29 November 2016

সুলতানা শিরীন সাজি



তোমাকে 
স্বপ্নলোকে জেগে থাকা স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এসেছিল ভালোবাসা।
ভুল স্রোতে মিশে গিয়ে সুখ হলো দুখের কাঁপন।
তুমিহীনা এই বিজন শহরে বহুদিন হয়ে গেলো পথ হাঁটা।
এক
দুই
তিন করে


অজস্র সকাল বিকেলের শুকসারী গল্পবলা প্রহর অযথাই কেটে গেল।
একটা জীবনের সূর্যমুখী সুই সুতোয় কাঁথা সেলাই এর কাব্যগাঁথা না হোক
শুধু দারুচিনি,এলাচি গন্ধমাখা সময়ের জন্য তোমাকে খুঁজে বেড়াই ।
তোমাকে
শুধু তোমাকেই ভালোবাসার জন্য টুকরো চাঁদ এর দিকে তাকিয়ে কবিতা সাজাই।
অন্ধকার ভীড় করে এলে জোনাকীর খোঁজ করি।
চাঁদ হাসে।
মুঠোভরা জোনাকীর আলো হাসে।
শুধু তুমি আসোনা না আর!
বিষণ্ন ছায়ার মত ঘুরে বেড়াই এ ঘর ঘর!
দুঃখর দ্রাঘিমা ছাপিয়ে যায় অন্যকিছু।
এই শহরে একটাও ফুল নেই যার সুরভীতে তোমাকে পাই!
নিঃশ্বাস নিতে ভালো লাগেনা আর তবু বাঁচি ,শুধু তুমি যদি আসো!
যদি আবার ঘরের জানালায় ঝোলানো পর্দার পাখিরা উড়তে উড়তে একদিন সত্যিই নীল আকাশ ছুঁয়ে যায়।
যদি বই এর শেলফে প্রিয় বইগুলো সব কোথায় বলে অনুযোগ করো।
আর
আমি চুপিসারে তোমার ওড়ার ডানা ফেলে আসি আগুনে।
এই শহর তোমাকে চায়।
এইঘর তোমাকে চায়।
এই বই শেলফ তোমাকে চায়।
এমনকি সাদা দেয়ালের শুন্য ফটোফ্রেম তোমাকে চায় !




শুধুমাত্র বেঁচে থাকলেই
কিভাবে পুড়ে যাচ্ছে দেখো সব।
গাছ পুড়ছে
ফুল পুড়ছে
স্মৃতি পুড়ছে।
আমরা পালাচ্ছি।
ঘর থেকে দূরে
বাঁচবো বলে
হাসবো বলে।
বাঁচলে জীবন ঘর লাগে।
ঘরের ভেতর পর লাগে।
পরের সাথে জ্বর লাগে।
বেঁচে থাকলে একদিন আগুন থেকে বের হয়ে আসে 
শুদ্ধস্বরের প্রাণ।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকলেই একদিন কাক ডাকা ভোরে
তোমার সিঁথানে আমার ঘ্রাণ।




বুকের ভিতর অসুখেরই ঘোর
উল্টোডাঙার পথে গোধূলির আলোতে তোমার সাথে দেখা।
তোমার চোখের কালো কাজলের সাথে বিস্ময়
আর ঠোঁটের আলাপনে অবাক পাখির সুর।
আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বিভোর হলাম আগের মতই।
দিন, মাস বা বছর গুনিনি কোনদিন।
আমি তোমার চুলের বিনুনীতে সময় দেখেছি।
তোমার হাতের কাঁপনে খুঁজে পেয়েছি হারানো দিন।
মানুষ আমরা কেনো এমন অবুঝ হই ভালোবাসায়।
কেনো মনে হয় জীবনের যেই দিনগুলোতে দেখা হয়নি,
সেই দিনগুলোতে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো!
কেনো মনে হয় শরীরের ভিতর যেই অচীন অসুখের বোধ।

এই অসুখের নাম যে যাই বলুক,
আমি বলি প্রেম।
এই প্রেমের জন্যই এখনো আমি বেঁচে আছি।
এই প্রেমের জন্যই তুমি কাছে এলে
আবারো আমার চোখের ভেতর তোমার জন্য তারাবতি জ্বলবে।
তোমার চুলের বেনী বাঁধবো আমি।
তুমি আঠারো বছর বয়সী বালিকার মতন
আমার বুকের খুব কাছে দাঁড়াবে।
অদ্ভুত জোছনায় ভাসতে ভাসতে তুমি সবুজ ঘাসের বুকে পাখি হবে।
আমি শুধু তোমাকে দেখবো।
তোমাকেই মন।
চাওয়ার মত চাইলে জীবনের কোন চাওয়া ব্যর্থ হয়না।
তুমি আমাকে কতটুকু চেয়েছো জানিনা।
আমার কাঙাল স্বভাব তোমাকে অহংকারী ময়ূরের মতন করেছে।
আমি আমার প্রার্থনায় শুধু তোমার সুখ চেয়েছি।
চেয়েছি তুমি দেবীর মত মহিয়সী হও।
আমি তোমার নিবেদনে প্রতিদিন সাজিয়েছি ফুলের অর্ঘ্য ।
আজ এতদিন পর দেখা হলো যদি!
কেনো বলো তুমি আর আগের মত নেই।
কেনো বলো তোমার বুকের ভিতর অসুখেরই ঘোর।






আবার ঝুমতলি
কতদিন পর আবার কুয়াশামাখা ভোর! ঝুমতলিতে দেখা হবার পর কেটে গেছে কত দিন! রেলষ্টেশনে রেলগাড়ি থামলো যখন,আকাশ তখন সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে। ষ্টেশন বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে ছবিতে দেখা পিওনগিয়ান ষ্টেশনের কথা মনে এলো। প্লাটফর্ম এ এ নেমে সামনে এগোতেই দেখি তুমি এগিয়ে আসছো। লম্বা একটা ওভারকোট পড়েছো,মাথায়-কানে বাদুর টুপি। মনে ভাবি,দেশটা কি রাশিয়া হয়ে গেলো নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলে তুমি।হাতের উষ্ণতা ছড়িয়ে গেলো হৃদয় পর্যন্ত।
প্লার্টফর্মের এক কোণে বসলাম আমরা। দূরে চায়ের দোকান থেকে দু'কাপ ধোঁয়াওঠা চা আর একটা প্লেটে কয়েকটি বাকরখানি দিয়ে গেলো একটি কিশোর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। অদ্ভুত মায়াময় এই মুখ আমি আগেও দেখেছি।নিমেষেই মনে পড়ে গেলো। এর সাথে দেখা হয়েছিল সেইবার, তোমার সাথে যে'বার গৌহাটির সরাইঘাট ব্রীজ এর কাছে ষ্টিমারে এ দেখা হলো।
দোল পূর্ণিমার রাত ছিলো সেটা। একটা ছেলে জাহাজের ডেকে বসে অদ্ভুত সুন্দর বাঁশি বাজিয়েছিল।
বাঁশিবাদককে দেখবো বলে ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। মগ্ন কিশোর চোখ মেলে তাকায় আর নিমেষেই মাথানীচু করে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
অবাক আমি ফিরে আসি কথাটা তোমাকে বলতে। অথচ কোথায় তুমি!
গতবার তোমার সাথে দেখা হলো প্যারিসের ডাউন টাউনে উইলিয়াম আর গ্রান্ড্ররিভার এর কর্ণার এর কফি শপটার কাছে। মন বলছিলে তুমি আসবে। রাস্তার পাশের একটা কফিশপের চেয়ারে বসে একটা স্কিনি ক্যাপাচিনোয় চুমুক ।
বজ্যু মাদমোয়াজেল,চমকে তাকিয়ে দেখি তুমি।
তুমি কি ইলুউশনিষ্ট মুভ্যির নায়ক এর মতন ম্যাজিশিয়ান?
তোমার অদ্ভুত চোখের দিকে তাকালে কোন কথা বলতে পারিনা। অথচ কত প্রশ্ন,কত কৌতূহল!
তুমি বললে,চলো হাঁটি।
তোমার পাশে হাঁটার সময় আমার খুউব ইউক্যালিপটাসের কথা মনে হয়।
তুমি প্রশ্ন করলে,সবুজ পাতার গন্ধ পাচ্ছো?
তোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ঢুকে পড়লে একটা গিফট শপ এ।
আমরা অজস্র প্রজাপতির ভীড়ে হারিয়ে গেলাম। এই দোকানের সবকিছুতেই প্রজাপতির ছাপ!
একটা রুপালী ব্রেসলেট কিনলাম তোমার জন্য। তোমাকে হাত এ পড়িয়ে দেবো বলে সারা দোকানে তোমাকে খুঁজি তন্ন তন্ন করে ।কোথাও তুমি নাই! অথচ পুরো দোকান জুড়ে তখনো ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ!
তুমি কি সত্যি কখনো ছিলে আমার সাথে অথবা তোমার সাথে আমি?
আমি কি তোমাকে চিনি অথবা তুমি কি আমার চেনা? এভাবে কতবার তোমার সাথে লুকোচুরি দেখা হওয়া ক্ষণ?
দোল পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটাকে দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে। অথবা ভীষন ভীড়ে মাঝে একলা হলে। মনে হয় তুমি আছো,কাছাকাছি কোথাও! হয়তো গীটার হাতে পথের ধারে দাঁড়িয়ে স্যাম হান্ট এর মত করে অদ্ভুত সেই গানটা" টেইক ইয়োর টাইম" গাইছো।
হয়তো একদিন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে বাফেলো শহরে। আমি সৌখিন পর্যটকের মত ঘুরছি। ছবি তুলছি। তুমি একমনে বসে কারো ছবি আঁকছো। যাযাবর মনটা আমার এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার পিছে পিছে। আর তুমি পরিযায়ী পাখির মত উড়ছো এক আকাশ থেকে অন্য আকাশ!
হয়তোবা তুমি হেঁটে হেঁটে আমায় খুঁজছো নেপালের ভূমিকম্প বিধ্বস্ত কোন গ্রামে। আর আমি হয়তো অদ্ভুত সুন্দর শাদা ফুলের বাগান থেকে বের হয়ে আসছি। যেনো এখানে কোন বিপর্যয়ই ঘটেনি ।আমি অবাক তাকিয়ে তোমাকে দেখছি।বৌদ্ধ ভিক্ষুর মত দেখাচ্ছে তোমাকে। আমি তোমার জন্য একগোছা সাদা ফুল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
বেঁচে থাকার অদ্ভুত খেয়ালীপনায় কেউ কেউ হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকছি আমরা।
কখনো স্বপ্নতে, কখনো সত্যিতে, কখনো শাদা ফুল মূর্ছনায়!