27 December 2017

গুচ্ছ কবিতা- শুভ্র সরকার


মানুষের শব্দার্থ
ফুল ফোটার শব্দ, তুমি জামার বোতামে ঘরে লুকিয়ে রাখো। আর মুখস্থ অঙ্কের মতো আমি ভুলে যাই মানুষের শব্দার্থ।
সন্ধ্যাঝোপে ধ্বনিত হয় অভিজ্ঞ অন্ধকার দিগন্তরেখায় চেয়ে থাকে মেঘধুলো।

অনভ্যস্ততায় বিদার হয়ে যায় ধূলোর স্নান; পাখির বাগান। যেমন পালকের অবয়বে হারিয়ে যায় উড়ান। অলীক হাওয়ার তোড়ে হারিয়ে ফেলি আত্মার ঘ্রাণ।

আর বিলীন ধুলোর অবয়ব উড়িয়ে দিলে পথের নিশানা। দীর্ঘকাল হেঁটেও মানুষ নিজের কাছে পৌঁছাতে পারে না।




ধুপছায়া
কার শরৎ রঙের ত্বকে বড়ই ফুলের মতো ক'রে তুমি ফোটো
কার ছায়ায় তুমি নুয়ে পড়োচোখের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকো
কার দহলিজে গেয়ে ওঠো মনস্তাপ; রেণুর মতো ঝ'রে পড়ো

যেন ছুঁয়ে দিলে ভাঙচুর হয়ে যাবে তুমি
ডাক দিলে হয়ে যাবে মোহবশ নদী।

আমার ভেতর যতদূর তুমিপাখোয়াজ ভরতি বিষণ্ণ সুর
আমি বহুদিন আমাকে খুঁজে পাই না; খুঁজে পাই নির্জনদূর

যেন কাছে এলে ম্লান হয়ে যায় যত আড়াল
দূরে গেলে চোখে এসে দাঁড়ায় বর্ষাকাল।

মন্দ্রিত হাওয়ার অবয়বে ফিরে ফিরে আসো, যতটা জাদুকরী ঘ্রাণ
তোমার আলোকচ্ছটায় নিহিত ধুপছায়া; মুছে দেবে সমস্ত অইরান।




মায়াবেলা
এরপর, চন্দনবনের পাশে নুয়ে পড়ে তোমার এক অবিকল মায়াবেলা
একটা নিশ্চুপ ভোর কোলাহলের চেয়ে অধিক দূর চ'লে যায়।

সাঁকো পার হলেই উড়ে যায় সমস্ত জলপায়রা;
তোমার পিঞ্জরে বেজে ওঠে শূন্য পাখিরালয়।

ফুলতোলা চাদরের আড়ালে নম্র চোখে চেয়ে থাকে অনুপস্থিতি
টুপটাপ শব্দে চোখের ডানা থেকে ঝ'রে পড়ে দূঃখ-দূঃখ গন্ধ।

আর, সমস্ত মায়া কুড়িয়ে তুমিও একদিন পশ্চিমদিকের চৌকাঠে হেলে পড়ো ছায়া হ'য়ে।



ঘড়ি মেকার
আচ্ছা, রোজ সূর্যের বদলে একদিন যদি জোনাক উঠতো...
ঘুম খুলে দেখতাম তার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে একজন ঘড়ি মেকার।
মার্গারেট বিশ্বাস করতেন স্বপ্নের মধ্যে কখনো ঘুমতে হয় না।
অথচ আপনি জানেন না মার্গারেট, ঘুমের মধ্যে রোপণ করা থাকে

অলৌকিক জোনাক, মার্গারেট, আপনি ঘুমিয়ে আছেন। স্বপ্ন দেখছেন
টিনভর্তি বিস্কুট নিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা সেলাই করছেন।
সেলাই করতে করতে বড়শিতে গেঁথে ফেলছেনউড়তে পারা মাছের চোখ।

বৃষ্টিতে পাখি আর মাছ আপনি গুলিয়ে ফেলেন, চিনতে আপনার কষ্ট হয়।
আপনি ঘুমিয়ে পড়েন। অথচ আপনি  বিশ্বাস করেন
স্বপ্নের মধ্যে কখনো ঘুমতে হয় না। মার্গারেট আপনি ঘুমিয়ে আছেন।
একজন ঘড়ি মেকার আপনার ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে।

অথচ ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে আপনি ফেলে রেখে এসেছেন সময়। 




পাকস্থলীর ক্ষেত্রফল
শস্যখেতের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে অগণন মানুষ।
চালের দাম বেড়ে গেলে, তাদের মনোযোগ বাড়ে  স্ত্রী সমূহের প্রতি
তাদের মনে পড়ে যায়, মার্গারেট আপনার অনাবিষ্কৃত অন্তর্বাসে লুকিয়ে আছে প্রাচীন খাদ্যনালী;

একে অন্যের কাছে তারা বয়ান করে নিজ নিজ পাকস্থলীর ক্ষেত্রফল।
আধ খাওয়া ফলের বিমর্ষতায় ধানের ছড়া নিয়ে তারা দৌড়ে বেড়ায় আপনার তলপেটে।
এই দৃশ্যে ধানক্ষেত থেকে ফিরে আসে কৃষকের সামর্থ্য হাতগুলো,
যার ব'খে যাওয়া আঙুলে খোদাই করা আছে ফসলের প্রকারভেদ

অথবা আপনার স্তনের বোঁটা থেকে চুইয়ে পড়া চাল ধোয়া জলের দাগ।

কেউ ভাতের অভাবে, স্তনের ক্ষেত্রফল লিখে রাখে,
কেউ একা একা পড়ে ফেলে আত্মহত্যার নিয়মাবলী।




ভগবানের চর
ঘুম ভাঙার শব্দে অন্ধকার শিবির থেকে ফিরে আসো। তুমি মৃত্যুদিন, মায়ের আত্মহত্যা। দ্যাখো শিশুটিও কেঁদে ওঠে ক্ষুধার যন্ত্রণায়।
ক্ষুধার্তের কাছে ঈশ্বরের ডাকনাম একটুকরো শুঁকনো রুটি।

ভ্রান্ত ছায়ায় অঙ্কুরিত হয় মায়ের কোল। যেখানে দীর্ঘকাল হাঁটতে হাঁটতে মানুষ পথ হয়ে যায়।

মায়ের আঁচলের চেয়ে প্রবল ক্ষুধার স্রোত ভেঙে মায়ের কবরে নামাজ পড়ছেন ভগবান। অথচ জায়নামাজের পাশে ভাতের থালা রেখে মা তবু অপেক্ষায় থাকেন; যেন অসংখ্য ক্ষুধার মাঝে জায়মান হচ্ছে
একটুকরো ভগবান।





No comments:

Post a Comment