08 October 2016

সুজয় চক্রবর্তী






আমার ভাই আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। আমার ত্রিশ ওর সাতাশ। বয়সটা বলা কেন,ঐ বয়সেই ও ওর প্রায় সব লক্ষ পূরণ করে ফেলেছে। শেয়ার মার্কেটে কাজ জুটিয়েছে, মলি'র বোন পলিকে পটিয়ে ফেলেছে, একটা পালসারও কিনে ফেলেছে। মোটামুটি ওর যা ইচ্ছে ছিল করে ফেলেছে। আমি এখনও কিছু করে উঠতে পারিনি। ভ্যারেন্ডা বাজাচ্ছি। আর হাত খরচের জন্য হাত পাতছি বাড়িতে।
বন্ধুরা কেউ কেউ প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে ঢুকে পড়ছিল আমার চোখের সামনে দিয়ে। ওদের দেখাদেখি আমিও গিয়েছিলাম কয়েকবার। সবই মার্কেটিং। ভালো লাগেনি। ফিরে এসেছি।
মা কিছু না বললেও বাবা আমাকে বলতে ছাড়ে না।কখনও বলে,"তোর তিন বছরের ছোট ভাই গাড়ি কিনে ফেললো,আর তুই এখনও হাত পাতছিস!তোর দ্বারা কিস্যু হবে না।"
আবার কখনও,"তুই তো বাড়ির থেকেই বেরোলি না, আর দেখ্, সাধন সারা দুনিয়া চষে ফেললো,কত লোক ওকে চেনে বলতো।"
মানে আমি যে একটা অকালকুষ্মাণ্ড তৈরি হয়েছি, তা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় বাবা। এটা প্রায়ই ঘটে।তখনই মাথাটা গরম হয়ে যায়। বাবুর চায়ের দোকানে চলে আসি। বেকার ছেলেদের। আত্মমর্যাদা বেশি। একটার পর একটা বিড়ি টানি,আর ভাবি,এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো কবে! আমাকে সাধনের মতো কি কেউ চিনবে না!ভেতরে ভেতরে একটা জেদ কাজ করে। নিজেই নিজেকে সাহস যোগাই,চিনবে,চিনবে, আমাকে স্বনামেই চিনবে লোকে। তখন দেখিয়ে দেবো আমি পারি কি না।
এই সময় আমার দীপান্বিতাকে মনে পড়ে। আমাদের তিনটে বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। ওকে আমার বেশ লাগে। স্বপ্নেও ওকে দেখেছি দু-একবার। সেদিন গুলোতে সকালে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল।খুব সাবধানে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একছুটে বাথরুমে চলে গিয়েছিলাম। যেটা হয় আর কি। ও যখন বিকেলের দিকে বাবুর চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে পাস করে, ওকে দেখলেই আমার বুক ঢিপঢিপ করে। ব্যস্, ঐ পর্যন্তই। আর বেশি দূর এগোতে পারি না। আসলে বরাবরের মুখচোরা আমি। বেকার-জ্বালা ভুলিয়ে দেয় প্রেমিকারা। এসব শুনেছি। অন্য বন্ধুদের সে সুযোগ হয়েছে। আমার হয়নি। আগে নিজের পায়ে দাঁড়াই, নিজের একটা পরিচয় তৈরি হোক,তারপর দীপান্বিতাকে পাড়বো কথাটা,এই রকম ভেবে রেখেছি।
আমার কাছে খবরের কাগজ পড়া মানে, কর্মখালির পাতা দেখা। সবাই জানে। চাকরির চেষ্টাতেই থাকি সবসময়। যেমন কালকে একটা ইন্টারভিউ ছিল।
-আপনার ছবির সাথে কিন্তু আপনার মুখ মিলছে না!ব্লেজার পরা ভদ্রলোকের কথায় সামনের চেয়ারে বসা তিনজনই তখন আমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে।
মনে পড়ে গেলো যতীনদা'র কথাটা। যতীন দা গেলবার এসএসসি দিয়ে মুর্শিদাবাদের একটা স্কুলে জয়েন করেছে। সাতবারের বার। দু'বার পার্সোনালিটি টেস্টে ডাক পেয়েও চাকরি বাগাতে পারেনি, কিন্তু হাল ছাড়েনি। আমরা তো জানি। কম খাটেনি। শেষে আটত্রিশের কোটায় গিয়ে চাকরিটা হল।তাই পার্সোনালিটি টেস্টে ডাক পেয়েই যতীনদা'র কাছে ছুটেছিলাম। ঐ-ই তখন বলেছিল,"ওরা কিন্তু নানাভাবে তোর ধৈর্যের পরীক্ষা নেবে মিন্টু, রেগে গেলে চলবে না,মুখে সবসময় একটা মোনালিসা-স্মাইল রেখে দিবি।"
মৃদু হেসে বললাম,"স্যার,ওটা আমারই ফটো, চশমা ছাড়া।"
-কিন্তু আপনার তো চশমা আছে, চশমা ছাড়া ফটো তুলতে গেলেন কেন? 
-আসলে আমাদের পাড়ার স্টুডিও থেকে তোলা। চশমাতে ফ্লাশ পড়ে ছবি ভালো আসছিল না বলে ক্যামেরাম্যান চশমাটা খুলে দিতে বলেন, আমি তখন অতটা বুঝিনি।
-বোঝেননি মানে, এটা তো আপনার মুখই নয়!রীতিমতো সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তার।
পাশের জনকে ফটোটা দেখালেন উনি। ওনারও দেখলাম ইশারায় সেই একই ভাব প্রকাশ পেল।
কেমন যেন ক্যাবলা ক্যাবলা মনে হল নিজেকে। রাগ হচ্ছিল টুকাইয়ের দাদাটার উপরে। স্টুডিওতে খুব একটা বসে-টসে না। আর বসবি বস, সেদিনই, যেদিন আমার ফটো তোলার দরকার হল! নিজে তো কোনও দিনও কোনও ইন্টারভিউতে গেছে বলে মনে হয় না। এদিকে সবজান্তা ভাব দেখালো সেদিন। যখন বললাম,"আমি তো আজ পর্যন্ত চশমা পরেই ফটো তুলেছি সব জায়গায়...তুমি চেষ্টা করে দেখো না, যদি তোলা যায়। আসলে ইন্টারভিউতে লাগবে ফটোগুলো। "আরে, ফটোতে চোখ অস্পষ্ট আসলে অসুবিধা আছে। বাদ পড়ে যাবি। দেখিস না,মোবাইলে কানেকশনের জন্য ফটো দিতে হলে, কোম্পানী চশমা ছাড়া ফটো দিতে বলে!"
ওর দায়সারা গোছের উত্তরও তখন আমাকে চুপ করিয়ে দেয়। মনে হয় ঐ ঠিক বলছে। টুকাই যদিও প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। কিন্তু ওর দাদা যে সেসব কিছুই জানে না, জানতাম। কিন্তু তখন সেসব মাথায় আসেনি। ওর কথা শুনতে গিয়েই এখন আমার এই বিপত্তি! এতদূর এসে এই এক ফটোর জন্য বাদ পড়ে যাবো! সমস্ত খাটাখাটনি জলে যাবে! নিজেকে খুব অসহায় মনে হল।
-স্যার, যদি বলেন তো আমি চশমাটা খুলে দেখাতে পারি।
এরাই এখন আমার ভগবান। তাই কাকুতি-মিনতির স্বর আমার গলায় স্পষ্ট। একজন দেখলাম একটু নরম মনের। তিনিই বললেন, ‍“ঠিক আছে, আপনি চশমাটা খুলুন
ওনার কথায় বেশ বল পেলাম। এবার সব সন্দেহের অবসান হবে। চশমাটা খুলে
দেখো তো আমারে চিনিতে পারো কিনা এমন ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
-না, এ ছবি আপনার নয়।
এ কেমন ব্যাপার! মুখটা আমার। এই মুখেরই যে ছবি তোলা হয়েছে, সেটা আমার নয়! বললাম,"স্যার, কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল হচ্ছে না।
যতীনদার কথাটা আর মাথায় নেই। অত মোনালিসা মার্কা হাসি আর এলো না। 
চোখ কটমট করে ব্লেজার গায়ের সেই ভদ্রলোক আমাকে বললেন,"আপনি এখন আসতে পারেন।" অগত্যা ফাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটা শুষ্ক হাসি মুখে রেখে তিনজনের দিকেই তাকিয়ে হাত দুটো প্রণামের ভঙ্গিতে জড়ো করে বললাম," নমস্কার।"

চলে আসার সময় পেছনের দিকে আর তাকায়নি। এটা যতীন দা বলেছিল। ফলাফল কি হবে জানি না। জ্যোতিষীরা নাকি বলতে পারে। তবে এই মূহুর্তে আমার কাছে বড়ো জ্যোতিষী যতীন দা।
এর আগে কল্যাণী ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরী অ্যাটেনডেন্ট পোস্টের ইন্টারভিউতে আশানুরূপ ফল করতে পারিনি। তাই বাড়ি ফিরতেই সবারই এক প্রশ্ন। কিন্তু একেকজন একেক ভঙ্গিতে। 
মা বললো,"কি বাবা, ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে?"
ভাই বলল,"ওরা যা জিজ্ঞেস করেছিল,সব ঠিকঠাক বলেছিস তো?"
বাবা বললো,"যতীনের কথাগুলো মনে ছিল তো?"
বোন বললো,"হ্যারে দাদা,তিনজনকেই কি খুশি খুশি দেখালো?"এতোটা হেজিয়ে গিয়েছিলাম যে ওদের প্রশ্নগুলোর আলাদা করে উত্তর দিতে ভালো লাগছিল না। সবাইকে একই উত্তর দিয়েছি-হ্যাঁ।
ফাইল থেকে সার্টিফিকেটগুলো বার করে আলমারিতে রেখে দিলাম। ফাইলটা সন্তুর। চকলেট কালারের। ওরকম ফাইল দোকানে খোঁজ করেও পাইনি। শেষে চেয়ে নিয়েছিলাম। ওটা দিতে হবে। জামাটা হ্যাঙারে রেখে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখলাম, কোনও দাগ লেগেছে কিনা। কেননা জামাটা বাপ্পার। ওরকম ঘিয়ে রঙের জামা আমার ছিল না। বাপ্পার কাছ থেকে ধার করেছিলাম। ওটা দিতে হবে। বেল্টটা খুলে রাখলাম। ওটা যতীনদা'র। প্যান্টটাও যতীনদা'র। ওরকম দুদিকে প্লেট দেওয়া প্যান্ট আমার নেই। বেশিরভাগই জিন্স। কিন্তু বাংলার মাস্টারের ড্রেস তো একটু ঢিলেঢালাই হবে! তাই পড়েছিলাম। ওটা দিতে হবে। চশমাটা টেবিলে রাখলাম। ওটা কাউকে দেওয়ার নেই। ওটা আমার। সেই ক্লাস নাইন থেকে চশমা নাকে আমার। টেস্টে রেজাল্ট ভালো হল বলে সত্যব্রত স্যার বললেন,"কয়েকজন রীতিমত খাটছে বুঝতে পারছি। চশমা তারই লক্ষণ। এবার আমাদের স্কুলে ছ থেকে সাতটা স্টার বাঁধা।" না,আমি আর স্টার পাইনি। তবে বাবা বলতো,"হায়ার ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে ছেলে।"
আমি শুধু যতীনদাকে দেখতাম। ও মেরেকেটে ফার্স্ট ডিভিশনটা উতরে গিয়েছিল। ঐ রেজাল্টেই শেষে লক্ষে পৌঁছতে পেরেছে! চেষ্টা দরকার। শুধু ভাগ্য না। ভাগ্য যোগ চেষ্টা ইকুয়াল টু ফল। যতীনদা বলে। চেষ্টা থাকলে অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছানো শুধু সময়ের অপেক্ষা। ফ্রেশ হয়ে বাড়ির বাইরে পা দিলাম।
-জীবন কুন্ডুর মিষ্টির দোকান থেকে একটু সন্দেশ এনে দিস তো, বুড়ো। বলবি, ঠাকুরের জন্য।
পয়সাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ছেলেটা মায়ের কথায় ঘাড় নেড়েই ধা হয়ে গেল। আমি ওর পেছন পেছনই আসছিলাম। গলির মোড়ে পা রাখতেই ওর টিকিটির আর দেখা পেলাম না।
জীবন কুন্ডু আমার বাবার নাম। কুন্ডু মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক। খুব বেশি বড়ো না। ছোটখাটো মিষ্টির দোকান আমাদের। বাজারে। নামটা শুনলেই বোঝা যাচ্ছে আমাদের জাতিগত পেশা এটা না। ক্লাস নাইনে যখন পড়ি, রাজুর সঙ্গে কি নিয়ে যেন মারপিট বেঁধে ছিল। ও আমাকে বলেছিল,"এই ময়রার ছেলে, তোর কপালে দু:খ আছে।" ময়রার ছেলে কথাটা শুনতে খুব খারাপ লেগেছিল। বাবাকে এসে বলেছিলাম তা। বাবা বলেছিল,"মুখার্জির ছোট ছেলেটা বিউটি পার্লারে কাজ করে। মানে লোকের দাড়ি চাঁচে। ওরা নাপিত না। শেখরদের জুয়েলার্সের দোকান। ওদের টাইটেল দত্ত। ওরা কর্মকার না। তাই জীবন কুন্ডু ঘোষ না হয়েও যদি মিষ্টির দোকান দেয়, তাতে কার কোথায় চুলকাচ্ছে!" 

চুপ করে গিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, দাদু মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল কাঁধে এসে পড়েছিল বাবার। ঠাম্মা, মেজপিসি, ছোটকাকা, সবাই তখন বাবার মুখের দিকে চেয়ে। সেই সময়ের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান 'ঘোষ মহাশয়ে' কর্মচারী হিসেবে ঢুকেছিল বাবা। পনেরো বছর কাজ করার পর মিষ্টির বিভিন্ন আইটেম শিখে ফেলেছিল। তারপর অনেক কষ্টে দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে এই মিষ্টির দোকান খুলেছিল বাবা। বাবাকে এলাকায় প্রায় সবাই চেনে। বাবার নামেই চেনে আমাদের দুইভাইকে। জীবন কুন্ডুর বড়ো ছেলে আমি। কিন্তু আমি চাই, আমারও একটা নিজের পরিচয় হোক। যেমন যতীনদা। যতীনদাকে এখন সবাই চেনে! ওর বাবার নাম বাদল সরকার। এলাকায় বাদল সরকারকেই সবাই যতীনের বাবা বলে চেনে। জানি না আমার ক্ষেত্রে সেটা কোনও দিনও হবে কিনা।
বাঙালি কাঁকড়ার জাত। কথাটা এমনি কেউ বলে না। একেবারে ঠিক। যে নিজে কোনও চাকরিই আজ পর্যন্ত বাগাতে পারলো না, সে কি আর আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেবে! স্রেফ এই জন্যই দিল না টুকাইয়ের দাদাটা। হিংসা, হিংসা। একটা বেকার ছেলে তার নিজস্ব পরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এটা সহ্য হল না!
যতীনদার সাথে আমার দেখা হওয়া খুব প্রয়োজন। আর কেউ বুঝবে না, ইন্টারভিউ থেকে খালি হাতে ফিরে এলে ক্যান্ডিডেটের মানসিক অবস্থা কেমন থাকে। উলটে তারা জ্ঞান দেবে। এই তো পিন্টু, আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড, যদিও ওর স্ট্রিম আলাদা। পরীক্ষায় বসার আগে আমাকে কতোবার বলেছিল, "শোন বোধন, কর্মক্ষেত্র, কর্মসংস্থান পড়লেই লোকে চাকরি পায় না। এরজন্য পার্টির থ্রু আর ব্যাকিং লাগে, বুঝলি!"বোধন আমার স্কুলের নাম। পাড়ায় সবাই ডাকে মিন্টু। পিন্টুর কথায় সায় দিই নি। ও দুটোই যাদের নেই, তারা কি রাস্তায় খালি ভ্যা ভ্যা করে ঘুরে বেড়াবে! চেয়ারটার যোগ্য দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও আরেকজন এসে থপ্ করে বসে পড়বে সেই চেয়ারে! মামদোবাজি! তবে কথাটা শুনে একটু ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে দিইনি। বলেছিলাম,"দেখা যাক।"তাই আর কাউকে না যতীনদাকেই আমার দরকার।
যতীনদার বাড়ি পৌঁছতেই ওর মা বললো,"যতীন তো শনিবার আসবে, মিন্টু। বলো তোমার চাকরির পরীক্ষা কেমন হল?"
-ভালো হয়েছে মাসিমা। আপনি ভালো আছেন তো? আচ্ছা আমি না হয় পরে আসবো।এক প্রকার পালিয়েই চলে এসেছি যতীনদার বাড়ি থেকে। মাথার ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল। আমারই ভুল। যতীনদা সপ্তাহে একবার বাড়ি আসে জানতাম। কিন্তু মনে ছিল না।
মন্ডলের বুথ থেকে যতীনদার নাম্বারে কল করলাম।
-হ্যাঁ ভাই,বলো। কেমন হল ইন্টারভিউ?
-বুঝতে পারলাম না দাদা। এই বলে ওকে টেলিফোনেই বিস্তারিত জানালাম। 
-ও,এই। আর সব উত্তর তো দিয়েছো, দেখো। তবে ভেঙে পড়ো না।
-কি মনে হল, হবে মনে হয়?
-বলছি তো,আশা রাখো। আমি শনিবার যাচ্ছি। তখন দেখা হবে।
ফোন রাখতেই দেখলাম বারোটা কল হয়ে গিয়েছে! মানে বারো টাকা! আর চাওয়া যাবে না মা'র কাছ থেকে। বাবার কাছ থেকে ইদানীং পয়সা চাইতে বেশ লজ্জা করতো। অগত্যা মা। দুটো টিউশানি করি। কিন্তু তিন মাস পর এক মাসের টাকা পায়। সৌরভ আর দীপুকে পড়ায়। দুই ভাই। তবে স্বভাবে না, অভাবে দিতে পারে না ওরা। আর আমারও না দিলে নিজের থেকে তাগাদা করতে ইচ্ছে করে না। দেখিই তো সামনে ওদের সংসারের যা অবস্থা!
বারো টাকা গুনে মন্ডলের হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলাম।


_২_
ইন্টারভিউয়ের ফল কি হবে, সে আশা ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। তবে হাল ছাড়িনি। পরের বারের জন্য প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছি। চাকরি আমার একটা চাই। সবই ঐ যতীনদার কথায়। ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। মানুষটাকে এত ভালো লাগে যে, ওর আদবকায়দা, হাঁটাচলাও নকল করতে শুরু করে দিয়েছি আমি! একজন টিচারের মনে হয় এইভাবেই হেঁটে যাওয়া উচিত। আর কতো ধৈর্য লোকটার! একেবারে আটত্রিশে এসে চাকরিটা পেল!কি না করেছে। ছাত্র পড়িয়েছে, বাজারের বুকস্টল গুলোতে কলেজস্ট্রিট থেকে বই এনে দিয়েছে, শেষে একটা কুরিয়ার সংস্থার এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছে। লোকটাকে দেখলে মনে এমনিই জোর চলে আসে। ভক্তিও।
-দাদা, একটা রেষ্ট্রি চিঠি এসছে তোর নামে।
পম্পার গলা না? কথাটা কানে যেতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। পিওন আমাদের চেনাশোনা,রিয়ার বাবা। বললো, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। আমাদের মিষ্টির দোকান। বাড়িতেও মিষ্টি তৈরি হয়। তাই খাওয়ানোটা এমন কিছু ব্যাপার না। কিন্তু হঠাৎ মিষ্টি!উনি যে খামটা আমাকে বের করে দিলেন, তার ওপরে ক্যাপিটাল লেটারে স্পষ্ট লেখা দেখলাম " সেন্ট্রাল স্কুল সার্ভিস কমিশন"।চমকে গেলাম। সই করেই খামটা খুললাম। ঠিক যা ভেবেছি, তাই। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার! হ্যাঁ, আমার।
বাড়িতে খবরটা জানিয়েই সোজা চলে গেলাম মন্ডলের টেলিফোন বুথে। ফোন করলাম যতীনদাকে। ও তো শুনে খুব খুশি। বলেই দিলো, তালে,বোধন মাস্টার কেমন লাগছে?"
-খুব ভালো যতীনদা। তোমাকে আমার প্রণাম। বাড়ি এসো। দেখা করবো।
ফোনটা রাখলাম। যতীনদার কথায়ই ঠিক। আমাকে হেজিয়েছে ওরা। আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিল তখন! এবার বাড়ির সবাই খুশি। আমার মনে হচ্ছে একটা যুদ্ধ জয় করতে পেরেছি আমি।
একই সঙ্গে নিজেকে খুব অপরাধীও মনে হচ্ছে। টুকাইয়ের দাদাটাকে খামোখা দোষ দিয়েছি। কোনও ভুলই তো করেনি বেচারা! ওকেও সরি বলতে হবে। কিন্তু সে তো কিছুই জানে না এ ব্যাপারে। তার চেয়ে থাক, অপ্রিয় সত্য না বলাই ভালো। তবে ওকে মিষ্টি খাইয়ে আসতে হবে, নইলে শান্তি পাবো না।
আমি এখন তারাপদ সাঁতরা উচ্চবিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক, বোধন কুন্ডু। আমার এখন একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে। বোধন মাস্টার।গ্রামের স্কুল।এখানে টিচারদের 'স্যার' না, মাস্টার বলে। মাস্টারমশাই। স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। ওদের চোখে অনেক স্বপ্ন।
মাসের প্রথম মাইনে পেয়ে সবার জন্যই কিছু না কিছু কিনে নিয়ে গেলাম বাড়িতে। বাবাকে প্রণাম করে বললাম, " আমার দ্বারা কিছু হল তাহলে!...এখন শুধু জীবন কুন্ডু'র বড়ো ছেলে না, বোধন কুন্ডু নামেও অনেকে চেনে আমাকে। কি বলো?" 
বাবা কিছু বললো না। হাসলো শুধু।
'চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো' এটা বলার সময়টুকু দিল না দীপান্বিতা। ঝটপট বিয়ে হয়ে গেল এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের সাথে। মন একটু খারাপ হয়েছিল, ওটা সিগারেটে পুষিয়ে দিয়েছি। আমি এখন মৌলির বর। মৌলি আমার এক মাসতুতো দিদির দু:সম্পর্কের ননদ হয়। সম্বন্ধটা ঐ মাসতুতো দিদিই দিয়েছিল।দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর দিব্যি কাটিয়ে দিলাম এই মফস্বলে, কেষ্টপুরে।

চৈতালীদি বিএড করতে গেছে। ওরও বিষয় বাংলা। ও না আসা পর্যন্ত ওর জায়গায় একজন অস্থায়ী টিচার নেওয়া হবে। স্থানীয় সংবাদপত্রে সে বিষয়ে বিজ্ঞাপনও বেরিয়েছে মাস খানেক আগে। আজ প্রার্থী বাছাই পরীক্ষা হবে। মানে ইন্টার্ভিউ। জনা কুড়ি বেকার যুবক ফাইলপত্র হাতে নিয়ে এদিকওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ওরাও নিশ্চয় নিজের একটা পরিচয় চায়।
একটা অস্থায়ী পদে কুড়িজন! বেকারের সংখ্যা দিনকে দিন যে বাড়ছে, এটা তারই ইঙ্গিত। হেড মাস্টারমশাই আমাকে গতকালই বলেছিলেন তুমি সাবজেক্ট টিচার। আমরা ম্যানেজিং কমিটির তিনজন থাকবো। তুমিও থেকো। বাংলা বিষয়ের কিছু প্রশ্ন ক'রো।
ইন্টার্ভিউ শুরু হল।

শীতকাল। হেড মাস্টারমশাই বরাবরই ব্লেজার পরেন। আমিও আজ ব্লেজার পরে এসেছি। ক্যান্ডিডেটের পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ করছি। পোষাক-আশাক, তার কথাবার্তা, তার হাঁটাচলা, এমন কি ছবির সঙ্গে তার মুখের মিল আছে কি না!
একজনকে প্রশ্ন করলাম,"প্রত্যয় আর উপসর্গ দুটোই শব্দ তৈরি করলেও এদের মূল পার্থক্যটা কোথায় বলুন তো ?
ছেলেটা ভাবছে। ছেলেটার পরনে একটা ঢিলেঢালা প্যান্ট। খুব ছোট করে ছাঁটা চুল।
-অতো সময় দেওয়া যাবে না।
ছেলেটা দেখি ঘামছে। মুখটা বেশ মলিন। খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। হয় তো কালকে সারারাত ঘুমাইনি ও। বুঝতে পারছি, চাকরিটা ওর খুব দরকার। আরও দুটো প্রশ্নের পর হেড মাস্টারমশাই বললেন, "ঠিক আছে, এবার তুমি এসো।" খুব করুণ একটা চাউনি নিয়ে আমার দিকে তাকালো ছেলেটা। ও নিশ্চয় ভাবছে, আমি ওর ভগবান। এইভাবে চোদ্দজনের পর যে এলো তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেওয়া মানে যোগ্য সম্মানটুকু থেকে তাকে বঞ্চিত করা। চুলে পাকও ধরেছে কিছু। সাধারণ জামাকাপড়েও এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তার মার্কশিটে চোখ বোলাতেই চমকে উঠলাম। বিএ থেকে এমএ, সবেতেই ফার্স্ট ক্লাস। উচ্চমাধ্যমিকেও স্টার! এমন একজন লোক আজও বেকার বসে আছে!
 
-আপনার নাম?
-নিলয় সূত্রধর।
-আজ পর্যন্ত কোনও চাকরির পরীক্ষায় বসেন নি?
-বসেছিলাম স্যার অনেকবার কিন্তু হয়নি। আমার অনেক ছাত্রই আজ মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার,বড়ো অফিসার। 
-ও,টিউশানি করেন?
-যখন ইলেভেনে পড়ি তখনই মাধ্যমিকের ব্যাচ পড়িয়েছি,সেই থেকে শুরু। চলছে।
মনে পড়ে গেল সমরদার কথা। সমরদার কাছ থেকে কোচিং নিয়েই আজ আমরা'মাস্টার'। কিন্তু সমরদার আজও চাকরি হল না। ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হলেন না।
-এটা তো অস্থায়ী পদ, তারপর?
-তারপর কি, টিউশানি। একটা স্বপ্ন ছিল, স্কুলের চাকরি। ব্যস্।
ইন্টারভিউ শেষে হেড মাস্টারমশাইকে বললাম, "স্যার, ঐ নিলয় সূত্রধরকে চৈতালিদির জায়গায়....। "আমাকে থামিয়ে দিয়ে স্যার বললেন,"আরে, ওসব রাখো তো। এ নাও, চা খাও। ক্যান্ডিডেট আমাদের ঠিক করাই আছে। শিবুর লোক।"
ন্যাকা চৈতন্য কাউকে না। নিজেকেই বললাম কথাটা। যখনই জানা গেল ম্যানেজিং কমিটি থাকবে, তখনই তো বোঝা উচিত সেখানে ঘাপলা আছে। যোগ্যতা, যোগ্যতা। পৃথিবীতে সব কিছু যেন যোগ্য ব্যক্তিরাই ভোগ করছে! পলিটিক্স বোঝ' না! রাজনীতি! আর কথা না বলে চায়ে চুমুক দিলাম। একটা মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিল মন্টুদা। আমাদের গ্রুপ ডি স্টাফ। বুঝলাম, আমার 'কাজ' শেষ। ফর শো। আমাকে প্রথম ছেলেটি হয়তো ভেবেছিল 'ভগবান'। আমার অনেক ক্ষমতা। আমার এক কলমের আঁচড়ে ওর একটা পরিচ তৈরি হবে। হোক তা সাময়িক। সত্যিই ওকে ডেকে আনতে ইচ্ছে করছে। ও এসে দেখে যাক্ আমি এক ঠুঁটো জগন্নাথ। ছাপোষা 'মাস্টার'। আমার কোনও ক্ষমতাই নেই।
শিবু আমাদের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি। এলাকার শাসক দলের একজন ডাকাবুকো নেতা। সবাই ওকে চেনে। ওর লোক মানে পার্টির থ্রু, ব্যাকিং...
পিন্টু সেদিন তাহলে কথাটা খুব একটা খারাপ বলেনি!
পিন্টুকেও সরি' বললাম মনে মনে। পুজোর ছুটিতে তেভাগা এক্সপ্রেসে বাড়ি যাচ্ছি। স্কুল থেকে ফোন করে সন্তুকে বলেছিলাম, সন্তুই নেট থেকে টিকিটটা করে দিয়েছে। লোয়ার মিডল কোনটাই পায়নি। আপার। ট্রেন বর্ধমানে আসতেই চেকার উঠলো। 
-দেখি আপনার টিকিটটা। পার্স থেকে টিকিটটা বের করে দিলাম।
-আই কার্ড আছে তো?
-হ্যাঁ।
-বের করুন। বেশ রাগ হল। মাল'টা কি আমাকে বাংলা পার্টি মনে করেছে না কি! আবার পার্স থেকে ভোটার কার্ডটা বের করলাম। হাতে দিয়েছি কি দিইনি, ওনার দেখা সারা।
-ঠিক আছে। আসলে অনেকে....।
কথাটা পুরো না বলেই পাশের জনের কাছে আবার টিকিট চেয়ে বসলো লোকটা।হাতে তখনও ভোটার কার্ডটা ধরা। বোধন কুন্ডু। ফাদার্স নেম:জীবন কুন্ডু। ডেট অফ বার্থ...অত সহজ না। প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড সবেতেই খাতায় কলমে আমি এখনও জীবন কুন্ডুর ছেলে। এমন কি আমার সার্ভিস বুকেও জীবন কুন্ডু!
না,এতো স্লেট-জল-ন্যাকড়ার সম্পর্ক না। জন্ম দিয়েছে যে লোকটা, তাকে কি অত সহজে মুছে ফেলা যায়? আমার অজান্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কথাটা, 'সরি বাবা'।

 __________________________

No comments:

Post a Comment