13 April 2017

মনোজিৎকুমার দাস



                

একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে বাঙালি অর্জন করে তার কাঙ্খিত স্বাধীনতা। রণাঙ্গণে সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি কবি সাহিত্যিকরা তাদের লেখনির মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য কলমযুদ্ধ চালিয়ে যান।তাদের লেখা কবিতা, গান নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দান করে।
১৯৪৭ এর দেশভাগের ফলে বাঙালি অধ্যুষিত পুরো বাংলা খণ্ডিত হয়ে  বাংলার পূর্ব অংশ  পূর্ব বাংলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্ন্তভুক্ত হয়। হাজারেরও বেশি মাইল দূরের উর্দু ভাষী পশ্চিম পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মিলমহব্বত কোন দিনই সম্ভব নয় তা বুঝতে পারা যায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ঢাকার কার্জন হলে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহম্মদ আলী জিন্নাহ্ এই ঘোষণায়।এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে  ১৯৪৭ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন দেখার যাত্রা শুরু হয়।

 ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন , ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, ১৯৫৮ এ জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ১৯৬৬ এ বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুথান আমাদের দেশের মানুষের জীবনকে টালমাটাল করে তোলে। ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালির মুক্তির  চেতনা এ আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা ভাবনা এবং মন ও মনন দৃঢ় ভাবে প্রোথিত হয়। একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে তা চরম উৎকর্ষতা লাভ করে। বাঙালি অর্জন করে তার চিরস্বপ্ন লালিত স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বে কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গিয়ে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পূর্বকাল পর্বে  আমাদের দেশের কবিরা তাদের কবিতায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তা অল্প হলেও তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে   হাসান হাফিজুর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সিকান্দার আবু জাফর, আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী, শামসুর রাহমান প্রমুখ কবিতা ও গান রচনা করেন।হাসান হাফিজুর রহমান রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’তে:

‘আম্মা তার নামটি একবারও ডাকবে না তবে আর?
ঘূর্ণিঝড়ের মতো সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?
আবুল বকর নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুরস্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
তাকে ডেকো না;
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার- কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারী নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে;
যাদের হারালাম তারা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে,
কণা কণা করে প্রাণে দীপ্তি ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে
আবুল বরকত; সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার
কি আশ্চর্য, কি বিষণ্ন নাম! এক সার জ্বলন্ত নাম।’

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহের কবিতায় উঠে আসে বায়ান্ন’র একুশে ফ্রেব্রুয়ারিতে ছেলে হারানো মায়ের আকুতি এভাবে
‘মাগো, ভাবনা কিসের? আসছে ছুটিতে আবার
ফিরবো তোমার কোলেই।

শহীদ ছেলের শেষ কথাগুলো মনে পড়ে যায় একলা রাতে। আলাউদ্দিন আল আজাদ রচনা করেন-
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো।...
ইটের মিনার
ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরি
চার কোটি পরিবার।’

সিকান্দার আবু জাফরের কবিতায়-
কালো পতাকায়
প্রাচীর-পত্রে
অশ্রু-তরল রক্তরঙের লিপি
ক্রোধের
ঘৃণার
ভয়াল বিস্ফোরণ
একুশে ফেব্রুয়ারি।

আব্দুল গফ্ফার চৌধুরী রচনা করেন হৃদয় স্পর্শী এই বিখ্যাত গানটি:
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।

এই গানটি আদ্দুল গফ্ফার চৌধুরীর লেখা মাস্টার পিস হিসাবে বিবেচিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কবি শামসুর রাহমান তাঁর  ‘বর্ণমালা’ কবিতায় উঠে এসেছে আটচল্লিশ থেকে ঊনসত্তরে পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকচক্রের শাসন শোষণে করুণ গাথা, যার মাঝে তিনি হতাশার চিত্র উপস্থাপন করেছেন। আমার দুঃখিনী বর্ণমালা কবিতায়-
“নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের পূত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই।
তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?
উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি।
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষ মাস!
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা”

কিন্তু ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থানে আমরা কবি শামসুর রাহমান কবিতায় নতুনমাত্রা।
“বুঝি তাই উনিশশো ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তোলে ফ্ল্যাগ,
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা,
সালামের চোখ আজ আলোকিত ঢাকা,
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ব বাংলা”।

‘আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’র কবি শামসুর রাহমান ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ব হয়ে ওই হতাশা আর নৈরাশ্য থেকে মুক্তি লাভ করে বলছেন,  মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক কবিকে শরণার্থী হয়ে পরবাসী জীবনযাপন করতে হয়।
“দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই জনসাধারন
দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো
ঝরে অবিনাশী বর্ণমালা
আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে
এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে
ফোটে ফুল বাস্তবে চত্বরে”।


উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে শামসুর রাহমান সশরীরে অংশ নিয়েছিলেন । সেই আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল লিখেছিলেন কালজয়ী  কবিতা ‘আসাদের শার্ট ’
“আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।”
এই একই প্রেরণা, এই একই চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি কিন্তু ছয়কোটি অবরুদ্ধ বাঙালির একজন হয়ে দেখে গেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। পৈতৃক নিবাস পাহাড়তলীতে বসে একাত্তরে এপ্রিলে একই দিনে লেখলেন দুটো কবিতা স্বাধীনতা তুমি ও তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা । লিখলেন-
 “স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা” (স্বাধীনতা তুমি )
সে সময়ের লেখায় কবিরা তাদের কবিতায় দু:খ বেদনা, হতাশা থাকলেও দ্রোহ ও বিদ্রোহের অনুরণন অবশ্যই আমরা লক্ষ করি।১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বে কবিদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে।
___________________________________________
আমরা মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বের কবিতার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্ব মুক্ত পরিবেশে সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় কবিতাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বে কবিতা আসলে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, কারণ ওই সময়ের কবিতায় নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো তমস আঁধারে ঘেরা।লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বভূমি থেকে বিতাড়িত, তিরিশ লক্ষ নরনারী পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত, আড়াই লক্ষ নারী নির্যাতিতা!যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে, সেতু, রাস্তা, অফিস আদালতের অবকাঠামো ধ্বংসপ্রাপ্ত পাকবাহিনীর দ্বারা।খাদ্যে অভাব চরম, ব্যাংকের রিজার্ভ্ শূন্যের কোঠায়।এ সময়ের কবিতায় বিশেষভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের আবেগতাড়িত অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে রচনা শুরু করেও যাঁরা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতায় সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে আবুল হাসান, আবিদ আজাদ, হুমায়ুন আজাদ ,আল মামুদ, খোন্দকার আশরাফ, নিমলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, শামসুর রাহমান, হেলাল হাফিজ , আবদুল্লাহ আবু সাঈদ, মোহাম্মদ রফিক, , আসাদ চৌধুরী আলতাফ হোসেন, কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন , সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, ময়ুখ চৌধুরী, শহীদ কাদরী সুফিয়া কমাল, প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়কাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর কবিতা রচয়িত হয়েছে পর্যাপ্ত এবং বর্তমানেও হচ্ছে। এসব কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা উঠে আসছে এবং উঠে আসছে বাঙালির বীরত্ব ও আত্মোৎসর্গের গৌরব গাথা।
শামসুর রাহমানের ‘সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিনরাত্রি’ কবিতায় হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বর্ণিত হয়েছে অসাধারণ কাব্যিক অনুষঙ্গে।
‘কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিন-দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা,
মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে’।

কবি হাসান হাফিজুর রহমান তার ‘গেরিলা’ কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাঁথা এভাবে--
‘বাংলার আপদে আজ লক্ষ কোটি বীর সেনা
ঘরে ও বাইরে হাঁকে রনধ্বনি একটি শপথে
আজ হয়ে যায় শৗর্য ও বীরগাঁথার মহান
সৈনিক, যেন সূর্যসেন, যেন স্পার্টাকাস স্বয়ং সবাই।’

এছাড়াও তরুণ কবিদের মধ্যে রফিক আজাদ, দাউদ হায়দার, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় দ্রোহ ও আবেগ উঠে আসে বেশি মাত্রায়। তাছাড়া , তীব্র আবেগ, দ্রোহ আর প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ুন কবীর প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এঁদের কবিতা অনেক বেশি জীবনঘনিষ্ঠ এবং মাটি ও মানুষের কাছাকাছি। এ সময়ের কবিতা ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ বা বেদনাবোধের পরিবর্তে সমষ্টির চেতনাকে অধিক রূপায়িত করেছে। কবিতার চিরচেনা ভাব ও ভাষাকে বাদ দিয়ে এঁরা অনমনীয় ও বিষয়নির্ভর কবিতা রচনার প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যা প্রত্যাশা করেছিল, তা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা না দেখে আশাহত ও বঞ্চনার বেদনায় মুষড়ে পড়েন এদেশের সাধারণ মানুষের মতো কবিরাও। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে দাউদ হায়দারের ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা তা না হলে মানচিত্র খাবো’ ইত্যাদি কবিতায়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং দুর্ভিক্ষ জর্জরিত জীবন নিয়ে রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রফিক আজাদের ভাত দে হারামজাদা, দাউদ হায়দারের জন্মই আমার আজন্ম পাপ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’তাদের লেখা এ সব কবিতা নিয়ে বিতর্ক্ও কমনি। একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে অভাব অনটন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় ।যুদ্ধের উত্তরকাল পর্ব্ ছিল ত্যাগ তিতিক্ষার কাল।কিন্তু এই কবিরা ধৈর্য্ না ধরে দ্রোহের অভিব্যক্তি প্রকাশ করায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়।
যখনই আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পদদলিত হয়েছে,দেশে অপশক্তির শাসন ও শোষণ চলেছে তখনই শামসুর রাহমানের কলম থেমে থাকেনি,,তাই তো এক সময় তিনি  লিখলেন-
“উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।” (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)
তিনি কখনোই সময় কাল এবং দেশভাবনা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন থাকেননি তিনি। তাঁর কবিতায় বার বার উঠে এসেছে দেশপ্রেম ও দেশভাবনা। সামরিক শাসনে পিষ্ট দলিত বাংলাদেশকে দেখে বলেছেন-
“তুমি কি জল্লাদের হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো
বিদেশীকে দেখে
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমিষে?” (গুড মর্নিং বাংলাদেশ)
কবি এরপর অভিশাপ দিয়েছেন সেই সব রক্তখেকো হায়েনাদের-
“তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমার বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে” (অভিশাপ দিচ্ছি)

নূর হোসেন এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান বুকে লিখে শহীদ হয়েছিল তাকে নিয়ে লিখেছেন-
বাংলাদেশ
মনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে তার
বুক থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে ঝরতে থাকে।” (বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)

এক সময় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা আর ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে জাতি  দিশেহারা,  ধেয়ে আসছে তমস আঁধার! এই অন্ধকারের বুক চিড়ে প্রতিবাদের মশাল হাতে এগিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁকে সম্মান জানিয়ে কবি লিখেন-

“এই তিমরাবৃত প্রহরে দেখতে পেলাম
তোমার উত্তোলিত হাতে
নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে ফেরারি বসন্ত,
আর আমাদের ভবিষ্যৎ।” (‘শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙক্তিমালা’
অবরুদ্ধ জীবন চারপাশের এই জটিল কুটিল জীবন, অসত্যের বেড়াজাল, অন্যায় আর অসাম্য মাথাচাড়া উঠায় কবি নানাভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। শাসমুর রাহমানের কলমে বার বার ঘৃণা ও ক্ষোভ উদ্গীরিত হলেও তিনি ছিলেন আশাবাদী। তাই তিনি এই পঙ্কিল সমাজ থেকে আহরণ করতে চেয়েছেন গোলাপ-
“ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নই তো আমি মুদ্দোফরাস। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলিফোটা সকাল নেব।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার
আমি গোলাপ নেব।” ( ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)
কবি শামসুর রাহমান তাঁর সময়, সমসাময়িক রাজনীতি, দেশ, দেশের ভবিষ্যত সচেতন কবি ছিলেন। তাঁর লেখা ধারণ করেছে কাল, রাজনীতি, দেশপ্রেম, দেশভাবনা ও আত্মজাগরণ। এই জীবনবোধ দেশের জন্য মমতা ও প্রেম শামসুর রাহমানকে আবার পরিণত করেছিল বিশ্ব নাগরিকে। তার মধ্যে এসেছিল আন্তর্জাতিকতাবোধ। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন-
“আমার যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,
পড়ছে বোমা ভিয়েতমানে!”
একাত্তর এ জাতির কাছে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা নয়, দীর্ঘদিনের লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত ফলস। কোনো আন্দোলনই একক হয় না। সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সংঘবদ্ধ আর সুশৃংখল অংশগ্রহণের ভেতর দিয়েই আন্দোলন তার চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।একজন সংগঠকের প্রয়োজন হয় শোষিত মানুষদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে।সর্ব্ কালের সর্ব্ শ্রেষ্ঠবাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  বাঙালি জাতিকে এক কাতারে আনাতে সক্ষম হন আর একাত্তরের ৭ মার্চ্ ঢাকার রেসকোর্স্ ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তার মধ্যে নিহিত ছিল স্বাধীনতার ডাক।তিনি এই ভাষণে বলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা ।’                                             ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অদ্ভূদয় ঘটে। কবি নির্মলেন্দু গুণ জাতির জনকের এ ভাষণকে কবিতা বলেছেন, বলেছেন অমর কবিতা। এ নিয়ে ‘স্বাধীনতা এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হল’ শিরোনামে গুণ’যে কবিতা রচনা করেছেন তার অংশবিশেষ এ রকম-
একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের।
‘কখন আসবে কবি? ‘কখন আসবে কবি?
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা-
কে রোধে তাঁহার বজ কণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতা খানি:
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

নির্মলেন্দু গুণ তার এই কবিতায় দুটো বার্তা তুলে ধরেছেন। একটা হচ্ছে, স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অপরটি হচ্ছে, একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিকামী মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে জ্বলে ওঠা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দ্রোহের অগ্নিশিখা।
বাংলা সাহিত্যের কবিতা শাখায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভূদ্ধ হয়ে যুদ্ধোত্তর কাল পর্বে সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত বাংলা’, পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আহসান হাবীবের ‘স্বাধীনতা’ হাসান হাফিজুর রহমানের ‘তোমার আপন পতাকা’ , আবু জাফর ওবায়দুল্লার ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’ মহাদেব সাহার ‘ফিরে আসা গ্রাম’ হুমায়ুন আজাদের ‘মুক্তিবাহনীর জন্যে’ আবিদ আজাদের ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’ রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ আবুল হাসানের ‘উচ্চারণগুলি শোকের’ শিরোনামে’  কবিতার মতো অসংখ্য কবিতা আরো আরো কবিরা লিখেছেন।
পৃথিবীতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়েছেপ্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই দুটো যুদ্ধ পৃথিবীর নানা দেশে নানা প্রকারের বিপযয় ডেকে এনেছে।বিশ্ব সাহিত্য এই দুটো যুদ্ধের ক্ষত নানা ভাবে উঠে এসেছে।বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।আগেই আভাস দিয়েছি ।মুক্তির চেতনা যেদিন থেকে বাঙালির মনে জাগরিত হয়েছে, মূলত সেদিন থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মানুষের মনোজগতের চেতনার কথাই উঠে এসেছে বাংলা কবিতা ও গানে, যা বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে।
পরিশেষে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বে কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের বাংলা সাহিত্যের আমাদের আশা, আকাঙ্খা ও  অনুপ্রেরণার উৎস। বাঙালির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ  পর্বের চেতনার চিরন্তন গৌরব গাঁথা।




No comments:

Post a Comment