08 October 2016

সাজিদ উল হক আবির



মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোন দেশে
হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কোনও প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে নয়,একদম দুম করেযেন আলগোছে হাত থেকে কাঁচের গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার মত করেই ঘুম টুটে গেলো চোখ থেকে। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে চলে এলাম জানালার কাছে।
নিশুত-বিজন রাত,যদিও আয়ু তার আর বেশীক্ষণ নেই। পুব আকাশটা কেউ যেন চীরে ফেলেছে ছুরির ফলা দিয়ে। খুব ক্ষীণ একটা আলোর রেখা ফুটেছে তা থেকে। রাস্তায় কেউ নেই, জনমানব- যানবাহন,এমনকি যে কুকুরগুলোর চিৎকারে রাত একটা পর্যন্ত কান পাতা দায় হয়ে ওঠেসেগুলোও যেন উধাও হয়ে গেছে হঠাৎ। আমার চেনা পরিচিত পৃথিবীর যেন বদলে গেছে পুরোটাই। রাতের এই সময়টা থাকে অপার্থিব জগতের অধিবাসীদের দখলে। সজাগ থাকে কেবল ধর্মদ্রোহী অথবা ধর্মপ্রাণ মানুষেরা। রাতের আঁধারে ঢাকা অচেনা এ পৃথিবী আমার দিনের আলোতে দেখা জগতের তুলনায় অনেক অনেক আলাদা।


ঠিক এমন সময় হঠাৎ আমাকে ছুঁয়ে গেলো জানালা দিয়ে হু হু করে ছুটে আসা এক পশলা ভেজা হাওয়া। নাকে এসে লাগলো মিষ্টি শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। বাবা বড় শখ করে আমাদের বাড়ির সামনে লাগিয়েছেন শিউলি গাছ। এ বাতাস,এ ফুলের ঘ্রাণ আমার বড় চেনা,বড় পছন্দের। একাকী রাতে ঠিক যেন পরিচিত বন্ধুর মোট তারা আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। এদিকে আঁধার কেটে আবছা আবছা আলো ফুটছে চারিদিকে। বাড়ির সামনের ঘাস শিশিরে ভেজা। শরতের আরেকটি দিনের সূচনালগ্ন।

শরতের ব্যাপারে আমার উপলব্ধি হল,এর সময়কালটা যেন আসতে না আসতেই চলে যায়। ধরে রাখা যায় না। নদীর ধারে কাশবনের মধ্যে ছোটাছুটির সুযোগবঞ্চিত আমরা যারা ইট-পাথরের নগরীতে জন্মে এখানেই কাটিয়ে দিয়েছি পুরোটা জীবন, শরতে প্রকৃতির পরিবর্তনগুলো আমাদের চোখে ঠিক সেভাবে ধরা পড়েনা। গ্রীষ্মে তীব্র গরম
তার বিপরীতে শীতকালে তীব্র ঠাণ্ডা আর বর্ষাকালে বৃষ্টি এসব কিছু বড় বেশী রকম করে অনুভব করা যায়। শরতকাল সে তুলনায় যেন অনেক মুখচোরা,হুটহাট করে কোত্থেকে যেন এসে হাজির হয়,ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চার ছেলেটার মত বাকী ঋতুগুলোর পেছনে মুখ লুকিয়ে পুরো সময়টা জুড়ে বসে থাকে,আবার এক সময় উধাও হয়ে যায়। তারপরেও,শরত ঋতুটি আমার মনে অন্য রকম এক দুর্বল জায়গা দখল করে রেখেছে। কারণটি অবশ্য সেই অর্থে সার্বজনীন কিছু না।
বাচ্চাকাল থেকেই নানা রোগশোকে ভুগতাম বলে আমার জন্যে বৃষ্টিতে ভেজা বারণ ছিল পুরো স্কুলজীবন। বন্ধুরা স্কুল ছুটির পর বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলত,আমি বাসায় ফিরে জানালা দিয়ে হিংসা হিংসা চোখে তাকিয়ে থাকতাম। শীতকালে সকালে বিছানা ছাড়তে মন না চাইলেও মর্নিং স্কুলের কারণে শীতের কাপড়চোপড় একটার ওপর আরেকটা চাপিয়ে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিতাম। গরমের সময় একটানা বেশীক্ষণ রৌদ্রে দৌড়ালেই মাথা ঘুরে পড়ার অবস্থা হত। কাজেই এই তিন প্রধান ঋতু সম্পর্কিত আমার যত স্মৃতি,সবই বঞ্চনার। শরতকালই একমাত্র সময়,যখন আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম,সুযোগ পেতাম নিজের মত করে চারপাশটাকে আবিষ্কার করার।

ছোটবেলায় বাবা এই সময়টাতেই আমাকে এনে দিতেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ছোটদের পত্রিকা আনন্দমেলার শারদীয় পূজাসংখ্যা। ঢাউস সাইজের সেই বইয়ের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকতাম পুরোটা বছর জুড়ে। হাতে পাওয়া মাত্রই আমাকে আর পায় কে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু- সন্তু আর জোজোর সাথে বেরিয়ে পড়তাম শ্বাসরুদ্ধকর নতুন অভিযানে। 
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে উপন্যাসের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতাম বাস্তব-অবাস্তবের মিশেলে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক জগতে। সাথে থাকত সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাপ্রফেসর শঙ্কু এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার রঙিন কমিকস। বাস্তবের রুক্ষতা থেকে কল্পনার ডালপালায় ভর করে পালানোর জন্যে শৈশবে এর বেশী কিছু আমার আর প্রয়োজন হয়নি। খানিকটা বড় হয়ে যখন কলেজে ভর্তি হলাম,চিন্তার জগতটা হল আরও খানিকটা বিস্তৃত,শরতকে আবিষ্কার করলাম নতুন ভাবে। ঢাকার গলিঘুঁজির ফাঁকফোকর দিয়ে যে আকাশ দেখা যায়, তাতে মন ভরে না। কলেজ শেষ করে এসে তাই প্রায় প্রতি বিকেলে গিয়ে বসতাম বাড়ির পাশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ছোট্ট সংকীর্ণ এক চিলতে নদী,তার ওপর বিস্তীর্ণ আকাশ,আর তাতে যেন জীবনানন্দের কবিতার পাতা থেকে উঠে আসা, ভেসে আসা পেঁজা তুলোর মত সাদা সাদা মেঘেরা দল বেঁধে ছুটে বেড়াতো। কোন বিরাম ছিল না তাদের। মেঘেদের দলবেঁধে ছোটাছুটি সেই যে আমার মনকে অস্থির করে দিল,আজও তার কোন স্থিরতার হদিস খুঁজে পাই নি। ফটিকের মত বাঁও মেলানোর চেষ্টা করি,এক বাঁও-দশ বাঁও-শ বাঁও,বাঁও তো আর মেলে না! 

এরই ফাঁকে,নদীর তিরেই,সাদা মেঘের ঠিক বিপরীত,ঠিক যেন, সেই জীবনানন্দের কবিতার পাতা থেকেই উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে, অন্ধকার বিদিশার নেশা ছড়ানো এলোচুলের এক নারীমূর্তি। তার সৌম্যকান্ত মুখচ্ছবি চোখে ঠিকরে এসে বিঁধেছিল ঠিক তীরের মত। সেই একবারই দেখলাম তাকে,আর তাতেই আমার উনিশ বছর ধরে আগলে রাখা অন্তর পুরো এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল প্রথমবারের মত, কলেজ জীবনের কোন এক শরতের বিকেলে। বহু খোঁজাখুঁজির পরও তাকে আর পাই না। পাইনা মানে একদমই পাইনা। দৈবাৎ তার সাথে দেখা হল আবার সপ্তাহখানেক পর,গোসাইবাড়ি পূজোর মণ্ডপে,শারদীয় পূজা উৎসবের এক সন্ধ্যায় । সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী তিনরাত পূজোর মণ্ডপে তার সাথে চলল আমার চোখে চোখে কথোপকথন। দশমীর দিন,দেবী বিসর্জনের সকাল থেকেই সেই যে তাকে আবার হারালাম, আজ পর্যন্ত তাকে আর খুঁজে পাইনি। আজ শরতের এই ভোরে এসে শৈশব থেকে কাটিয়ে দেয়া শরতের প্রতিটি দিনই যেন এক হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু মনে এক প্রছন্ন শোকের আবহ বাজতে থাকে।

আমি তার সূত্র ধরতে পারি না। নদীর তীরে বা পুজোর মণ্ডপে দেখা হওয়া সেই রাবিন্দ্রিক তন্বী হয়ত অন্যকারো হাত ধরে আবার এসে দাঁড়াবে এই নদীর তীরে শরতের কোন বিকেলে,সুখী দম্পতির চোখেমুখে ঝিকমিক করবে নদীর জলে সূর্যের সোনা রঙ। শরতের আকাশে ভেসে যাবে জীবনানন্দের ধবল বকের ডানার মত মেঘ,আরও হাজার হাজার বছর ধরে।আমারি মত আরেকটি ছেলে,ঠিক আজকের মত আরেকটি ভোরে,খালি পায়ে শরতের শিশির ভেজান ঘাসে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে রচনা করবে শরত বন্দনা।
আজকের মত,শরতের আরেকটি দিনে,হয়ত শুধু আমিই থাকবো না,এই যা!

___________________________ 

No comments:

Post a Comment