22 August 2017

রাবেয়া রাহীম


মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর
আমার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রক্রিয়াগুলো
গভীর মমতায়-নিপুন হাতে-সুচারুভাবে শেষ করে
আমার বাবা তার বুকের সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
মায়ের পার্থিব শরীর আজ থেকে বিলীন হয়ে যাওয়া মেনে নিতে
বাবার কষ্ট কতটা তীব্র সেটা বুঝার বয়স আমার তখনও হয়নি
তবে তাঁর দুচোখ গড়িয়ে জলের ধারা
এখনও আমার কপালে- চোখে-মুখে লেগে আছে ।।  
আমার ছয় বছর বয়সে মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে
বাড়ি জুড়ে অতিথির কোলাহল আমার জন্য ছিল আনন্দ-উৎসব!!
বাবা তার হৃদয়ের ক্ষরণ গোপন করে আমাতেই সদা ব্যাস্ত 
তার কাছে করা ছেলেমানুষি বায়নার তালিকাটিও হতো বেশ দীর্ঘ
নামাজের কাতার, গির্জার ঘণ্টা, ভজন গাওয়া পুরুত  মিলেমিশে এক হয়ে যায়!!

বয়স বাড়ে;
অশরীরী মায়ের অস্পষ্ট ছবি ভেসে উঠে মানসপটে
এক গভীর রাতে, বৃষ্টি হয় খুব
অবিশ্রান্ত বৃষ্টির টুপটাপ--কুকুরের ডাক।
নাহ! এ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিলো না ।
হঠাত মায়ের সাথে দেখা--
কপালে কোমল করতলের স্পর্শ দিয়ে  ঘুম ভাঙ্গায়
অন্ধকারে স্পষ্ট আমার মা আর তার চোখ। 
নবভাঁজের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ধূসর অবয়বে
শাহাদাৎ আঙুলে ঠোট চেপে মা খিলখিলিয়ে উঠে
উচ্ছল এক কিশোরী যেন সে এই সময়ে 
ফিসফিস করে কিছু বলতে চায়।
অস্পষ্ট।
আমি কান পাতি।
আমার সাথে মলিন স্মৃতিস্তূপও চেয়ে থাকে,
দেখা হয় মায়ের সাথে--
অশরীরি মায়ের বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকি,
মাঝরাতে তখনও বৃষ্টি।

মায়ের অপেক্ষায় যে পথ শেষ হয়---সে পথে চেয়ে থাকি
পশ্চিম আকাশে গোধূলির লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রার্থনার জন্য  শ্রেষ্ঠ সময়।
কাঁদবারও।। 


আসছো কি
রাস্তায় দুপাশের গাছ গুলোয় ফুলের কুঁড়িতে অজানা কিছু গন্ধ
অনেক আগে রোজ তুমি পাশে থাকতে যখন
অদ্ভুত  মাদকতাময় এই সুগন্ধী ছেয়ে থাকতো
আর আমি বুক ভরে শ্বাস নিতাম---প্রেমে ডুবে যেতাম।
এমন সুন্দর গন্ধ অন্য আর কোন ফুলে খুঁজে পাইনা।
আজকে অনেক দিন পর এই গন্ধ আবার পেলাম
বুক ভরে তাজা ফুলের ঘ্রাণ নিলাম ---
তুমি আসছো কি?

বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবনের আড়ালের গল্পটিকে
মনের গহিনে চাপা দিয়ে এগিয়ে যাই,
খুব সাধারণ  একটা জীবন, পাশে তুমি--
খসড়া পাতায় অগোছালো কিছু পঙতিমালা
আর আলুথালু একটি সন্ধ্যা,
বিশ্বাস করো আর ঝগড়া করবো না---
আঁচলে জড়িয়ে নেবো সব ভুল গুলো 
হ্যারিকেনের অবুঝ ক্ষীণ আলোয়,
বয়ে যাবে আমাদের চিরশান্তির অফুরন্ত প্রহর
তারপর একদিন দুজনে বুড়ো-বুড়ি হব--
হালকা পাক ধরা চুল, সিগারেটে পোড়া ঠোঁট,
সাথে সেই ভীষণ চেনা দুর্বোধ্য চাহনি!
শীতের কুয়াশামাখা সকালে মিষ্টি রোদে
বারান্দার বেতের চেয়ারটায় হালকা ওম জড়ানো ছোঁয়ায়
তুমি চা খাবে-
আর আমি মায়াজালে বিভোর হয়ে বকবক করতেই থাকবো,
অনেক বছরের না বলা কথা জমা হয়ে থাকবে যে
তুমি মুচকি হেসে খসড়া পাতায় ব্যাস্ত ---
কি লিখছ? কতোটা লিখেছ...!!! ওমা তেমন কিছুই তো না,
ঝরে পড়া শিশিরের স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় লিখে দেব জমা থাকা এক জীবনের পূর্ণতা
চকচকে রোদের আলোয় দুজনের হাসি আলো ছড়াবে
ওটাই যে বুড়ো বুড়ির  না বলা প্রেম!! কেউ বুঝতে পারবেনা--
শুধু আমিই জেনে যাবো,
বহুদিন, বহুদিন ঘুম কেড়ে নেয়া শিরশিরে হাওয়া
কারণে অকারণে অপেক্ষায় ছল ছল চোখের জল শুকিয়ে
কতটা ভালোবাসা জমা করে রেখেছে শোকাতুর দুটি হৃদয়।। 


কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতে
এক কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতে---
ঘাসে ভরা সবুজ মাঠে শিমুলের তলে তোমাকে পেয়েছিলাম!
তোমার ওই উদোম বুক--জল কামড়ে নরম দু:খ,  
হৃদয়ে হৃদয় অবাক পরিচয়--জাপ্টে ধরা আলিঙ্গন!
আবেশ জড়ানো চোখে ফিসফিসিয়ে বলে উঠেছিলাম "ভালবাসি"
বাঁশির সুরে বেজে চলেছিল আমাদের একান্ত কথামালা;
যেন রাধার মিলন  কৃষ্ণের সাথে-
আমার ঠোঁটের পরে তোমার ঠোঁট !
উত্তপ্ত মরুতে  শুষে নিতে চেয়েছিলে সবটুকু লালারস
তোমাকে জড়াতে গিয়ে উথলানো দুধের মত বয়েই গেলাম শুধু 
আকণ্ঠ পান করেছিলাম দুজন  দুজনার অমৃত !!  
 
অশরীরী প্রেমে শরীরী করে তুমি এসেছিলে কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতে।
তুমি এসেছিলে ?
হ্যাঁ তুমি এসেছিলে !
তোমাকে আসতেই  হয়েছিল সেই নিষিদ্ধ রাতে !
আমাতে মাতাল হতে-
তোমাতে মিশিয়ে  নিতে !! 


বিশ্বাস হারাইনি
মহামান্য,
অপরাধ না শুনিয়ে দণ্ডবিধি ৩০২ ধারায়
শাস্তির রায় দেওয়া কি উচিত হয়েছে !!
বুকের মানচিত্রে আঁকা আছে যে চিহ্ন
অবারিত-গতিশীল এখন কেবলই স্তব্ধ।
আহত স্বপ্নগুলো সদ্য সমাহিত করে
স্তূপাকৃতি ছাইয়ের দিকে
বুভুক্ষুর মতো চেয়ে আছি;

প্রশ্নাতীত ভালোবাসার বিনিময়ে চাওয়ার ছিলো না কিছুই।
দুইশত ছয়খানা হাড় চিতায় সাজিয়ে
প্রজ্বলিত শিখায় ভালবাসার অর্থ খুঁজেছি
সার্কাসের সঙ হয়ে !!
শুনুন, বিশ্বাস হারাইনি আমি !!

No comments:

Post a Comment