনাথের প্রপৌত্র সুপ্রিয় ঠাকুর দেরাদুনে পৌঁছেছিলেন কিন্তু তাঁকে রথীন্দ্রনাথের মরদেহের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি এবং রথীন্দ্রনাথের বাড়ির লোকজন পৌঁছানোর আগেই তাঁর মরদেহের সৎকার করা হয়। এটা আমার দাদুর মুখে শোনা।
১৯৮৮-৮৯ সালের কোনও এক সময়ে রথীন্দ্রনাথের পৌত্র শ্রী সুনন্দন লালা রবীন্দ্র ভারতী সোসাইটি থেকে তাঁর মায়ের নামে Royalty-র চেক নিতে এসে ভোলাবাবুর খোঁজ করে জানতে পারেন যে আমি ভোলাবাবুর নাতি দোতলায় থাকি তখন তিনি এসে আমাকে তাঁর পরিচয় দিয়ে আন্তরিকভাবে কিছু সময় কথা বলে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন তাঁরা রিজেন্ট পার্কে থাকেন। সুনন্দন লালা আমার থেকে ৫/৬ বছরের ছোটো এবং তাঁর ২ বছর বয়স থেকে তাঁকে দেখেছি।
দ্বারকানাথ-গিরীন্দ্রনাথ(সেজ)- গুণেন্দ্রনাথ (মেজ)-- সমরেন্দ্রনাথ(মেজ)- সুরীন্দ্রনাথ (মেজ) সুজনেন্দ্রনাথ (জ্যেষ্ঠ) +অপর্ণা। সুজনেন্দ্রমাথের ভাই সুজিতেন্দ্রনাথ (বুড়ো)। মা, স্ত্রী, কন্যা সুদেবী (বাপি) এবং পুত্র সুবিদ(মানু) বাস করতেন সৌমেন্দ্রনাথের নীচের তলায় যদিও ওনারা ছিলেন ৫নং বাড়ির শরিক। সুবিদের সাথে এক স্কুলে এবং এক ক্লাসে (আলাদা section এ) পড়েছি এবং দুই ভাই-বোনের সাথে লুকোচুরি খেলেছি বহুদিন।
৫নং বাড়িটি সম্পত্তি বাঁটোয়ারার সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সেজ ভাই গিরীন্দ্রনাথের ভাগে পড়ে। এই বাড়িটিরই লাগোয়া ছিল দক্ষিণের বারান্দা বর্তমানে রথীন্দ্র মঞ্চের জায়গায় এবং ঘাসের লনের মাঝ বরাবর ছিল দ্বারকানাথের বহির্বাটী যেটি ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে ভাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল রথীন্দ্রনাথের নির্দেশে এটি আমার শোনা কথা কারণ আমার জন্ম ১৯৪৯ সালে ১৯৫৪-৫৫ সাল নাগাদ বর্তমানের রথীন্দ্র মঞ্চ তৈরি হতে দেখেছি যা আমার মনে আছে তখন কিন্তু ঐ হলটির নাম রথীন্দ্র মঞ্চ ছিল না। পরবর্তীকালে রথীন্দ্র মঞ্চ নামকরণ করা হয়।
আমার ছোটোবেলায় দেখা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের একটি প্লাস্টার অফ প্যারিসের চেয়ারে বসা মূর্তি ছিল বর্তমানে প্রশাসনিক ভবনের পাম গাছের কাছাকাছি জায়গায় একটি বেদির উপর এবং মূর্তিটির মাথার উপর ছিল hexagonal বা octagonal ছাউনি। আমরা ছোটোবেলায় খেলার সময় বহু বার বেদির উপর উঠেছি। মূর্তিটি ছিল অযত্নরক্ষিত এবং যেটি উধাও হয়ে গেছে যা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের কেউই জানেন না।
একটি মজার কথা বলি যেটা জানলে সকলে বিস্মিত হবেন যে "বিচিত্রা ভবন" এর নকশা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এবং বাড়িটি তৈরির মাঝামাঝি সময়ে আবিষ্কার করা হয় যে বাড়িটির সিঁড়ির জন্য কোনও নকশা করা হয়নি তখন খুব চিন্তা করে একটি কাঠের গোল ঘোরানো সিঁড়ি তৈরি করা হয় যেটি একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত বা পূর্বপরিকল্পিত নয়।
১৯৬১ সালের ৮ই মে কবিগুরুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিচিত্রা ভবনের দোতলায় এবং মহর্ষি ভবনের দোতলায় যেখানে কবিগুরুর প্রয়াণকক্ষ, বেডরুম, ক্লোকরুম, খাবার ঘর, রান্নাঘর ইত্যাদি আছে সেই অংশে রবীন্দ্র ভারতী প্রদর্শশালার উদ্বোধন করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত শ্রী জওহরলাল নেহরু, উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় এবং রাজ্যপাল শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু। ওই দিন এক সমাবর্তন উৎসবে শ্রী মন্মথ রায়, শ্রী হুমায়ুন কবীর সহ বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিকে সাম্মানিক ডি.লিট. উপাধি প্রদান করা হয়। জনসংযোগ দপ্তরে আলোকচিত্র রক্ষিত আছে (দাদুর সংগ্রহ থেকে আমারই দেওয়া)এবং প্রদর্শশালাতেও আছে বলে শুনেছি। শ্রী কে. পি. সেন (কুলপ্রসাদ সেন) মহাশয়কে প্রদর্শশালার কনভেনর নিযুক্ত করা হয়। ঐদিন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় (যা আজও বিদ্যমান) এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে RABINDRA-BHARATI Tagore University ঘোষণা করা হয় এবং ১৯৬২ সালের ৮ই মে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়। প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত করা হয় ICS ডঃ হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে।

আমার দেখা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস লিখতে গেলেও অনেক বড়ো হয়ে যাবে কিন্তু স্থানাভাবের জন্য সংক্ষেপিত করা হলো।

No comments:

Post a Comment