আজকের পৃথিবী যখন হিংসা, সন্ত্রাস আর অসহনশীলতার আগুনে জ্বলছে
পুড়ছে। প্রতিদিন বিশ্বের কোন না কোন জায়গা রক্তে
স্নাত হচ্ছে শিশু কিশোর, নারী পুরুষের নির্মল রক্তে তখন অনেকেই আমরা শান্তির
খোঁজে সেই সব মনীষীদের সুস্থ ভাবধারার দ্বারস্থ হচ্ছি যারা একদিন অন্তরের অন্তঃ স্থল
হতে মানুষকে ভালোবেসেছিল। মানুষের জন্য শান্তি, সৌভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতার আর বন্ধুত্বের
আকাশ প্রদীপ জ্বেলে রেখেছিলেন। পৃথিবীর এই করুণ কণ্টকময় সময়ে আজ সেই সব মহান ব্যক্তিত্বের
অবদানকে বার বার স্মরণ করছি। স্বামী বিবেকানন্দ স্বমহিমায় বিরাজমান কেবল ভারত বর্ষের
নয়, ভারত বর্ষের বাইরেও। এই মানুষটির জীবনপাতার পাশে আর একটি মুখ খুব সপ্রতিভভাবে স্মরণে
আসে তিনি ভগিনী নিবেদিতা বা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। একজন অ্যাংলো আইরিশ যাজক কন্যা।
পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যিনি শিখেছিলেন মানব সেবাই ঈশ্বর সেবা তুল্য।
মার্গারেট ছিলেন শিক্ষক। ছোটদের পড়িয়ে তিনি অপরিসীম আনন্দ
পেতেন। শিশুমনের সার্বিক বিকাশে তিনি তাদের ভেতর সুকুমার ভাবনা চিন্তার পক্ষপাতি ছিলেন।
ছবি আঁকা, সাহিত্য জানতে এবং চর্চা করতে তিনি শিশুদের উৎসাহ দিতেন। পরবর্তীতে মার্গারেট শিশুদের জন্য
একটি ইশকুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন প্রচুর।
সুনাম ও সম্মানও পেয়েছিলেন যথেষ্ট। মানুষের সেবা করার চিন্তাটা তার হৃদয়ে গভীরভাবে
গেঁথে ছিল। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি জ্ঞান এবং সমাজ সেবামুলক বিভিন্ন আলোচনা চক্র,
সভা বৈঠকে যোগ দিতেন। সাহিত্য ও শিল্পচর্চা সম্পর্কে তাঁর লেখা প্রকাশিত হচ্ছিল লন্ডনের
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও শিশু শিক্ষণ এবং শিশু মনের বিকাশ,
নারীর অধিকার বিষয়ে তার বক্তৃতা এবং লেখা প্রবন্ধগুলো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল।
তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন একজন আদর্শ শিক্ষাব্রতী হিসেবে।
জ্ঞান অর্জনের অপরিসীম ক্ষুধা ছিল তাঁর অন্তরে। তিনি প্রচুর
পড়াশুনাও করতেন। এই সময় বুদ্ধের জীবন কর্ম, শিক্ষা তাকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
তিনি বুদ্ধ সম্পর্কে পড়াশুনা শুরু করেন আরো বেশী করে জানার আগ্রহে। নিজেকে নির্লোভ সুশিক্ষিত সুরুচির মানুষ হিসেবে তৈরি করতে
তিনি ত্যাগ এবং সেবার পথ গ্রহন করেন। তার অন্তরে সর্বদা জানার আকুলতা প্রচুর প্রশ্নের
জন্ম দিত। তিনি নানাভাবে এই প্রশ্নের উত্তর জানার চেস্টা করতেন। লোভ ,হিংসা, অজ্ঞানতা
দূর করে কি করে জ্ঞানের আলো দিয়ে মানুষের মনের মুক্তি আনা যায় এই বিষয়ে তিনি সারাক্ষণ
চিন্তিত থাকতেন।
১৮৯৫ সালের নভেম্বরে
লন্ডনের এক বিদুষী পরিবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে
স্বামী বিবেকানন্দের সাথে মার্গারেটের পরিচয়
হয়। স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা এবং ব্যক্তিত্বে তিনি মুগ্ধ হন। এই সময়ে স্বামীজির কাছ থেকে তিনি ভারতবর্ষের
ইতিহাস,দর্শন, সাহিত্য, লোকাচার, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিষয় জেনে নেন।
স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে তিনি ভারত বর্ষের
প্রাচীন এবং আধুনিক মহাপুরুষদের জীবনী জেনে অত্যন্ত বিস্মিত এবং কৌতূহল অনুভব
করেন। ভারতবর্ষের দর্শন, সাহিত্য এবং জ্ঞানের প্রতি তিনি এক অভাবনীয় টান অনুভব করেন।
মার্গারেট বুঝতে পারেন, “ মানুষের মধ্যে যে পূর্ণতা আছে, তাকে প্রকাশ করার নামই হল শিক্ষা।” তাই তিনি তার ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্র হিসেবে ভারতকেই স্থির করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ মার্গারেটের আগ্রহ দেখে অনুভব করলেন ভারতবর্ষে
শিক্ষার আলো ছড়াতে, বিশেষ করে ভারতীয় নারীর মধ্যে অশিক্ষা, কুসংস্কার আর দুঃখ দৈন্য
দূর করতে মার্গারেটের ছিলেন উপযুক্ত শিক্ষিত সম্মোহনী একজন নারী। তিনি মার্গারেটের
আগ্রহ দেখে পরামর্শ দেন, কাজে ঝাঁপ দেওয়ার আগে ভাল করে ভেবে দেখার। স্বামীজি বুঝেছিলেন
ভারতবর্ষের সেবার জন্য, ভারতীয় নারীদের মানসিক শৃংখল মুক্তির জন্য, স্বনির্ভরতা ও শিক্ষাদানের
জন্য মার্গারেটের মত শিক্ষিত, পবিত্র, অসীম ধৈর্য্যশীল, দৃঢ় ও প্রীতিপূর্ন মনের অধিকারী
নারীর একান্ত প্রয়োজন। তাই তিনি এই কর্মবীর কন্যাকে আন্তরিকভাবে ভারতবর্ষে স্বাগত জানান।
স্বামীজির আহবানে সাড়া দিয়ে এবং সকল সাবধান বাণীকে উপেক্ষা
করে মার্গারেট ১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারী আত্মীয়
স্বজন এবং প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে চলে আসেন নব্য জ্ঞানপীঠ কলকাতা। এসেই তিনি কাজে ঝাঁপিয়ে
পড়লেন। স্বামীজি এই বিদেশিনী তেজস্বিনী নামকরণ করেন ভগিনী নিবেদিতা। ভারতবর্ষের জন্য
তীব্র ভালবাসা নিয়ে ১৮৯৮ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ভারতীয় নারীদের শিক্ষাদানের জন্য
কলকাতায় একটি ইশকুল প্রতিষ্ঠা করেন। সমস্ত সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় বাঁধাকে অতিক্রম
করে এই বিদেশিনী নারী খালি পায়ে হেঁটে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝাতেন যে কন্যা
সন্তানের জন্য শিক্ষা কত প্রয়োজন। আজকের ভারতবর্ষের আলোকিত নারীদের জন্য সিস্টার নিবেদিতা
রচনা করে দিয়েছিলেন প্রগতির পথ। মেয়েরাও যে এই সমাজের মানুষ , দেশ, কাল, সমাজ, রাজনীতিতে
মেয়েরাও যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে এই কথাটি তিনি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হন।
১৮৯৯ সালে কলকাতায় মহামারী আকারে প্লেগ দেখা দেয়। নিবেদিতা স্থানীয় যুবকদের সহায়তায়
এই সব রোগিদের সেবা কাজে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। এখানেই এই বিদেশিনী সিস্টার নিবেদিতার
মাহাত্ম্য। কত বড় ভালবাসাময় অন্তর থাকলে এরকম কাজ করা যায় ভাবা যায়!
ভারতবর্ষের ইতিহাসে সিস্টার নিবেদিতা একটি শক্তিময়ী নাম।
সকল শ্রেণির নারীদের জন্য সমান আগ্রহ নিয়ে তিনি কাজ করতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্যার
জগদীশচন্দ্র বসু এবং তার সহধর্মিনী লেডি অবলা বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত তৎকালীন
সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে নিবেদিতার চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল। তিনি শিল্পের সমঝদার
ছিলেন বলে ভারতের আধুনিক চিত্রকলার সৃজনে অন্যতম অনুপ্রেরণার কাজ করেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের
ব্যাপার এই ছিল যে নিবেদিতা ভারত বর্ষের স্বাধীনতার স্বপক্ষে বৃটিশ বিরোধী কাজে সক্রিয়
সমর্থন দেন। ভারতের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তিনি স্বদেশ প্রেম, ধর্মের সারল্য, সমাজ,
শিক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেন।
তিনি স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী নেতা ঋষি
অরবিন্দের সান্নিধ্যে আসেন এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার স্বপক্ষে সোচ্চার ভুমিকা পালন
করেন। তার ১৬নং বোসপাড়া লেনের বাড়িটা ছিল ভারতবর্ষের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা
স্থল। বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দ নিবেদিতাকে “শিখাময়ী” নামে অভিহিত করন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর সিস্টার নিবেদিতাকে “লোকমাতা” নামে ডাকতেন । শিল্প সাহিত্য ভাষা চর্চা, দেশপ্রেম
নারী জাতির শিক্ষা ও উন্নতি, মানবসেবার পাশাপাশি এই মহিয়সী নারী ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার
প্রসারতায়ও নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সস্ত্রীক বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে গভীর
আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞান চর্চায় তিনি পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে
বিভিন্নভাবে সাহায্য ও সহযোগীতা করেছেন।
সব কিছুর উর্ধ্বে তিনি নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে
পছন্দ করতেন। তার শিক্ষাপদ্ধতির মূলে ছিল সার্বজনীনতা। গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে
তিনি সৃজনীশক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দিতেন। শিক্ষাকে তিনি করে তুলেছিলেন মানব কল্যাণমুখী।
ভারতবর্ষের মানুষদের প্রতি এক নিগূঢ় ভালবাসার বন্ধনে তিনি নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে
নিয়েছিলেন। সেই সময়ের ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর গণ্ডি ছাড়িয়ে সিস্টার নিবেদিতা
ছিলেন ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞান ও মানবসেবার এক অনন্য আলোকস্তম্ভ। একজন বিদেশিনী
হিসেবে সাধারণ মানুষের এই ভরসা অর্জনের পেছনে ছিল সিস্টার নিবেদিতার গভীর নিষ্ঠা এবং
ভালোবাসা।
তিনি আভিজাত, ধনী, মধ্যবিত্তের বাইরেও কৃষক- শ্রমিকের জীবনের মান উন্নয়নেও
অবদান রেখেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ভারতের জনগন এবং তাদের স্বাধীনতার জন্য
কাজ করে গেছেন। অতিরিক্ত কাজের ভারে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯১১ সালের ১৩অক্টোবর
দার্জিলিং এ এই মহিয়সী নারী মৃত্যুকে বরণ করে নেন। তার মৃত্যু তাকে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। সিস্টার নিবেদিতা
বেঁচে থাকবেন অনুপ্রেরণার আলোকদাত্রী হয়ে।
বর্তমান অস্থির সময়ের দোলাচলে অস্থিতিশীল
এই পৃথিবীতে সিস্টার নিবেদিতার মত মানুষদের আজ আমাদের বড় প্রয়োজন ।
asdasdasd
ReplyDeletedsadasdasd
ReplyDeleter3weade
ReplyDelete