রেণুবালার ব্যস্ত গলার দিনগুলিতে
সেই দিনগুলিতে আমি নবনির্মিত তিনশ ফিট রাস্তায় শার্টের সবচেয়ে উপরের বোতামটাও লাগিয়ে সময় কাটাতে যেতাম। বোতামটা লাগানো শুরু করি এই ভেবে, গলার ওই অংশটুকুর অনেক অপচয় করেছি।এর আগে বোতামটা খোলাই থাকত।
ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের ঢালে চা রেখে তাতে কুনুই পেতে ফোনে কথা বলছিল রেণুবালা। চায়ের কাপটা পিছলে পড়ে যাচ্ছে দেখে আমি ছুটে গিয়ে থামালাম। রেণু এজন্য আমাকে থ্যাংকস দিয়েছিল। আমি সে সময়ই তার সাথে প্রথম পরিচিত হলাম।
এরপর অনেকদিন বাদে হঠাৎ রেণুকে দেখলাম, একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। মাফলারে গলা ঢাকা তার। শীত পড়তে শুরু করায় মডেল হয়েছে সে মাফলারের। সুন্দর মানিয়েছে।
তারও কয়েক মাস পরে ফেসবুকে একটা ছবি ভাসল নিউজফিডে। ছবিটা রেণুর। সে উঁচু কলারের কামিজ পরেছে। গলা ঢাকা। খুব মানিয়েছে তাকে।
তারও কয়েক মাস বাদে একটা নাইট পার্টিতে রেণুকে দেখলাম বন্ধুদের সাথে নাচতেছে। তার মুখে ফেসপ্যাক লাগানো, চোখ দুটোতে দুখণ্ড শশা, মুখ উপরে তুলে চাতকের মতো তাকিয়ে, হাতে সন্তোষের গ্লাস। অতি ঘোরে এক বন্ধু তাকে আলিঙ্গন করতে চাইল, করলও। আরো অতি ঘোরে এবার যুবকটি রেণুবালাকে চুমো খেতে চাইল। কিন্তু রেণুর কিছুই খালি নাই, গালে- কপালে উপটান, ঠোঁটের ভেতর সাইডে পানীয়। এমনকি তার গলাও খালি নাই, উঁচু কলারের কামিজ পরিহিত সে।
আমার শার্টের সবচেয়ে উপরের বোতামটা লাগাতে শুরু করার পর থেকে রেণুবালার গলাটাও খুব ব্যস্ত!
সমুদ্রগামী
একবার এক কবি বন্ধুর সাক্ষাতকার নেওয়ার সময় তার শৈশবের কিছুটা ঘটনা আমাকে অবাক করেছিল।
তিনি খুব ছোটবেলায় ঘূর্ণীঝড়ের সময় দিনের বেলায় একটা থ্রিকোয়ার্টার পরে একহাতে একটা টর্চলাইট আর হাতে একটা রেডিও নিয়ে ফরফর বৃষ্টিতে ভিজতেন। মাথায় থাকত একটা ক্যাপ। রেডিওতে আবহাওয়ার সংবাদ শুনতেন আর হাঁটতেন। সমুদ্রে নয় নম্বর বিপদের দিনেই তিনি এই বেশে বের হতেন।
একবার এক কবি বন্ধুর সাক্ষাতকার নেওয়ার সময় তার শৈশবের কিছুটা ঘটনা আমাকে অবাক করেছিল।
তিনি খুব ছোটবেলায় ঘূর্ণীঝড়ের সময় দিনের বেলায় একটা থ্রিকোয়ার্টার পরে একহাতে একটা টর্চলাইট আর হাতে একটা রেডিও নিয়ে ফরফর বৃষ্টিতে ভিজতেন। মাথায় থাকত একটা ক্যাপ। রেডিওতে আবহাওয়ার সংবাদ শুনতেন আর হাঁটতেন। সমুদ্রে নয় নম্বর বিপদের দিনেই তিনি এই বেশে বের হতেন।
বন্ধুর এই আচরণ ছোটবেলার দরুন মোটেও উদ্ভট আর আজব নয়, বরং শৈশবেই মানুষের সব চলে।
অনেক দিন কবি বন্ধুর সঙ্গে দেখা নেই। মাঝেমধ্যে কথা হয়। শরতের শুভ্র আকাশ আর শাদা কাশফুলের মধ্যে কবি ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রসঙ্গ তোলার মত একটা ঘটনা এর মধ্যে ঘটে গেছে।
দিন কয় আগে বাসায় ফিরছিলাম। মধ্যরাতে একটা ওষুধের দোকানের সামনে এক লোককে শুয়ে তড়পাতে দেখলাম। কাছে গেলাম। লোকটার বয়স ষাটের বেশি হবে। দেখে মনে হলো সিকিউরিটি গার্ড, বাজার পাহারা দেয়। কিন্তু না, গার্ড একজন দায়িত্বরত দেখছি। ফুঁ দিচ্ছে পরপর, তার নিয়ম মতো। এ ব্যক্তি গার্ড না। তার কাছে বন্ধুর শৈশবের সব ইনস্ট্রুমেন্ট। গলা থেকে একটা টর্চ বাঁধা, বুকে পড়ে ঝুলছে, ক্যাপটা মাথার সাইডে।
এই শায়িত ব্যক্তির সাথে কথায় কথায় জানা গেল, তিনি অনেক অসুস্থ, তবুও প্রবল ঘূর্ণীঝড়ের অপেক্ষায় আছেন। ঝড়টা এলেই সমুদ্রে যাবেন। কোনোরকম দেরি না করেই। গহীন রাতে সাড়ে উনিশ হাজার বর্গ.কি. সমুদ্রসীমার মধ্যে তিনি টর্চ মারতেই থাকবেন। যেটা এদেশ নতুন পেয়েছে মিয়ানমারের কাছ থেকে।
তখন ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে থাকবে, রেডিও বলবে, নয় নম্বর বিপদ সংকেত দেখানোর কথা!
ভাবছি এই বেশে সমুদ্রগামী হবো নাকি, তাহার সাথে, অথবা একাকী একদিন।
বরাত
আমার বাল্যবন্ধু জুলকারনাইন এখনো গ্রামেই থাকে।এই জীবনে সে কখনো শহরের মসজিদে নামায পড়ে নাই। শহর থেকে কোনো ধনী বন্ধু গ্রামে দুয়েক দিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে তাকে দেখে অবাক হলে হ্যান্ডশেক করতে চায়। তখন সে ফিরিয়ে দেয়। কেমন যেন হাসে। তার হাসির দিকে তাকিয়ে বড়লোক বন্ধুরা কনফিউজড হয়ে যায়। তার চোখে গভীর অভিমান।
জুলকারনাইনের মাথায় এখনো গোল্ডেন সুতার অ্যামব্রয়ডারি করা টিয়া কালারের টুপি, গলায় ভাগ্য পরিবর্তনকরণ জনিত দুটি তাবিজ; চিবুক বরাবর ঝুলে আছে একটা দাঁতের খিলান, আলিফ সাইজ।
গ্রামে একবার আমার সাথে দেখা হলে আমি বলি, 'পরিজনদের কষ্ট দিস না। এবার একটা কাজে নাম।'
সে দুঃখ করে বলে,'বন্ধু কণ্ঠটা সোন্দর না বলে আযানের চাকরিটাও গতবছর গেল!'
অথচ আমার বন্ধু জুলকারনাইনের ইমামতিতে আমরা একবার অন্তত গ্রামের মসজিদটিতে নামায আদায়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম।
সে দুঃখ করে বলে,'বন্ধু কণ্ঠটা সোন্দর না বলে আযানের চাকরিটাও গতবছর গেল!'
অথচ আমার বন্ধু জুলকারনাইনের ইমামতিতে আমরা একবার অন্তত গ্রামের মসজিদটিতে নামায আদায়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম।
জুলকারনাইন বিবি-বাচ্চা নিয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করলেও কখনো তার বিত্তবান বন্ধুদের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে নি।
আমি খেয়াল করলাম, জুলকার সব সময় একটা জিনিস লুকায়। মনে হলো, তা নিয়ে সে বিরাট বিব্রত। আমাদের থেকেই বেশি লুকায়। বরং সে জিনিসটাই একটু আগে বাড়িয়ে দিল তার সামনে। তিনি বললেন, দে। সে দিল।
ছোটবেলায় জুলকারসহ আমরা কয়েকজন একবার দেখিয়েছিলাম। জুলকারেরটা হুবহু মিলে গেছে। আরো কিছু বাকি আছে, যা মেলাতে তাকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জুলকারের আশা যদিবা বদলায় কিছু! তাই সে আমাদের দিকে না বাড়িয়ে পরম ভরসায় তার হাত দুটি বাড়িয়ে দেয় গনকের দিকে। এই আশায়, যদি জীবনের প্রথম এইবার ম্যাগনেফাইং গ্লাস আছে এমন গনককে দিয়ে হাত দেখালে ভাগ্যে কিছুটা বদল আসে।
আমি জানি, হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে জুলকারনাইন আমাদের সাথে হাত মেলায় না। ফলে ওর কাঁধে হাত রেখে বিদায় নিলাম।
আমি জানি, হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে জুলকারনাইন আমাদের সাথে হাত মেলায় না। ফলে ওর কাঁধে হাত রেখে বিদায় নিলাম।
No comments:
Post a Comment