সুমেরুপ্রভা
গভীর
কোনো বেদনাবোধে পাটোয়ারি পাড়ায় আল্লার আযান ছড়িয়ে পড়ে- আসসালাতু খাইরুম্ মিনান
নাউম...
ধীরে
কুয়াশা কাটতে শুরু করে দূর গ্রামে...
ঊনত্রিশ
রজনী পার হলে বেলিফুল-ফোটা ভর সন্ধ্যায় রায়পুরার দাদীর ইন্তেকাল হবে... ইন্নাহ
লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন
এমন
সুন্দরী দাদীর পাকনা কেশর আর উড়বে না দক্ষিণমুখি বাতাসে। পিতলের বাটাল দিয়ে সুপারি
কুটতে কুটতে দাদী বলবেন না- আমি মা ফাতেমা, হযরত আলীর বউ; আমি মা ফাতেমা, হযরত আলীর বউ...
দীর্ঘক্ষণ সে ছায়ায় বসে থাকে; দীর্ঘক্ষণ ছিদ্র হতে থাকে। ছিঁড়ে-আনা টগরের ডাঁটা হতে গল্ গল্ করে কষ ঝরছে। কষ ও কান্নার বিভ্রম টের পায় না রায়পুরা; পেছন থেকে পাগলা দাদী এসে দুচোখের ওপর হাত রেখে ফিস্ ফিস্ করে- বৈনারী গো, শের-এ-আলীর কলিজার টুকরা তুই, তুই মা ফাতিমা, হযরত আলীর বউ...
দাদীর
জন্ম হয়েছিলো আরো ঊনত্রিশবার পৃথিবীর ঊনত্রিশটি গ্রামে। বৌদ্ধের গ্রামে দাদীর
পাখিজন্ম বড় নিঃসঙ্গ ছিলো । জন্ম, পুনর্জন্ম আর কোনোদিন বরণ করবে না দাদী; তিরিশ দিবসে মুখোমুখি হবেন ঈশ্বরের। তারপর তাকে দীর্ঘ চুম্বন করবেন। পৃথিবীতে
পুরুষের ঠোঁটে কোনো তৃপ্তি ছিলো না যে!
গহনা-ভূমি
বৃষ্টিতে
জল ভিজেছিলো আর তোমাকে কালিগঞ্জ বাজার পৌঁছে দিয়েছিলো একগাছা পাল-তোলা নদী। অংকুরুদ্গমের অদম্য বাসনা নিয়ে তোমাকে স্পর্শ
করে বৃষ্টির বিচি, স্তনাগ্রে
লুটিয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা তীর, তীরন্দাজ...। সেই থেকে হয়তো বা তোমার জলযাত্রা শুরু হয়েছিলো। স্পষ্ট মনে পড়ে-
ঐ দিন বক্ষব্যাপী লাফিয়ে উঠেছিলো গোরস্তানের শাদা শাদা বেতবুটা, হরপ্পা নদী। তুমি নগ্ন হয়েছিলে, মেঘের চাদরে হয়তো তুমি লজ্জা নিবারণ করেছিলে।
সেই
লাবণ্য-পুরাণ
আমি জানি, আদমের বহুপ্রস্থ আদিম তুমি। চরণ স্পর্শ করে যায় মেঘ আর
কালিদাস। নখরে বাতাস কাটলে অতঃপর হাত ভিজালে পোয়াতি জলে। হলুদিয়া ঝিঙেফুলেরা
দেখলো- তোমার দুই হাতে হল্হল্ করছে জয়তুনের বাগান আর গন্ধমের গরম।
ঐ উঠোনে
তুমি দীর্ঘ দাঁড়িয়েছিলে।
বুনিয়াদি
ভিটার সৌরভ
ঐ উঠোনে
তুমি দীর্ঘ দাঁড়িয়েছিলে। তোমায় ভালোবেসে ঐ মেঘমালা কোনো এক ধর্মদা গ্রামে নেমে
এসেছিলো আর নিরন্তর ভিজিয়েছিলো তুলসীপত্র ও প্রার্থনার পিঁড়ি।
মেঘে
মেঘে ঘাট-পার গলে যায়। যখন একে একে সবগুলো শান বাঁধানো সিঁড়ি খসে পড়ে, তুমি মুখ ফুটে প্রস্ফূটন করো- ইস্! আবার সোনার কইগুলো জল
ছেড়ে যখন ডাঙায় উঠে আসে, কানকো দিয়ে
চরণে চিমটি কেটে যায়, ঈষৎ লজ্জিত
তুমি মুখ ফুটে প্রস্ফুটন করো- ইস্!
বহু
বর্ষ পরে, কবুতর ডানা আর
খুদের খোয়াবে নিদ্রা ভেঙে যায়। মনে পড়ে তোমার- উঠান-ভরা রোদ আর শিয়ালের বিয়া...
ঝরে-পড়া চুরুক আমটির কথা, সোনালি গোদার
স্বাদ আজও তোমার স্নায়ুমূলে লেগে আছে। ...আর ঐ যে হরতকি বন- বরই, কামরাঙা-বাগান হতে কোচভরে শুধুই কি বেদনা আর বৃষ্টি
কুড়িয়েছিলে! আজও তো রাত জাগো! কুদাল ভরে এলাচির শহর খুঁড়ে আনো। আজও ভরা যৌবন নিয়ে
তোমার বন্দরে ভিড়ে বক্ষ-খোলা এক লাল সওয়ারি নাও।
২
ঐ
ভূ-পৃষ্ঠের কথা আমার মনে নেই। মনে পড়ে-বেলোরুশিয়ার বৃষ্টিতে একদা একজোড়া ফর্সা উরু
ভিজেছিলো। আমি নিদ্রিত ছিলাম। সিথান-ভরা দীর্ঘ ঘুমের স্মৃতি ব্যতিরেকে আমার কোনো
বৃষ্টিভেজা করমচা বৃক্ষ কিংবা আমের মুকুর ছিলো
না। তুমি বললে,
কালো
নদীটি পাড়ি দিয়ে দিরারাই গ্রামে সূর্য উঠিয়াছে। পিতার কবরে লকলক করে হেইছা ঘাস ও
পল্লী বিদ্যুৎ। বাড়ির পেছনে, পইরদাদার কবর হতে রমণীরা শুকনা পুরল পেড়ে আনে। অতঃপর নরম ছোলায় তারা পায়ের
পাতা মাঞ্জন করে। পৃথিবীতে পুনর্বার বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ফর্সা উরু আর পিতার কবর
ভিজে যায়...
ভরা
আসমান নীচে নেমে আসে। আমার স্মৃতিতে লাল লাল তরকারির বাগানসহ মঁ মঁ করে তৃষ্ণার
তুকার। কাটা খঞ্জরের কথা মনে পড়ে- সমূহ শিকারের স্মৃতি... তুষের আগুনে মনে পড়ে
যায়- মেঘনা নদীর পুরাতন মাঝিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আমিও তো ছিলাম,
আমি
বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম...
No comments:
Post a Comment