সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে
বিশ্বসভায় বাঙালি জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। তার হাত ধরেই বিশ্বজনীনতার স্বীকৃতি পেয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য
বাংলাসাহিত্য। সাহিত্যের যে ধারায়ই আমরা যেতে চাই না কেন তার সূচনা-বিস্তার
রবীন্দ্রনাথের হাতেই। পার্থিব-অপার্থিব-পারমার্থিক, সামাজিক, বিজ্ঞান, প্রকৃতি
ও পরিবেশসহ এমন কোনো বিষয় নেই যা রবীন্দ্রনাথে অনুপস্থিত। যে কারণে বাংলা
ভাষাভাষীদের বারবারই ফিরে যেতে হয় রবীন্দ্রনাথে। বর্তমানের বিজ্ঞান বিশ্ব প্রমাণ
করেছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে ক্রমশ বিশ্বের পরিবেশ প্রাণিকুলের
বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ জন্য গবেষকরা দায়ী করেছেন উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে। যারা
তাদের প্রয়োজনে পরিবেশকে দূষিত করছে প্রতিনিয়ত। তবে পরিবেশের এ অবক্ষয়ের জন্য
মানুষের লোভই যে সর্বাংশে দায়ী এ কথা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিলেন।
যে কারণে তিনি ‘আপনি
আচরি ধর্ম জীবেরে শিখাও’ নীতিতে প্রথমত নিজেকে প্রকৃতি-পরিবেশের কাছে সমর্পিত করেছিলেন। পরে তিনি
সাহিত্যের মাধ্যমে এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাজের মাধ্যমেও এ বিষয়ে মানুষকে সজাগ করতে
সচেতন ছিলেন। তিনি নিজেও পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণে নিরন্তর কাজ করেছেন। যে কারণে গান, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাসে তিনি পরিবেশ রক্ষায়, পরিবেশ বিস্তারে প্রযত্ন চেষ্টা
করেছেন।
যশ-খ্যাতি, প্রতিপত্তি-উচ্চাকাঙ্ক্ষার
মতো লোভও মানুষকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য বিনষ্ট করে
মানুষ তার সমূহ ক্ষতিকেই সামনে টেনে এনেছে। ফলে গোটা মানবজাতিকেই আজ চরম হুমকির
মুখে পড়তে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসব বুঝেছিলেন বলে ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে বলেছেন- ‘মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত
থেকে অরণ্য সম্পদ রক্ষা করাই সর্বত্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিধাতা পাঠিয়েছিলেন
প্রাণকে, চারিদিকে তারই
আয়োজন করে রেখেছিলেন। মানুষই নিজের লোভের দ্বারা মরণের উপকরণ জুগিয়েছে।... মানুষ
অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা
দেয়, তাকেই সে
নির্মূল করেছে। বিধাতার যা কিছু কল্যাণের দান, আপনার কল্যাণ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তাকেই ধ্বংস করেছে।’
বিশ্বস্রষ্টার রহস্যময় অপূর্ব কীর্তি এ পরিবেশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গভীরভাবে
পর্যবেক্ষণ করে জাতিকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেন। যে কারণে ‘আত্মশক্তি’তে তিনি বলেন-
‘আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি। আমাদের ধর্মে-কর্মে, ভাবে-ভঙ্গিতে প্রত্যহই তাহা করিতেছি, এই জন্য
আমাদের সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিয়াছে- আমরা কেবলই অকৃতকার্য এবং
ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িতেছি। বস্তুত জটিলতা আমাদের দেশের ধর্ম নহে। উপকরণের বিরলতা, জীবন যাত্রার সরলতা আমাদের দেশের নিজস্ব- এখানেই আমাদের বল, আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
মানুষের জন্য যা কিছু হিতকর তার সবটুকুই প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে
প্রকৃতির কাছেই মানুষকে সমর্পিত থাকতে হয়। মানুষ তার বাঁচা-বাড়া, শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি, প্রেরণা, আহার-বিহার, সৃষ্টিশীলতা থেকে শুরু করে
দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতিটি অনুষঙ্গের জন্যই প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর চিরায়ত এসব অনুষঙ্গ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মানুষের
কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরিবেশের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় তার ফলই
মানুষকে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে সর্বাধিক। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিবেশ
সংকটকে এমনি প্রকট করে তুলবার বহুপূর্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই রবীন্দ্রনাথ
হৃদয়াঙ্গম থেকে মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন পরিবেশকে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর রাখতে
হবে। প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এই ভূমিশ্রীকে মর্যাদা দিতে হবে। দূষণভার সহনক্ষমতার
প্রায় শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে আমাদের এই পৃথিবীতে। তাই কেবল প্রাকৃতিক নির্বাচনের
উপর নির্ভর না করে মানুষকেই পরিকল্পিত ভাবে প্রকৃতির যত্ন নিতে হবে। কবি তাই কবি
বৃক্ষকে আর দশজন মানুষের মতো কেবল বৃক্ষ জ্ঞান করেননি। তিনি বৃক্ষকে জীবনের সঙ্গে
একাকার করে ভেবেছেন। বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে এ-এক বিস্ময়কর অনুধপ্রণ
নিঃসন্দেহে। ছিন্নপত্রের ৬৪ তথা ছিন্নপত্রাবলীর ৭০ সংখ্যক পত্রে কবি বৃক্ষের সঙ্গে
নিজের সম্পর্কের পরিচয় উম্মোচন করে বলেন-
“...এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলাম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত, সূর্যকিরণে আমার সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের
সুগন্ধ উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূরদূরান্তর
দেশদেশান্তরের জলস্থল ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে
থাকতাম, তখন শরৎসূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে-একটি আনন্দরস, যে-একটি জীবনীশক্তি
অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকা- বৃহৎভাবে
সঞ্চারিত হতে থাকত, তাই যেন খানিকটা মনে পড়ল। আমার এই
যে মনের ভাব, এ যেন এই প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত
মুকুলিত পুলকিত সূর্যনাথ আদিম পৃথিবীর ভাব। যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর
ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে, সমস্ত শস্যক্ষেত রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে, এবং
নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর থর করে কাঁপছে।”
আবার ‘তপোবন’ এ তিনি বলেন-
‘...ভারতবর্ষের একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা গেছে এখানকার সভ্যতার মূল প্রস্রবণ শহরে
নয়, বনে। ভারতবর্ষের প্রথমত আশ্চর্য বিকাশ দেখিতে পাই সেখানে, মানুষের সঙ্গে মানুষের অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি একেবারে পি- পাকিয়ে ওঠেনি। সেখানে
গাছপালা, নদী সরোবর মানুষের সঙ্গে মিলে
থাকার যথেষ্ট অবকাশ পেয়েছিল।’
শুধু প্রবন্ধ সাহিত্যই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যকর্মের প্রতিটি শাখায় প্রকৃতি বন্দনায় পঞ্চমুখ
থেকেছেন সবসময়। কখনো পালকিতে চেপে আবার কখনো বা নৌবিহারে তিনি প্রকৃতি সম্ভোগ করে
বেড়িয়েছেন। ধ্যানস্থ ঋষি হয়ে প্রকৃতি-পরিবেশ থেকে এক আশ্চর্য দক্ষতায় তুলে এনেছেন
উপমা রাশি। ঋদ্ধ করেছেন সাহিত্য ভান্ডার। প্রকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই মানুষকে
বেঁচে থাকতে হয়। মানুষ বেঁচে থাকতে গিয়ে, বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে, শক্তিধর হতে গিয়ে মানুষ তার নিজের
অজান্তেই প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। ফলে ক্রমশ আমরা প্রকৃতির সেই
বৈপরীত্যে নিজেদের খাপ খাইতে নিতে পারছি না। যে কারণে আমাদের ‘কোপেনহেগেন সম্মেলন’ করতে হচ্ছে। বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে
যুদ্ধ করতে গিয়ে, পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তহবিল গঠন করতে হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী আর্তনাদ
তুলতে হচ্ছে আমরা পারমাণবিক বিষ চাই না, কার্বন নির্গমন বন্ধ কর, আমাদের বাঁচাও। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বরাবরই সমন্বয় ও
ঐক্যের পক্ষে ছিলেন বলেই কলকাতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলতে পেরেছেন, ‘ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট, নেইকো স্নেহ, নেইকো ভালোবাসা।’ পাশাপাশি প্রকৃতি নিবিষ্ট গ্রাম
সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আমার যে নিরন্তর ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে আমি পল্লী গ্রামকে দেখেছি, তাতেই আমার হৃদয়ের দ্বার খুলে
দিয়েছে।’
ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষভাবে জমিদারি দেখাশোনা
ছেড়ে দিলে, তার
প্রতিভূ নিযুক্ত হন জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ। মহালে গিয়ে তিনি গ্রামের
দূরবস্থা দেখেই পিতাকে জিজ্ঞেস করেন ‘সেন্ড ফিফটি থাউজেন্ড’ এবং উত্তর পান ‘কাম ব্যাক্’। অতঃপর তার অন্যান্য ছেলেদের ব্যর্থতার পর ১৮৯০ সালে
ব্যবস্থাপক হন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমদিকে তিনি অবশ্য শুধুমাত্র জমিদারি পরিদর্শনের
ভার পান। সফল শিক্ষানবিশির পরে ‘পাওয়ার অফ এটর্নি’র মাধ্যমে পিতার কাছ থেকে সমগ্র সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের সর্বময় কর্তৃত্ব পান
১৮৯৬ সালের ৮ই আগস্ট। জমিদারির কার্যক্ষেত্র মূলত গ্রাম। সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভের
পর রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই গ্রামকে যথাযথভাবে চিনে নেন একজন নিরাবেগ সমাজবিজ্ঞানীর
পর্যবেক্ষণে। সেই চেনা সার্বিকভাবেই মৌলিক এবং বিস্ময়কর ভাবে সামগ্রিক। ১৯০৭ সালের
পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীতে সভাপতির ভাষণ থেকেই তা স্পষ্ট হতে পারে-
‘গ্রামের মধ্যে চেষ্টার কোনো লক্ষণ নেই। জলাশয় পূর্বে ছিল, আজ তাহা বুজিয়া আসিতেছে; কেননা দেশের স্বাভাবিক কাজ
বন্ধ। যে গো-চারণের মাঠ ছিল তাহা রক্ষণের কোনো উপায় নাই, যে দেবালয় ছিল তাহা সংস্কারের কোনো শক্তি নাই; যে-সকল পতি সমাজের বন্ধন ছিলেন তাহাদের গ-মুর্খ ছেলেরা আদালতে মিথ্যা
সাক্ষ্যের ব্যবসা ধরিয়াছে। জঙ্গল বাড়িয়া উঠিতেছে, ম্যালেরিয়া নিদারুণ হইতেছে, দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া
আসিতেছে; অকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত
ক্ষুধা মিটাইয়া বাঁচিবে এমন সঞ্চয় নাই। অন্ন নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই, আঘাত উপস্থিত হইলে মাথা পাতিয়া লই, মৃত্যু
উপস্থিত হইলে নিশ্চেষ্ট হইয়া মরি, অবিচার উপস্থিত হইলে
অদৃষ্টকে দোষী করি এবং আত্মীয়ের বিপদ উপস্থিত হইলে দৈবের উপর তাহার ভার সমর্পণ
করিয়া বসিয়া থাকি।’
রবীন্দ্রনাথের সমাজনিরীক্ষণের সক্ষমতা এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। অন্যদিকে
প্রকৃতির গুরুত্ব উপলব্ধি করেই যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পুত্র, জামাতা এবং বন্ধুপুত্রকে বিদেশে
কৃষি বিষয়ে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছিলেন তা রবীন্দ্র গবেষক থেকে শুরু করে বোধ সম্পন্ন
মানুষ মাত্রই স্বীকার করেন। ১৯০৬ সালে কৃষিবিদ্যা ও গোষ্ঠবিদ্যা শেখাতে
রবীন্দ্রনাথ তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে
আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৯০৭ সালে কনিষ্ঠা কন্যা মীরার
বিবাহের পর জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও বিদেশে পাঠান কৃষিবিদ্যা পড়ার জন্য।
গবেষক আবদুশ শাকুরের মতে-
‘যে-যুগে সন্তানদের আই. সি. এস বা ব্যারিস্টার বানানো ধনী বাঙালি পরিবারের
একমাত্র লক্ষ্য ছিল, সে-সময় জনৈক ধনী জমিদারের পুত্র, জামাতা ও বন্ধুপুত্রকে চাষাবাদ শিখতে বিদেশ পাঠানোর মতো একটা বিপ্লবাত্মক
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন একমাত্র রবীন্দ্রনাথের মতো একজন দায়বদ্ধ
স্বদেশভাবুকের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল।’
রবীন্দ্রনাথের ব্যতিক্রমধর্মী এই উদ্যোগের পেছনে কাজ করেছে গ্রামবাংলার
জনসাধারণের উন্নতিবিধান এবং বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ ও ফসল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার
তাগিদ। একথা ঠিক যে, ছেলে, বন্ধুপুত্র এবং
জামাতাকে বিদেশে পাঠিয়ে বসে থাকেননি তিনি। ১৯০৯ সালে রথীন্দ্রনাথরা বিদেশ থেকে
ফিরে কবির তত্ত্বাবধানে শুরু করেন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষাবাদ। আজ যে-পন্থায় সারা
উপমহাদেশে চাষবাস করা হয় সে-প্রক্রিয়া রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন শতবর্ষ পূর্বে।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন ৮০ বিঘা খাস জমিতে চালু হয় সুদূর ভবিষ্যৎমুখী সেই আধুনিক কৃষি খামার, যার আদলে পুরো গ্রামেই গড়ে ওঠে এর
রক্ষাকবচ সমবায়ী খামার। এছাড়া ‘শ্রীনিকেতন’ নামে
কৃষি খামারবাড়ি স্থাপন করেন। শ্রীনিকেতন হলো কৃষিবিষয়ক গবেষণার বহুমুখী
প্রতিষ্ঠান। যার প্রধান কাজ হচ্ছে কৃষিবিষয়ক উন্নয়নে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে গড়া ওই প্রতিষ্ঠানটি ভারতবর্ষের কৃষি উন্নয়নে অপরিসীম
অবদান রাখছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘শান্তিনিকেতন’ বিদ্যায়তনটির দিকে তাকালে বোঝা যাবে তিনি পরিবেশ নিয়ে
কতখানি ভাবতেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের শিক্ষানীতিও (পরিবেশবান্ধব) পরিবেশের
সান্নিধ্যেই গড়ে তুলেছেন তিনি। এতে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশবাদী সত্তারও নিবিড় পরিচয়
মেলে। আশ্রমের ছাত্রদের পরিবেশ পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে প্রতিদিন আকাশের অবস্থা, বাতাসের প্রবাহ, তাপমাত্রা এমনকি বৃষ্টির পরিমাণ
লিখে রাখতে হতো। এসবের মূলে ছিল শান্তিনিকেতনকে একটি পরিবেশবান্ধব আদর্শ ভূমি
হিসেবে গড়ে তোলা। রবীন্দ্রনাথ এভাবেই তার পরিবেশ চিন্তায় একজন সাধারণ
প্রকৃতিকেন্দ্রিক ভাববাদীকে ছাড়িয়ে পরিণত হন একজন মহৎ বিজ্ঞানসম্মত পরিবেশ চিন্তাবিদে। তিনি দৃঢ়চিত্তে উচ্চারণ
করেন, ‘আমাদের এ
প্রকৃতির প্রতি প্রভুত্ব করা নয়, প্রকৃতিকে ভোগ করা নয়, এ প্রকৃতির সঙ্গে সম্মেলন।’ রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন- ‘এক সময়ে আমি যখন পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম, যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠত, শরতের আলো পড়ত সূর্য কিরণে আমার সুদূরবিস্তৃত শ্যামল অঙ্গে
প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকত, আমি কত দূর দূরান্ত কত দেশ
দেশান্তরের জল স’ল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নীচে নিস্তব্ধভাবে শুয়ে পড়ে থাকতুম- তখন
শরৎ সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস, একটি জীবনী শক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত
অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকা-ভাবে সঞ্চারিত হতে থাকত তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে।’
কবি ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে নিজের জন্মদিনে উত্তরায়ণে পঞ্চবটী বৃক্ষরোপণের
মধ্য দিয়ে বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা
করেন। তবে ঋতু উৎসব হিসেবে
আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণ শুরু হয় ১৯২৮ সালের ১৪ই জুলাই। এর ১০ দিন পর ১৩৩৫ সালের ৯ই
শ্রাবণ প্রতিমা দেবীকে লেখা চিঠিতে কবি বলেন-
‘এখানে ও শ্রীনিকেতনে যে দুটো উৎসব হয়ে গেছে তার সমস্ত বিবরণ
তোমরা পেয়েছ। এখানে হলো বৃক্ষরোপণ, শ্রীনিকেতনে
হলো হলচালন।’
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা কৃষিতে ব্যাপক জ্ঞানার্জনের জন্য
শ্রীনিকেতন পরিদর্শন করছেন, কৃষিতে গবেষণার জন্য সেখানে অবস্থান করছেন। মূলত রবীন্দ্রনাথের ভাবনার বিরাট
একটা অংশ জুড়ে ছিল পরিবেশ-সচেতনতা। দূষণমুক্ত পরিবেশ চেতনায় তিনি ছিলেন বিস্ময়কর
রকম অগ্রগামী। বিশ্বমানবতার এই মহান কবি যদিও পরিবেশ বলতে বিশ্বমানবের পরিবেশই
বুঝতেন, তবু তার স্বদেশই
ছিল এর কেন্দ্রে। তার বাংলাদেশ ছিল, নগরবাংলা নয়, গ্রামবাংলা; সবুজ পত্রপল্লবে ঢাকা পাখিডাকা নদীমাতৃক বাংলাদেশ।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃজনকর্মেও এর সাক্ষ্য ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি লেখনীতে মানুষের
জন্য যা কিছু কল্যাণকর তার উৎকর্ষ সাধন করেছেন। ফলে এ কথা নিঃশঙ্কচিত্তে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমনই এক
বিশ্ববাঙালি, যিনি
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও সমাদৃত। তিনি তার দর্শন-চিন্তন
সর্বোপরি সৃষ্টি দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তায় চিরসমকালীন।
তথ্যসহায়তা
১. রবীন্দ্রনাথের গ্রাম ও
পরিবেশ ভাবনা, প্রবন্ধ: আবদুশ শাকুর।
২. রবীন্দ্রনাথ ও
শান্তিনিকেতন: প্রমথনাথ বিশী, বিশ্বভারতী।
৩. রবীন্দ্র জীবনী:
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কলিকাতা।
৪. রবীন্দ্রকাব্য-সঙ্গীতে
বিজ্ঞান ও পরিবেশ চেতনা, প্রবন্ধ: সালিম সাবরিন।
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:
শ্রীসুকুমার সেন, ইস্টার্ন পাবলিশার্স, কলকাতা।
লেখক: বীরেন মুখার্জী: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
No comments:
Post a Comment