সাহিত্য সংসারে দীর্ঘ হাহাকার!
সময়ে অবসাদগ্রস্থতা নগরীর মানবিক রোগের নাম। যাপিত জীবনে নৈতিকতা-মূল্যবোধ
মানব অস্তিত্বের বড় দিক হলেও প্রকটভাবে সংকট তৈরি হয়েছে।যোগ করেছে সৃজনশীলতায়- নগরে
মোড়ে মোড়ে জমাট বেঁধে নেড়িকাকের অহেতুক চিৎকার আর চেচামেচিতে অস্বস্থিকর পরিবেশ। প্রকৃত
মূল্যবোধের কাঠামো ভেঙে যে বুদ্বুদ তোলার চেষ্টা চলছে, তাতে মনোরাসায়নিক দুর্গন্ধ সহ
পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা। সৃজনশীল সাহিত্যের নামে কতেক তোষামোদকারী কিংবা সুবিধাবাদী লোকের
আখড়ায়...
পাঠাভিজ্ঞতায় দেখা যায় সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সাহিত্য বিচার
করবার কাজটিও একটি বড় বিষয় বলে সবসময় মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য-‘জ্ঞানের বিষয়
নহে, ভাবের বিষয়’-এ্ই বিশ্বাস তাঁর আজীবন ছিল। সেই সাথে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করি- অন্তরের
জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানের এবং ক্ষণকালের জিনিসকে
চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ’। এর ফলে সাহিত্য ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে
উঠে। আর এ বিশ্বজনীন করতে হলে উন্নত রুচি, বোধ, চিন্তাশীলতার জায়গা বিস্তৃত প্রয়োজন।
সেটা সমকালে প্রচন্ড সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
গতকাল এক কবিবন্ধু দেখায়, ঐ যে উনি যাচ্ছেন, তিনি কবিতা যেমনই
লিখেন, তার কবিতা যে কাউকে ছাপতে হয় এবং তার অনুষ্ঠানে দাওয়াত করলে আসতে হয়, অন্যথায়
অপমান কপালে।
আমি কিঞ্চিত বিচলিত হলাম না। এই সমাজে আরো হেন কাজ যে হচ্ছে
সেটি জানি বলে। একবার গীতিকবি শহিদুল্লাহ ফরায়েজী বললেন : ইমরান, শিল্পচর্চার পূর্বে
মানুষ হতে হয়। সে মানুষ হবে- সুন্দর আর উন্নত রুচির, তাহলেই সে শিল্পচর্চা থেকে পাঠক
উপকৃত হবে।
মানুষ হওয়া তো দূরের কথা শিল্পজ্ঞান না নিয়েই ক্ষমতা কিংবা
লবিংয়ের ‘গুণে’ দেশ থেকে দেশান্তরে বাংলাসাহিত্যের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে দূর্বাঘাসের
মতো মাড়িয়ে দিয়ে আসছে প্রকৃত সাহিত্য কৃষকের ফসল। আর ভিনদেশীরা ভাবছে ‘বাংলা সাহিত্য
বুঝি এমনই’। অথচ যার শিল্পজ্ঞান ভাল, শ্রেণী/সংগঠন না মনে রেখে কীর্তিকে জানান দিয়ে
আসতে পারতো, তিঁনি যেতেই পারছে না।
প্রসঙ্গে বলি, সমাজে এখনো একটা চিত্র আছে- যে ছেলেটি পড়াশোনা
ভালভাবে করেনা, মা-বাবার কথা শোনে না, লোকাল পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়ছে, নারী কেলেঙ্কারিতে
পরিবারের মানসম্মান যায় যায়, ঠিক সে সময় সিদ্ধান্ত হয় ছেলেটিকে বিদেশ পাঠানোর। এতে
কি ছেলেটি কত অংশে ভাল হয়ে যায়? সেকি আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেতে পারে? অবশ্যই না।
এমনটাই হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। মেধাবী সাহিত্যজন, যে জায়গা
থাকলে সাহিত্যের উপকার হতো তাকে যোগ্যস্থানে বসাতে সক্ষম হচ্ছি না। কথাও বলছি না কুলুপ
এঁটে আছি। যারা আবার বলছে- ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে কথা বলতে দেখছি না। কখনো কখনো দলকানার
পরিচয়ও দিচ্ছে। আবার কখনো ‘তকমা’ জুড়ে কথা বলে কাউকে একঘরে রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত একশ্রেণী।
যেন হরিলুটের বাজার। পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত সাহিত্য- যে যার মতো বিলিয়ে যাচ্ছে। বলারও
কেউ নেই। দেখার আছে হলভর্তি দর্শক।
সমালোচনা সাহিত্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ কিছুটা ভূমিকা রেখেছেন।
এই সময়ে তাঁর অনুপস্থিতেতে হাহাকার দীর্ঘ হচ্ছে। আড্ডাগুলোতে প্রশংসার ঝুড়ি নিয়ে আসতে
দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যজনের পিঠ চুলকানোর মত, কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। শৈল্পিক সমালোচনা
থাকছে অধরা। বিলের ফেনার মতো সবাই ভেসে আছি নয় কি!
আজ সত্যি- ‘মানুষ’ অধরা। ফলে যোগ্য জায়গায় যোগ্য লোক না থাকায়
এই ‘প্রজন্ম’ কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল দেখছি। আর যাঁরা ভোর এনেছিল আজ তারা লিফটের ডানে কিংবা
বামে দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ঘরে কলিংবেল দিচ্ছে। অযোগ্যদের ‘কদমবুসি’ করে সূর্যসকালের স্বপ্ন
দেখাচ্ছে। দূর থেকে পাখিরাও হাসছে!
ব্যক্তি পরিচয় কিংবা ‘নারী’ বলে নিন্মমানের লেখা ছাপানো হচ্ছে
সাময়িকীতে। আবার কখনো না ছাপলে নিজেই পত্রিকা করে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
একজন পাঠক সৃজনশীল মানুষ থেকে সৃষ্টিটাই চায় নারী কিংবা ক্ষমতার নয়। কীর্তন হউক সৃষ্টির।
যা হোক এই সময়ের ময়না তদন্ত আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং এতে দুর্গন্ধ
ছড়ায়। আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। মানব জীবনে বিশ্বাস হারানো পাপ। সময়ের উদ্দেশ্য হউক আলোকোজ্জ্বল।
সাহিত্য হয়ে উঠুক দেশীয় এবং বৈশ্বিক। সৃষ্টিশীলতার দৃষ্টিবোধ কীর্তি নিয়ে দাঁড়াক আকাশচূড়া
ক্যানভাসে। স্বপ্নের মশাল হাতে সমকালের মুখোমুখি আমরা।
কবি ও সম্পাদক
: কালের ধ্বনি
No comments:
Post a Comment