নীলাম্বরী
পাহাড়ের এ-পাশটাতে বাড়ি আমার,
নীলচে আকাশ সাদা মেঘের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে এখানটায় এসে মিলে
যায়।
পাহাড়ের গা বেয়ে আসা বুনো লতা সবুজ আস্তরনে ঢেকে দিয়েছে কাঠের
দোতালা বাড়ি।
শুনেছি ওপাশে সাঁওতাল পল্লী,
তবে শ্যামলী মায়ের আঁচল ডিঙিয়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
উত্তরের জানালার পাশে বেতের চেয়ার,
ঘুম ঘুম চোখ আর হাতে চায়ের কাপ, ঘড়ির কাটার ঠিক ৭:৩০, পাহাড়ি
শিমুল গাছের মগডাল থেকে ডেকে ওঠে সুকণ্ঠী পাখি।
প্রতি শীতে জানালার সোজা পাহাড়ের পশ্চিমাংশ ছোট ছোট নীল ফুলে
ছেয়ে যায়।
পরিচিত এ দৃশ্য, তবু কেন জানি হৃৎকম্পন বাড়ে।
হালকা একটা হিম হাওয়ার সাথে শির শির করে জেগে ওঠে সারা শরীরের
লোম।
হাতের আলতো ছোঁয়ার নিপুন কারুকার্যে টপাটপ ঝুড়ি ভরে যায় নীল
ফুলে।
কাছ থেকে এ স্বর্গীয় দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনো, জানালার
এপাশের বেড়াজালেই আটকে ছিল পদচারণ।
স্কুল পড়ুয়া বালক তখন আমি, তাই বালক বয়সের পাওয়া সে ছোট্ট চিরকুট
বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছে।
হারিয়ে ফেলেছি পরিচিত দৃশ্যপটের ছবি।
সেবার স্কুল ফাইনালের পর আমাকে ছোট কাকার বাসায় রাখা হয়, ভাল
কলেজে ভর্তির আশায়।
কোথায় যেন এক সূক্ষ্ম টান আর নিঃসঙ্গ শূন্যতা আমাকে টেনে নিয়ে
আসে পাহাড়ে।
প্রতিদিনকার অভ্যেস মত রোজ সকালে পড়ার টেবিলে বসা হয়।
ঠিক ৭:৩০ এ টিং টিং করে বেজে ওঠে টেবিল ঘড়ির এলার্ম।
অন্যসব ঋতু কেমন নির্জীব, প্রাণহীন।
কেবল শীতকালটাই আমেজে পূর্ন থাকে।
একটা দুটো করে সবুজের মাঝে নীল নীল চোখ উকি, যেন ডিম ফুটে বাচ্চা
বের হয়।
দু'দিনেই পুরো পাহাড় নীল হয় যাবে।
ফুল কুড়ানো এ মেয়েটির নাম দিয়েছি নীলাম্বরী।
গেরুয়া বসন আর রোদে পোড়া তামাটে চামড়ার সে মুখে অদ্ভুত এক মাদকতা
ছিল।
মুখ তুলে আমার জানালার পানে তাকায়নি কখনো নীলাম্বরী,
তবু আমি দেখতে পেতাম ওর চিবুক বেয়ে কেমন বিষণ্ণতা ঝড়ে পরে।
ক'দিন হয় নীলাম্বরী আসে না,
বোবা কান্নায় ভেঙে পড়েছে পাহাড়।
শুঁকনো ঝর্না থেকেও ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে।
হিম হিম হাওয়া এখন আর কাঁপুনি জাগায় না,
খলসে মাছের মত অস্থির ছটফটানি কাজ করে।
শীতের ছুটিতে এই প্রথম সাঁওতাল পল্লী এলাম।
নীলাম্বরীকে কেউ চিনে না ওরা।
৭:৩০ এর এলার্ম যেন ঘন্টা পিটিয়ে বলে নীলাম্বরী আর আসবে না,
দূর পাহাড়ের শিমুল গাছের সেই পাখিটা আর ডাকে না মধুর সুরে,
কুই কুই কান্নার আওয়াজ বের হয়।
তবু প্রতীক্ষা শেষ হয় না।
উচ্চ শিক্ষার্থে কাঠের বাড়ি, সবুজ পাহাড়, নীল আকাশ, সাদা মেঘ
আর নীলাম্বরীর রেখে যাওয়া নীল ফুল সব ছাড়তে হয় আমায়।
শত বাঁধা পাড়ি দিয়ে প্রতি শীতে পাহাড় ডাকে ছুটে যাই,কাঠের দোতলা
বাড়িতে।
টেবিল ঘড়িটা ৭:৩০ এ থেমে আছে,
বেতের চেয়ারটাও নড়বড়ে।
ঘরের আসবাব, কাঠের দেয়াল সবই পাল্টে গেছে।
নীল ফুল গুলোকে আজ যেন আবার উৎফুল্ল মনে হয়,
ভাল করে তাকাতেই দেখি চঞ্চলা এক কিশোরী সবুজ-টিয়ে পাখির মত
টুক টুক করে ফুল তুলছে।
কাঠগোলাপ গাছের পেছন থেকে ছোট মেয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
"বাবা দেখ তোমার নীলাম্বরী এসেছে।"
পিছনে তাকাতেই দেখি সবাই হুর-মুর করে জানালায় ভিড় জমাচ্ছে।
কৌতূহলী সে চোখগুলো নীলাম্বরী নয়, আমাকেই দেখছে।
ম্লান হেসে আমি জায়গা করে দেই ওদের।
আজ থেকে যেন অবসর পেলাম,
টিয়ে পাখিটার মুখের আদলে আজ নীলাম্বরী হাসছে।
রঙ করা মুখ
দেবব্রত, খুব কেঁদেছিলাম তখন,
আমার রঙ করা মুখটা তোর বেশি প্রিয় শুনে।
আমার ফ্যাকাসে মুখের নির্লিপ্ত চোখ, অমলিন হাসি, অগোছালো কথা
এ সব কিছুই কেমন থেমে গিয়েছিল সেদিন।
তোকে ঠকানোর কোন ইচ্ছা আমার ছিল না,
তাই তো প্রলেপ দেয়া এ দেবী মুখের আড়ালের
নরম কাদা আর খড়কুটোর কথা তোকে জানিয়েছিলাম।
অথচ তোর কাছে সে কাদা অস্পৃশ্য কোন নষ্টা কলনীর মনে হল।
ঘেটে দেখলি না কতশত অপবাদ নিয়ে
একের পর এক প্রলেপ দিয়ে সে নোংরা গুলোকে চাপা দিতে হয় দেবীকে।
রঙ করা ঐ দেবী মুখের কত প্রেমিক থাকে!
হাজার হাজার মনোবাসনা নিয়ে মাথা ঠুকে লোকে,
গড় হয়ে প্রণাম করে দশভূজা দেবীকে।
আমার রঙ করা মুখে আমিও দেবী ছিলাম তোর কাছে,
কতশত আব্দার তখন
তোর।
অথচ দেখ, সরলতম সত্যটা মেনে নিতে পারে না কেউ,
তুইও তার ব্যতিক্রম
নোস।
বিশ্বাস কর, প্রতিদিন রঙ না মাখতে পারি
একফোঁটা কাজল ঠিকই তুলে নেব।
সলতে জ্বালানো প্রতি সন্ধ্যা পূজোর পরের আলোটুকু কাজলের জন্য
বরাদ্দ হবে।
তবু তোর চোখ আটকে রইল গোলাপি আভার,
রঙ করা সে মুখে।
আমিও তাই দেবীর মত নিজেকে বিসর্জন দিলাম গঙ্গার ঘাটে।
বাংলার বীর
রচিব স্তুতি গান,
লক্ষকোটি জনতার বঙ্গবন্ধু প্রাণ।
চোখ যার দৃঢ় প্রত্যয়ে
হাসে,
বিজয়ের উল্লাসে।
মুখোশের আড়ালে শত্রুর বন্ধ আস্ফালন।
বিপ্লব তব হয়েছে শুরু, আটচল্লিশে ভাষার প্রশ্নবাণে।
মায়ের কোলেতে সর্পেরা গড়ে ডেরা
তুমি ছিলে বাঙালির কাটাতারের বেড়া।
বিপর্যস্ত গণতন্ত্র নিয়ে
খেলে মৃত্যুর পাঞ্জা বারংবার,
৬ দফা দাবি করেছ উত্থাপন।
পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
শত ভ্রুকুটি, পদেপদে তীরবান।
বাঙালিকে তবু করেছ বুকে ধারন
ভালবেসে তাই করেছি বঙ্গবন্ধু নামকরণ।
মুগ্ধ জনতা যপে একটাই নাম,
আলোর দিশারী, বঙ্গবীর তুমি বাংলার প্রাণ
হাসি মুখে কারা করেছ বরণ।
লঙ্ঘিতে ক্ষতি কাঁদিছে প্রাণ
বঙ্গবন্ধু তুমি, বাংলার বীর, করি তোমার জয়গান।
শ্মশান
শরীর থেকে পঁচা মাংসের গন্ধ পেয়ে
ছুটে গিয়েছিলাম আমি শ্মশানে,
নিজেকে পোড়াতে।
কাছাকাছি যেতেই পোড়া মাংসের গন্ধ আসে
পোড়া তবু মাংসের গন্ধটা চিরচেনা মনে হয়।
দূরে শ্মশানের এক কোনে দেখি
একটা চিতা জ্বলছে নিঃসঙ্গ ভাবে।
ধীর পদক্ষেপে চিতার কাছে গিয়ে
লাশটাকে সনাক্ত করে নিজেই চমকে উঠি
চিতার মধ্যে যে আমার শরীরটা বসানো!
আস্তে আস্তে দেহটা পুড়ে হয়ে যায় ছাই
হঠাৎ বৃষ্টি নামে, ছাই গুলো ধুয়ে নিয়ে যায় নদীতে।
বৃষ্টি থেমে গেছে, তবুও জলের গৌরব থামেনি
নদীর উত্তাল ঢেউ আমার পোড়া ছাই নিয়ে যাচ্ছে,
বিশাল সমুদ্রের বুকে বিলিয়ে দিতে।
আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি,
জায়গাটা এখন নির্মল বিশুদ্ধ
পোড়া ছাইয়ের কোন চিহ্ন মাত্র নেই।
_________________________________
No comments:
Post a Comment