31 December 2017

পালা সুন্দরী—শাহরিয়ার কাসেম




বড্ড অলস কাটছে রাতুলের। সবে মাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে বেশ অবসর। পড়াশুনার নেই খুব চাপ। বাবামাও বলে না কোন কাজ করতে। উদাসী হয়ে রাত দিন পাড় করছে। যদিও রাতুলের অবাদে ঘোরাঘুরির খুব অভ্যাস নেই তবুও ইদানিং বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এখন রাতবিরেতে রুটিন ছাড়া বাড়ি ফিরে। বকুল, জসিম, শুভ ও জয়নাল রাতুলের খুব কাছের বন্ধু। তাঁরা রাতুলের মত এত ভাল ছাত্র নয়। তবে দুষ্টুমির জন্য রাতুলের চেয়ে ঢের বেশি। ইদানিং তাঁদের সাথে বেশী সঙ্গ দেয়ায় রাতুলও বেশ দুষ্ট হয়ে উঠছে।

পশ্চাদময় গ্রাম শেরপুর। এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছেনি। শহর থেকে অনেক দূর এই গ্রাম। খেটে খাওয়া মানুষ এ গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের সব ঋতুই উপস্থিত হয় সময়ে সময়ে। লঙ্গন নদী শেরপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। শাফলার বিলও এক পাশে। অন্য পাশে বিশাল ভরা ফসলি মাঠ।
এই গ্রামে আছে একটি জমিদার বাড়ি। আগের মত এখন আর নেই এই বাড়ির জৌলুস। নেই বাড়ির যত্ন।
কারণ এই বাড়িতে এখন আর কেউ থাকেনা। পৈত্রিক সূত্রে এখন যিনি মালিক তিনি থাকেন শহুরে তাঁর একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউবাচ্চার সাথে। তিনি এ গ্রামে নিয়মিত আসে না। তবে মাঝে মাঝে আসেন।

আগে নাকি জমিদার পুত্র গ্রামে আসলে তার জলসাখানায় গানের আসর হত। এ আসরে গ্রামের সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যাকে পালাগান বলে। তবে কখনো রাতুল পালাগান দেখেনি। লোক মুখে শুনেছে বহুবার। রাতুলের খুব ইচ্ছা এবার যদি জমিদার গ্রামে আসে আর তিনি যদি পালাগানের আসন দেন তাহলে রাতুল রাতভর পালাগান শুনবে।

কি কারণে জমিদার পুত্র গ্রামে আসলেন। এবং সাথে করে তিনি তাঁর আদরের নাতনিকে নিয়ে এলেন। জমিদার আসার সময় থেকেই এ বাড়ি প্রতিটি রুমে রুমে আলো জ্বলে। আর নাহলে এ বিশাল বাড়ি যেন ভূতের বাসঘর। রাতুল আর তার সহপাঠীরা জমিদার বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন দেখল জমিদার বাড়িতে লোকজনের সমাগম। কোণায় কোণায় আলোর রশ্মি। রাতুলরা ভাবল মনে হয় জমিদার বাড়িতে এসেছে।

জমিদার বাড়িতে আছে আর পালাগান হবেনা তা কি করে হয়। আজ রাতেই জমিদার বাড়ির চেলাচামুণ্ডারা গানের ব্যাবস্থা করল। গ্রামে ঢুল পিঠিয়ে জানান দিল আজ জমিদার বাড়িতে পালাগান হবে। এ খবর রাতুলের কানে পৌঁছতেই খুশির আহ্লাদে আটখানা। রাতুলের মনে হয় আজ পালাগান দেখার শখ মিটবে এবার।

পালাগান সম্পর্কে জানেনা রাতুল। লোকমুখে যা শুনেছে তাই। পালাগানে প্রধানত পাঁচটি পর্ব থাকে। টপ্পা, গুরু বন্দনা, পাঁচালী, মুখ ছড়া আর জুড়ির পালা, মানে শিল্পী ও প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পীর পাল্লা। পালাগান বিশুদ্ধ গানই। কিন্তু কেবল সুরের গান নয়। প্রচুর জ্ঞানের কথা নিয়ে বাগ বিস্তার করতে হয় এ গানে। অর্থাৎ এখানে গায়ককে কেবল গায়ক হলেই চলবে না। তাকে জীবন-জিজ্ঞাসায় দীর্ণ হতে হবে। গানের সঙ্গে থাকবে নাচ। তবে এ নাচ মানে এমনি এমনি অঙ্গভঙ্গি করা নয় কেবল। ভাব প্রকাশের একটা মাধ্যম হয়ে উঠতে হবে ঐ অঙ্গভঙ্গিকে। তবে পালাগানের সময় যে নাচনেওয়ালী থাকে তার বয়স খুব বেশী হয়না। যেমন দশ থেকে চৌদ্দ বছরের। এখন অার এ বয়সের মেয়ে না পাওয়ায় পনের থেকে বিশ বা বাইশ বছরের মেয়েদের দিয়ে নাচ করানো হয়।

আগে অবশ্য মানুষজন নাচনেওয়ালীর নাচ দেখে গানের কাহিনী বুঝত। এখন তো কিছু লোক পালাগানের নামে নাচই উপভোগ করে। যেমন রাতুলের বন্ধুরা তো দশ গ্রাম ঘুরে পালাগানে যায় নাচনেওয়ালীর নাচ দেখতে।

পালাগানের শিল্পীর দলবলকে জলসায় আনা হল। আর জমিদার পুত্র আর তাঁর নাতনি আসন পেতে বসল। আস্তে আস্তে জলসাখানা কানায় কানায় পূর্ণ হল গ্রামের মানুষ। পরক্ষণই শুরু হবে পালাগান।
খুব সেজেগুজে রাতুল আর তার বন্ধুরা আসল জমিদার বাড়িতে। অনেক মানুষের সমাগম আজ এ বাড়িতে। মানুষ ভেদ করে রাতুলরা আসরের খুব কাছে বসল। অনেক আনন্দ নিয়ে রাতুল মনযোগী হয়ে গানের অপেক্ষায় রইল।

পালাগান শুরু হল গুরু বন্দনা দিয়ে। কিন্তু রাতুলের একটুও পছন্দ হলনা। তবুও পরের জনের গানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল রাতুল। ভাবছে পরের গান হয়ত ভাল লাগবে।

ঘাড় ফিরিয়ে যখন অন্য পাশে রাতুল তাকাল তখনই অন্য মনস্ক হয়ে গেল রাতুল। জমিদার পুত্রের নাতনিকে দেখে পুরো মাথায় আউলা হয়ে গেল। রাতুল ভাবছে ঐ মেয়েটা হয়ত নাচনেওয়ালী। রাতুল জানেনা মেয়েটা জমিদার পুত্রের নাতনি।
রাতুল বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে তাকে। রাতুলের আর পালাগানে মনযোগ নেই। রাতুল ভাবে কবে এ মেয়ে পালাক্রমে নাচবে। ঘুরে ফিরে দু'তিন জনের নাচে রাতুল সন্তুষ্টি নয় রাতুল।

পালাগানের নাচনেওয়ালীরা এত সুন্দর হয় রাতুলের আগে জানা ছিল না। যদি সে জানত তাহলে আশপাশের একটাও পালাগান দেখা বাঁধ দিত না। আজকের জমিদার বাড়ির পালা সুন্দরীর রূপে মশগুল রাতুল। পালা পরে পালা শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু রাতুলের সেই আকাঙ্খিত পালা সুন্দরী আর মঞ্চে এসে নাচছে না।

অপ্রয়োজনেই যখন হাতে ঘড়ির দিকে তাকাল তখন দেখল রাত প্রায় ভোরের  অপেক্ষায়। আর রাতুল অপেক্ষায় পালা সুন্দরীর নাচনের অপেক্ষায়। কিন্তু সে তো নাচছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই জমিদার পুত্র পালাগানের সমাপ্তি ঘোষণা করল।

গোমড়ো মুখে বাড়ি ফিরল রাতুল। এক দুপুর ঘুমিয়ে রাতুল বিকেলে গেলে বন্ধুদের কাছে। এবং বকুলকে জিজ্ঞেস করল...
     - কিরে পালাগান ক'দিন হয়?
     - কেন তুই জানিস না?
     - জানলে কি বলতাম
     - পালাগান এ যাবত এক রাতই শুনছি। তবে   অনুষ্ঠান অনুযায়ী আরো বেশীও হতে পারে।
     - আজ কি জমিদার বাড়িতে অাবার গান হবে?
     - হা হা হা
     - হাসার কি হল?
     - জমিদার পুত্র আজই শহুরে চলে যাবে
     - তো আরেকজন শিল্পীর যে নাচ বাকী রইল?
     - কোন শিল্পীর?
     - আরে জমিদার পুত্রের পাশে যে বসা পালা সুন্দরীটা ছিল তাঁর?
     - হা হা হা
     - ভূতের মত আবার হাসিলে কেন?
     - তোর কথা কথা শুনে
     - মানে?
     - জমিদার পুত্রের কাছে যে বসা ছিল, সে পালা সুন্দরী নয়। সে হল জমিদার পুত্রের একমাত্র আদরের নাতনি।

পালাগানের প্রতি যে রকম মোহ ছিল রাতুলের। বকুলের কথা শুনে মুহূর্তেই ফিকে হয়ে গেল। রাতুল ভাবছিল ঐ পালা সুন্দরীর নাচ দেখে একটু মোহিত হবে। তা না হয়ে বরং হলো উল্টো।



No comments:

Post a Comment