13 April 2017

সঞ্চারিণী






চৈত্রমাস এলেই সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি মনে পরে যায়! সবাই সাতেতের আড়ষ্ঠতা নিয়ে সমালোচনা করে, ভীতু বলে ব্যঙ্গ করে, কিন্তু কেউ জানেনা সাতেতের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাগুলো কিভাবে তা’কে ভীতু করে তুলেছে! নিজে শিল্পী হওয়া স্বত্ত্বেও শিল্পীদের প্রতি কেন তার এই আস্থাহীনতা! তার মনে শিল্পীদের জন্য আলাদা আসন করে রাখা সেই সন্মান কিভাবে ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছে। ঘটনাগুলোয় এত বেশিই নাটকীয়তা; যে কাউকে বললে তা কেউ বিশ্বাসও করতে চাইবে না!

হঠাৎ করেই এক সন্ধ্যায় জামান চাচা এলেন সাতেতের বাবার কাছে। সাতেতের বাবা তখন তবলায় হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে দিয়ে সুরে আনায় ব্যস্ত। সা-পা রীড ধরে হারমোনিয়ামের ভাঁজ টেনে তবলার সুর মেলানোর জন্য সাহায্য করছিলেন সাতেতের বাবার শৈশবের বন্ধু- আইয়ুব কাকা। ঝিমুনি ধরে যেতেই হাত আটকে গেলো আইয়ুব কাকা’র; আর সেই সাথে হারমোনিয়ামে পাম দেয়াও বন্ধ হয়ে সুর তৈরী করা থেমে গেলো। তা’র বাবা ধমক দিয়ে বলে ওঠলেন- “সুর কানে আসছে না!... ঘুমুচ্ছ না কী তুমি?... ওই আইয়ুব!!!!!” জিভ ঝুলিয়ে ঢুলতে থাকা আইয়ুব কাকা নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে মৃদু স্বরে কুশল জিজ্ঞেস করলেন জামান চাচার। জামান চাচা সাতেতদের পশ্চিম দিকের বাসাটার এক তালায় ভাড়া থাকেন। প্রায় সন্ধ্যাতেই বারান্দায় বসে তিনি সাতেতের গান শুনতেন আর ভাবতেন এত চমকার গান গাওয়া মেয়েটিকে তার বাবা কেন শিল্পী বানানোর চেষ্টা করেন না!
সে যাই হোক, সে রাতে সাতেতদের বাসায় জামান চাচার আসার হেতুটা জানা গেলো পরদিন দুপুরে। অত্যন্ত মিতভাষী সাতেতকে প্রতিদিন একটু গল্প করার মাধ্যমে আলাপচারিতায় সহজ করে নেয়ার ইচ্ছেতে; লাঞ্চ টাইমে তা’র বাবা অফিস থেকে ফোন কল দিতেন। কারণ গান গাওয়ার সময় ছাড়া সারাদিন রাতে সাতেতের কথা শোনা যেত না। তাই এ ব্যাবস্থা। এ সময়ে বাড়ির আর কেউ যেন ফোন ধরতে না পারে; সে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ছিলো সবাইকে, তাই সাতেতও বাবার ফোন কলের অপেক্ষাতেই ছিলো।

আজ দুপুরে সাতেত তার বাবার মুখে যা জানলো; তা যেন বিশ্বাস হচ্ছিলনা! এতই আনন্দিত হয়েছিলো যে খুশিতে গা কাঁপছিলো। আজ রাত ৮ টায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে জামান চাচার অফিসের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইবার প্রস্তাব এনেছেন জামান চাচা। আর সে অনুষ্ঠান উপযোগী সাজে সজ্জিত হতে কেনা কাটায় সহায়তা করতে ফোন করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলা হয়েছে রত্না দাদীকে। সম্পর্কে বাবার দূর সম্পর্কের এক মামী; তাই রত্না সাতেতের দাদী। তা’র গানের বরাবরই ভক্ত তিনি, তাই প্রতি মাসেই গিয়াস দাদার বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো সাতেতকে। স্বপ্না- রত্না দাদীরই ছোট বোন, গ্রাম থেকে শহরের মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির এই বাসায় থেকেই প্রিপারেটরী গার্লস হাই স্কুল ডিঙ্গিয়ে এখন ইডেন কলেজে পাস কোর্সে ডিগ্রী পড়ছে। স্বপ্না সাতেতের সমবয়সী; যে কি না সাতেতকে খুব ভালো বুঝে এবং সমাদর করে। বিকেলে রত্না দাদী আর স্বপ্নাকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে কেনা হলো শাড়ীসহ আনুষঙ্গিক।

মাথায় সাদা স্কার্ফ বাঁধা সাদা শাড়িতে সাতেতকে ঢুকতে দেখে গ্রীণ রুমের সবাই শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে গেলেন। অফিসের কয়েকজনকে সাথে করে জামান চাচা জেসিকে বরণ করে নিলেন ফুলের তোড়া, মালা আর উপহারে। ম্যাক আপ নিচ্ছিলেন নৃত্য-শিল্পী শিবলী মোহাম্মদ, তিনি ঘুরে তাকালেন অবাক হয়ে! কারণ সচরাচর পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ছাড়া এমন জাঁকজমক অনুষ্ঠানে তারকারা কেউ সাদা শাড়ি পরে আসেন না! তাও আবার লালের কম্বিনেশনে! আর ইনাকে ছাড়া আর কাওকেই ফুলের তোড়া দেয়া হয়নি, কারণ অন্য সব শিল্পী টাকার বিনিময়ে গান আর নাচ করতে এসেছেন, আর আসার আগেই এডভান্স ও নিয়েছেন ৫০%। সে যাই হোক-টি,ভি,র পর্দায় দেখা তারকা জগতের মানুষগুলোকে চোখের সামনে পাওয়া স্বত্ত্বেও ড্যাব-ড্যাব করে দেখা যাচ্ছে না। কারণ সাতেতের মনে হচ্ছে সে তাকিয়ে দেখলে উনারা বুঝেই যাবেন যে সে “ হা” করে ওদের তাকিয়ে দেখছে। শিল্পী সুবীর নন্দীর সাথে আগেও বেশ কতক অনুষ্ঠানে তা’র দেখা হয়েছে তাই সাতেত তারও মুখ চেনা। সাতেতকে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে শিল্পী সুবীর নন্দী বাইরে চলে গেলেন, সেই সাথে শিবলী মোহাম্মদও। গ্রীণ রুমের ছোট্ট টেবিলটার এক পাশে চায়ের কাপ হাতে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন শিল্পী কনক চাঁপা, আর আরেক পাশে ফুলের তোড়া, ফুলের মালা আর উপহারের প্যাকেট হাতে সাতেত অধঃ মুখে বসে। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই অন্যান্য শিল্পীরা চলে এলেন। শিল্পী রিজিয়া পারভীন, দিলরুবা খান সহ সুবীর নন্দী গ্রীণ রুমে প্রবেশ করতেই সাতেত ওঠে চেয়ার এগিয়ে দিলো শিল্পীকে। তিনি আপত্তি করলেও; সে আপত্তি না শুনে গ্রীণ রুমের এক কোনে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সাতেত। কিছুক্ষনের মধ্যেই গান শুরু হবে। এর আগে পরিবেশক দলের সাথে শিল্পীদের চলছে বাকি ৫০% টাকা বুঝে নেবার কথোপকথনসহ হিসেব নিকেশ। দম আটকে আসছিলো এই পরিবেশ। কারণ শিল্পী পরিবারে জন্ম নেয়া সাতেত কখনও তার পরিবারের কাওকে এমন দর দাম করে গান গাইতে দেখেনি।

সে শিক্ষা পেয়েছে এই যে; শিল্পীরা অর্থের মূল্যে বিকায় না! হৃদয়ের অমূল্যে জয় করা যায় শিল্পীদের।তা’কে ভালোবাসার আতিশয্যের অনুভূতি থেকে আদর করে নাম দেয়া হয়েছিলো “সাতেত” যা কি না মিশরীয় নীল নদের প্লাবনের দেবীর নাম। মাঝে মাঝে বাসায় মা অন্য ঘর থেকে জোরে তা’কে ডাকতে চাইলে ডাকেন “প্লাবনী” নামে। গ্রীণ রুম থেকে বেরিয়ে অল্প আলোর সরু পথটা পেরিয়ে মঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ালো সাতেত। উদ্দেশ্য তারকাদের পরিবেশিত গান খুব কাছে থেকে দেখা ও শোনা। শিল্পী কনক চাঁপার গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে একে একে অন্যান্য শিল্পীদের গান চলছে আর সেই সাথে চমৎকৃত হচ্ছে সাতেতের মন।অনুষ্ঠানের আয়োজকদের একজন সাতেতের কাছে এসে বলে গেলো তৈরী থাকতে। বিপত্তিটা বাঁধলো সেখানেই। অন্য আরেক শিল্পীর সিরিয়াল পেছনে ফেলে সাতেতকে কেন আগে গাইতে দেয়া হলো; সে নিয়ে ওই সিনিয়র শিল্পী তেড়ে উঠলেন আয়োজকদের, আর সেই সাথে বলতে লাগলেন- “ রুপ দেইখ্যা মিয়ারা আপনেগো আর হুশ থাহে না! এই মেয়ে কে? একে তো আগে কখনও কোথাও গাইতে দেখি নাই! একে এত মর্যাদা দিয়ে আমার আগে গান গাইতে দেয়ার মানে কি?” এতে সাতেতের আহত হওয়ার কথা না যদিও, তবুও আহত হলো, ভাবলো তাকে ঘিরে এই শিল্পী কষ্ট পেলেন।

মাইক্রোফোন হাতে সাতেত, “ও জীবনরে… ও জীবন…” সুর তুলে মঞ্চে ঢুকতেই দর্শক সারির মানুষদের মুহুর্মুহুঃ করতালি আর শিস! এবার চলছে মিউজিক… ড্রামার সোহেলকে আড় চোখে দেখে নিলো সাতেত। কারণ ড্রামের তাল ধরেই গাইতে হবে তাকে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান চল্ল। সাতেতের ভালো লাগছিলো এই প্রথম ফুল অর্কেষ্ট্রা সহ গান গাইতে পারছে বলে। গান শেষ করে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গ্রীন রুমের দিকে পা বাড়াতে যাবে, ঠিক তখনই তা’র সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই ড্রামার সোহেল; সাতেতের দিকে একটি ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে ধরে, আর মুখে বললেন গুলশান ডিসকো থ্যাকে প্রতি সান্ধ্য অনুষ্ঠানে গাইবার আমন্ত্রণ রইলো, আসবেন আশা করি! কার্ডটা হাতে নিয়ে সোহেলের চোখের দিকে তাকাতেই ঘাবড়ে গেলো সাতেত, পরক্ষনেই সোহেলকে অনুসরণ করলো তার দৃষ্টি। সোহেল গিয়ে শিল্পী মনি কিশোরের পাশে বসে কানে-কানে কিছু একটা বলতেই দু’জনেই হেসে ওঠলো। আর তার পাশে বসা শিল্পী রুক্সি; পপ তারকা হিসেবেই পরিচিতা সে। জামান চাচার ডাকে তাড়াতাড়ি লিফটে চলে গেলো সাতেত। কিন্তু লিফট পর্যন্ত যাওয়ার ওই পথটা সাতেতের গা কুঁকড়ে আসছিলো লজ্জায়। কারণ তা’র সমস্ত দেহটাকে যেন দৃষ্টি চুম্বকে আটকে নিচ্ছিলো অদূরে বসে থাকা কেউ। লিফটে রত্না দাদীসহ স্বপ্না, গিয়াস দাদা আর দাদীর ভাই হেলালের সাথে পৌঁছে গেলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সেখানে জামান চাচার বন্ধুরা সম্মানের সাথে বিদায় জানিয়ে গাড়ির ব্যাবস্থা করা আছে জানালো। কিন্তু সাতেতের বাসায় ফেরা হলো গিয়াস দাদার গাড়িতে চড়ে। সমস্ত পথ দাদী আর স্বপ্নার আদরে আর গিয়াস দাদার ভালোবাসামাখা কথায় আপ্লুত হয়ে পার হলো। কিন্তু অনুভূতির প্রকাশে ব্যার্থ সাতেতের দু’চোখে শুধু স্মীত হাসির কাঁপুনি ছাড়া আর কিছুই বুঝা গেলো না! বাসার গেইটের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন সবাই। সাতেতের সাথে নিজ পরিবারের আর কেউ যায়নি। একতলা বাসার নীল সদর দরজা পর্যন্ত পৌঁছানো পর্যন্ত গিয়াস দাদার গাড়ি অপেক্ষমান ছিলো। মা দরজা খুলতেই পেছন ফিরে হাত দিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানালো সাতেত; আর তার মা গলা চড়িয়ে দূর থেকেই আহবান করলেন রাতের খাবার তাদের বাসায় খেয়ে যেতে। গিয়াস দাদা আর রত্না দাদীও গাড়ি থেকেই জোরে বললেন, রাতের খাবার খেয়ে ফিরতে বেশি রাত হয়ে যাবে তাই আজ আর নয়; অন্যদিন আসা যাবে!

পরদিন সকালে ঘুম ভাংলো টেলিফোনের রিং শুনে। বাসায় তখনও সবাই ঘুমুচ্ছে, তাই বার কয়েক রিং বাজতেই রিসিভারটা কানে দিলো সাতেত। ঘুম জরানো কন্ঠে- “হ্যালো” বলতেই টেলিফোনের অপর পার্শ্ব থেকে পুরুষ কন্ঠের কারও হাসি ভেসে এলো। ঘাবড়ে গেলেও কিছু না বলে চুপ রইলো সাতেত, পরক্ষনেই পুরুষ কন্ঠটি বলে ওঠলো, “এই সাত সকালে চমকে দিলাম? ঘাবড়ে গেলেন- মিস সাতেত? আমি কে তা নিশ্চই বুঝতে পারছেন! ঐ যে গতরাতে আপনার গানের পর-পর আমি গান গাইলাম!” এবার ছোট্ট করে সাতেত শুধু বলল- “জ্বী। কিন্তু আমার ফোন নাম্বার কি করে পেলেন?”  শিল্পীটি হেসে উত্তর দিলো- “কি করে পেলাম সেটা বলা যাবে না! এ আর এমন কি কঠিন কাজ, যা যোগাড় করা যাবে না! রাতে গান গাইলেন, আর সারা রাতের ক্লান্তি এলিয়ে ঘুম শেষে সকালে আপনার কন্ঠস্বরটা কেমন হয়; তা শোনার আগ্রহেই ফোন করা। অপেক্ষায় আছি, আজ সন্ধ্যায় আসছেন তো? আপনার বাসা থেকে বেশি দূরে না! গুলশান ডিস্কো থ্যাকে এলে দেখা হবে! আসতেই হবে কিন্তু! আপনার ফিগারটা যা চমৎকার না! বাঙ্গালী মেয়ে মনেই হয় না! সাদা জর্জেট শাড়িতে আপনাকে কেমন লাগতে পারে তা ভেবে সারারাত ঘুমুতে পারিনি! একটার পর একটা সিগারেট…” বলতেই লাইনটা কেটে দিলো সাতেত। এ ধরণের সংলাপ শুনতে শুনতে বিরক্ত সে। আর ভালো লাগে না! বার বার কল করে বাসার সবার ঘুম ভাঙ্গাক তা চায় না বলে টেলিফোন লাইনটা ডিসকানেক্ট করে ঘুমুতে চেষ্টা করলো সাতেত। চোখে ঘুম লেগে আছে তখনও, আর গ্রীন রুমে সবার মাঝে বসে থাকতে অসস্তি লাগছিলো বলে গ্রীণ রুমের বাইরের নীম আলো এলাকাটায় অনবরত পায়চারী করে কাটিয়েছে সে, তাই পায়ের মাংসপেশীতেও টাণ খেয়ে আছে। কিন্তু যা ভেবেছে তা-ই হলো। ঘুম এলো না! কারণ কন্ঠস্বরে না চিনলেও দৃশ্য মিলিয়ে শিল্পীটাকে চিনতে দেরী হলো না তা’র! এও কী সম্ভব? তার মত এমন একজন তারকা এমনভাবে!? . . .

দিনের প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত থাকায় সকালের সেই ঘটনাটা সাতেত মা’কে আর বলার সময় পায়নি। তাদের বাসা ভেঙ্গে নতুন দো’তলা করার কাজে বাবা রাজ-মিস্ত্রীদের কাজ তদারকিতে ব্যস্ত। মা’ এইসব ঠক-ঠক শব্দের মাঝেই বালি আর সুরকী গুড়োর ঝামেলা এড়িয়ে রান্না করছেন কল পাড়ে টিন দিয়ে ঘেরাও দেয়া স্বল্প পরিসরেই। কাজের বুয়া বলছে- বাড়ির কাজ চলাকালীন গুড়া মশলা দিয়ে রান্না করা তরকারি খেতে। কারণ উড়াল বালু মিশে যায় মশলা পিষতে গেলে; আর তাতে ভাতের সাথে বালি কড়-কড় করে ভাত খাওয়ার সময়। তাই যদিওবা সকালে শিল্পীটির ফোন কল এবং তা’তে ঘাবড়ে যাওয়া সাতেত তার মা বাবাকে বিষয়টা জানানো প্রয়োজন মনে করছিলো, কিন্তু সে পরিস্থিতি সে খুঁজে পেলোনা!

পটলভাজি দিয়ে ভাতের লোকমাটা মুখে দিতেই- ফোনের রিং বেজে উঠলো। সাতেত তখন নতুন প্লাস্টার সেরে ওঠা ঘরটায় বসে ভাগ্নে ভাগ্নীর সাথে খেতে বসেছে। দেয়ালে লম্বালম্বিভাবে সেঁটে রাখা প্যারালাল লাইনের টেলিফোনটায় অনবরত রিং বেজেই চলেছে. . . সকালের ফোন সংক্রান্ত আতঙ্কের কারণে নিজে আগ বাড়িয়ে ফোন রিসিভ করার আগ্রহ দেখাচ্ছেনা সাতেত। কারণ সে তা’র নিজ পরিবারের মানুষদের চেনে। যে কোন বিষয়ে আগ্রহ দেখানো মানেই তার পেছনে কোন সন্দেহ করা হবে, আর ঝামেলা বাড়ানো হতে থাকবে। তা ছাড়া সকালে যেহেতু একটি পুরুষ শিল্পীর ফোন কল এসেছিলো; তাই ফোন রিসিভ করার ব্যাপারে নিজের আগ্রহ আরো সংযত করে নিলো সাতেত। অবশেষে সামনের বাসা থেকে ফোন এর রিসিভার হাতে মানই বুয়া ঘরে ঢুকলো। সাতেতের হাতে রিসিভারটা ধরিয়ে দিতে দিতে মানই বুয়া হাসিমুখে বল্ল- “একটা গান’র শিলফি আফনের সাতো কতা কইতাইন চাইন!” ঘাবড়ে গেলেও বুঝতে না দিয়ে মুখে উচ্চারণ করলো সাতেত- “ গানের শিল্পী? দাও তো দেখি?” ফোন রিসিভ করার আগ পর্যন্ত সাতেত ভেবেই নিয়েছিলো; সকালের সেই পুরুষ কন্ঠের শিল্পীই হয়তো আবার কল করেছে আজ সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে যাবার তাগাদা দিতে। তাই কিভাবে বিষয়টি পরে ম্যানেজ করবে তা ভেবে শংকিত সাতেত কর্ডলেস ফোন সেটটা হাতে নিয়ে “হ্যালো” বলতেই- ওপার থেকে নারী কন্ঠ ভেসে এলো… “ ক্যামন আছেন প্লাবনী? আমি চৈতি। আমাকে আপনি চিনবেন না। আজ কি আপনার কোথাও গান গাইতে যাওয়ার কথা? কেউ কি আপনাকে ফোন করেছিলো?” এসব কি বলছে মহিলাটি? সে জানে কি করে এসব কথা? কে সে? পরক্ষনেই মনে হলো, ওই শিল্পীর প্রেমিকা বা বউ হতে পারে, তাই সাবধানে শুধু উত্তরে বল্ল – “না, আমি তো ডিসকো থ্যাকে গান করিনা! আপনি কে?” প্রতুত্ত্যরে মহিলাটি শুধু বল্ল- “আপনি খুব ইনোসেন্ট! এসব ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো! আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।‘’ বলেই ফোনটা কেটে দিলো ওপ্রান্ত থেকে। সাতেতের গলা শুকিয়ে এলো এই ভেবে যে; তা’কে বাসায় তা’র মা যে “প্লাবনী” নামে ডাকে, সে নাম এই মহিলা জানলো কি করে? আর এসব কেন হচ্ছে তা’র সাথে?!!!!!

সন্ধ্যায় আবারও একই মহিলার ফোন। এবার সাতেত নিজেই ফোনটা ধরেছে। কারণ পরিবারের সদস্যরা বিরক্তির সাথে বলছিলো- কে যেন আজ সারা দিন ফোন করছে, কিন্তু ফোনে “হ্যালো” বলতেই উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিচ্ছে। সাতেত বুঝে নিলো যে-ই ফোন করছে সে নিশ্চই চাইছে সাতেতই ফোনটা রিসিভ করুক! আর তাই অন্য আর কেউ ফোন রিসিভ করলে কথা বলছে না! এভাবে বারংবার রিং হওয়া, ফোন কেটে যাওয়ার বিরক্তি থেকে বাসার সবাইকে উদ্ধার করতে সাতেত ফোন কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে সেই একই নারী কন্ঠ ভেসে এলো ফোনের পথ ধরে। এবার তার কন্ঠে কান্নাভেজা সুর। সে তার নাম এবার “চৈতি” না বলে বল্ল- “আমি বৈশাখী, আপনি প্লিজ কিশোরকে বলবেন না যে আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম!” সাতেত এবার গম্ভীরভাবে বিষয়টি হ্যান্ডেল করার আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো- “আচ্ছা, তা না হয় আমি কিশোর কেন, কাউকেই কখনও বললাম না! কিন্তু আপনি আপনার নিজের নাম কেন লুকিয়ে মিথ্যা নামে আমাকে বার বার ফোন করছেন? আর আসলে কেন ফোন করছেন? কি বলতে চান আপনি?” নিজেকে সামলে নিয়ে মিথ্যে বল্ল এবার মেয়েটি- “আপনি ভুল করছেন সাতেত, আমি বৈশাখী, অন্য আর কেউ নই!” যাক, সাতেত এবার আশ্বস্ত হলো যে মহিলাটি তার সাতেত নামটাও জানে! মন দিয়ে কথাগুলো শুনে গেলো সাতেত। মহিলাটি যা বুঝালো তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে- কিশোরকে সে ভালোবাসে, এবং সে চায় তা’দের দু’জনের বিয়ে হোক। কিন্তু গতরাতের অনুষ্ঠানে সে লক্ষ্য করেছে কিশোর সাতেতকে পছন্দ করে ফেলেছে, এবং সাতেতকে যে ফোন করে কথা হয়েছে সে কথাটি কিশোর তা’কে জানিয়েছে। শুধু তা’কেই না সেই ড্রামার সোহেলসহ আরো অন্যান্য বন্ধুরাও সবাই জেনেছে সে কথা। আর সাতেতকে এত কিছু বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- আজ রাতের ডিসকো থ্যাকে যেন সাতেত না যায়। কারণ আজ কিশোর ওই অনুষ্ঠানে তার পছন্দ করা হবু বউ কে হবে তা বন্ধুদের মাঝে ঘোষণা যে দেবে তা ইতিমধ্যে ফোনে সব বন্ধুদের জানিয়ে দিয়েছে। সেই সাথে সেই মহিলাটিকেও জানিয়েছে। তাই সে কোনভাবেই চায় না সাতেত সেই অনুষ্ঠানে যাক, বা অন্য কোন সময়ও ডিসকো থ্যাকে গান করতে যাক। সাতেত সেই মেয়েটিকে নিশ্চিত করে বলে দিলো যে সে এ ধরণের অনুষ্ঠানে কখনই যাবে না। শুনে খুশী হলো কি না বুঝা গেলো না যদিও তবুও সেই চৈতি/ বৈশাখী নাম নেয়া মেয়ে/ মহিলাটিকে খুব অসহায় মনে হলো।

রাত সাড়ে দশটায় কল এলো আবার! এবারও সাতেত সচেতন ছিলো যেন বাসার অন্য আর কেউ ফোনটা রিসিভ করতে না পারে! দীর্ঘশ্বাস সহ পুরুষ কন্ঠস্বর বলে ওঠলো- “আপনি এলেনই না শেষ পর্যন্ত! অথচ জেনেছিলাম আপনার থিসিস কমপ্লিট করতে আপনার বেশ টাকার দরকার! আর এখানে গান করে আপনি প্রতি সন্ধ্যায় পেতে পারতেন ৩ হাজার টাকা করে। তা ছাড়া আপনাকে নিয়ে আমার আরো বড় স্বপ্ন ছিলো; সবই ধূলিস্যাত করে দিলেন! আমি ভাবতে পারিনি, আপনি আসবেন না!” সাতেত শিল্পীটি যেন কষ্ট না পায় তার জন্য শুধু বল্ল – “আমার বাবা আমাকে আর বাইরে কোথাও গান গাইতে দিবেন না বলে দিয়েছেন, তাই যাইনি। আপনি কষ্ট পাবেন না!” ওপাশ থেকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস সহ ফোন রেখে দেয়ার শব্দ শুনতে পেলো সাতেত।

জীবন এগিয়ে যায়; স্মৃতিরাও সাথে সাথে হাঁটে ছায়ার মতন, কখনওবা আড়ালে থেকে। সাতেতের জীবনের বাস্তবতার কষাঘাত স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলো; আর তাই কলেজে প্রভাষিকা পদে নামী কলেজে সারা মাস কঠোর পরিশ্রম শেষে যখন সাড়ে তিন হাজার টাকা হাতে পেতো; মনে পরে যেত সেই ৫ হাজার টাকার প্রলোভনের কথা। অন্য কোন পরিবারের অন্য যে কোন গায়িকা হয়তোবা এই প্রস্তাব লুফে নিতো! যেমন লুফে নিতে দেখেছে তারই সাথে  বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গান গাওয়া আরেক শিল্পী আল-বেরুনী অনুকে। জাত শিল্পী পরিবারের মেয়ে বলে সে তা পারেনি। বরং হাড় মাংস কয়লা করা পরিশ্রমের টাকা উপার্জনকে মনে হয়েছে ঢের ভালো!
এরপর আর তাদের কারোরই কোন ফোন কল সাতেতের কাছে আসেনি। কিন্তু সাতেত ভুলতে পারেনি একই নারীর দুই নামের ছদ্ম পরিচয়ে পরিচয় দিয়ে; তার প্রেমিককে পাওয়ার একাগ্র ইচ্ছের বাস্তবায়নের চেষ্টার কথা। সাতেত বিষয়টিকে অন্যভাবে ভাবলো। সে ভাবলো; কিশোর যদি প্রতিশ্রুতি না-ই দিয়ে থাকতো, তাহলে চৈতি/ বৈশাখী নামের সেই মেয়ে তার বধূ হওয়ার বাসনা পোষণ করবেইবা কেন? আর যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া; তা’কে বাদ দিয়ে সাতেত কিংবা অন্য কোন মেয়ে দেখলেই আগে বাগদত্তা কাউকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুনকে পাওয়ার এমন ব্যাগ্রতা কেন? কোনটি পুরুষের আসল ভালোবাসার রূপ তাহলে?

রুক্সীর গান এর পর টি. ভি পর্দায় দেখলেই সাতেত খুব মন দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতো তার সুরের দহন। একদিন পত্রিকান্তরে বিনোদন পাতার সুবাদে জানতে পারলো রুক্সী একজন ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষিকা; তাও আবার রাজধানীর প্রধান সারির এক কলেজে, কিন্তু রুক্সী তখনও অবিবাহিতা; অথচ কত সুন্দরী, সুশিক্ষিতা সে! ১৯৯৩ এ টি.ভিতে অডিশন দিতে গিয়ে যদি কিশোরের সাথে দেখা হওয়ার সেই বিপত্তিটা না ঘটতো; তাহলে শিল্পী জীবনের এই পাট চুকানোর কাজটা সাতেতকে হয়তো করতে হতো না! কিন্তু আজ সেই কিশোরের নামও আর শোনা যায়না, শোনা যায় না রুক্সীর নাম ও। কোথায় হারিয়ে গেলো এই দুই শিল্পীর গান! অথচ চৈত্র এলেই সাতেতের মনে পরে যায় বৈশাখীকে। চৈতির রূপ আর বৈশাখীর ক্রন্দন সব মিলিয়ে অসুখী শিল্পী জীবনের এই দৃশ্যপট, শিল্পী হওয়া স্বত্ত্বেও ভালোবাসার ক্ষেত্রে কপট রূপ আর একজন অন্যজনকে জীবনে গ্রহন না করার অপারগ হৃদয়ের সংকীর্ণতা; সব মনে পরে যায়। সাতেতের বোধের ক্যানভাসে যে আচড় রেখে গেছে চৈতি; তার চৈতালী হাওয়ায়, বৈশাখের রুদ্র আকাশ সে চিত্রকল্প এঁকে দিয়ে যায় তার- স্মরণের খাতায়।
                

No comments:

Post a Comment