25 September 2017

জুলিয়ান সিদ্দিকী





যৌবনে ছিলেন মক্ষীরানির মতো। এখন বিগত যৌবনেও প্রায় তেমনই আছেন। চারপাশে শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। যেচে পড়ে উপকার করবার মানুষেরও অভাব নেই। তারপরও এক ধরনের শূন্যতা অথবা অপরাধ-বোধ তাকে কুরেকুরে খায়। রাতভর ঘুমুতে পারেন না। বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করেন শুধু। ওষুধ না খেলে ভোরের দিকে দু ঘণ্টার ঘুমটাও ঘুমাতে পারেন না। চুল উঠতে উঠতে মাথায় প্রায় টাক পড়ে যাচ্ছে। পরচুলা না পরে বাইরে বের হবার কথা কল্পনাও করতে পারেন না।
একেক সময় একেক জায়গায় তার নাম হয় ভিন্ন ভিন্ন। সকালে এক নাম তো বিকেলে আরেক নাম। কেবল দলের মানুষ ছাড়া তার নাম কেউ জানে না। অবশ্য সেটাও নকল। পিতৃদত্ত নামটা কেবল তিনি নিজেই জানেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক বিশাল অপরাধ-চক্র। অবৈধ আয়ের এক অন্ধকার সাম্রাজ্য। যেখানে তার কথাই শেষ কথা। প্রতিবাদ করবার কেউ নেই। ভুল করলে শুধরে দেবারও কেউ নেই।

গ্রামের নিম্নবিত্ত এক কৃষক পরিবারে যখন তার জন্ম হয়, বাপ-মা আদর করে নাম রেখেছিলেন বাসন্তি। শহুরে চাকরিজীবী আনসার আলির সঙ্গে বিয়ের সুবাদে তার পা পড়ে ঢাকা শহরে। স্বামীর হাত ধরে উঠেছিল বাবুপুরা বস্তির একটি ছোট্ট খুপরি ঘরে। তখনই সে জানতে পেরেছিল আনসার আলির চাকরি বলতে রিকশা চালানো। সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে ফিরে আসে আনাজপাতি আর চালডাল নিয়ে। রান্না বাড়া শেষে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে দুজনেই। আনসার আলি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে নাক ডাকতে আরম্ভ করতে পারলেও ভিন্ন রকম একটি কষ্টের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। মাঝে মাঝে ভেতরটা কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে ওঠে। ইচ্ছে হয় কোথাও চলে যেতে উদ্দেশ্যহীন। কিন্তু কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? সবই যে তার অজানা আর অচেনা।
দিনভর ঘরের দরজায় বসে থাকা নয়তো বিছানায় গড়াগড়ি। ইচ্ছে হলে রাঁধে, খায়। কখনো বা উপোষ পড়ে থাকে। কিন্তু তার দিনরাত্রির দৃশ্যগুলো যে কেউ একজন দৃষ্টির ফ্রেমে তুলে রাখছে মনের পর্দায়, তা মোটেও জানা ছিল না বাসন্তির। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সে বুঝে ফেলে যে, বস্তিতে নতুন আসা আচার বিক্রেতা শান্ত নামের ছেলেটির পুরো মনোযোগ যেন তার ওপরই। ছেলেটি নামেই শান্ত, কিন্তু খুবই ছটফটে। তা ছাড়া নামটা যেন তার পেশার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না বাসন্তি। বড় বড় স্বপ্নাতুর দুটো চোখের মায়াবী দৃষ্টি হেনে যখন বলে, ভাবি কি উপাস দিলা? মুখটা কেমন শুকাইয়া আছে।
শুকনো মুখেই জানায় বাসন্তি, কী আর করমু? আমার মানুষটা তো এইসব দেখে না।
-কইলে না হয় আমিই দেখতাম!
দুষ্টুদুষ্টু মুখ করে চোখ নাচিয়ে বলেছিল শান্ত।
বাসন্তির বুকটা কেমন দুরুদুরু করে উঠেছিল হঠাৎ। সতর্ক চোখে আশপাশটা একবার দেখে নিয়েছিল তৃতীয় কারো কানে গেল কিনা কথাগুলো। কথাগুলো যে একান্তই তাকে উদ্দেশ্য করে, অন্যেরা তা শুনবার কোনো অধিকার রাখে না। খানিকটা ভালোলাগা, খানিকটা লজ্জা তাকে যেন আড়ষ্ট করে তুলেছিল। চটপট উঠে গিয়ে ঘরের ভেতর নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল সেদিন।
হয়তো শান্তর চাহনিতে বা কথায় কিছু একটা ছিল যা তাকে মুগ্ধতার ছোঁয়া দিয়ে গিয়েছিল। নয়তো সে কেন ভুলতে পারছিল না সেদিনের ঘটনা? তাহলে কি আনসার আলি তার মনের এদিকটির সন্ধান পায়নি? আর সে কারণেই কি দিনভর রিকশা চালানো, পেট ভরে খাওয়া, রাতভর ভোঁস ভোঁস করে ঘুমানোর বাইরে আর কোনো চাওয়া নেই তার?
আচারের থালা মাথায় হাতে ঝুলিয়ে ধরা বাঁশের বেতে তৈরি থালা রাখবার মোড়াটি নিয়ে বস্তির গলি ধরে যাবার সময় ফের মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল শান্ত। তেমনি দুষ্টু দুষ্টু মুখে প্রায় অস্ফুটে বলেছিল, যাই গো সুন্দরী!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস তীরের মতো বের হয়ে এসেছিল। সে সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বুকের ওপর চেপে বসে থাকা ভারি কিছু একটা যেন দূর হয়ে গিয়েছিল নিমেষেই।
সেদিনের পর থেকেই যেন হঠাৎ করে নিজের প্রতি সচেতন হয়ে উঠেছিল বাসন্তি। সময় মতো রান্না, খাওয়া আর ঘুমের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। আর তাই যেন আরো দ্বিগুণ শক্তিতে কাছাকাছি টেনে এনেছিল শান্তকে। সপ্তাহ খানেক পর দিনে দিনেই সব আচার বিক্রি করে সন্ধ্যার খানিকটা আগে দিয়েই ঘরে ফেরা শান্তর চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিল। আর তখনই সে বাসন্তির উদ্দেশ্যে বলে উঠেছিল, খয়ের দিয়া পান খাইতে পার না?
ততদিনে দুজনের সম্পর্ক অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই সে শান্তকে বলতে পেরেছিল, খয়ের দিয়া পান খাইলে কী হইব?
-ঠোট দুইটা তাজা তাজা দেখাইব।
-পান ছাড়াও আরো কত কিছুই আছে।
ঠোঁট উলটে বলেছিল বাসন্তি।
শান্ত সেদিন কী বুঝেছিল কে জানে। দুদিন পর পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যার লালিমা মুছে যাবার পরপরই বস্তির অন্যান্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে ছোট মতো একটি কাগজের মোড়ক ধরিয়ে দিয়েছিল বাসন্তির হাতে। রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে চুপি চুপি মোড়ক খুলে অবাক হয়ে গিয়েছিল বাসন্তি। বিয়ের আগে বাপের ঘরে মাঝেমধ্যেই এসব পেয়েছে। কখনো বা নিজেই দোকানপাট থেকে কিনে এনেছে। বিয়ের সময় পাওয়া সাজগোজের এসব জিনিস তো তার আছেই। এতদিন কেন মনে পড়েনি তার? শুধুশুধু সুটকেসে ফেলে রেখেই বা কী লাভ?
রাতের রান্না সেরে বস্তির কল থেকে নেয়ে ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সাজায় সে। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও যেন নিজেকে চিনতে পারে না সে। ঠিক তখনই আনাজপাতি আর চালডাল নিয়ে ঘরে ঢোকে আনসার আলি। আর বাসন্তিকে দেখে কী যে হয় তার, ঘামে ভেজা শরীরেই জাপটে ধরে। মুগ্ধ চোখে তাকায় বারবার।
সে রাতেই অবসান ঘটেছিল বাসন্তির দীর্ঘ প্রতীক্ষার পালা। কিন্তু আনসার আলি বড্ড দেরি করে ফেলেছিল বাসন্তির মনের দরজার কড়া নাড়তে। এরই মাঝে অন্য একজন তার মনের দরজায় খটখটিয়ে জেগে উঠবার সংকেত দিয়ে গেছে তার আগেই। আনসার আলির জন্য তার মনের যাবতীয় অপেক্ষা ফুরিয়ে গেছে। সে জায়গাটি দখল করে নিয়েছে আচার বিক্রেতা ছেলেটি।

দুপুরে খেয়ে খানিকটা ভাত-ঘুম দিয়ে বেরিয়ে যায় আনসার আলি। আর ফিরতে ফিরতে রাত বারটা কি একটা বেজে যেতো। দীর্ঘ একটা একাকীত্ব তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো সে সময়টাতে। কিন্তু সেই অপূর্ণ সময়টাকেই নানা বর্ণে ভরিয়ে দিতো শান্ত। আর এভাবেই তার মনের ছোট্ট নাওটি আনসার আলির ঘাট থেকে ভাসতে ভাসতে স্থির হয়েছিল শান্ত নামের ফেরিওয়ালাটির চরায়।
হঠাৎ করেই শান্ত একদিন জানায়, রমনায় মেলা হইতাছে। যাইবা?
-আমি তো চিনি না।
-আমি নিয়া যামু।
-তাইলে ব্যডা বাইর হইয়া যাউক।
মেলায় ঘুরতে ঘুরতে আর নানা বয়সের মানুষের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে করতেই যেন নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে। সে সঙ্গে আসন্ন দিনগুলোকে নিয়ে লুকোচুরি করতে হবে ভেবেই যেন বিগত দিনগুলোতে আনসার আলিকে বঞ্চনার অপরাধে নিজের কাছেই যেন ছোট হয়ে যেতে থাকে বাসন্তি। নানা ভাবে মনটাকে শাসনে বেঁধে রাখতে চায়। কিন্তু সে বাঁধন যেন ছিঁড়ে যায় শান্তর একটি ইশারাতেই।
পরপর দুদিন আচার বানায় না শান্ত। আচার নিয়ে তাকে বের হতেও দেখা যায় না। বাসন্তি ভাবে যে, ছেলেটার অসুখ-বিসুখ করেনি তো? কিন্তু তার ঘরে গিয়ে দরজায় তালা দেখে ফিরে আসে বাসন্তি। সে বুঝতে পারে না শান্ত এ দুদিন ঘরেই আসেনি বা খুব ভোরেই ঘর থেকে বের হয়ে যায়। দুপুরের দিকে শান্তকে দেখা যায় ভিন্ন রূপে। সংক্ষিপ্ত কথায় জানা যায় যে, শান্ত আচার বিক্রি করা ছেড়ে দিয়েছে। এখন আরো বড় আর ভালো ব্যবসায় হাত দিয়েছে। সত্যি সত্যিই যেন বদলে যাচ্ছিল শান্ত। চলনে বলনে  আর পোশাক-আশাকে। কিন্তু অনেকবার জিজ্ঞেস করেও বাসন্তি জানতে পারেনি যে, কী এমন ব্যবসায় হাত দিয়েছে শান্ত। তবে এ কথা বস্তির কারো কাছে গোপন থাকে না যে, শান্ত দু হাতে টাকা রোজগার করছে।
দুপুরের খাওয়া সেরে আনসার আলি হঠাৎ বলে, একটা জরিলি কামে বাইত্যে যাইতাছি। তিন-চাইরদিন তুই একলা একলা থাকতে পারবি না?
ঘিঞ্জি বস্তিতে পাশের ঘরের বিছানায় কেউ পাশ ফিরলেও অন্যরা যেখানে টের পায়, তেমন বস্তিতে একা থাকা বলতে আনসার আলি কী বোঝাতে চায় বুঝতে পারে না বাসন্তি।
বাসন্তিকে চুপ থাকতে দেখেই হয়তো আনসার আলি বলে, রাইতে ডরাইলে তুই মতির মায়েরে আইয়া থাকতে কইস।
এসব নিয়ে ভাবে না বাসন্তি। রাতের বেলা কাকে নিয়ে থাকবে বা কীভাবে থাকবে এসব নিয়ে ভাবছে না সে। এ মুহূর্তে তার ভাবনা হলো আনসার আলি কখন বের হয়ে যাবে।
শান্ত হয়তো চোখ রাখছিল বাসন্তির ঘরে। আনসার আলি বেরিয়ে যেতেই কিছুক্ষণ পর সে লাফিয়ে আসে। চাপা স্বরে বলে, তুমি কি তৈয়ার?
-কী পিন্দা যামু? তোমার বন্ধুর বাইত্যে আরো কত ভালা কাপুর পিন্দা মাইয়ারা আইবো না?
-তোমার ভালা কাপুর নাই?
-বিয়ার কাপুরডা আছে।
-আইচ্ছা, হেইডা পিন্দাই বাইর হও। নয়া কাপুর কিন্যা দিমু।
সুটকেস খুলে অবাক হয়ে যায় বাসন্তি। তুলোর মতো অনেকগুলো ছোটছোট রঙিন পিণ্ড। বিয়ের শাড়িটা দু হাতে তুলে চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখতে পায় অনেকগুলো ছিদ্র। নতুন কাপড়টা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তার দু চোখ ফেটে পানি চলে আসে। এমন কাপড় পড়ে কি কোথাও যাওয়া যাবে? সুটকেস কেটে ভেতরে ইঁদুর বাসা বানিয়ে রেখেছিল। ছোটছোট অনেকগুলো জ্যান্ত আর মরা বাচ্চাও দেখতে পায় সে।
দৃশ্যটা দেখে হয়তো খারাপ লাগে শান্তর। বলে, যা পিন্দনে আছে তা নিয়াই চল। আগে তুমি তৈয়ার হও, আমি বাইরে আছি।
বাসন্তির তৈরি হবার মতো কিছু ছিল না। তবু শান্তর এনে দেয়া মোড়কটা খুলে দেখে আবার। লাল-সবুজ চুড়িগুলো বাংলাদেশের পতাকার মতো করে হাতে পরে। কপালে লাল টিপ। দু ঠোঁটে ঘষে লাল লিপস্টিক। পাউডার বা ক্রিম নেই বলে মুখটা কেমন খসখসে হয়ে থাকে।

এতদিন বস্তির অন্যান্য মেয়েরা যেন তাকে দেখতেই পায়নি। এমন ভাবে তারা তার দিকে তাকাচ্ছিল যেন এই প্রথম সে বস্তিতে এসেছে। শান্তর পেছন পেছন সে বস্তি থেকে বেরিয়ে আসে। আগে আনসার আলির সঙ্গে এভাবে কখনো বের হয়নি বলে কেমন যেন আড়ষ্টতায় ভুগতে থাকে সে। কিন্তু সে আড়ষ্টতাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে দিতেই যেন শান্ত তার একটি হাত ধরে খালি রিকশার দিকে এগিয়ে যায়।
পাশাপাশি একই রিকশায় বসবে বলতেই শান্তর মুখের দিকে তাকায় সে। খানিকটা দ্বিধা থাকলেও সে উঠে বসে। আর তখনই শান্ত তার পাশে গা ঘেঁষে বসে পড়ে।
এবড়ো থেবড়ো পথে রিকশা চলতে চলতে বারবার ঝাঁকুনি খায়। সে সময় শান্তর বাহুর সঙ্গে তার বাহু ঘষা খায়। ঊরুর সঙ্গে ঊরুর ধাক্কা লাগে। আর সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত এক শিহরণে মোচড় খায় তার দেহ-মন। ইচ্ছে হয় পেছন দিয়ে শান্তর কোমর জড়িয়ে ধরে। কিন্তু ইচ্ছেটা তার মনের ভেতরই চাপা পড়ে যায়।
ঠিক তখনই শান্ত তাকে বলে, আমার দিকে আরো চাইপ্যা বস। নাইলে পইড়া যাইবা কইলাম! বলতে বলতে সে নিজেই এক হাতে বাসন্তির কোমর জড়িয়ে ধরে।
বাসন্তির বরং ভালোই লাগে। আরো খানিকটা প্রশ্রয় দিতেই যেন সে শান্তর দিকে চেপে বসে হাসিমুখে বলে, তুমি থাকতে পইড়া যামু ক্যান?
বাসন্তির প্রশ্রয়ে হয়তো আরো সাহসী হয়ে ওঠে শান্ত। মুক্ত হাতটি দিয়ে বুকের কাছে বাসন্তির বাহুটি চেপে ধরে।
শান্তর সাহসী পদক্ষেপ যেন বাসন্তিকে স্পর্শ করে না। খুশি খুশি মুখে ডানে বায়ে বিচিত্র সব মানুষ, গাড়ি অথবা অন্য কিছু দেখে।

ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় দুজনের। বাসন্তি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শান্তকে বলে, এইবার যাইয়া ঘুম দেও!
-কইছ যখন যাইতে তো হইবোই। তয় একলা একলা ডরাইবা না তো?
-ভয়-ডর আমার নাই।
-আমারে তো থাকতে কইতে পারতা।
বলে মুচকি হাসে শান্ত।
-আগে হেই কপাল বানাও!
বলতে বলতে দরজা বন্ধ করে দেয় বাসন্তি। তারপর হাতের শপিং ব্যাগগুলো বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেও চিত হয়ে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ। এতসব জামা-কাপড়, শাড়ি-স্যান্ডেল দেখে আনসার আলি কি কোনো প্রশ্ন করবে না তাকে? যদি বলে, আমি তো তরে এইসব কিন্যা দেই নাই! কী জবাব দেবে সে? খারাপ কিছু যদি ভেবে বসে? সংসারে যদি অশান্তি হয়? ভাবতে ভাবতে উঠে পড়ে সে। ভাবে, যদির কথাই বা মনে করছে কেন? অশান্তি তো হবেই। তা ছাড়া স্বামী যদি স্ত্রীর সাধ-আহ্লাদ পূরণে অক্ষম হয়, তাহলে কি অন্যের মাধ্যমে তা পূরণ করা উচিত?
এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তার এক সময় মনে হয় যে, কাজটা মোটেও উচিত হয়নি। শান্তর কাছ থেকে এতসব জিনিস গ্রহণ করাটা বড্ড হুল হয়ে গেছে। আনসার আলি দেখলে মনে কষ্ট পাবে সন্দেহ নেই। বউয়ের চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করতেও ছাড়বে না হয়তো।
নিজেকেই নানা প্রশ্ন করে বাসন্তি আর আরো জটিল ভাবনা এসে তার মস্তিষ্ককে এলোমেলো করে দেয়। একবার মনে হয় সদ্য কিনে আনা কাপড়-চোপড় সব লুকিয়ে রাখবে। কিন্তু লুকানোর মতো জায়গাটা তার চোখে পড়ে না। বাপের ঘর থেকে যে সুটকেসটা নিয়ে এসেছিল তা ইঁদুরের পাল্লায় পড়ে শেষ হয়ে গেছে। ছোটবেলায় তার দাদিকে দেখেছে বড় মাটির হাঁড়ি বা মটকায় কাপড়-চোপড় আর মূল্যবান জিনিসপত্র রেখে মুখটা কাপড় দিয়ে ভালো মতো বেঁধে রাখতে। অবশ্য আসবার পথে এক লোকের মাথায় টিনের ট্রাঙ্ক দেখতে পেয়েছিল। তেমন একটা হলেও কাপড়গুলো ইঁদুরের হাত থেকে নিরাপদ থাকতো। তাহলে কি সে আনসার আলিকে বলবে এমন একটি বাক্সের কথা? শান্তকেও বলা যায়। কিন্তু এত কিছু নেবার পর আবার ট্রাঙ্কের কথা কোন মুখে বলবে? লজ্জা-শরমের তো কিছু ব্যাপার-স্যাপার থাকে।
আনসার আলি ফিরতে ফিরতে তিন-চারদিন হয়তো লাগবে। কিন্তু ততদিন এগুলোকে নিরাপদ রাখবে কী করে ভেবে কোনো কূল করতে পারে না সে। হঠাৎ তার মনে হয় যার জিনিস তার ঘরে থাকলেই ভাল হবে। শপিং ব্যাগগুলো সব হাতে নিয়ে চুপি চুপি সে শান্তর ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হয়। অন্য কেউ যাতে শুনতে না পায় তেমন মৃদু শব্দে ডেকে ডেকে হতাশ হয়ে পড়ে বাসন্তি। এক সময় দরজায় ঠেলা দিতেই খুলে যায়। শান্ত বসে বসে কাগজ দিয়ে ছোট ছোট মোড়ক বানাচ্ছিল। সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে সে শান্তর দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ব্যস্ত আর ত্রস্ত শান্ত উঠে এসে অস্ফুটে বলে, এত রাইতে কী? মানুষে দেখলে জুতা মারবো আমারে!
-আমার ঘরে ইন্দুরে সব কাইট্যা ফালাইবো। তোমার ঘরে রাইখ্যা দেও সব।
-আমার ঘরে এমন কিছু নাই। রাইতটা কোনোমতে পার কর। কাইলকা একটা টিনের বাক্স আনমু। তখন দিয়া যাইও।
বাসন্তি ফিরে আসে। রাতভর ঘুম হয় না তার। মনে মনে নিজের ওপর বিরক্ত হয়।  আগে কিছু ছিল না। ভাবনাও ছিল না। শান্ত তাকে এতসব জিনিস কিনে দিয়ে কী যে বিপদে ফেলল!
মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে নানা রকম ছোটখাটো জিনিস কিনতে কিনতে সে ভুলে গিয়েছিল যে, সে বস্তিতে থাকে। তার ঘরে এমন কোনো জায়গা নেই যে এত সব জিনিস রাখতে পারে। এমন কি তার বাপের ঘরেও এসব মূল্যবান জিনিসের নিরাপত্তা নেই। শুধু কি জিনিসপত্র? মেয়েকে নিরাপত্তা দিতে না পেরেই তো অসহায় বাপ চালচুলোহীন এক রিকশা চালকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। নিরাপদে থাকতে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হতে পারে গ্রামে কোনো বিপদ হলে তিনি তা সহ্য করতে পারবেন না। শহরে তো মেয়ে তার চোখের আড়ালে থাকবে। সেটাই হয়তো তার শেষ ভরসা। কিন্তু শহরে এসে কি তার নিরাপত্তা বেড়েছে? এই যে একা একটি ঘরে প্রমত্ত যৌবনা একটি বউ শুয়ে আছে, বলা কি যায় কোনো দিক থেকে তার বিপদ ঘটবে না? বেড়ার ঝাঁপ খুলতে হয়তো শব্দ হবে। পাশের ঘরের মানুষগুলোও হয়তো জেগে উঠবে। হয়তো তার ভীত আর আর্ত চিৎকারও হয়তো তাদের কানে পৌঁছুবে। কিন্তু জোট বেঁধে কি তারা আসবে তাকে নিরাপত্তা দিতে?
কিন্তু বাসন্তির অন্তর্গত জিজ্ঞাসার উত্তরগুলোও হয়তো বা হয়তো নয় এমন কিছুর মাঝামাঝি কোথাও আটকে থাকে। বাসন্তি শপিং ব্যাগগুলোকে বালিশ বানিয়ে মাথার নিচে দিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে পাহাড় সম অনিশ্চয়তার ভেতর।
বস্তির পাশেই বড় মসজিদ। ফজরের সময় বিপুল বেগে আজানের ধনি আঘাত করে তার কানের পর্দায়। ঘুমের ঘোরেই চমকে জেগে ওঠে বাসন্তি। গ্রামে থাকতেও ফজরের আজান শুনে ঘুম ভেঙেছে তার। কিন্তু শহরের এ মসজিদটির আজান বড্ড কর্কশ হয়ে তার কানে বাজে। মুয়াজ্জিন কি এমনিই যন্ত্রের মতো আজান দেয়? লোকটির মনে ভক্তি-শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা কি বিন্দুমাত্র নেই?
ঘুম ভাঙলেও বিছানায় পড়ে থাকে সে। উঠতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। তবু তার মনে হয় নাস্তার সময় কী খাবে? দিনের শুরুতে কিছু একটা খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খালি পেটে দিনটা শুরু করলে পুরোটা দিনই কষ্টেকষ্টে কাটাতে হয়। বাপের সংসারে এমন অভিজ্ঞতা অনেকবার হয়েছে। আনসার আলি রিকশা চালালে কি হবে, ঘরে চাল-ডাল, তেল-নুন, আনাজপাতির কোনো অভাব নেই। খাওয়ার দিক দিয়ে সচ্ছল বলতে সে যতটা বোঝে, আনসার আলির ঘরে ততটা সে পেয়েছে। এ নিয়ে কোনো ধরনের অভিযোগ তার মনে ভুলেও উদয় হয় না কখনো। তবু উঠে গিয়ে রান্না-বান্নার ঝামেলা করতে মন থেকে সায় পায় না সে। কেমন একটা আলস্য যেন তাকে জোর করেই বিছানার সঙ্গে ঠেসে রাখে।
অনেক বেলা করে উঠে সে প্রথমেই শান্তর ঘরের দিকে যায়। কিন্তু ঘরে তাকে পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার দিকেও আরেকবার সেখানে উঁকি মারে। সে ঘরের আশপাশের মানুষও কিছু বলতে পারে না। এভাবে দুদিন-চারদিন করে পুরো একটি সপ্তাহ পার হয়ে যায় শান্তর দেখা মেলে না। এমন কি তিন-চারদিন পর আনসার আলি ফিরে আসবার কথা থাকলেও সে ফিরে আসে না। ঘরের চাল-ডাল ফুরিয়ে গেলে শান্তর জমানো টাকা থেকেই খরচ করে সে। দরকারি মনে করে একটি টিনের ট্রাঙ্ক আর তালা-চাবিও কিনেছে। কিন্তু শান্তর জমানো টাকায় কদিন বা চলতে পারবে সে? হাজার বিশেক টাকায় যে জীবন ভর চলা সম্ভব নয় তা সে বোঝে। শান্ত ফিরে এসে টাকা ফেরত চাইলে কোনোভাবে সামাল দিতে পারবে সে। কিন্তু যদি আনসার আলি বা শান্ত কেউই ফিরে না আসে তাহলে তার সামনে ঘোরতর বিপদের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে সে। হাতের টাকা ফুরোবার আগেই তাকে কিছু একটা করতে হবে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে যে, রমনার মেলা দেখতে গিয়ে চাউমিন নামের হলদেটে কৃমির মতো দেখতে এক ধরনের খাবার দেখে প্রায় অসুস্থ হয়ে গেলে একটি ভাতের হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল শান্ত। খেতে খেতে খুবই সতর্কভাবে জানিয়েছিল যে, সে যদি একাধারে কয়েকদিন বস্তিতে না আসে, তাহলে তার ঘর থেকে যেন দুধের টিনটা নিয়ে আসে। যেটা চালের কাছে ঝুলানো চটের আড়ালে বা পুরোনো বোতলের জঞ্জালের ভেতর লুকানো থাকবে।
দুপুরের দিকে বলতে গেলে পুরো বস্তি ফাঁকা থাকে। অচল আর শিশু ছাড়া তেমন কেউ থাকে না। কথাটা আবার মনে হতেই সে শান্তর ঘরে যায় চুপি চুপি। দিন-দুপুরেই ঘরের ভেতরটা অন্ধকার মনে হয়। কেউ দেখে ফেলতে পারে ভেবে দরজাটাও পুরোপুরি মেলে দিতে পারে না। অন্ধকারে কোথায় কী আছে ঠাহর করতে না পেরে শান্তর বিছানায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সে। চোখে ঘরের অন্ধকার কিছুটা সয়ে এলে সে এদিক ওদিক আর চালের দিকে দৃষ্টি ফেলে। কথা মতো চালের কাছে কোনো চট ঝুলানো দেখতে পায় না।
ঘরের কোনে নানা আকৃতির বোতলের স্তূপ দেখতে পেয়ে সেদিকেই এগিয়ে যায়। আস্তে ধীরে বোতল সরিয়ে চটে জড়ানো গোল মতো কিছু একটা দেখতে পেয়ে তুলে আনে। চটের মোড়ক খুলতেই পেয়ে যায় দুধের টিন। ঢাকনা খুলতেই চোখে পড়ে একটি পাঁচশ টাকার তাড়া। চটপট বের করে বুকের কাছে ব্লাউজের ভেতর লুকিয়ে ফেলে সেটা। তারপর স্বচ্ছ পলিথিনে মোড়ানো সাদা পাউডারের মতো কিছু। দেখতে মনে হয় সোডা জাতীয় কিছু। কিন্তু আচারের সঙ্গে কি সোডার সম্পর্ক আছে? আর সোডার সঙ্গে টাকা কেন? অতটা সস্তার কিছু হলে শান্ত অমন করে বলতো না। কাজেই জিনিসটা মোটেও হেলা ফেলার নয়। শান্ত যে কদিন ধরে ঘরে ফিরছে না তা হয়তো কেউ খেয়াল করেনি। নয়তো ঘরের যাবতীয় মালামাল চুরি হয়ে যেতো। এমন কি খালি বোতলগুলোও রেখে যেতো না চোরের দল।

হঠাৎ করেই শান্তর হাতে টাকাপয়সা চলে আসবার রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়। আর কেনই বা সে অমন করে আচার বিক্রি বন্ধ করে নতুন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। তবে এও সে বুঝতে পারে যে শান্ত নিখোঁজ হলেও তার সন্ধানে কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে। ব্যাপারটা অত সহজে মিটবে না হয়তো। সাদা জিনিসটা চিনতে না পারলেও তা যে খুব হেলা ফেলা বা সস্তার কিছু নয় তা সে ভালোই বুঝতে পারে বাসন্তি। তাই টাকার বান্ডিলটা পলিথিনে ভালো করে মুড়ে ঘরের মাঝামাঝি মাটির মেঝেতে গর্ত করে লুকিয়ে রাখে। চিহ্ন হিসেবে পানির জগটা রেখে দেয় তার ওপর। তবু তার মন শান্ত হয় না। এক ধরনের অজানা আশঙ্কায় মনের ভেতর সারাক্ষণ কেমন একটা উথাল পাথাল ভাব লুকোচুরি খেলে। তা আড়াল করতেই হয়তো সে নতুন থ্রি-পিস সেলাই করিয়ে আনে দর্জির কাছ থেকে। বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সুতীর শাড়ি দুটো তুলে রাখে।
আগামী বেশ কিছুদিন তার খাওয়া পরা আর ঘর ভাড়ার ভাবনা না থাকলেও তার মনের ভেতরকার কু ডাক বন্ধ হয় না। এমন কি মন থেকে দূর করতে পারে না অজানা সেই শঙ্কাও। একবার ভাবে যে বস্তি ছেড়ে অন্য কোথাও উঠে যাবে সে। গ্রামেও ফিরে যেতে পারে। বাবার বাড়ি তো বলতে গেলে খালিই পড়ে আছে। শান্ত যদি ফিরে আসে? তার কাছে যদি সাদা পাউডার আর টাকার সন্ধান চায়? গ্রামে চলে গেলে শান্ত তাকে খুঁজে পাবে না। এক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে হয়তো ওই দুটো জিনিসের কারণে নতুন করে আরো বড় বিপদে পড়ে যাবে। শান্তর কথা ভেবেই বস্তি ছেড়ে বাসন্তির কোথাও যাওয়া হয় না। কিন্তু এখানে নিজেকে নিরাপদও ভাবতে পারে না।
শাড়ি ছেড়ে হঠাৎ থ্রি-পিস পরতে আরম্ভ করলে বস্তির অনেকেরই চোখ পড়ে তার ওপর। কেউ কেউ নিজ থেকেই তার ভালোমন্দের খোঁজ করতে আরম্ভ করে। নতুন বন্ধুও জুটে যায় কয়েকজন। তাদের সঙ্গেই মোটামুটি সময় কেটে যায় তার। তবে তাদের কৌতূহল তার আয়ের উৎস নিয়ে। সারাদিন সে ঘরেই থাকে। বাইরে কোথাও বের হয় না। এমন কি রাতের বেলাও কোনো পুরুষকে তার ঘরের দরজায় দেখা যায় না। তাহলে চলছে কী করে? নিত্য নতুন পোশাকই বা সে পাচ্ছে কোথায়?
সবার কৌতূহলের জবাবে সে জানায়, আল্লায় চালায়!
-নাকি শান্তর লগে গোপনে কোনো কালেকশান আছে?
একজন বয়স্কা মহিলা মুখ টিপে জানতে চাইলে পাশ থেকে আরেকজন ফোড়ন কাটার মতো বলে ওঠে, শান্ত পাইবো কই? তার লাশ পাইছে মেঘনায়। হাতপাও বান্ধা।
বাসন্তির পৃথিবী যেন হঠাৎ করেই দুলে ওঠে। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, এই খবর কে কইল? নদীতে কত মানুষই তো মরে। নৌকা ডুইব্যা মরে। লঞ্চ ডুইব্যা মরে।
-খবর কাগজে তার ফটু দেখছি। আমাগো মসজিদ গলির বস্তির কথাও লেখছে। ছেড়ায় যে আচার বানাইয়া ফেরি করতো হেই কথাও।
বাসন্তির কোনো সন্দেহ থাকে না। হঠাৎ করেই তার বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল করে। দু চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চোখের পানিতে বাধ দিতে পারে না। মেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে। একটি অচেনা অজানা যুবকের জন্য তার কান্নার পেছনে কী এমন হেতু থাকতে পারে সেটাই হয়তো ভাবে।
দিন কয়েক ঘর থেকে বের হয় না বাসন্তি। খাওয়া গোসল রান্না কোনোটাই ঠিকমত করে না। কোনো কাজেই তার মন সরে না। শান্তই যখন নেই তখন আনসার আলির আশায় দিন কাটাবারও কোনো মানে হয় না। মনে মনে সে ঠিক করে ফেলে যে, এখান থেকে চলে যাবে সে। নতুন কোথাও গিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে চেষ্টা করবে। যেখানে শান্ত, আনসার আলির কোনো নামগন্ধও থাকবে না। তবে তার আগে তাকে ঘুরে ঘুরে নতুন আবাসের খোঁজ করতে হবে।
সকাল সকাল গোসল-স্নান সেরে নতুন আরেক প্রস্ত পোশাক পরে মুখে ক্রিম আর পাউডার ঘষে নিয়ে চোখে কাজল লাগায়। গাঢ় করে দু-ঠোঁটে লিপস্টিক লাগায়। একটি কালো টিপ পরতে ইচ্ছে হলেও পরে না। ভেজা চুল বেঁধে রাখলে দুর্গন্ধ হয় বলে পিঠের ওপর ছড়িয়ে দেয় তা। নতুন স্যান্ডেল পায়ে হাঁটলে ফোস্কা পড়ে যেতে পারে বলে পুরোনো স্যান্ডেলেই বের হয় সে।
বস্তির মুখ থেকে খানিকটা দূরে একটি চায়ের দোকানে দুজন নারী-পুরুষকে তার দিকেই কেমন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ভেতরে ভেতরে খানিকটা শঙ্কা থাকলেও তাদের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় নারীটি হঠাৎ বাসন্তির হাত চেপে ধরে বলে ওঠে, কই যাও বাসন্তি?
ভয় পেলেও নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করে সে।
নারীটি জানায়, আমারে তুমি চিনবা না। আমার নাম কুসুম। তোমার লাইগা আমরা বইসা আছি কয়দিন ধইরা। পরিষ্কার কইরা কইলে তোমারে আমরা পাহারা দিতাছি দিন-রাইত।
এত কিছু জানা ছিল না বাসন্তির। তাই সে মনে মনে ভয় পায় আরো বেশি। যদিও শঙ্কা ছিল পাউডারের সন্ধানে কেউ আসতে পারে, তবে এমন করে চোখে চোখে রাখবে তা কল্পনাও করতে পারেনি।
কুসুম বাসন্তির হাত ধরে টেনে খানিকটা আড়ালে গিয়ে প্রায় চুপিসারে বলে, বইন, আমি তোমার শত্রু  না, তুমিও আমার শত্রু  না। জানলে সত্যি কইরা কইবা। না জানলে না করবা। তয় জিনিসটা আমরা বাইর করতে পারমু। অত্যাচার জুলুমও করতে হইব। কিন্তু আমরা চাই না এর লাইগা নির্দোষ মানুষ কষ্ট পাউক।
ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারলেও বাসন্তি বলে, আমি কী জানি হেইডাই তো বুঝতে পারতাছি না!
কুসুম হঠাৎ রেগে উঠে বলে, শান্তর লগে তর পিরীত আছিল না মাগি? রমনার মেলায় আর বাবুলের বিয়ায় যাস নাই তর পিরীতের নাগরের লগে?
-হেইডা তো না করতাসি না। আমি কী এমন জানি হেইডা বুঝাইয়া কইবেন না?
-শান্ত কি তোর কাছে কোনো পাউডারের প্যাকেট রাখতে দিছিল?
-দিছিল তো! খাওনের সোডা।
-হেইডা কই?
-ঘরেই আছে। আইজ তো ফালাইয়া দিতে গিয়াও কী মনে কইরা রাইখ্যা দিলাম!
-চল, ঘরে চল!
বাসন্তির বাহু ধরে টানতে টানতে বস্তিতে নিয়ে আসে কুসুম। বলে, ঘরে ঢোক!
বাসন্তির সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢোকে কুসুম। ঘরের এক কোনে ঝাড়ুর পাশেই অবহেলায় পড়ে আছে সেই প্যাকেট। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতেই চিলের মতো ছোঁ মেরে সেটা হাতে তুলে নেয় কুসুম। তারপর আঁচলের তলায় কোথাও লুকিয়ে ফেলে বিজয়ীর ভঙ্গীতে বলে, বড় বাচন বাইচ্যা গেছি!
বাসন্তিরও যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে।


সেদিনের পর থেকেই কুসুমের সঙ্গে একটি সম্পর্ক তৈরি হয় বাসন্তির। আস্তে ধীরে একজন আরেকজনের পেটের খবর জানে। কিন্তু বাসন্তি দুশ্চিন্তায় ছিল হাতের টাকাপয়সা শেষ হয়ে গেলে তার দিন চলবে কিভাবে? কুসুমের সঙ্গে কথায় কথায় একদিন বলে, বইনরে, জামাই নাই, পুত নাই, নাঙও নাই, কাজ-কামাইও করি না। আমার দিন চলবো কেমনে?
-আমি আছি তো! এত চিন্তা কী তর?
-তারপরেও। তোমার কান্ধে বইয়া খাইলে চুপ থাকবা কতদিন?
-একলা আছস কতদিন হইল? শইল কিরাম কিরাম লাগে না? আমার জানাশুনা অনেক বিশ্বাসী মানুষ আছে। মজার মজা পাবি আর ট্যাকাও পাবি।
অল্পতেই যেন কুসুমের ইঙ্গিতের পেছনকার যাবতীয় দৃশ্য ফুটে উঠেছিল চোখের সামনে। ধরে নিয়েছিল এটাই তার নিয়তি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকলে কোনো একটা পথ নিশ্চয় পাওয়া যাবে। তাই কুসুমের কথাকে এক কথায় ফেলে দিতে পারেনি।
প্রথম দিনটা ছিল বড্ড অদ্ভুত। নতুন পোশাক পরে পার্লার থেকে সাজগোজ করে এসেছিল। আয়নায় নিজের প্রতিরূপ দেখে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। কোথাকার কোন অঁজপাড়াগায়ের নাম না জানা রস-গন্ধ-রূপহীন ফুল হঠাৎ করেই যেন হাজার মৌমাছির লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠলো।
হোটেলের রুমটিতে প্রায় বৃদ্ধ একজন বসে বসে টিভির মতো পাতলা একটি বাক্সের দিকে ঝুঁকে বসে কিছু একটা করছিল। মুখ ঘুরিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে লোকটি সহাস্য বদনে বলে উঠেছিল- কিউট গার্ল!
তারপরই কেমন যেন শিশুদের মতো হয়ে উঠেছিল লোকটি। তড়িঘড়ি উঠে দরজাটা লক করে ফিরে এসে বাসন্তির সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিল, সব জেনে বুঝে এসেছো তো?
-হুম।
নির্বিকার জবাব দিয়েছিল সে।
-তোমার সঙ্গে কী হতে পারে বুঝতে পারছো তো?
লোকটির দ্বিধা দেখে হঠাৎ হেসে উঠেছিল বাসন্তি। বলেছিল, মনে করেন আমি আপনের ইচ্ছাবউ। ইচ্ছা করলেই আমারে পাইবেন।
কথা শুনে লোকটি হালকা পদক্ষেপে আরো এগিয়ে এসেছিল। আলতো হাতে দুটো গালে হাত দিয়ে বলেছিল, আম হ্যাপি নাউ!
তারপর উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, কী খাবে, চা, কফি, সফট-হার্ড ড্রিঙ্কস। কোনটা?
-না। কিছুই না। আমি শুধু আপনের জন্য আসছি।
-গুড! তাহলে আমার পাশে এসে বসো।
কাজটাজ বন্ধ করে লোকটি প্রায় সারাদিন হুটোপুটি করে কাটিয়ে দিল। লোকটা নিজে যেমন তৃপ্ত হলো বাসন্তিকেও যেন অনন্ত সুখের কবরে কিছুদিনের জন্য মাটিচাপা দিয়ে দিল।
শান্তর মৃত্যু কিংবা আনসার আলির অন্তর্ধানের পর সে যেন এমনটাই চেয়েছিল মনেমনে। ক্ষুধা পরিমাণ ভোগ।
লোকটি যেন খুশি হয়েই নিজের ঘর আর জীবনের যাবতীয় অতৃপ্তির কাহিনী বলে যেতে লাগলো। দিনশেষে বেশ কয়েকটি পাঁচশ টাকার নোট আর একটি কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি সাইদি। আমার কথা মনে হলেই ফোন দেবে কেমন? আমার একটাই কমতি আর তা হলো বয়সটা খুব বেশি! তারপরই হাহা করে হাসতে আরম্ভ করেছিল লোকটি।
এরপর যতদিন খাওয়া-পরার সংকট ছিল অন্য কারো কাছে যেতে হয়নি বাসন্তিকে। কিন্তু কুসুমের হয়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে তাকে। বিনিময়ে পেয়েছে নানা অংকের টাকা। অত টাকা তার একার পক্ষে খরচ করা সম্ভব হয়নি। টাকা হলে মানুষের বোধবুদ্ধি আর চলাফেরার ধরন পালটায়। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করে ভেবে চিন্তে। নানা অংকের টাকা আর নানা ধরনের পুরুষে জীবনটাকে উলটে-পালটে ছেনে-ভেঙে দেখতে দেখতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। কোনো কিছুই আর ভালো লাগছিল না। কিন্তু ক্ষুধা তাকে সব সময় নির্বোধের মতো কাজ করা থেকে ফিরিয়েছে। বুঝতে পেরেছিল কোথাও থিতু হওয়া দরকার। তাও সে পেরেছে। ঢাকা শহরের বনেদী এলাকায় সাততলা বাড়ি হয়েছে। কৃষক বাপের নামে হয়েছে গাড়ি-জমি, ব্রিকফিল্ড। বাজারে একটি আলাদা মার্কেট। এক জীবনে আর কত চাই একজন মানুষের? বাসন্তির চাহিদাও যেন থেমে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে একটি আক্ষেপ তাকে তাড়া করে ফেরে যে, স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করাটা বোঝা হলো না।
ভাবতে ভাবতে দুপুর কখন পার হয়ে গেছে বুঝতে পারে না বাসন্তি অথবা কুসুম। বাইরে কোথাও গিয়ে খেয়ে নেবে ভাবতেই তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে হঠাৎ। রাজীব নামের একটি ছেলে।
-হ্যালো। ফোন করতাছিস ক্যান?
-কুসুম আপা ঝন্টু ক্লিনিকে আছে। তিন নম্বর কেবিনে।
-আপার অবস্থা কেমন?
-বেশি ভালো না। আপনেরে দেখতে চাইতাছে।
বাসন্তি ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু বেশিক্ষণ কথা হয়নি তার সঙ্গে। গুলি লেগেছে বুকের বাঁ দিকে। ডাক্তারের অনুমান হৃদপিণ্ড ভেদ করে গেছে। যত টাকা লাগে চিকিচ্ছা করেন। বিমান ভাড়া কইরা বিদেশে নেন। টাকার চিন্তা কইরেন না!
অনেক বেশি রক্তপাত হয়েছিল। হাতে সময় নেই। কুসুম মারা যাচ্ছে। ডাক্তারেরও কিছু করবার নেই। শেষ সময় বাসন্তির হাত ধরে বলেছিল, আমি বাচমু না। কার্পেটের নিচে লকারের চাবিটা আছে। বাকি সব চাবি রাখা আছে লকারে। দলটার রুটি-রুজি সব তর হাতে। সবাইরে দেখিস! যারা আগে তোরে দেখে নাই। তাগো কাছে কুসুম বইলা নিজের পরিচয় দিস।
মিনিট কয়েক পর কুসুম ফুরিয়ে গেল। এক অন্ধকার থেকে পৌঁছে গেল আরেক অন্ধকারে। অন্ধকার জগতে থেকেও কুসুম তার জীবনটাকে আলোকিত করে রেখেছিল নানাভাবে। কিন্তু এখন কি সে পারবে একা একা নিজেকে রক্ষা করতে?

সময়ের সঙ্গে মানুষের পছন্দ আর প্রয়োজনও পালটায়। কিন্তু বাসন্তি এখনকার কুসুম হলেও সাদা পাউডারের মতো জিনিসটার ব্যাপারে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেননি। এটির চাহিদা আর মূল্য কেন এত বেশি তা নিয়েও কখনো মাথা ঘামাননি তিনি। এমন কি এটার স্বাদ কেমন তা নিয়েও কোনো আগ্রহ তার ছিল না। এখনও নেই। তা ছাড়া নতুন আরেকটা জিনিস দেখতে আলতার বড়ির মতো। ছোটবেলা দশ পয়সা দিয়ে একটি আলতার বড়ি কিনতেন। বড়িটাকে পানিতে চুবিয়ে হাত পা রাঙাতে খুব মজা পেতেন।। দেখতে আলতার বড়ির মতো জিনিসটার স্বাদ-গন্ধ, উপকার বা অপকার কিছুই জানেন না। শুধু জানেন খুব লাভজনক। প্রতিটা বড়িতে কম করে হলেও দুশো টাকা থাকে। চাহিদা বাড়লে লাভও বাড়ে। তার ইচ্ছে খুব শীঘ্রই এ পেশা ছেড়ে দেবেন। একটি নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে সবার চোখের আড়ালে চলে যাবেন।
সম্প্রতি একজন মফস্বল সংবাদদাতার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। ছেলেটি লোভী হলেও কাজের। কুসুম নামের বর্তমান মাদক সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুর সংবাদটি যাতে ছবি সহ পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় সে জন্য আগাম টাকা-পয়সা, ভিজিটিং কার্ড আর তার ব্যবহারের একটি পার্স ও কিছু টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে এক কপি ছবিও দেয়া হয়েছে। অজ্ঞাত পরিচয় কোনো নারীর মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা সে পার্স আর ভেতরকার তথ্যাবলী প্রমাণ দেবে মৃত কুসুমের।
অফিসে বসলেই আজকাল অতীত তাকে টেনে নিয়ে যায় পেছনের দিনগুলোর কাছে। মাঝে মধ্য পিএস মেয়েটা ইন্টারকমে জানতে চায়, ম্যাডাম, চা বা কফি কিছু দেবো?
কখনো না বলেন। কখনো বা হ্যাঁ। এভাবেই তার সময়গুলো পার হয়ে যায়। কিন্তু আর অফিসে বসবেন না তিনি। আজই শেষদিন। সে অনুযায়ী চারটার দিকে অফিস বন্ধ করে চলে যাবেন সবার চোখের আড়ালে।
হঠাৎ ফোনটা বাজতে থাকে। হ্যালো?
-আপা, আমি রমজান। এক্সিডেন্ট কইরা পাও ভাইঙ্গা ফালাইছি। পঙ্গু হাসপাতালের দোতালায় নয় নম্বর কেবিন। আপনে ছাড়া আর কেউ নাই।
-ঠিকানা কই লেখছিলি?
-আমার মুখস্থ আছে।
তার মানে জিনিসটা হাতবদল করতে পারেনি সে। ফুল-মতি ওরফে কুসুম দ্রুত পোশাক পালটায়। আলমারি, ড্রয়ার, লকার সবগুলোতে তালা লাগায় নিয়ম মাফিক। মূল চাবিটা কার্পেটের নিচে রেখে সিকিউরিটি রুমে ফোন করে বলেন, ড্রাইভারকে বলও, গেটে দাঁড়ানো মহিলাটিকে পঙ্গু হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে এসো। এখনি।
ফোনে নির্দেশ দিয়ে লিফটে দ্রুত নিচে নেমে আসেন তিনি। মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচলের প্রান্তটা দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছেন। খানিকটা পরেই ড্রাইভার গাড়ি বের করে জানালা দিয়ে বলে, ওই মাতারি, গাড়িতে উঠো।
বাসন্তি বিনা বাক্য ব্যয়ে গাড়িতে উঠে বসেন।
গাড়ি ছুটে চলে নানা পথে। পঙ্গু হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসে ড্রাইভার। দরজা খুলে ধরে ধমক দিয়ে বলে, নাম মাতারি!
বাসন্তি ড্রাইভারের দুর্ব্যবহারে মনে মনে হাসেন। কিন্তু দেরি করবার উপায় নেই। সিঁড়ি ভেঙে দোতলার দিকে ছুটে চলেন।
নয় নাম্বার কেবিনে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা লক করে দিয়ে রমজানের পায়ের দিকে সন্দিহান চোখে তাকান। খুবই বিশ্বস্ত মানুষ রমজান। তবু কেন এমন সন্দেহ হচ্ছে যে, রমজানের কিছুই হয়নি। কিন্তু পায়ের অবস্থা দেখে মনে হয় পা ভাঙার ঘটনা মিথ্যে নয়। বিছানায় আধা শোয়া অবস্থায় আছে রমজান। ডান পায়ের হাঁটু অবধি প্লাস্টার করা। তারপরও বাসন্তির মনটা কেমন খুঁত খুঁত করতে থাকে। আর খুঁতখুঁতে মন নিয়েই হাত পাতেন তিনি।
পেটের কাছে প্যান্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে নীল রঙের পলিথিনে মোড়ানো একটি প্যাকেট বের করে বাসন্তির হাতে দিয়ে বলে, রূপনগর কয়লা গলির সোবান। ভাঙ্গারির দোকানে জিগাইলেই হইব।
-সাইডে বা কাছাকাছি আর কোনো ভাঙ্গারির দোকান আছে?
-নাই।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশা নেন তিনি। রাস্তায় অনেক গাড়ি-রিকশা-সিএনজি চলছে। জ্যামে জ্যামেই সময় কেটে যাচ্ছে। এক সময় সূর্য হেলে পড়ে পশ্চিমে। সন্ধ্যার লালচে আলোয় সব যেন কেমন অচেনা মনে হয়। শেষবার  এ এলাকায় এসেছিলেন বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু এই পাঁচ বছরে ডোবা-নালা সব কোথায় গেল? কত না দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব। কয়লার গলির মুখে নেমে পড়ে তিনি ভাঙ্গারির দোকানের খোঁজ করেন। গলির মুখে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে মনে হয় অনেকগুলো চোখ যেন অনুসরণ করছে তাকে। আগে কখনো এমনটা মনে হয়নি। আজ কেন যেন নিশুতি রাতে ভয় পাওয়ার মতো পুরো দেহ ছমছম করছে। গলির দু পাশের খোলা জানালাগুলোতে কারো মুখ দেখা না গেলেও মনে হচ্ছিল কেউ না কেউ তাকিয়ে আছে।
আরো কিছুটা পথ এগোতেই একটি ভাঙ্গারির দোকান চোখে পড়ে। একটি আট-দশ বছরের ছেলে বসে আছে। এই ছেমড়া, এইডা কি সোবানের দোকান?
-হ।
বলেই সন্দিহান চোখে তাকায় ছেলেটি। তারপর আবার বলে, আমি কিন্তু মালিক না। আমার মামুর দোকান।
-হ্যারে ডাইক্যা দে তো! ক, একজন তার লগে কথা কইবো।
-মামু, ও মামু! দ্যাহ ক্যাডা আইছে?
দোকানের পেছনকার সরু পথ ধরে কাঁচা-পাকা চুল দাড়ির শক্ত-সমর্থ চিকার মতো মুখের এক মাঝ বয়সী পুরুষ বের হয়ে আসে।
লোকটিকে দেখে বাসন্তির বিরক্তি বাড়লেও শান্ত স্বরে বলেন, আপনে সোবান?
-হ।
-একটা সংবাদ আছিল।
বলেই সংকেতের অপেক্ষা করেন বাসন্তি।
-আসেন, ভিতরে আসেন!
বাসন্তি সংকেত না পেলে আগাবেন না বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন।
-কী আপা, আমরা হইলাম গরিব-গুর্বা দেড় পয়সার কারবারী! মাল আনছেন?
সংকেত মিলে গেছে। এ লোকই তাহলে আসল লোক। বাসন্তি নির্ভয়ে এগিয়ে গেলেও হঠাৎ কেউ পেছন থেকে তার মুখটা চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে দু পাশ থেকে দু বাহু ধরে আরো দুটো তাগড়া মতো লোক।
অবাক হয়ে গেলেও কিছু বলতে পারেন না বাসন্তি। কিছু বুঝে উঠবার আগেই হাত-পা আর মুখ বাঁধা অবস্থায় আবিষ্কার করেন নিজেকে। অল্প বয়সের একটি যুবক তার শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে হাতড়াতে থাকে।
পাশ থেকে সোবান বলে, এমনে পাবি না। কাপড়-টাপড় খুইলা ফালা!
লোকটি তাই করে। শাড়ি টেনে খুলে ফেলে। পেটিকোট আর ব্লাউজ টেনে ছিঁড়ে ফেলেও কিছু পায় না। কিন্তু সোবান এগিয়ে এসে এক হাতে হ্যাঁচকা টানে বুক থেকে কাঁচুলি টেনে ছিঁড়ে ফেলতেই আচমকা দু স্তনের মাঝখান থেকে বাদামী রঙের পাউডার ভর্তি পলিথিনের একটি মোড়ক লাফিয়ে পড়ে নোংরা মেঝেতে।
সোবান সেটা তুলে মুঠোতে নিয়ে বলে, পাইয়া গেছি গরম মশল্লা!
বাসন্তি এবার নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, দলের কেউ না কেউ, হতে পারে সেটা রমজান যাবতীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে অথবা নিজেরাই একটি আলাদা দল বানিয়েছে বুঝতে পারেননি তিনি। আসলে খুব বেশি উপরে উঠে গেলে তৃণমূলের সব কিছু চোখে পড়ে না। একদিন যেভাবে প্রকৃত কুসুমও চূড়ায় পৌঁছে যাবার খেসারত দিয়েছিল প্রাণ দিয়ে। অতি আগ্রহী কটি ব্যস্ত হাত তার শরীরে বাড়তি কিছুর তালাশ করতে থাকলে সোবানের কণ্ঠ শোনা যায়, হারামির বাচ্চারা, বুইড়া মাগীর শইল্যে কী খুজস? সর!
পাশ থেকে কেউ একজন বলে, ওস্তাদ, দিমুনি গলার মাইদে একটা পোচ? মাছের আদার বানাইয়া ভ্যানে তুইল্যা দিমু!
কুসুম অথবা বাসন্তি বুঝতে পারেন না তার অদৃষ্টে কী আছে। এ যাত্রা কি বেঁচে ফিরতে পারবেন? আর বাঁচলেই বা কী আসবে যাবে? স্বামী-সন্তান আর সংসার থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে যাদের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, কী পেলেন বিনিময়ে? অথচ তার সময় যেন ফুরায় না কিছুতেই। যেন অনন্ত কাল ধরে প্রতীক্ষায় আছেন মৃত্যু কখন তাকে উদ্ধার করতে আসবে। কিন্তু গলায় পোচ দেবার কথা বললেও লোকটির মাঝে  কোনো রকম আগ্রহ বা তৎপরতা দেখা যায় না।

(সমাপ্ত)

No comments:

Post a Comment