সুপ্রিয়
সঙ্গীত,
আজ আমার মন ভাল নেই। মন ভাল নেই বললে
ভুল হবে। আজ আমার মন খুব খারাপ। তোমার ভাষায় আজ ‘খুব বরষা দিন’। ভেতরেও। বাইরেও।
সেই ভোর রাত থেকে ছন্নছাড়া বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই। তবু মেঘেদের ওজন কমছে না
কিছুতেই। দু’দিন ধরেই ঢাকায় খুব বৃষ্টি। একটানা ঝরছে। থামবার নামটি করছে না। ঘরে
বসে থেকে থেকে এমনিতেই বোর হচ্ছি। তার ওপর মনের মাঝেও বরষার প্রভাব। আজ বৃষ্টি না
থাকলে বাইরে বের হতাম। সারাদিন বৃষ্টির মতই সৃষ্টিছাড়া এদিক ওদিক। একা একাই গোটা
ঢাকা চষে বেড়াতাম। ঘুরতাম, খেতাম, শপিং করতাম। কতক্ষণ লাগত বল মন খারাপ ঠিক হতে?
অবশ্য ঢাকার বৃষ্টি আর আগের মত
উপভোগ্য নয়। বরং উপদ্রবও বলতে পার। বৃষ্টি এলেই এখন স্বস্তির চেয়ে শংকা বেশি। দৈব
দুর্বিপাকের সাথে দৈব দুর্ঘটনাও যোগ হয়। রাজপথের এখানে হাঁটু পানি তো সামনেই তা
কোমর ছোঁয়। ঢাকনা বিহীন অদৃশ্য ম্যানহোলের পাঁকে জীবনও যেতে পারে। কর্তৃপক্ষের বেহিসেবি খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তাগুলো ধুঁকছে। ঢাকাবাসীর অবস্থা অনেকটা জলবাসী কৈ এর
মত। জল-ডাঙার খেলায় সবার ভীষণ ছটফটে অবস্থা। ঢাকা এখন খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। মানুষের
মনের মত। চেনা ঢাকাকে তুমি এখন একদম চিনবে না সঙ্গীত। নব্বইয়ের ঢাকায় এখন বিড়ম্বিত
মানুষের দুঃসহ জীবন।
বৃষ্টি আরও বাড়ছে। চারপাশে শুধু
বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টির দিন গুলো আসলে বড্ডো অদ্ভুত। খারাপ মন আরও খারাপ করে দেয়।
ভাল মনকে আরও ভাল। অবশ্য আমার মন খারাপের ঐতিহ্য বেশ ঐতিহাসিক। মনে পড়ে!
ভার্সিটিতে থাকতে একবার... তখন আমরা সেকেন্ড ইয়ারে। মায়ের বকা খেয়ে সকালে
ক্যাম্পাসে এসেছি। ক্যাম্পাসে পা দেয়া মাত্রই তুমি খোঁচাতে শুরু করলে... কী হয়েছে?
কী হয়েছে? যতই তোমাকে থামতে বলছিলাম তুমি ততই বিরক্ত করছিলে। শেষ পর্যন্ত এক চড়ে
তুমি ঠাণ্ডা। এমনই ঠাণ্ডা যে মুখ দিয়ে কথা বের করতে আমার সাতদিন-সাতরাত লেগেছিল।
মান-অভিমান, আড্ডা-হুল্লোড়, কখনো-সখনো জেলাসি-ঝগড়া তবু কী দারুণ সব দিন ছিল তখন!
মনে পড়ে সঙ্গীত? নাকি ভুলে যাচ্ছ প্রতিদিন? আমি ভুলিনি। ভুললে যে তোমাকেও ভুলতে
হয়।
অনেক স্মৃতি কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায়
না। কেউ চাইলেও পারে না। হয়তো মানুষ নিজেরও নিভৃতে সেসব পুরনো দিন পেলে পুষে রাখে।
টের পায় না। হঠাৎ হঠাৎ কোনো বৃষ্টিমুখর দিনে বৃষ্টির মতই সেসব স্মৃতি মানুষকে
ভিজিয়ে দেয়। খুব নিষ্ঠুর- খুব ব্যস্ত মানুষও তখন স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। উটকো বরষায়
সেও তখন ভিজতে থাকে। বৃষ্টিভেজা গাছের মত মূক বিষণ্ন মুখে। আসলে স্মৃতিগুলো পুরনো
দেব মন্দিরের আনাচে কানাচে জমে থাকা শ্যাওলার মত স্যাঁতস্যাঁতে, তবুও তাতে যেন
সবুজের সজীবতা আছে।
সেবার ক্যাম্পাসে পত্রিকা বের করা
নিয়ে কী কাণ্ড! সবুজ, নাসিম, শুভ্রদের মত বখাটেরা থাকবে বলে আমি কাজই করব না!
সবশেষে ওদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন। রাত জেগে লেখা বাছাই-প্রচ্ছদ-এ্যাড-প্রেসে
ছোটাছুটি! শেষ পর্যন্ত দারুণ একটা ‘স্বপ্ন’ বের হলো। ছেলে-মেয়েরা ঘুরে ঘুরে তোমার
সম্পাদকীয় এর প্রশংসা করছে আর আমি তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি আমারও একটা লেখা আছে।
‘স্বপ্ন’ বের হবার পরদিন ক্লাসের সেইসব বড় বড় নেতারা ডিপার্টমেন্টের বারান্দাতেই
‘স্বপ্ন’ এর কয়েকটি কপি পোড়ালো। আমার কী কান্না! তুমি আমার দু’হাত-দু’মুঠিতে পুরে
বলেছিলে, ‘স্বপ্নের’ ২য় সংখ্যা বের হবে। আমরা পেরেছিলাম সঙ্গীত। তুমি। আমি। আমরা
অনেকেই পেরেছিলাম। সেই স্বপ্ন কি এখনো টিকে আছে?
আনান কাঁদছে। বোধহয় ভাইয়ের সাথে ঝগড়া
হচ্ছে। আমাকে থামাতে হবে না। একটু পরেই দুটোতে আবার ভীষণ ভাব হবে। আমার ছেলে মেয়ে
দুটো বেশ হয়েছে। মেয়েটার সারাদিন যায় বাপি বাপি করে। ছেলেটা আমাকে খুব ভালবাসে।
আরিয়ানতো এখনই ভীষণ স্বাবলম্বী। নিজের ছোটখাট কাজ গুলো নিজেই করে। নিজের ঘর গুছায়।
পড়ার টেবিল, শেলফ এমন কি নিজের জামা কাপড় গুলোও সবসময় ভীষণ পরিপাটি। ভাবতে পার! এ
তোমাদের দস্যি চকোরীর লক্ষ্মী ছেলে!
শুধু মেয়েটাকে নিয়ে খুব ভয়। কারো হাতে
দিয়ে ভরসা পাইনা। চারপাশে এত নষ্ট মানুষ। রোজ পত্রিকা মেললেই বাচ্চা বাচ্চা
মেয়েদের ছবি চোখে পড়ে। কী সুন্দর নিষ্পাপ ফুলের মতন ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে! কিন্তু' এরা
মৃত-ধর্ষিত-নির্যাতিত। রোজ এসব মুখগুলো দেখে দেখে ভেতরটা ফাঁপা হয়ে গেছে।
কান্না আসে না। শুধু আতংকে ভেতরটা ভরে থাকে...কাল বুঝি পত্রিকার লোকেরা আমার
আনানের ছবি ছাপাবে। আমার আনান! আমার মেয়ে! একদিন যদি তৃষার মত পানিতে ঝাঁপ দেয়!
অশ্লীল কাম-রিপুর পৃথিবী থেকে তাচ্ছিল্যের সাথে রুমীর মত নিজেকে জীবন থেকে সরিয়ে
নেয়!
তোমাদের ওখানে বাংলা পত্রিকা যায়?
তুমি তৃষার কথা জান? তানিয়া, রুমী, সিমি, মহিমা, রুশনী... এদের কথা? নাকি এসব খবরে
তোমাদের মত পুরুষদের কিছু যায় আসে না? তোমরা খুঁজে ফিরো ক্যারিয়ার অপরচুনিটি?
গ্লোবালাইজেশনের নিউ স্টেপস্? আর আমাদের এসব নিয়েই বসবাস। সেদিন শিল্পকলা
একাডেমীতে গিয়েছি। চারুকলা প্রর্দশনীতে। আমি আর আরিয়ান। আরিয়ান আমাকে একটা ছবির
সামনে টেনে নিয়ে গেল। ছবির নাম-লুই কানের স্বপ্ন। লাল ফ্রক পড়া একটা ফুটফুটে মেয়ে
সংসদ ভবনের লেকের পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। পেছনে কতগুলো উত্থিত লিঙ্গের পুরুষের
ছায়া।
ছবিটা দেখে আমার চোখের সামনের সব কিছু
ঝাপসা হয়ে গেল। আমি শিল্পীর নাম দেখলাম না। আর কোন শিল্পও দেখলাম না। বাসায় ফিরবার
পথে আরিয়ানকেও অপরিচিত লাগছিল। এ আমার ছেলে! একটা পুরুষ কতকাল... আমার ভেতরে ছিল!
ওকে নিজের জঠরে আশ্রয় দিয়েছিলাম বলে হঠাৎ কী যে ঘেন্না হল! তারপর কি হল জান? বাসার
সামনে যখন রিকশা থেকে নামছি আরিয়ান আমার হাত চেপে ধরলো, মা আমি ওদের মত হব না...
আমি তোমাকে ভালবাসি মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে আরিয়ান কাঁদছে! আমার আবার ঘেন্না ধরল
নিজের ওপর। আমার ছেলে! আমি কী ভাবছি ওকে নিয়ে! একমাসের আরিয়ানের মত ওকে বুকে চেপে
বললাম, কখনো অমন পুরুষ হোসনে বাবা...।
কী অদ্ভুত না! সারাজীবনের কত ঘেন্না
আমার পুরুষের উপর। অথচ এই পুরুষের প্রেমেই আমি কাতর হই। এই পুরুষই আমাকে বাজায়।
আমি যেন কোন অদম্য পুরুষের হাতের সেতার হয়ে বেজে যাই অবিরাম। এই পুরুষই আমাকে বীজ
দেয়। স্বপ্নের বীজ। আরিয়ান-আনান...আমার স্বপ্ন... ওদেরকে আমার ভেতরে রোপণ করে একজন
পুরুষই। তসলিমার একটা কবিতা পড়েছিলাম। নাম-দেহতত্ত্ব। ... আসলে পুরুষ নয়/ প্রকৃতিই
আমাকে বাজায়/ আমি তার শখের সেতার। আসলে প্রকৃতি আর পুরুষ দু’টোই তো
পরাক্রমশালী!
তবু আমি জানতাম, তুমি কেবল পুরুষ নও।
মানুষ। খুব সহমর্মী। খুব কাছের একজন মানুষ। লিঙ্গভেদ নেই। মানসিকতায় ভেদ নেই।
ক্যাম্পাসে বেশির ভাগ ছেলেই ক্ষ্যাপা ছিল আমার উপর। বলত দেখে নেবে। একমাত্র তুমি
কখনই আমার সাথে তর্কে যেতে না। তুমি আমাকে কতটুকু চাইতে আমি জানতাম না বহুদিন।
যেদিন জানলাম এত রাগ হল! মনে হল শেষ পর্যন্ত তুমিও আমার কাছে পুরুষ হিসেবে নিজেকে
নিবেদন করছো! এত তুচ্ছ হয়ে গেলে তুমি আমার কাছে! তারপর থেকে খুব সেধে দূরত্ব তৈরি
করতে শুরু করলাম। কী অবাক কাণ্ড, না! একসময় সেই আকাশ উচুঁ মেঘের দূরত্বও বৃষ্টির
সাথে ভেসে গেল। আচ্ছা মনে পড়ে, কে আগে ক্ষমা চাইল? উহ্ তুমি... আমি কোনদিনই না!
কখনই না! কি পড়লো মনে? নাকি খুব বাহাদুরি দেখাবে এখন?
দেখেছ ঝগড়া করার স্বভাবটা এখনো যায়নি!
আবার পুরনো ঝগড়া। ভাবছো, পাগলটা বদলায়নি একটুও। আসলে আমি বদলেছি অনেক। বলতে পার
পুরোটাই বদলে গেছি। আকাশে উড়বার সাধ ছিল। সেই সাধ এখন হাড়ি-পাতিলের দৌরাত্মে
চার দেয়ালে আটকা পড়েছে। সেদিন হয়েছে কী জানো? আনান স্কুল থেকে ফিরেছে। দু’ভাইবোনে
সেকি ঝগড়া। স্কুলে মিস্ আনানকে জিজ্ঞাসা করেছে, তোমার মা কী করে? আনান বলেছে, আমার
মা কিচ্ছুই করে না। বাসায় থাকে। তাই আরিয়ানের কী রাগ! মা কিছু করে না মানে? মা’ই
তো সব করে। ঘরের কত কাজ করে! নার্সারীর আনান ফিক হেসে ফেলল, ধ্যাত ওগুলো কী কোনো
কাজ! বারে মা কি বাবার মত চাকরি করে? রোজ অফিসে যায়?
আমি চমকে উঠলাম। আনানের কথার সত্যতার
চেয়ে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ব্যঙ্গ আমাকে চমকে দিল। আমি কত তুচ্ছ! কত ক্ষুদ্র!
কোনো যোগ্যতাই নেই আমার! আনান হাসছে! আনানের মিহি গলার হাসি ঘরের চারদেয়ালে আছড়ে
পড়লো। সেই সাথে আমার ফার্স্টক্লাসের সার্টিফিকেট গুলোও যেন দেরাজের ভেতর থেকে আমার
পুরো সংসার কাঁপিয়ে হেসে উঠলো জোরে। রূপম বলত যে কোনো একটা ছাড়তে। বাইরের ব্যস্ততা
নতুবা ঘরের স্বাচ্ছন্দ্যতা। আমি ততোদিনে বৃত্তবন্দী হয়ে গেছি। পারলাম না। শেষ
পর্যন্ত তোমাদের অহংকারী চকোরী পারল না অপ্রতিরোধ্য হতে।
অনেক বকছি আমি। আসলে মনে হচ্ছে
অনেকদিন পর তোমার সাথে প্রাণ উজার করে কথা বলবার ফুরসৎ পেলাম। এলোমেলো কথা।
অগোছালো কথা। অনেক কথা। তবু কথার কী আর শেষ আছে! প্রতি বাক্য শেষ হবার সাথে সাথেই
নতুন নতুন শব্দের হাত-পা গজায়। কি করি বল। খুব লোভ হচ্ছে তোমার সাথে একটা
ধুম আড্ডা দিতে। সেই ক্যাম্পাসের মত ‘চক্কোরী আড্ডা’। চক্কোর মারতে মারতে বকবক।
সেই যে ভার্সিটি ছাড়লাম! তুমি দেশ ছাড়লে! এখন শুধু স্মৃতির চক্কোর। যার পিছু ছুটে
ছুটে আমি দিশেহারা। এখন আমার এ্যাত্তো-এ্যাত্তো স্মৃতি। একেবারে মেঘ-কান্না আর জলজ
স্মৃতি।
মনে পড়ে? তোমার সাথে আমার যেদিন শেষ
দেখা হল সেদিনের কথা? তোমার কানাডা চলে যাবার আগের দিন। যেদিন তোমার সাথে আমার শেষ
দেখা। তুমি আমাকে ফোন করেছিলে। আমি ছুটে গিয়েছিলাম তোমার বাড়িতে। আমি সত্যিই ছুটে
গিয়েছিলাম। বিশ্বাস কর, আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, তুমি চলে যাবে। মাস ঘুরে যাবে,
বছর ঘুরে যাবে তবু তোমার সাথে দেখা হবে না! আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সেদিন আমাদের
বকবকানি জমছিল না একেবারেই। আসলে আমার এত রাগ হচ্ছিল তোমার উপরে যে কথা খুঁজে
পাচ্ছিলাম না। আমি ফিরে আসছিলাম। তখনই আমার জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি ঘটল।
আমি যখন বেরোবার জন্য দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে পিছু ডাকলে। তোমার সেই কন্ঠ আমি কোনোদিন শুনিনি। বহুদূর থেকে
ভেসে আসা সুরহীন- ক্লান্তিকর কণ্ঠ। যেন কেউ শ্বাসরোধ করে রেখেছে তোমার। তারপর তুমি
ধীর পায়ে আমার কাছে এলে। তোমার সেই কাছে আসার সময়টা এত দীর্ঘ ছিল! যেন দু’জনের
ভেতরকার এই এক গজ দূরত্বও তুমি কিছুতেই অতিক্রম করতে পারছিলে না। কাছে এসে আমার
কপালের উড়ো চুলগুলো দু’হাতের আদরে সরিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালে। আমি তুমুল ভাবে
কেঁপে উঠলাম। কিশোরী জীবনের প্রথম অধঃপতনের মত আমার ভেতরে ঝড় শুরু হলো। টের পেলাম
আমার আমার বুকের মধ্যে ঢেউয়ের উজান। আমার কানের কাছে রবিবাবুর আকুল সুর। আমার
চোখের সামনে লক্ষ জোনাকের ছুটোছুটি। আমার ত্রিশোর্ধ্ব নারী শরীর সেদিন প্রথমবারের
মত আমাকে জানাল জীবনের মধুরতম বেজে ওঠা কেমন।
ভীষণ অহংকারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা
বিনম্র আমার দুর্ভেদ্য প্রাচীরেও সেদিন ধস নামল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম
আমার জরায়ুর মধ্যে রূপমের উপহার দেয়া একটি দেব শিশু বেড়ে উঠছে। আমি ভুলে গেলাম আমি
আরিয়ানের মা। আমি ভুলে গেলাম আমার চারপাশের সীমারেখা আর দুর্লঙ্ঘনীয় গণ্ডি। আমি
ভুলে গেলাম আমাকে। এতটুকু স্পর্শে এত ভাল লাগা! এত প্রাপ্তি! বিশ্বাস কর সঙ্গীত
আমার জানা ছিল না। মনে হল আমি যেন মেঘবালিকা। যে দুরন্ত ঝড়ও ভালবাসে।
কিন্তু বহুকাল ধরে লালন করা অহম বোধকে
জিইয়ে রাখার তীব্রতায় আবারও সেই প্রতারণা নিজের সাথে। আমি তোমাকে কিচ্ছু বলিনি।
আমি কিচ্ছু চাইনি তোমার কাছে। তুমি জান সঙ্গীত কারও কাছ থেকে হ্যাংলার মত কোনোদিন
কিছু চেয়ে নেয়া আমার স্বভাবে নেই। আমি চাইনি। তাই কিছুই চাইনি তোমার কাছে। তবু না
চাইতেই যা পেয়েছি তা আজও আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সেদিনের পর থেকেই মাঝে মাঝে ভাবি
সঙ্গীত, তুমি আমার কে? আমার প্রেমিক? বন্ধু? কিন্তু তুমি আমার প্রেমিক হবে কি করে?
তোমার আমার এতদিনের সম্পর্কে কোনোদিন তো কোনো চাওয়া ছিল না। কাম ছিল না। কই কখনো
তো তোমায় পেলে হাত দুখানা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়নি! কখনো তো তোমায় না পেলে পাওয়ার
আকাঙ্ক্ষায় আমার ভেতরটা তীব্র ভাবে জেগে ওঠেনি! হয়তো সত্যিই তুমি আমার জীবনের কোনো
প্রত্যাশিত পুরুষ নও। প্রেমিক নও। বন্ধুও নও। তবু যেন আমি ধরেই নিয়েছিলাম তুমি
আমারই। সত্যি বলছি মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি আমার স্নানযোগ্য নদী। যার স্বচ্ছ
জলে আমার বিষণ্ন ছায়াটাও ভীষণ স্পষ্ট হয়ে পড়ে। আবার যাতে ডুব দিলে সব পাপ- সব
যাতনা দূর হয়ে যায় আমার।
আমি জানি আমার মত আমাকে নিয়ে তোমার
ভেতর কোনো দ্বিধা নেই। আমি জানি তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে। তবু সারাজীবন শুধু সব
দুঃখের ভাগ নিতে চেয়েছ, দিতে চাওনি। আসলে বেশির ভাগ মানুষই তাদের ভালোবাসার
মানচিত্রটি আঁকতে বসে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই। তাই একসময় এবড়ো থেবড়ো সীমাহীন
দূর্বোধ্য রেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়, এর চেয়ে একটা নদী আঁকলেও বেশ হতো
নতুবা একটা সাগর। তখন হয়তো টলমলে নতুবা নোনতা জলের ঘনত্বে মিশে যেত অবাধ্য চোখের
নোনা জল। তখন কষ্টগুলো ছড়িয়ে যেত সবখানেই। নিজেকে দুঃখী ভাববার দুঃসাহস হয়তো হতো
না কারোই।
তুমি কি খুব দুঃখী সঙ্গীত? আমার
চেয়েও? তোমার দুঃখ চেয়ে নেব সেই সাধ্য আমার নেই। আজকাল নিজেকেই খুব ভারি মনে হয়।
শুধু চাইছি সুখে না থাকলেও অন্তত ভাল থেকো। শুদ্ধ থেকো।
ইতি
চকোরী
No comments:
Post a Comment