26 May 2018

আলোকলতা— স্মৃতি ভদ্র



“মা
ভালবাসা জীবনের যে কোন সময় আসতে পারে।”
বুবুনের এই কথাটা আমার জীবনে মিলে যাবে তাযেন আমার ভাবনার অতিরিক্ত ছিল। জীবনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা পিছনে ফেলে তখন আমি বেশ গুছিয়ে উঠেছি। স্বনির্ভর আমিই বুবুনের একমাত্র আশ্রয়স্থল। না, আশ্রয় নয় বুবুন আমার জীবনে জড়িয়ে আছে লতার মতোন। আর আমি ওর আলোকলতা।

আশ্রয়, এই শব্দটি ঠিক কতটা লজ্জাজনক হতে পারে তার উদাহরণ আমার জীবন। খুব ছোটবেলায় মা মারা যায়। এরপর বাবা বিয়ে করে নতুন মা ঘরে আনলে সেই ঘর আমাকে পর করে দেয়। আমার জায়গা হয় মামাদের কাছে। জায়গা নয় আশ্রয় দেয়। যা দিয়ে বিনিময়ে আমার আত্মসম্মানটুকু নিয়ে নিতে চায়। কিন্তু আমার আশ্রয়দাতারা বিনিময় সূত্রেই যে ভুল করছিলো তা মানতে নারাজ ছিল। তারা আমাকে তাদের উচ্ছিষ্ট একটু জায়গা দিয়েছিলো আশ্রয় হিসেবে যা ছিল স্টোররুমের এক কোণা কিন্তু বিনিময়ে চাইছিলো আমার সব থেকে মূল্যবান আত্মসম্মান। তাহলে কিভাবে সম্ভব ছিল এই বিনিময়? আর তাই আমার জন্য তারা বরাদ্দ রাখত কটু কথা আর উপহাস। তাদের সবচেয়ে বেশী উপহাসের স্বীকার হতো আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছাটি। “কুঁজোর শখ হয় সোজা হয়ে দাঁড়াতে!” মামির এই বাক্যটির সাথে ঘর ছিল যেন  আমার সকালবিকাল। এই উপহাসকে গা থেকে ঝেরে ফেলে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম। মায়ের নামে নানার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল টুকু দিয়েই আমি এগিয়ে যেতে থাকলাম।

এই এগিয়ে যাওয়ার পথেই একদিন আমার জীবনে পলাশ নামের বসন্ত এলো। আমার জীবনের সব তিক্ততায়, ক্ষতে  প্রলেপ লাগানো শুরু করলো। এতদিন যা পাইনি পলাশ আমার দু'হাত ভরে তা দিতে লাগলো। ভালবাসা আমার হাত উপচিয়ে পড়তে লাগলো। পলাশের এই আগলে রাখাটা আমি খুব উপভোগ করতাম। একদিন দেখা না হলেই ওর অস্থিরতা আমার বুকের ভিতর তিরতির করে ছুঁয়ে যেত। আমি আপ্লুত হতাম। কলাপাতায় করে শিউলি ফুল এনে দেওয়া হোক বা মুঠোয় ভরা বেলী; পলাশ আমার জীবন সুঘ্রাণে ভরিয়ে তুললো।

আত্মসম্মানী আমি প্রথমবারের মতো মামাদের কাছে কিছু চেয়ে বসলাম। “আমি পলাশকে বিয়ে করতে চাই” এই বাক্যতেই ঠিক কী খুঁজে পেল মামারা তা আমি জানি না। তবে তারা খুব অপমানিত বোধ করে। সারাজীবন আমাকে খড়কুটো ভাবা মামারা আমার বিয়ে নিয়ে নাকি অনেক স্বপ্ন দেখে রেখেছিলেন। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর আমার মামারা এক কাপড়ে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।

আশ্রয়হীনা আমাকে পলাশ বিয়ে করে নতুন আশ্রয় দেয়। হ্যাঁ
আশ্রয়ই তো। পলাশ আমাকে বিয়ের তিনমাসের মধ্যেই বুঝিয়ে দেয় ওর বাড়িতে আমি আশ্রিতা। নিজের ভেবে সে বাড়ির একটি শোপিসের জায়গা বদল করলেও পলাশের কাছে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হতো। সে বাড়িতে আমার কোন বন্ধু এলে পলাশ বুঝিয়ে দিতো ওর বাড়িকে আড্ডাখানা বানানো যাবে না। বুঝলাম আশ্রিতা আমি, এক আশ্রয় ছেড়ে আরেক আশ্রয়ে এসেছি; জীবনভর আশ্রয় খুঁজেই ফিরতে হবে আমাকে। কিন্তু আমার সেই আত্মসম্মান যা পলাশের ভালবাসায় একটু একটু করে ম্রিয়মাণ হয়ে গিয়েছিল তা আবার স্বমহিমায় ফিরে এলো। আমি পলাশের কথার প্রতিবাদ করা শুরু করলাম। নিজেকে গড়ে তুলতে চাইলাম এবার। একটি স্কুলে চাকরি নিলাম পলাশকে না জানিয়ে। ভুল ছিল আমার। না, চাকরি নেওয়াটা ভুল নয়, ভুল ছিল পলাশকে চিনতে। আমি ভেবেছিলাম পলাশ আমাকে চাকরি করতে দিবে না। কিন্তু আমাকে অবাক করে পলাশ বরং আমার বেতন ঠিকমতো গুণে নেওয়া শুরু করলো। দিনশেষে আবার ওর কাছে আমাকেই হাত পাততে হতো। এভাবেই দিন কাটছিলো।

আমি কনসিভ করলাম। পলাশ খুব খুশী হলো। আমি পলাশের পরিবর্তন দেখতে পেলাম। আমার খুব যত্ন নেওয়া শুরু করলো। আমি যা খেতে ভালবাসি সব এনে মুখের সামনে ধরতো। প্রতিদিন ঘুমের আগে এক গ্লাস দুধ দিয়ে বলতো খাও ছেলে ফর্সা হবে। এটা ওর ভালবাসা ভেবে বলতাম, “ইশ্, ছেলে কেন? হয়তো মেয়ে হবে”। পলাশ কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলতো, “মেয়ে দিয়ে কী করবো?”
নাআমি নিরাশ করি নি পলাশকে। একটি রাজপুত্র উপহার দিয়েছিলাম ওকে। এই রাজপুত্রই আমার বুবুন। বুবুনকে নিয়ে প্রথম বছর খুব ভাল কাটলো আমাদের। পলাশও খুব খুশি ছিল। কিন্তু সেই যে আমার আশ্রয়, সেখানেই তো সমস্যা  ছিল। পলাশ খুব ধীরে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছিল। ছেলের সব দায়িত্ব আমাকে দেবার পরেও কর্তৃত্ব তার ছিল। ছেলে ব্যথা পেলেও আমি আসামী আবার জ্বর এলেও তার জবাবদিহি আমাকেই করতে হতো। আমি আবার আত্মসম্মানহীনবোধ করা শুরু করলাম। আর এবার এর সাথে শুরু হলো পলাশের অদ্ভুত কিছু আচরণ।  সারাক্ষণ ফোনে ব্যস্ত থাকা, আমাকে লুকিয়ে এটা ওটা কেনা, না জানিয়ে কোথাও চলে যাওয়া। যেন সবকিছুতেই খুব রাখঢাক।  প্রথমে বুঝতে পারি নি। কিছুদিন যাবার পর বুঝতে পারলাম পলাশ আবার নতুন কাউকে আশ্রয় দিতে চলেছে। আর সম্ভব নয়। আমি পলাশের আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, সাথে বুবুন। ভেবেছিলাম বুবুনকে আটকে দিবে ও। কিন্তু দেয়নি, পরে বুঝতে পেরেছি কোনকিছু বেশিদিন ভাল লাগে না পলাশের।

আমি এবার আক্ষরিকভাবেই আশ্রয়হীন। একটা দিন আমাদের পথেই কাটলো। অবশেষে এক বন্ধুর সহায়তায় ওদের ছাদের চিলেকোঠা ভাড়া নিলাম। শুরু হলো বুবুনের নিয়ে আমার যুদ্ধ। আমি তো আজীবনের যোদ্ধা কিন্তু আমার বুবুন এতদিন রাজপুত্র হয়ে ছিল। ও
কীভাবে প্রাসাদ ছেড়ে যুদ্ধে নামবে, খুব ভাবনা ছিল। তবে  যুদ্ধে নিজেকে কীভাবে মায়ের শ্রেষ্ঠ সহযোদ্ধা বানাতে হয় তা আমার বুবুন খুব তাড়াতাড়ি শিখে যায়। বুবুন ছোট, তাই ওকে দেখাশোনা করে কী কাজ করা যায় ভেবে যখন কূলহারা, তখন একদিন এক ছেলেকে বেশ অনেকগুলো টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে যেতে দেখে অফিসে লাঞ্চ সাপ্লাইয়ের কাজের পরিকল্পনা মাথায় আসে, আমি কাজ শুরু করি।
ভোর থেকে দুপুর অব্দি ঘেমে নেয়ে রান্না করে দুপুরের মধ্যে সব খাবার সাপ্লাই দিয়ে সারা বিকেল আমার চিলেকোঠার সামনের ছাদে অফুরন্ত সময় কাটতো। এই অফুরন্ত সময়কে আমি হেলায় যেতে দিলাম না। আমি সুঁইয়ের ফোঁড়ে গল্প আঁকতে লাগলাম কাপড়ে। এটাকেও আমি উপার্জনের মাধ্যম করে নিলাম। বুবুনের সাথে সাথে আমার ব্যবসাও বড় হতে লাগলো। আস্তে আস্তে আমার বুটিক শুরু করলাম, লাঞ্চ সাপ্লাই বন্ধ করে দিলাম। বুবুন স্কুলে যাওয়া শুরু করলো। নিজের পুরো মনোযোগ ব্যবসায় দিলাম।  সারাদিন ব্যস্ত সময় কাটিয়ে বাসার এসে সেই ঘরের সামনের খোলা ছাদে মা ছেলের বৃষ্টি বা জ্যোৎস্নায় ভেজার দিন এক একটি কাব্য হয়ে থাকতো।


“কাব্য” শব্দটি জীবনে এভাবে জুড়ে যাবে আগে ভাবিনি কখনো। কাব্য’র সাথে আমার বারো বছরের পরিচয়, ব্যবসার সুত্রেই। বিপত্নীক কাব্য তখনো যেমন ছিল, এখনো তেমন। খুব হাসিখুশি আর অন্যের কষ্টে ম্রিয়মাণ। আমার প্রতি কাব্য’র ব্যবহারে প্রথম দিকে খুব বিরক্ত হতাম। আমি মেয়ে বলে ও যেন আমায় করুণা করতো বলে মনে হতো। কিন্তু এই ধারণা খুব বেশিদিন বইতে হয় নি। কাব্য খুব তাড়াতাড়ি আমার বন্ধু হয়ে উঠলো। ও সাহায্য করতো কম, নিতো বেশি। আর যখন জেনে গেলাম আমরা ব্যাচমেট তখন সম্পর্কটা আপনি থেকে এক লাফে তুই তে এসে দাঁড়ালো। এরপর কাব্য তো আমার বাড়ির নিত্য দিনের অতিথি। অর্ডার আটকে গেছে কিছু টাকা দে বা আজ তোর বাসায় কী রান্না হয়েছে রে, আসবো? এই হলো কাব্য।
 
এই প্রাণোচ্ছল ছেলেটির সহচার্য আমার আর বুবুনের জীবনের এক টুকরো শীতের রোদের মতো উপভোগ্য হয়ে উঠলো। ভারহীন কোন সম্পর্কের অনুভূতি যে এত মিষ্টি হয় বুবুনের সাথে আমিও বুঝলাম। আমার বাড়ির বাগানে কোন কোন ফুলের গাছ লাগানো হবে তাও মালি চাচাকে বলে দিতো কাব্য। আবার বুবুন ঠিক কী নিয়ে পড়লে ভাল করবে তা নিয়েও নিজ দায়িত্বে মত দিয়ে যেত কাব্য, ওর মতামত আমরা মানি আর না মানি তাতে ওর কিছু আসতো
যেতো না।
 
সেদিন সন্ধ্যায় সাম্প্রতিক সময়ের খুব আলোচিত একটি বই নিয়ে আমার আর কাব্যের তুমুল আলোচনা বুবুন চুপচাপ আমাদের পাশেই বসেই শুনছিলো। আসলে বুবুন শুনছিলো কম বরং বলা যায় আমাদের লক্ষ্য করছিলো। কাব্য চলে গেলেই বুবুন আমাকে বলে, “মা, তুমি কাব্য আংকেল কে বিয়ে করো।”
বুবুনের কথায় আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। মধ্য চল্লিশের আমি এখন কেন বিয়ে করবো? আর কাব্যকেই কেন?
মা, তুমি কাব্য আংকেল কে ভালবাসো?
না, আমি কাব্যকে নিয়ে ওভাবে ভাবিই নি কখনো।
মা, ভালবাসা ভেবে আসে না, জীবনে জড়িয়ে যায়।
তাই বলে এই বয়সে! আমার প্রশ্নের উত্তরেই বুবুন বলে, “মা, ভালবাসা জীবনের যে কোন সময়েই আসতে পারে।”

আমার এখন নিজের বাড়ির একটি চিলেকোঠা সহ খোলা ছাদ আছে। আজ পয়লা বৈশাখ। বুবুন নিজের বন্ধুদের নিয়ে সেই ছাদ ফুল দিয়ে সাজিয়েছে। আমি পড়েছি লাল-সাদায় সুঁইয়ে তোলা পুতুল আর হাতির গল্পের একটি রাজশাহী সিল্ক আর কাব্য একটি লাল পাঞ্জাবি। আমার বাগানের কাঠগোলাপ কাব্য’র প্রথম উপহার আমার জন্য। আমাদের দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে বুবুন আমার কানে ফিসফিস করে বলে, “আজ আমি খুব খুশী আলোকলতা।”

বুবুন যখন আমার বাবা হয়ে শাসন করতো তখন আমাকে এই নাম ধরেই ডাকতো।



No comments:

Post a Comment