01 January 2016

ফ্লোরা সরকার


অপরাজেয় কিংবদন্তী কবি
নাজিম হিকমত
(১৯০২-১৯৬৩)


শিল্প যখন মনের গহীন থেকে উঠে আসে তখন তা হয় সৃষ্টি আর যখন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থেকে উঠে আসে তখন ঘটায় বিপ্লব। যে বিপ্লব শিল্পী শুধু নিজের দেশেই নয়, ছড়িয়ে দেন পৃথিবীর নানা দেশে, নানা প্রান্তে। মৃত্যুর পরেও যে শিল্প থাকে অপরাজেয়। নাজিম হিকমত-তুরস্কের এমনই একজন বিপ্লবী কবির নাম। অথবা বলা যায় যার কিংবদন্তী জীবন তার লেখনীকে বিপ্লব ঘটাতে বাধ্য করেছিলো।

ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র নাজিম হিকমত সম্পর্কে বলেছিলেন-“তিনি এমন একজন কবি যার কাব্য আর জীবনের মাঝে কোন ভেদরেখা টানা যায় না”। আর তাই হিকমতের কাব্যের পাশাপাশি তার জীবনীও অত্যন্ত আগ্রহী করে তোলে পাঠককে। ১৫ জানুয়ারি নাজিম হিকমতের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে জানাই আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। তার সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনার পাশাপাশি আমরা তার কাব্যেরও উপরেও কিছু কিছু আলোচনা করবো।

নাজিম হিকমতকে বিশ শতকের আধুনিক কবি হিসেবে পরিগণিত করা হয়ে থাকে। যার কবিতা পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। নাজিম হিকমতের জন্ম হয়েছিলো ১৯০২ সালের ১৫ জানুয়ারি, অটোমান সাম্রাজ্যের সোলানিকা, বর্তমান গ্রিসের থেসালোনিকি শহরে, যেখানে তার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। হিকমত বেড়ে উঠেছেন ইস্তাম্বুলে। তার মা একজন শিল্পী ছিলেন, দাদা ছিলেন কবি। মাত্র সতর বছর বয়স থেকেই হিকমতের কবিতার স্ফুরণ ঘটতে থাকে এবং প্রকাশিত হতে থাকে তার কবিতা। তুরস্কের নেভেল একাডেমিতে কিছুদিন কাজ করার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পশ্চিম তুরস্কে মিলিটারি একাডেমিতে পড়াবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে বিয়ের পর প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মস্কো চলে যান। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ভীষণ ভাবে আলোড়িত করে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন শিল্পাঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৪ সালে আবার তুরস্কে ফিরে যান, যে সময়ে তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বামপন্থী পত্রিকা প্রচারের অভিযোগে কিছুদিনের মধ্যেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯২৬ এ আবার তিনি মস্কো পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, যেখানে রাশিয়ার আরেক বিখ্যাত কবি মায়াকোভস্কির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। সেই সময়ের নাট্য-মঞ্চের আরেক দিকপাল মায়ারহোল্ডের সঙ্গে তিনি কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৮ এ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে তাকে আবার তুরস্কে ফিরে যাবার অনুমতি দেয়া হলে হিকমত দেশে ফিরে যান। যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত, তাই হিকমত অনেকটা তুরুপের তাসের মতো কর্তৃপক্ষের দ্বারা ব্যবহৃত হন। অকারণ সন্দেহ আর পর্যবেক্ষনের মাঝে তাকে রাখা হতো। ১৯৩৩ এ পোস্টার লাগাবার অপরাধে তাকে জেলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বিচারের পর প্রমাণ পাওয়া যায় যে হিকমত সেই অপরাধে আদৌ অপরাধী ছিলেন না। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ এর মধ্যে তার নয়টি বই প্রকাশিত হয়ে যায়। যার মধ্যে চারটি দীর্ঘ বিপ্লবী কবিতা ছিলো। কবিতা ছাড়াও বেশকিছু নাটক, উপন্যাস, চিত্রনাট্য, শিশুতোষ গল্প, প্রুফরিডার, অনুবাদক আর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। দুই সন্তান, দ্বিতীয় স্ত্রী আর বিধবা মা নিয়ে তখন তার সংসার।

১৯৩৮ এ ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হন। গ্রেপ্তার এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়ে আঠাশ বছরের কারাজীবনে তাকে প্রেরণ করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তার কবিতা তুর্কি সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত আর বিদ্রাহী করে তুলেছিলো। বিশেষ করে ১৯৩৬ এ প্রকাশিত, পনেরশ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে সংঘঠিত কৃষক বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘The Epic of Sheik Bedrettin’ (দা এপিক অফ শেখ বেডরেটিন) শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটি। হিকমতের খুব কাছের বন্ধু আরেক দিকপাল, কবি পাবলো নেরুদার বর্ণনায় পাওয়া যায় তার নিদারুণ কারাভোগের কাহিনীর কথা-“যতক্ষণ না পর্যন্ত হিকমত ক্লান্ত হয়ে পড়তেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে দীর্ঘ সময় ধরে হেঁটে যেতে বলা হতো। তারপর তাকে বিষ্ঠাপূর্ণ টয়লেটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে রাখা হতো।” কিন্তু হিকমত এতে দমে যেতেন না। এই জেলেই তিনি অনেক গান আর কবিতা রচনা করেন, যেগুলো তার বন্ধুদের দিয়ে বাইরে সরবরাহ করাতেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ এর মধ্যে তিনি অনেক গান আর কবিতা রচনা করেন, “Human Landscape”( হিউম্যান ল্যান্ডস্কেপ ) যার মধ্যে অন্যতম একটি মহাকাব্য। এই জেলে থাকা অবস্থাতেই দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এবং তৃতীয়বারের মতো আবার বিয়ে করেন।১৯৪৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি, যার সদস্যদের মাঝে ছিলেন-পাবলো পিকাসো, পল রবিনসন এবং জ্যঁ পল সার্ত্র এর মতো দিকপালেরা হিকমতের মুক্তির জন্যে প্যারিসে প্রচারণা শুরু করেন এবং অবশেষে হিকমত কারামুক্ত হন। তবে এই সময়েই তার প্রথম  হার্ট অ্যাটাক হয়। ১৯৫০ এ তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। তার “অটোবায়োগ্রাফি” নামক কবিতায় লেখেন-

“কিছু মানুষ জানে সব গাছ-পালা আর মাছের নাম
আমি জানি বিচ্ছেদ
কিছু মানুষ হৃদয়ে রাখে তারাদের নাম
আমি আবৃত্তি করে যাই নীরবতা
আমি শুয়েছি জেলখানায়, শুয়েছি শ্রেষ্ঠ হোটেলে
আমি চিনেছি ক্ষুধাকে, চিনেছি অনশন-ধর্মঘটকে, যেখানে খাবার প্রায় থাকে না
তিরিশে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাইলো
পঞ্চাশে দিলো নোবেল ----”

জেল থেকে মুক্তির পরেও তাকে দুই দুইবার হত্যার প্রচেষ্টা চলে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে তাকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হয়। মস্কোয় রাইটার কলোনিতে তাকে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু তার স্ত্রী আর সন্তানদের মস্কোতে যাবার অনুমতি দেয়া হয়না। ১৯৫২ সালে তার আবার দ্বিতীয় হার্ট এ্যাটেক হয়। সুস্থ্য হবার পর তিনি ইউরোপের নানান দেশ সহ এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। শুধু আমেরিকা প্রবেশের কোন অনুমতি না দেয়ায় সেখানে তার যাওয়া হয়ে ওঠে নাই। ১৯৫৯ এ তিনি পোল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্যে আবেদন করেন এবং সেই বছরেই আবার বিয়ে করেন। ইতিমধ্যে জার্মান, ফরাসি এবং অন্যান্য ভাষায় তার কবিতা অনুদিত হতে শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৩ তে তৃতীয়বারের হার্ট অ্যাটাক হয় এবং ৩ জুন তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার মস্কোতে মৃত্যুবরণ করে। তার মৃত্যুর দুই-এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৬৫-৬৬ র মধ্যেই তুরস্কে তার কবিতার ভলিয়্যুম সহ পুনর্মুদ্রণ শুরু হয়ে যায়। এবং পরবর্তী পনর বছর ক্রমে ক্রমে তার আটটি ভলিয়্যুম সহ সব লেখা তুরস্কে প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে পৃথিবীর আরো অনেক সংখ্যক ভাষায় অনুদিত হয় তার লেখা।

কবি হুইটম্যানের মতো নাজিম হিকমত তার কবিতায় যেভাবে বলেছেন তার নিজের কথা, দেশের কথা সেই একই ভাবে বলে গেছেন বিশ্বের কথা। আত্মকেন্দ্রিকতার উর্ধ্বে যেয়ে তিনি একাধারে ছিলেন ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত। তার কবিতা একাধারে বাস্তব এবং আবেগ প্রবণতায় পূর্ণ। মানবিকতার স্পর্শে তার কবিতাগুলো যেন- নাটকীয়, আশাবাদি এবং শিশুসুলভ আনন্দে পূর্ণ- যা তাকে করেছে উন্মুক্ত, গণমুখী এবং সামাজিক ও শৈল্পিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিবেদিত। তার জীবন এবং কর্মের এই একতাবোধ তাকে তার সময়ের নায়ক করে তুলেছিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন তার কবিতা এবং জীবন আলাদা কোন ঘটনা ছিলো না। আমেরিকান লেখক টেরেন্স দে প্রেস, যিনি “হলোকাস্ট রাইটার” হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি বলেন “হিকমতের দৃষ্টান্তমূলক জীবন এবং দূরদৃষ্টিতে তাকে করে তুলেছে ঐতিহাসিক এবং সময়হীন, মার্ক্সিস্ট এবং মিষ্টিক। কারণ শিল্পী হিকমত এবং ব্যক্তি হিকমত প্রকৃতি ও মানব উদ্দীপনার ঐকতান বিরোধীদের শত্র“ মনে করতেন। সহজ সরল ভাষায় গুরুগম্ভীর উপস্থাপন হিকমতের মতো কোন আধুনিক আমেরিকান কবিদের মাঝেও দেখা যায়নি। তার অন্যতম একটি কবিতা-“বেঁচে থাকায়”  তিনি লেখেন-
“বেঁচে থাকা কোন কৌতুক নয়
বেঁচে থাকবে ঐকান্তিকতায়, যেমন থাকে কাঠবিড়ালিরা
অর্থাৎ সবকিছুর উর্ধ্বে যেয়ে বেঁচে থাকো
অর্থাৎ বেঁচে থাকা হচ্ছে বৃত্তিমূলক জীবন”।

তার অভিশংসনকারীরাও তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছে, যখন তারা দেখলো কারো কবিতা সেনাবাহিনীর মতো মানুষকেও উদ্বেলিত করতে পারে। জীবনভর শত কষ্টের মাঝেও কখনোই তার জীবন বা শিল্পের সঙ্গে তিনি কোন আপস করেননি। আর তাই “The sad state of Freedom” বা “বিষণ্নতার স্বাধীনতা” কবিতায় স্বাধীনতার অসাধরণ বিষন্নতাকে আমরা খুঁজে পাই। তার এই কবিতাটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে দেয়া হলো।

“তুমি তোমার চোখ দুটোকে নষ্ট করেছো,
নষ্ট করেছো তোমার লাবণ্যময় হাত দুটো,
হাজার রুটির জন্যে ময়দার ময়ান করেছো
যার একটুকরো তোমার মুখে জোটেনি,
তুমি স্বাধীন অন্যের দাসত্ব করার জন্যে
তুমি স্বাধীন অন্যকে ধনী থেকে ধনীতর করার জন্যে;
যে মুহূর্তে তুমি জন্ম নিয়েছো
তারা তোমার চারপাশে রোপণ করেছে
জীবনভর মিথ্যার জাল, 
যে মিথ্যা উৎপাদিত হয় কারখানাগুলোতে,
তুমি জীবনভর স্বাধীনতার বাসনা করে চলেছো
মন্দিরে প্রার্থনা করেছো
স্বাধীন ভাবে ভাবতে চেয়েছো
তুমি ঘাড় নুয়ে থেকেছো
হাতদুটো ঝুলিয়ে,
অলসভঙ্গীতে ঘুরেছো মুক্তির আশায়
তুমি মুক্ত 
মুক্ত তুমি বেকারত্বের জালে।

তুমি তোমার দেশকে ভালোবেসেছো
পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান রত্নটির মতো;
কিন্তু হঠাৎএকদিন (উদাহরন স্বরূপ)
দেশটিকে তারা আমেরিকার কাছে সত্তা প্রদান করে দিলো
এবং সেই সঙ্গে তোমাকে এবং তোমার স্বাধীনতাকেও,
তুমি স্বাধীনতা পেলে বিমান-ঘাঁটি হবার,
তুমি প্রচার করলে মানুষ বেঁচে থাকবে
যন্ত্রবৎ নয়, নয় কোন সংখ্যা বা সংযুক্তি হিসেবে
থাকবে বেঁচে মানুষ হিসেবে,
ঠিক তখন তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে দেবে ওরা
তুমি বন্দিত্বের জন্যে মুক্ত হয়ে গেলে
মুক্ত হলে কারাগারে বা এমনকি মৃত্যুদণ্ডে দন্ডিত হয়ে,

মানুষের জীবনে নেই কোন লোহা বা কাষ্ঠবৎ
এমনকি সূক্ষ কারুকাজ পূর্ণ পর্দা
জীবনে স্বাধীনতা চাইবার কোন প্রয়োজন নেই
তুমি মুক্ত
আকাশের তারার নিচে, বিষণ্ন স্বাধীনতার মতো মুক্ত।  

No comments:

Post a Comment