08 May 2016

পিয়ালী বসু



“Men can only think. Women have a way of understanding without thinking. Woman was created out of God's own fancy. Man, He had to hammer into shape.”

রবীন্দ্রনাথের উপরোক্ত উক্তি থেকেই স্পষ্ট সমাজে 'অবলা' ট্যাগে ভূষিত 'নারী' সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত। অষ্টাদশ  শতকে নারীর অধিকার যখন অনেকটাই অকল্পনীয়, তখনও  রবীন্দ্রনাথ নারীকে তুলে এনেছেন তার লেখনির কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা, সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন ও সাহসী হিসেবে। তাঁর 'নারী' নামক দীর্ঘ কবিতায়  কবিতায় সতেরো জন নারীর বর্ণনা দিয়েছেন কবি। কাজলী, শামলী, হেয়ালী, খেয়ালী, জয়তী, নন্দিনী, মুরতি, প্রতিমা এ রকম সতেরো  জন নারীর নাম পাই আমরা এ কবিতায়, এবং এই প্রতিটি নারীর মধ্যেই সুপ্ত এক একটি বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য । 

প্রেম-প্রকৃতি আর সুন্দরের পূজারী রবীন্দ্রনাথ প্রথাবিরোধী লেখনির মাধ্যমে নারীর জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন। রবীন্দ্র সাহিত্যে আমরা এমনই কিছু অন্যতর নারীদের পাই, যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে আধুনিকতার প্রতীক হয়ে আলো জ্বালিয়েছেন। আবার রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানবমুক্তি তথা মানবতার গান, আর সেই মানবতা বা humanity'র প্রতীক ‘নারী’রাই।  
 
রবীন্দ্রনাথের গল্প আসলে জেহাদ,  নারীমুক্তির দরজা খুলেছে সেখানে । নারীকে সত্যের মুখোমুখী দাড় করিয়েছেন তিনি  পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে । তাঁর একাধিক  লেখায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদী রূপটি স্পষ্ট। ‘স্ত্রী’র পত্র’ এ মৃনাল তো আসলে  নারীর রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলেছে, এভাবেই ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ী, ‘ল্যাবরেটরী’র সোহিনী, অথবা ‘শাস্তি’ উপন্যাসের চন্দরা চরিত্রের মাধ্যমে নারীর জেহাদই ঘোষিত। ১৮৯৭ সালে ইবসেন তার ‘পুতুলের খেলাঘর’ (dolls house)  নাটকটিতে নায়িকা নোরার মুখ দিয়ে সরলভাবে বলিয়েছিলেন যে, নারী একজন মানুষ । নোরা পশ্চিমের  নারী গোষ্ঠীর  জন্য চেয়েছে মানুষের অধিকার। কিন্তু বিশ্বকবি হওয়ার আগে প্রাচ্যের তরুণ রবীন্দ্রনাথের লেখায় ১৮৮১ সালে উঠে এসেছে নারীমুক্তির কথা। তিনি বাঙালি নারীকে ঘরে আটকে রাখার অপরাধে অভিযুক্ত করেছিলেন পুরুষদের। 'প্রবাসীর পত্র' প্রবন্ধে একথা ব্যক্ত ‘একজন বুদ্ধি ও হৃদয় বিশিষ্ট মানুষকে জন্তুর মত, এমনকি তার চেয়েও অধম একটা জড়পদার্থের মত সম্পূর্ণরূপে নিজের প্রয়োজনের জিনিস করে তোলা... এ সকল যদি পাপ না হয় তবে নরহত্যা করাও পাপ নয়। ‘নারীর স্বাধীনতার প্রতি এতটাই গভীর চিন্তা ছিল তাঁর, ঐ সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতেও । 

আসলে দেশ কাল সমাজ মানুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার কেন্দ্রস্থল ছিল মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা নোঙচিকের চিঠিসভ্যতার সংকটশীর্ষক বিখ্যাত রচনার কথা অনেকেরই জানা। রাশিয়ার চিঠির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাই সেখানে ফুটে উঠেছে নতুন সমাজ গঠনের সাহসী উদ্যোগ, তার চিত্ররূপ।মানবতার বিস্ময়কর মানব বাউল সাধকের প্রতি কবির ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। সেই শ্রদ্ধার জায়গাটি আবেগসিক্ত করে রাখতেই রবীন্দ্রনাথ কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের খাতা সংগ্রহ করেছিলেন। যে খাতা দুটি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত রয়েছে। এই খাতা নিয়ে অনেক বিতর্ক অভিযোগ আছে । 

সুতরাং এ'কথা স্পষ্টতই বুঝে নেওয়া যায়, মানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের চোখে 'নারী শক্তিই সেই প্রতীক। ১৩১৬ মাঘ উসবে তিনি এক লিখিত ভাষণে বলেছিলেন, "যে বোধ সকলের চেয়ে বড়ো সেই বিশ্ববোধ- যে লাভ সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই ব্রহ্মলাভ কাল্পনিকতা নয়। "মানুষ নিজেকে যতই ব্যাপ্ত করতে থাকে ততই তার অহংকার এবং বাসনার বন্ধন কেটে যায়।" . . .  
“You cannot rob us of the rights we cherish, nor turn our thoughts away From the bright picture of a "Woman's Mission" Our hearts portray."
সনাতন হিন্দু শাস্ত্রমতে নারী হলেন-'পূজাৰ্হা গৃহদীপ্তয়',  অর্থা নারী মানেই গৃহলক্ষ্মী, -রবীন্দ্র সাহিত্যে কিন্তু ঠিক এর বিপ্রতীপ ছবি দেখি। সেখানে নারী কে তিনি দেখিয়েছেন হৃদয়েশ্বরী রূপে, মানস প্রতিমা হিসেবে। নারীর জেহাদী  রূপের ছবি সম্ভবত ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে বিনোদিনীর মাধ্যমেই প্রথম দেখান রবীন্দ্রনাথ। বৈধব্য যে অপরাধ নয় , নয় কোন অভিশাপ, তা স্পষ্টতই নাকচ করে দিয়েছেন তিনি, বিনোদিনীর চরিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে প্রলুব্ধ করেছে তার শারীরিক প্রেম দিয়ে , অথচ সেই একই বিনোদিনী তার অন্তরের সমস্ত পবিত্র প্রেম বাঁচিয়ে রেখেছে বিহারী'র জন্য। এই ক্ল্যাশ এই বৈপরীত্যই বিনোদিনীকে রবীন্দ্র উপন্যাসে অনন্য নারী চরিত্র করে তুলেছে। আর এক অনন্য জেহাদী চরিত্র 'চতুরঙ্গ'এর দামিনী। আসলে রবীন্দ্রনাথ অন্তর থেকে  বিশ্বাস করতেন রমণীর মন,/ সহস্র বর্ষেরই সাধনার ধনতাই 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে  বিমলার প্রেমও জয় করতে হয়েছে নিখিলেশকে অনেক যন্ত্রণার সমুদ্র পার হয়ে। বিবাহিতা স্ত্রীর প্রেমও বিধাতার দানের মতো অনায়াসলব্ধ এবং সহজাত বলেই  সে তার মর্যাদা হারায়,  তাই সন্দীপের মোহমুক্ত বিমলাকে অনেক কান্নার মূল্যে হারিয়ে পায়  নিখিলেশ, আর এখানেই তার সার্থকতা।  

রবীন্দ্রনাথের এই নারী' ভাবনা আরো সোচ্চার হয়ে ওঠে "রক্ত করবীর মঞ্জরীর লালিমায় 'নন্দিনী' চরিত্র অঙ্কনেনন্দিনীর মায়া ভরা চোখের দিকে তাকিয়েই বিশু গেয়ে উঠতে পারে, ‘ "ভালোবাসি, ভালোবাসি/এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি/ভালবাসি ভালবাসি" । নন্দিনীর প্রাণের সংস্পর্শে এসে তাকে  ভালোবেসেই মাটির মায়ায় ফেরেন রাজা, নিজের বন্ধন নিজে ছিন্ন করে নিজের সৃষ্টির  বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন, এ ভাবেই নন্দিনীর হাত ধরে জয় হয় যন্ত্রের বিরুদ্ধে মানব শক্তির । নন্দিনী এখানে প্রাণ এবং ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যক্ত এবং চিত্রিত।  

বিখ্যাত  নারীবাদী সাহিত্যিক সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর একটি উক্তি এক্ষেত্রে উল্লেখ্য-" কেউ নারী হয়ে জন্মায় না- তারা নারী হয়ে ওঠে" - আর নারী' হয়ে ওঠার এই জার্নিটা রবীন্দ্রনাথ অসম্ভব সুন্দর ভাবে দেখিয়েছেন । আধুনিকা চরিত্ররূপে যেমন শেষের কবিতার কেটি, গোরার ললিতা বা অপরিচিতার নায়িকার মতো অগণিত চরিত্র আছে তেমনি বিনোদীনি বা নিরুপমা কিংবা হৈমন্তীর চরিত্রও পাঠকচিত্ত মাত্রই বেদনার উদ্রেক ঘটায়। আবার শেষের কবিতার লাবণ্য বা চতুরঙ্গের মক্ষিরাণীযেমন সমাজ আর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে বারবার জর্জরিত হয়েছে তেমনি অপরিচিতায় কবি এক দিকে যেমন সমাজের পণ প্রথাকে আঘাত করেছেন তেমনি নারীদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতারও ছাপ রেখেছেন স্পষ্ট ভাবেই।  


নারী' শুধুই পুরুষের নর্ম সহচরী নয়, কর্ম সহচরীও বটে । মানভঞ্জন এ গিরিবালা , স্ত্রীর পত্র-এ মৃণালিনী, মহামায়া-তে মহামায়া'  নষ্ট নীড় -এর চারুলতা প্রত্যেকেই রবীন্দ্র মানসের মানস প্রতিমা, যাঁদের সৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের মানবিক দৃষ্টিবোধেরই প্রতিফলন হিসেবে চিহ্নিত। আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মগরিমায় উজ্জ্বল রবীন্দ্র-সৃষ্ট এই নারীরা আমাদের জীবন ও সাহিত্যে এখনও অনুকরণীয় আর অনুসরণীয়। 

No comments:

Post a Comment