মাস্টার মশাই সম্মুখ প্রান্তের দন্ত দু'পাটি প্রদর্শন পূর্বক কহিলেন- বিদ্যা মোর কর্মে, বিদ্যা মোর ধর্মে। আমার সংস্পর্শে আসিলে স্বয়ং কাষ্ঠখণ্ড বর্ণমালা শিখিয়া লইতে দ্বিমত করিবে না, আর কনিষ্ঠ মনুষ্য শাবক তা তো কোন ছার!
তাহার কণ্ঠে বীরত্বের সহিত
খ্যাতিবস্ত্র পরিহিত দম্ভের প্রকাশ হইতে লাগিল। ঠাকুর বাড়ীর ফটকে অর্ধশত বছর ধরিয়া
সগর্বে দণ্ডায়মান আম্রবৃক্ষ মাস্টার মশাইয়ের যোগ্যতা দেখিয়া তটস্থ হইয়া তাহার ডালপালা
আর পত্রগুলিকে চোখ রাঙাইয়া শাসাইয়া দিল চুপ থাকিতে।
পবন বালকের দল ছুটিয়া আসিতেই
তাহারাও মুখোমুখি হইল আম্র লংকার আশ্রয়ে, ফলে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই তাহারাও বিপরীতে
হাউমাউ করিয়া ছুটিয়া গেল। মাস্টার মশাই পবনের পশ্চাদপ্রবাহ দেখিয়া রাগে গজগজ করিতে
করিতে উর্ধ্বে তাকাইলেন। ক্ষাণিকক্ষণ চক্ষুদ্বয় ত্রিদিগন্তে নাচাইয়া ঠাকুরের পানে
মনোনিবেশ করিলেন। বৃক্ষ আসন্ন ঝাড়ি হইতে রক্ষা পাইয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। নিঃশব্দে
কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছাড়িল কিনা কে জানে!
শিব মাস্টারের চকচক করিতে থাকা
দন্ত দু'পাটির রূপ লাবণ্য আর বাচনভঙ্গির প্রেমে মজিয়া ঠাকুর মশাই নিজ পুত্রের জন্যে শিব
মাস্টারকে গৃহে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানাইলেন। বাতায়নের বিপরীতে গৃহবন্দী কৃষ্ণ ঠোঁট
বাঁকাইয়া কুটিল হাসি হাসিল।
প্রত্যুষে মোরগ সম্প্রদায়
জাগিবার প্রারম্ভে,
দিবাকর চোখ খুলিবার পূর্বেই খট করিয়া শিব মাস্টারের গৃহ দ্বার
খুলিয়া গেল। চটিদ্বয় ঠকঠক করিতে করিতে আগাইতে থাকিলেন ঠাকুর গৃহে। দক্ষিণ হস্তে সরু
একখণ্ড বাঁশের কঞ্চি ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া নিম্নমুখী হইয়া ঝুলিয়া রহিল। ঠাকুর ফটকে
পৌঁছবার আগে স্নান করিয়া পবিত্র হইয়া নিলেন। বড় গৃহে অদ্য বেলায় প্রবেশ করিতে যাইতেছেন, হর্ষ প্রভাবে
সুগন্ধি মাখিতে ভুলিলেন না। গুনগুন করিয়া গীত চর্চা তাহার জন্মলগ্ন হইতে চলিয়া আসিতেছে, অদ্য প্রত্যুষে
সেই প্রতিভা বহুগুন বাড়িয়া গিয়াছে। পথিমধ্যে বহুবার শুনিয়াছেন বজ্জাত বালকদিগের
“বেতী মাস্টার”
উপাধি, কর্ণে প্রবেশ না করাইতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাইতে লাগিলেন শিব।
এতদসত্ত্বেও বালকদিগের উচ্চস্বর
তাহার কর্ণে শোঁ-শোঁ সঙ্গীত তুলিয়া দিল। মাস্টার মশাই ভাবিলেন; শিক্ষার বড্ড
অভাব রহিয়াছে, আকাল দেখা দিয়াছে শিবের মতো মাস্টারের। বেত যে তাহার ঐতিহ্য, মনুষ্য জ্ঞাতি
জাতিগুলোকে মনুষ্য রুপদান করিতে ইহার চেয়ে ঢের কোন ঔষধ নাই।
কক্ষে প্রবেশ করিয়াই সতর্ক
হইলেন মাস্টার। স্মরণ করিলেন ঠাকুর মশাইয়ের মহৎ বাণী গুলিকে;
পূর্বে ডজনখানেক মাস্টারের কপালে গোল আলুর চাষ করিয়াছে কৃষ্ণ, চক্ষুদ্বয়ে
সর্ষে ফুল ছড়াইয়াছে বহুবার। এই বালক বড্ড ধূর্ত বটে। প্রবেশ করিয়াই মর্মে শীতল আবহ
অনুভব করিলেন শিব মাস্টার। কৃষ্ণ যে পুস্তক খুলিয়া মনোনিবেশ করিয়াছে। আরম্ভকালেই
উন্নতির শুভ লক্ষণ দেখিয়া হর্ষ সহযোগে বুক ফুলাইয়া নিজের কুষ্ঠি গণনা করিতে লাগিলেন
এক মুহূর্ত। ভাগ্য ভালো বটে, ললাটে গর্ব করিয়া আঙ্গুল বুলাইতে বুলাইতে কেদারাতে নিতম্ব স্থাপন
করিতেই মাস্টারের মাথা চক্কর দিতে আরম্ভ করিল। বুঝিয়া উঠিবার পূর্বেই ধপাস করিয়া
কেদারার ভূপতন সংঘটিত হইল। মাস্টার বোধ করিলেন তাহার কোমরের কয়েকখানা হাড় পরস্পর
বিরোধ করিয়া কটমট করিতে লাগিল। তাহার মস্তিষ্ক ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতেছিল। চারপায়ী
ততক্ষণে চুর্ণ,তাহার অঙ্গগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়িল। শিব কেবল বোধ
করিলেন তাহার পশ্চাৎদেশে সহিত শক্ত করিয়া একখানা চৌকোনা
কাষ্ঠখণ্ড আঁটকিয়া রহিয়াছে। উপলব্ধ হইল কৃষ্ণ নামের বালকটি তাহার কৃষ্ণকূটিল আত্মার
প্ররোচনায় কেদারায় আঠার প্রলেপ দিয়াছে। মুখ খানিকটা বিকৃত করিয়া শিব কহিলেন- এ
যে বড়ই অনাচার, এই বালকের শিক্ষালাভ সপ্ত জন্মে পড়িয়া চতুর্দশ জন্মেও হইবে না। ঠাকুর পরিবারের
ঘুম ভাঙ্গিবার পূর্বে,মোরগ সম্প্রদায় জাগিবার পূর্বেই মাস্টার ইজ্জতের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া নিজ গৃহের
পানে ছুটিতে লাগিলেন। ফটকে আম্রবৃক্ষ হাসিয়া বলিল; বাঁচিলাম, আমার ডাল
ভাঙ্গিতে আসিবে না তবে!
অদেখা শিব মাস্টার না পড়াইলে
অন্য কোনো মাস্টারের মুখের অবস্থান সঠিক জায়গায় রাখিবে না বলিয়া পণ করিয়াছিল শিব
মাস্টারের কৃষ্ণ। যখন জানিতে পারিল অদ্য প্রত্যুষে যাহাকে বিতাড়িত করিয়াছিল,তিনিই সেই
শিব মাস্টার তখন নগ্নপদে ছুটিয়া চলিল তাহার পদচুম্বন করিয়া মাফ চাহিবার তরে। মাস্টার
গৃহের সম্মুখে আসিয়া আকাশপানে তাকাইয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়িল। অপমানে তৃপ্ত হইয়া দিবাকরের
চোখ খুলিবার পূর্বেই অত্র এলাকা ত্যাগ করিয়াছেন শিব মাস্টার। আজন্মে বোধহয় এমুখো
হইবেন না। কৃষ্ণের কৃষ্ণবর্ণের কপোল বাহিয়া নোনাজল গড়াইতে লাগিল,তাহার জ্ঞানার্জন
যে সত্যি আর হইবে না। ধূলার মাঝে সহসা দৃষ্টিগোচর হইলো কয়েক খণ্ড বাঁশের কঞ্চি। ছাত্র
কর্তৃক প্রদেয় মানের ভারে কুঁজো মাস্টার তাঁর ঐতিহ্য বহিয়া নিতে ভুলিয়া গিয়াছে।
খাঁ খাঁ করিতেছিল তাহার শূন্য একচালা।
No comments:
Post a Comment