রম্ভগোল। চিৎকারটা হাওয়ার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই
লাফিয়ে উঠল আদিম আর্য। পতপত করে
সঙ্গত করলো অনিয়মিত দাড়ির জঙ্গল। এই ফাঁকা প্রান্তরে
তার নিজস্ব ডিকশনারির এই শব্দের ইনটারপ্রিট করার মতো কোনো হুলো নেই।
কংক্রিটানগর থেকে কতদিন হল পালিয়েছে সে? ৬ ৯ ০ ৪ সংখ্যাগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় এখন। অথচ অংকে সে নাকি বেশ ভালোই ছিল। এসব আর মনে রাখতে
পারেনা সে। হোকগে, ওসব মনে রেখে অন্তত তার যে কিছুই হবার নয় এটুকু বোঝে সে। কিছুই মনে রাখতে পারেনা। সাম্প্রতিক কোনো
ঘটনাই। ভুরু দুটো কুঁচকে যায়। কি যেন নাম
মেয়েটার? ভীষণ সুখী সুখী মুখ করে চিড়িয়াখানায় দেখা। বর নাকি পালিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। কদিন পরেই চিতপাত
এক মোটেলের বিছানায়। ফাঁকতালে ক্যামেরা,মোবাইল অনেক কিছুই গলে গেছে আঙুলের ফাঁকে। মেয়েটার স্বর্গ দরজার কাছে
একটা আঁচিল ছিল কি? লাল রঙের আঁচিলটা বড় হতে হতে আকাশে দপদপ
করতে থাকে। হা হা করে অনর্থক হেসে ওঠে জঙ্গুলে। কয়েকটা কুবো পাখী লাল কালো ডানা বার করে উড়ে যায়। উড়োজাহাজ … উড়োজাহাজ … লোকটা সেই ফেলে আসা
শৈশব ফিরে পায়। সে দৌড়ায়, মাঠ দৌড়ায়, চারপাশ দৌড়াতে থাকে।
শাল্লাহ! সেই কাফেটোরিয়া কোত্থেকে টুপ করে খসে পড়লো। বাঞ্চোত, আড়াইশো টাকা
পার কাপ ধক দিয়ে কুচ্ছিত কফি। ওয়াক থুঃ! বছরখানেক কফি দেখলেই ঘেন্না ধরে যেত। সেই
টানা একঘেয়ে সকাল থেকে রাত্রি, আর রাত্রি ফুস করেই ফের সকাল। বারো ঘন্টা, চোদ্দো
ঘন্টা কম্পিউটারে মুখ গুঁজে রগড়াও শালা যত ট্যাঁস কোম্পানীর রদ্দিমার্কা দস্তাবেজের
গর্ভশ্রাব। রাতে ঘুমের মধ্যেও বিড়বিড়। সন্ধের পরেই রোজ মাথার মধ্যে দশটনের
ডাম্পারের দাপাদাপি। কড়া ভোদকার গ্লাস নিয়ে অশোকার জঘন্য ভীড় গিলে বাড়ী ফিরতে
এগারো। ধুস শালা তোর চাকরির পোঁদে দু লাথ। লাথি মেরে একটা মোরামের খন্ডকে তিরিশ
ফুট দূরে পাঠালো সে। রম্ভগোওওওওল!
প্রচুর পোকামাকড়
উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে। অদ্ভুত দেখতে
এই পোকাগুলো আগে কখনো দেখেনি লোকটা। উড়ছে-উড়ছে-চারদিকে-চারপাশে। গোল বৃত্ত তৈরী করে ফেলছে। খুব শক্ত ক্যালকুলাসের অঙ্কের ধাঁধায় বেঁধে ফেলতে চাইছে যেন। ঘুরছে-উড়ছে, সংখ্যা-অতীত। বর্তমান হাওয়া। সে কি অস্বাভাবিক
হয়ে যাচ্ছে? এই আছে এই নেই থেকে অতীত টাইম
মেশিনে ফিরে ফিরে আসে। জাঁকিয়ে বসে মৌরসিপাট্টা
গেড়ে। মাথার মধ্যে একটা সাইরেন বেজে ওঠে। ভোঁওওওওওও…
স্কুলে যেতে চাইতো না ছেলেটা। অদ্ভুত এক আতঙ্ক
গলার কাছে চেপে বসতো। সকাল সাড়ে নটা বাজলেই স্কুল ইউনিফর্ম
পরার সময় হতো। ভাতের থালার সামনে চুপ করে বসে থাকতো
ছেলেটা। বাবার কানমলা, মায়ের বকুনি, সার-সার ছেলেমেয়ের দলবেঁধে হইহই করতে
করতে স্কুলে যাওয়া, কিছুই তার মনে ছাপ ফেলত না। এক অজানা ভয় অন্ধকার করে বিচ্ছিন্ন করে দিত আশেপাশের মানুষগুলোকে। ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। কেউ ভালোবাসে না
তাকে। কেউ বোঝেনা স্কুলের ক্লাসের কোনে তার জন্যে অপেক্ষা করছে
ভয়ংকর বিকট এক হুতুমথুম। সেকেন্ড মাস্টার ক্লাসে ঢুকলেই শিরশির
করে উঠত সারা শরীর। হাত পা ঝিনঝিন করত। কেউ বুঝতেই চাইত না।
একবার গুলতি দিয়ে একটা পায়রা মেরে ফেলেছিল সে। আসলে মারবে
বলে গুলতি ছোড়েনি। ছোড়দার সম্পত্তি গুলতিটা হঠাৎই হাতে
এসে গেছিল লুপ্ত গুপ্তধনের মত। কাঠটা ময়লা হয়ে গেছিল
ধুলো বসে। কিন্তু রাবারগুলো ছিল ঠিকঠাক। টেনে ছেড়ে দিলেই ব্যাং শব্দ করে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার আওয়াজ বেরোচ্ছিল। ছুটির দিনের অখন্ড অবসরে সেটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। যা দেখছিল
তাকেই ব্যাং। রাস্তার ইট, পাথরে বোঝাই দুটো পকেট। কিন্তু একটাও লক্ষ্যভেদ না করতে পেরে অনেকক্ষণ পরে ফিরে এসেছিল বাড়ীতে। সেখানেই বকবকম
বকবকম উঠোনে চরে বেড়াচ্ছিল কাকার বড় সাধের পায়রাগুলো। সাদা,ধুসর,ময়ূরী কত রঙ তাদের। পায়রাগুলো ভয় পায়নি তাকে। কতদিন খুঁটে খুঁটে
তার হাত থেকে খাবার খেয়েছে তারা। ঘুরেছে নির্ভয়ে। কি মনে হতেই, পকেট থেকে একটা
ইটের টুকরো হাতে চলে এল। দুই রাবারের সংযোগে
বসে ব্যাং। আর আশ্চর্য! এতক্ষণ যে একটা লক্ষ্যেও লাগাতে পারেনি নিশানা, সেটাই কি করে যে নির্ভুল ভাবে গিয়ে লাগলো একটা ছাইরঙার পেটে। ডানা ঝাপটিয়ে ধপ করে ছিটকে পড়ল সেটা। খোলা দুচোখে সাত
সমুদ্র বিস্ময়। ব্রুটাসের নাম শোনেনি পায়রাটা। কিন্তু যখন বুঝলো আর একচিলতে সময় পেলো না বাঁচবার। সে চোখে ধিক্কার
ছিলনা। ঘেন্না ছিলনা। রাগ ছিলনা। ছিল শুধু অপার বিস্ময়। অজান্তেই মাথার চুল
মুঠোয় চলে আসে লোকটার। পটপট করে ছিঁড়ে ফেলে কয়েকটা। কিন্তু ব্যাথার কোনো অনুভব স্পর্শ করেনা তাকে। পায়রার খোলা
চোখ বড় হতে হতে ছেয়ে ফেলে সারা আকাশ। গুমগুম শব্দ করে
নেমে আসে বাজ। শুরু হয় শ্রাবণের অঝোর ধারা। ভিজতে থাকে চালচুলোহীন। মাটি ভেজে, গাছ ভেজে। ভিজে পাতাল সোঁদা
গন্ধ ছাড়ে অনর্গল। সিজোফ্রেনিয়ার ফেড হয়ে যাওয়া রঙ চেপে
বসে ফুটো ওজোনস্তরের কালো গহবরে।
মুখের মধ্যে মুখ। মাথার মধ্যে অন্য মাথা। বলা ভালো দুটো মাথা কাজ করে পালা করে। এই এ, এই সে। কোনো কোনো সময় ভুতগ্রস্ততা। অপছন্দের মুখ সামনে এলে মনে হয় খুন করে ফেলবে। কে যে আসল, আর কে যে নকল সেটা আজো ঠিক করে উঠতে পারলো না সে। সারি সারি মুখোশের আড়ালে চাপা পড়ে যায় মুখ। হাঁটা সুঁড়ি
পথের ধারে গড়াগড়ি খায় কাটামুন্ডু। উত্তর আর দক্ষিণ মেরু দুটো ক্রমাগত বিশৃঙ্খলতায়
কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করেই পালটি মারতে থাকে। ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইডে মারপিট লেগে যায় ধুন্ধুমার।
সেইসব নারী কিম্বা সেইসব নারীদের মুখ। যাদের সে
ছুঁয়েছে কিম্বা ছোঁয়নি কালবেলার অজুহাতে। যাদের উত্তুঙ্গ দুই স্তনের বোঁটায়
শিরশিরে বিদ্যুৎ চমকে টাইফুন আছড়ে পড়েছে। নিঃশ্বাসের স্পিড ফর্মুলা ওয়ানের রেসিং এর লাস্ট পাকে আছড়ে পড়ে পুরুষত্বের গর্ব
পাতে। আর তখনি ঘাম ভরা তৃপ্তিতে মাখামাখি মুখ থেকে উঠে আসে সেই
অমোঘ প্রশ্ন। ভালোবাসো আমাকে?
ভালোবাসা! তাবৎ সাহিত্যিক,
শিল্পী, বিজ্ঞানী এর পেছনে দৌড়ে বেড়িয়েছেন
আজীবন। আবছায়ে কিছু রেখার সমষ্টিকে ধরতে পেরেছে
মুষ্টিমেয় কিছু ভাগ্যবান। ভালো কি সত্যিই বেসেছে কেউ তাকে? শরীরে শরীর মিশিয়ে শেষ মুহুর্তে কনডোম নাকি আইপিলের ভাবনায়
কুঁকড়ে যাওয়া মুখগুলো কি ভালোবাসা? মুখ আর মুখোশের লড়ায়ে মুখোশই
জিতে যায় বরাবর। নিউরো ট্রান্সমিটার সেরাটোনিন কমতে
কমতে শূন্যে এসে ঠেকে। চেতন-অবচেতন-অচেতন একাকার হয়ে যায়। শূন্য থেকে নেমে আসে এক অদৃশ্য দড়ি। প্রত্যেক পাকে রক্তের
দাগ। চেপে বসে গলায়, বুকে, পুরুষযন্ত্রে। টাইট, আরো টাইট হতে হতে নিঃশ্বাস
বন্ধ হয়ে আসে। অন্ধকার পড়ে ঝুপঝুপ করে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে লোকটা। হাউহাউ করে কেঁদে
ওঠে। কখন যেন সে নিজের অজান্তেই চুরি করে বসেছে নিজেরই অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত।
ভার শূন্য নীরবতায় দুলতে থাকে লোকটা। চেঙ্গিসের তরোয়ালের
ধারে বাস করা সময় আবার ফিরে এসেছে কোনো শমন জারি না করেই। বিড়বিড় করে
কে যেন কি সব বলে যায় একটানা, অনর্গল কানের লতির পাশে। গরম নিঃশ্বাস পাগল করে আরো একবার। হি হি করে হাসে ভূত
ভূতানি। শেষ শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে জমতে জমতে উলম্ব অবস্থানে এসে
ভেঙে পড়ে নির্জন রুক্ষ অনাবাদী টাড়ে। আর্যসভ্যতার সর্বশেষ
বংশধরের চোখের জল আর মেঘের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
*****
No comments:
Post a Comment