৫ই নভেম্বর- সন্ধ্যা ৭ টা
মগবাজার রেল-গেইটে সবে মাত্র চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে চলে গেল মহানগর গোধূলি । চলে যাওয়া ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে আছে দুই বন্ধু তিতাস আর রুবেল। দুইজনেই বেশ ফিটফাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেল গেইটের সিগন্যালের কোণায়।দুইজনই বিমর্ষ। এরই মাঝে আবার গাড়ির চলাচল শুরু হয়ে গেছে রেললাইন ধরে। শব্দের চোটে থাকতে না পেরে রেললাইন ধরে এগিয়ে যেতে শুরু করল ওরা। রুবেলের চুল উষ্কখুষ্ক। পরনের গেঞ্জিটা অপ্রতুল শীতের জন্য।মৃদু মৃদু কাঁপছে সে- তবে সেটা কাছ থেকে না দেখে বোঝার উপায় নেই। তিতাস অবশ্য স্যুট পড়ে আছে। ঠাণ্ডার আঁচ টের পাচ্ছেনা সে। ঈদের পরদিন থেকে রাত হলে প্রতিদিন ঠাণ্ডার উৎপাত শুরু হয়। একারণেই সে স্যুট পড়ে এসেছে। যদিও আসার সময় তার গাড়িটা নিয়ে আসেনি। কারণ তারা এসেছে একটা বিশেষ কারণে। একটা ঘটনা ঘটাতে চলেছে দুইজনে মিলে। এই ঘটনায় তিতাসের বাবার পঁচিশ লক্ষ টাকা দামের গাড়িটার কোন প্রয়োজন নেই।
“কিরে- নফিস কে ফোন দিবি নাকি একটা?” হটাত করেই বলল কথাটা রুবেল। সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল তিতাস। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে রুবেলের কাঁপতে থাকা নার্ভাস মুখটা দেখে হেসে ফেললো সে।
বললো-“এই কাজ করতে কি নাফিস কে লাগবে? আমরা দুইজনে পারবো না?”
“কিন্তু যদি ট্রেন দেখে ভয় পেয়ে যাই?”
“আরে ভয় পাবো কেন? এই কাজ করার জন্য আমরা দুইজনেই যথেষ্ট”
“আরে তুই ডাক না ওকে”
“আরে তুই জানিস না ওকে ফোন করে কোথাও আসতে বললে সে আসে এক ঘণ্টা পরে?”
“আরে ততোক্ষণ না হয় আমরা দুইজনে মিলে কিছু খেয়ে নেবো ”
“ ঠিক আছে- ফোন দিচ্ছি”– বলে পকেট থেকে মোবাইল সেট টা বের করে নফিসের নাম্বার ডায়াল করে বলল-“দোস্ত তুই কই?”
“এইতো দোস্ত ” ওপাশ থেকে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠ শোনা গেলো নফিসের।
“দোস্ত দুই মিনিটের মাঝে মগবাজার রেল-গেইটে আয়”
“কেন? কি হইসে?”
“বিশাল সমস্যা- ফোনে বলা যাবেনা-আমরা ফারুকের চায়ের দোকানে অপেক্ষা করছি-চটপট চলে আয়”- বলে ফোন কেটে দিল তিতাস। তিতাস জানে নফিসের আসতে বেশ সময় লাগবে।মগবাজারের জ্যামে একবার পড়লেই দিন শেষ। তবুও বন্ধুকে তাড়া দেয় সে।
কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে আবার মগবাজারে ফারুকের চায়ের দোকানের দিকে হাঁটতে যেতেই হটাত স্থির হয়ে গেল তিতাস। কারণ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা ছায়ামূর্তি। অন্ধকার হয়ে এসেছে প্রায়। এর মাঝেই সে ঠিক টের পেল ওর সামনে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি হাইটের নফিস দাঁড়িয়ে আছে। পা গুলো একটু লম্বা বলে বন্ধুরা ওকে উটপাখি নামে ডাকে। তবে স্বভাব চরিত্র কচ্ছপের মত। প্রচণ্ড আলসেমির জন্য ওকে কেউ সহজে ঘাটায় না।পা দেখেই চিনেছে ওকে তিতাস। কিন্তু আজকে ওকে ফোন দেবার মিনিট খানেকের মাঝেই সে যেন উড়ে এসেছে ওদের কাছে।
“কিরে- তুই কেমনে আসলি এতো তাড়াতাড়ি?” জিজ্ঞাসা করল রুবেল। ঠাণ্ডা আরও আরো কাঁপতে শুরু করেছে সে।
“এইতো দোস্ত আমার দুলাভাইয়ের মোটরবাইকে করে যাচ্ছিলাম- তুই ফোন দিলি- তাই চলে এলাম” ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল নফিস।
“কিন্তু মোবাইলে তোর আশেপাশের শব্দ শুনে মনে হল তুই বাসায়”- তিতাসের মনের কোণে জড়ো হয়েছে খানিকটা সন্দেহ।
“আরে না- তুই ভুল শুনেছিস”
“ আর তোকে বললাম আমরা ফারুকের চায়ের দোকানে থাকবো- কিভাবে জানলি আমরা এখানে?”- এবার প্রশ্নবানে ভালোমতো চেপে ধরল তিতাস নফিসকে। আর প্রশ্নটা করেই ভালোমতো খেয়াল করে দেখল ওদের থেকে হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়ানো নফিস একটা কালো মোটা শাল পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর শালটাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে যে ওর মুখটা দেখাই যাচ্ছেনা। শুধু চোখ দুটো কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে আছে ।চোখ দুটোই শুধু দেখা যাচ্ছে সারা মুখের মাঝে।
“ আমি আন্দাজ করেই এসেছি” বলেই চুপ মেরে গেল নফিস। উত্তরটা শুনেই কেমন যেন চুপসে গেলো তিতাস । উত্তরগুলো ওকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। রুবেলের সাথে চোখাচোখি হল ওর। দেখল রুবেল ও কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছে নফিসকে। রুবেলের বার বার মনে হচ্ছে নফিস কোন ভাবে জেনে গেছে ওদের প্ল্যান। তাই বাগড়া দিতে চলে এসেছে। কিন্তু নফিসের কথা কোন ভাবেই শোনা যাবেনা এই চিন্তা করতে করতে ফারুকের দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলো তিন জন। প্রথমে তিতাস- তারপর রুবেল আর সবার শেষে নফিস।
৫ই নভেম্বর- সন্ধ্যা ৭:৩০ টা
ফারুকের দোকানে কাষ্টমার নেই বললেই চলে। শুধু কয়েকজন মুরুব্বি গোছের লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান চিবোচ্ছে।সাধারণত এখানে অনেক মানুষ থাকে। মানুষে গিজগিজ করে বলে বাইরে দাড়িয়ে থাকে অনেক কাষ্টমার। আজকে ভেতরে বসার যায়গা আছে দেখে তিতাস সোজা ঢুকে গেল দোকানের ভেতর। পেছন পেছন ঢুকল রুবেল। কিন্তু ভেতরে না ঢুকেই নফিস বাইরে থেকে বলল-“আমি এখন খাবো না কিছু- খিদা নাই”
তিতাস বিরক্ত হয়ে ফারুক কে বলল-“ফারুক দুই-কাপ চা-দে? আর তিনটা বেনসন দে”
“নাহ- আমার এখন সিগারেট খেতেও ইচ্ছা করছেনা”- আগের মতই গম্ভীর ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল নফিস।
“আসলে কি হইসে তোর?”-রুবেল এবার বেশ আগ্রহ বোধ করছে নফিসের ব্যাপারে। কারণ নাফিস চেইন স্মোকার। আর চায়ের দোকানে এসে নফিস কখনো চা না খেয়ে থাকেনা । আজকে সে কিছুই খাচ্ছেনা। ব্যাপারটা ভাবায় ওকে।
“কিছু না- তোরা তাড়াতাড়ি খা”
“কেন? এত তাড়া কিসের তোর?”
কিন্তু প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার পর নফিস যেখানে দাড়িয়ে ছিল সেখানে তাকিয়ে রুবেল দেখলো সেখানে নফিস নাই। তিতাস সেদিকে খেয়াল করেনি। সে সিগারেট ধরাচ্ছিল। রুবেল তিতাসকে জিজ্ঞাসা করলো –“ কিরে- কই গেল নফিস?”
“কি জানি- শালার ভাবগতি ভালো লাগছেনা আমার। আমার মনে হয় ও আমাদের প্ল্যানের ব্যাপারে জেনে গেছে” বলল তিতাস।
“আমারো তাই মনে হয়। আমাদের ফলো করে করেই সে এখানে এসেছে। আর তুই কল দেবার সাথে সাথে চলে এসেছে পেছনে। দেখেছিসনা কেমন একটা কালো শাল জড়িয়ে আছে? নিজেকে লুকানোর তালে ছিল ও। আমাদের পেছনে ছিলো বলে দেখিনি আমরা কেউ” – সন্দেহযুক্ত কণ্ঠে বলল রুবেল।
“চল তাড়াতাড়ি চা শেষ করে আমরা দড়ি কিনবো” তাড়া দিল তিতাস।
“দড়ি দিয়ে কি হবে?”
“কেন নফিস আমাদের বেঁধে দেবে- নাইলে তো তুই শালা ভয়েই পালাবি”
“ঠিকই বলেছিস। চল”- বলেই বিল দিয়ে রওনা দিলো ওরা বাজারের দিকে।
বাজারে পৌঁছে দুইজনে শক্ত মোটা দেখে দড়ির খোঁজ লাগালো। কিন্তু এদিকে রুবেলের পকেটে তেমন একটা টাকা নাই দেখে সে চিকন একটা দড়ি কিনলো। চিকন হলেও খুব একটা নরম না। একটানে খোলা যাবেনা। আর তিতাস কিনলো ইয়া মোটা একটা দড়ি। এটা কোনভাবেই ছিঁড়ে পালাতে পারবেনা সে- নিশ্চিত হয়ে আবার রেলগেইটের কাছে চলে আসল দুজন। আর আবার সেই রেললাইন ধরে হেঁটে এসে যেই একটা ঝোপের কাছে এসেছে অমনি পেছন থেকে নফিসের কণ্ঠ শুনতে পেল তিতাস আর রুবেল-“ কিরে দড়ি কিনে এনেছিস?”
কণ্ঠ টা শুনেই কেমন যেন একটা ভয়ের শিহরন টের পেল তিতাস আর রুবেল। তিতাস বলল-
“ হ্যাঁ কিনেছি”- ভয় পাবার কথাটা পুরোই এড়িয়ে গেল সে।
“তোরা কি ভাবনা চিন্তা করেই কাজটা করবি?” ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল নফিস।
“হ্যাঁ আমরা ড্যাম শিওর” জোড় দিয়ে বলল তিতাস-“ আচ্ছা তুই কিভাবে আমাদের প্ল্যান এর কথা জানিস? আমরা তো কাউকেই না জানিয়ে এখানে এসেছি”
“আমি সব জানি”
“কিভাবে জানিস? কে বলেছে তোকে?” কথাটা বলেই থেমে গেল রুবেল। এতক্ষণে সে নাফিসের জ্বলজ্বলে চোখ দুটো দেখতে পেয়েছে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি সে।এখন নাফিসকে দেখে কেমন যেন বেড়ালের মত মনে হচ্ছে ওর।
“ কেউ বলেনি। আমি আন্দাজ করেছি” বলেই চুপ হয়ে গেল নফিস। সে এখন অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সামনে দেখার কিছু নেই। ঘন অন্ধকার । রেললাইন বেয়ে চলেছে সুদূরে। আর তিনজনেই এখন রেললাইনের উপর দাঁড়ানো। তিতাস আর রুবেল থেকে হাত পাঁচেক দূরে দাড়িয়ে থাকা নফিস যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেছে।
ওদিকে মুখ করেই নফিস বলল-
“তোরা বিরাট ভুল করতে চলেছিস। তোরা এটা করিস না”।
“এটা ছাড়া আর কি পথ খোলা আছে আমাদের?” চিৎকার করে প্রতিবাদ করল তিতাস।
“একটা মেয়ের জন্য তোরা এভাবে...” থেমে গেল নফিস। তারপর বলল-“ পৃথিবীতে আর কি কোণ মেয়ে নেই?”
“দোস্ত- আমি কি বলেছি নাই? কিন্তু অন্য মেয়েকে বিয়ে করে এক ছাদের নিচে থেকে দুইজন দুইজনকে ভালোবাসবো না-এটা হবার চাইতে...” গলা ধরে গেল রুবেলের।
“কেন? তুই কি তোর বাবা মার কথা একবারও ভেবেছিস?” কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ল নফিসের।
“আমি জানি ওরা আমাকে ছেড়েই বেঁচে থাকতে পারবে।পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করেনা”
“ বেঁচে থাকবে।সবাই বেঁচে থাকে। মরা মানুষকে কেউ মনে রাখেনা। কিন্তু তোর ছোট বোনটা? কি হবে ওর?”
“ওর একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শুনেছি একটা ছেলেকে ভালোবাসে সে। ছেলেটাও ভালো। ভবিষ্যৎ আছে”
“কিন্তু ভাই হিসেবে কি তোর কোন দায়িত্ব নেই? একটা মেয়ের জন্য মরে যেতে হবে- তাও আত্মহত্যা?”
“ হ্যাঁ মরে যেতে হবে। আমাদের জীবনের কোণ মূল্য আছে ওর কাছে?”
“নাই তো কি হয়েছে – অন্য কাউকে ভালবাসলেই পারিস। আমি ও তো তারুকে ভালবাসতাম।”
“কি? অন্য মেয়ে? তারু ছাড়া কাউকে ভালবাসতে হলে তো তারুকে ঘৃণা করতে হবে”- এবার রুবেলের সাথে সুর মেলালো তিতাস।
“ তাই বলে এভাবে?”- ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল নফিস।
“হুম এভাবে- এই দেখ আমরা দুইজনেই দড়ি কিনে এনেছি। এই জন্যেই তোকে ডেকেছিলাম। তুই তো সব জানিস। এখন আমাদেরকে রেললাইনের সাথে বেঁধে দিবি। আর রেল আমাদের কেটে টুকরো করে দিয়ে চলে যাবে। আমাদের কোণ চিহ্ন থাকবেনা। ঐসব ফাঁসি- বিষ খাওয়ার চাইতে ঢের ভালো”- বলল তিতাস।
“আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো?” এবার আবারো তাকালো নফিস তিতাসের দিকে। জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর দিকে এক সেকেন্ডও তাকাতে পারলোনা সে। চোখ নামিয়ে নিল তিতাস।তারপর বলল-
“আমার কোন পথে খোলা নেই রে। বেঁচে থাকার কোন মানেই নেই এখন আমাদের”
“কেন? তোর তো মেয়ের অভাব নেই। অন্তত তারুর প্রেমে পড়ার আগেও ছিলোনা। কি এখন কি কোন মেয়েকে নিয়ে আবার শুরু করা যাবেনা?”- বলল নফিস।
“ নাহ যাবেনা। আমি কোণ মেয়েকেই ভালবাসতে পারিনি রে। রিমা- কিংবা সুনিতা- কাউকেই না। ওরা আমার টাকাকে ভালোবেসেছিলো। আমাকে না। আমার কথাতে উঠতো বসতো। চেয়েছিল আমার সম্পত্তি পাবে ওরা। কিন্তু তারু সেটা চায়নি। আর চায়নি বলেই ওকে আমি যেন বেশি ভালোবেসেছি। আর...” বলেই থেমে গেল তিতাস। চোখের কোন দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর।
“আর?”
“আর গতকাল ওর বিয়ে হয়ে যাবার পর থেকেই আমার মনে হচ্ছে আমার বেঁচে থাকা উচিত না। অন্তত আমার না। আমি একটা মেয়ের প্রেম আদায় করতে পারিনি। আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি কোনদিন রুবেলের মতো। তোর মত ভালো ছেলে হয়ে থাকতে পারিনি। আর একটা মেয়েকে শুধু ভালবাসতে চেয়েছি- সেটাই যখন হবেনা তখন আমার বেঁচে থেকে কি লাভ বল?”
“কিন্তু তোরা ভুলে যাচ্ছিস জীবন তো একটাই। তারুকে দুইজনেই ভালোবেসেছিস।আমি নিজেও ভালোবেসেছিলাম। বিয়ে হয়ে গেছে বলে এখন দুইজনেরই মরে যেতে হবে? তারুর বিয়ে হয়ে গেছে তো কি হয়েছে? তোদের মাঝে কেউ একজন তারুকে বিয়ে করলে আরেকজন কি করতি?”
“আরে সে জন্যই তো মরে যেতে চাইছি। একজীবনে কতদিন এই ব্যাথা বয়ে বেড়াবো?” বলল রুবেল।
“আরে পৃথিবীতে কি আর কোন মানুষ প্রেমে ছ্যাঁক খায় না? নাকি ছ্যাঁক হলেই ওরা সবাই মরে যায়?”
“ আরে সবাই যা করে- যা পারে সব কি আমাকে পারতেই হবে? করতেই হবে? আমি তারুকে ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবোনা”- বলেই রেললাইনের উপর বসে পড়ল রুবেল।
“ আমার বাবার অনেক টাকা । সেই টাকা পায়ের উপর পা রেখে বাবা সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। আমাকে কোন দরকার নেই পৃথিবীর”-বলে তিতাস ও বসে পড়ল রেললাইনের উপর। ঠিক এমন সময় একটা ট্রেন ওদের পাশের লাইন দিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল মগবাজারের দিকে। তিতাস খেয়াল করলো কথা বলতে বলতে ওরা অনেক দূরে চলে এসেছে। জায়গাটা বেশ নির্জন। আশে পাশে কোন বস্তি ও নেই। সাথে সাথে ট্রেন লাইনের উপর বসে পড়ল সে। বলল -
“নে আমাদের এখানেই বেঁধে দে। আমরা এখানেই বসে পড়বো। আমাদের বেঁধে দিয়ে তুই চলে যেতে পারিস। কিংবা...”
“কিংবা?”
“কিংবা আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারিস। তোর কোন সমস্যা নেই। আমরা বাসায়...”
“ডেথ নোট লিখে রেখে এসেছিস-এইতো?”
“হুম তাই। তোর সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে সেটা কোন ভাবেই যেন পুলিশ জানতে না পারে সেজন্য আমরা আমাদের সিম ও নষ্ট করে ফেলবো এখন”।
“শোন এতো কিছুই করার দরকার হবেনা। এখন বাসায় যা। ভালো করে ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দে। তারপর সকালে চলে আয় আবার ভার্সিটিতে। ক্লাস আছে। আবার সাড়ে নটায় সিলভি ম্যাডামের পরীক্ষা। না দিলে নির্ঘাত ফেল” যন্ত্রের মত বলে গেল নফিস।
“আচ্ছা আমাদের কে বাঁচিয়ে রাখার কি এতো স্বার্থ তোর? আমরা তোর কি এমন বন্ধু? ভালোমতো খোঁজ ও নেই-না। কি করিস- কি খাস সেটাও জানিনা। একবার তোর বাসায় গিয়েছিলাম – ঠিকানাও ভুলে গেছি। আমাদের জন্য হটাত কর এতো দরদ উথলে উঠল কেন তোর?” জিজ্ঞাসা করল তিতাস। সে এখন ফুঁসলে ফাঁসলে নফিসকে দিয়ে কাজ আদায় করিয়ে নিতে চাইছে।
“আমি শুধু মাত্র তোদেরকে বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছি” বলেই আবার চোখ ঘুরিয়ে নিল নফিস। অন্ধকারে ওকে প্রায় দেখা যাচ্ছেই না। তিতাস আর রুবেল থেকে বেশ দূরে সে। দূর থেকেই ভেসে আসল ওর কণ্ঠ। আগের মতই ঘড়ঘড়ে।যন্ত্রের মত।
“আচ্ছা তোর কি হয়েছে বলতো দোস্ত? আজকে এরকম করছিস কেন?” জিজ্ঞাসা করল তিতাস।
“কিছু না। এখন চল। কিছুক্ষণ পর ট্রেন আসবে”- বলল নফিস।
“ট্রেন আসবে তুই কিভাবে জানিস?”
“আমি জানি সব। চল এখন”
“না- আমাদের এখন ফেরার উপায় নেই। বাবা নিশ্চয় এতক্ষণে ডেথ-নোট পেয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। এখন খুঁজে পেলে একেবারে কারাগারের ভেতরে ঢোকাবে”
“তাহলে কি এখন তোদের বেঁধে দেব?”
“সেটাই কর। এখন আমাদের বেঁধে দে। তারপর ভাগ তুই। আমাদের মরণ দেখার দরকার নেই” বলে তাড়া দিল তিতাস।
নিরুপায় হয়ে দুইজনকে দুইদিকে ফিরিয়ে বাঁধতে শুর করল নফিস। রুবেলের দড়ি চিকন হওয়ায় ট্রেন লাইনের রিং এর সাথে বেঁধে ফেললো সে সহজেই। তারপর হাত-পা বেঁধে দিলো নফিস। কিন্তু তিতাসের দড়ি অনেক কষ্টে বেঁধেছে নফিস। কষ্ট করে বাঁধা শেষ করেই নফিস বলল-“আমি এখন যাই। ট্রেন আসবে ভোরে। ততোক্ষণ পর্যন্ত তোদের কোন চিন্তা নাই”।
খেপে গেল তিতাস- “মানে কি? ট্রেন ভোরে আসবে মানে?”
“মানে চট্টগ্রামের "তূর্ণানিশীথা" এসে পৌছাবে ভোরে। ততোক্ষণ তোরা বেঁচে আছিস। এর মাঝে সিদ্ধান্ত পাল্টালে আমাকে ডাকিস। আমি আশেপাশেই আছি” বলেই চট করে গায়েব হয়ে গেল নফিস। এমনিতেই জায়গাটা অন্ধকার। এরই মাঝে নফিস ওদের দুইজনকে বেঁধে রেখে চলে যাওয়াতে আরো বেশি রেগে গেল রুবেল আর তিতাস। তিতাস ইচ্ছা মত গাল দিল নফিস কে। কিন্তু নফিসের টিকির নজরও দেখা গেলনা।
শেষে কোন উপায় না দেখে দুইজনেই বসে থাকলো লাইনের উপর। ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে চিন্তা করেই হাঁপিয়ে উঠল ওরা। নফিস কে অনেক ডেকেও কোন সাড়া পায়নি দুজন। একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে ।শেষে উপায় না পেয়ে ঘুমিয়ে সময়টা কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল ওরা।
৬ই নভেম্বর- ভোর ৫.০০ টা
আকাশ পুরো অন্ধকার। আলো একফোঁটাও নেই। কিন্তু একটু একটু ফর্সা হতে শুরু করেছে পুব আকাশ। তবে প্রচণ্ড কুয়াশায় বোঝা যাচ্ছেনা সূর্যের আঁচ। ঠিক এমন সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল তিতাসের। “রুবেল ট্রেন আসছে”
এমন সময় নফিসের কণ্ঠ শোনা গেল-“ হুম সেটাই দেখছি” নফিস যেন প্রস্তুত ছিল। সে এগিয়ে এলো দুইজনের কাছে। অন্ধকারে ভালোমতো ঠাহর করা যাচ্ছেনা ওকে। নফিস সামনে আসতেই তিতাস বলল
“দোস্ত আমাকে মাফ করে দিস। ট্রেন আসছে। আমি টের পেয়েছি। অনেক দূরে আছে। তবে খুব একটা বেশি দূরে নেই”
এর মাঝেই ট্রেনের কাঁপুনি টের পেয়ে রুবেল ও জেগে উঠেছে। জেগে উঠেই যেন অন্য মানুষ সে। ট্রেন আসা টের পেয়েই সে নফিসকে বলল-“ দোস্ত আমার বাঁধনটা খুলে দে। আমি মরবোনা”
শুনেই হেসে ফেললো নফিস।হাসিটা শুনে কেমন যেন ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল তিতাস। ট্রেন দেখে রুবেলের মৃত্যু চিন্তা একেবারেই উদাও হয়ে গেছে। ও জানতো এটা হবে। নফিস বলল-
“কি মরার ইচ্ছা চলে গেছে?”
“আমি দোস্ত অনেক চিন্তা করলাম। বেঁচে থাকাই ভালো। মরে গেলেতো সব শেষ”
“সেটাই” বলতে বলতে এগিয়ে গেল রুবেলের দিকে।পাতলা দড়ি। নফিস হাত ছোঁয়াতেই যেন আলগা হয়ে গেছে বাঁধন। দ্রুত উঠে দাঁড়াল রুবেল। শব্দ এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। নগরীতে প্রবেশের সাথে সাথে ট্রেনের গতি কমে এসেছে অনেক। কিন্তু অনেক দূর থেকেও ট্রেনের আলো চোখে পড়ল ওদের। কুয়াশা ভেদ আলো করে ওদের চোখে এসে লাগছে।
রুবেলকে খুলে দিতেই হাত পা নেড়ে বলল-“নে তিতাসের টা খুলে দে”
“নাহ-তোর সাথে এরকম কথা ছিলো না। কথা ছিলো যতই বাঁচতে ইচ্ছা করুক- আমরা মরবোই” রেগে গিয়ে বলল তিতাস। তবে এখন যেন দোটানায় পড়ে গেছে সে। তাই গলায় জোড় কম এই কারণে।
“ আরে ট্রেন কাছে চলে এসেছে। ” বলে কাছে তিতাসের কাছে আসল নফিস।
“ নাহ- আসবিনা। আমি মরবো। ঐ রুবেল মরবেনা বলে আমি ও কি মরবো না নাকি? আমি মরবোই”
“আরে ট্রেন চলে এসেছে। পাগলামি বন্ধ কর”
“আসলে আসুক”
“আরে দোস্ত পাগলামি করিস না”
কি যেন চিন্তা করে তিতাস বলল “ঠিক আছে- দে কেটে দে”
এর মাঝেই ট্রেন প্রায় একশ গজ সামনে চলে এসেছে। ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। কান ঝালাপালা করা হুইসেল।
নফিস চেষ্টা করছে দ্রুত দড়ি কাটার জন্য। হাতে একটা ছুড়ি। কোন ফাঁকে নিয়ে চলে এসেছে টের পায়নি তিতাস আর রুবেল। কিন্তু মোটা দড়ি কোন ভাবেই কাটছেনা। ছুড়িটার ও ধার নেই। একেবারেই ভোঁতা। ভোঁতা ছুড়ি দিয়ে দ্রুত কাটতে গিয়ে যেন আরো ভোঁতা হয়ে গেল ছুড়ি টা।
“দোস্ত তাড়াতাড়ি কর। ট্রেন প্রায় চলে এসেছে” তাগাদা দিল তিতাস। এখন সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছে সে। রুবেল ও দাড়িয়ে থাকলো না। দুইজনে মিলেই খুলতে চেষ্টা করছে দড়ি। কিন্তু মোটা দড়িটা দিয়ে স্লিপারের রিঙের সাথে ভালোভাবে বেঁধেছিল নফিস। এখন খুলতে পারছেনা। কাটতে ও পারছেনা।
ট্রেন এখন মাত্র বিশ গজ দূরে। সাক্ষাত মৃত্যুকে কাছে দেখতে পেয়ে তিতাস পুরো ভেঙ্গে পড়ল। কান্না শুরু করলো সে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই সে বলল-
“দোস্ত আমারে মাফ করে দিস। আমারে ক্ষমা করে দিস”
“আরে দাঁড়া প্রায় খুলে ফেলেছি” বলে হাত চালালো নফিস। আর কয়েক গজ দূরে থাকতে চট করে বাঁধন আলগা হয়ে গেল তিতাসের।যাদুর মত শক্ত গিট না কেটেই তিতাসকে মুক্ত করে দিল নফিস। আর বাঁধন আলগা করেই ওকে নিয়ে পাশে ঝোপের মাঝে গড়িয়ে পড়ল সে। রুবেল আগেই সরে গিয়েছিল। নিজের চোখেই যেন মৃত্যুকে দেখতে পেল তিতাস। আর কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেছে এবারের মত।
ট্রেন চলে যেতেই চোখ খুলল তিতাস। তারপর নফিস কে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। নফিস সান্ত্বনা দিয়ে বলল-
“যা–অনেক পাগলামি হয়েছে। এখন বাসায় যা। কিছুক্ষণ রেস্ট নে। আজকে ক্লাসে আয়। টেস্ট আছে- যা দুইজনেই বাড়ি যা”
“আমি তোর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ দোস্ত” এখনো কান্না থামছে না তিতাসের। তিতাসের অবস্থা দেখে রুবেল ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। শুধু নফিস আগের মতই নির্বিকার। শেষে যে যার বাড়ির পথ ধরলো।সূর্য উঠে গেছে এর মাঝেই। একটু পরেই ক্লাস শুরু হবে। তাই সবার মাথায় প্লান পরীক্ষায় কে কি লিখবে। কিছুক্ষণ আগেও যে মরতে বসেছিল সেই কথাটাই বেমালুম ভুলে গেলো তিতাস আর রুবেল। নফিসের দিকে তখন আর কোন খেয়াল নেই ওদের। একটু খেয়াল করলেই দেখতে পেতো নফিস দূরে তাকিয়ে আছে ওদের দুইজনের দিকে। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি।
৬ই নভেম্বর - সকাল ৯টা
ভার্সিটি গেটে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসল তিতাস আর রুবেল। রুবেল কে বাসা থেকে তুলে নিয়েছে তিতাস। এর মাঝে নফিসকে ও কল দিয়েছিল। কিন্তু ফোন বন্ধ ওর। বারবার ওপাশ থেকে কে যেন বলছে-‘অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন”
গেইট দিয়ে ঢুকতেই হটাত করে খেয়াল করল তিতাস- সবার মাঝে যেন কিছু একটা হয়েছে। কেমন যেন চুপচাপ পুরো এলাকা। সবাই যেন কথা বলতে ভুলে গেছে। থমথমে পরিবেশ।
“কিরে আবার মারামারি লাগল নাকি?” তিতাসকে জিজ্ঞাসা করল রুবেল।
“আগে গিয়ে দেখি” – যেন নিজেকেই নিজে বলল তিতাস।
মেইন বিল্ডিং পাশ কাটিয়ে ওদের বিল্ডিং এ ঢোকার মুখেই একটা জটলা দেখতে পেলো। জটলা ভেঙ্গে দুইজনেই ভেতরে ঢুকে চট করে ধাক্কা খেল। সবাই মন মরা। সামনে একটা স্টেজ বানানো হয়েছে।সেখানে একটা ব্যানার টানানো। তাতে লেখা-“মেধাবী ছাত্র নফিস ইন্তেখাবের অকাল মৃত্যুতে আমরা শোকাভিভূত। লা ইলাহা...রাজিউন”।
নিচে নফিস ইন্তেখাবের ছবি আর তার নিচে লেখা নফিস ইন্তেখাব; জন্ম ১২ই অক্টোবর ১৯৮৫-মৃত্যু ৫ই নভেম্বর ২০১২”
লেখাটা দেখে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল তিতাস আর রুবেল। দুইজনে নিজেদের দিকে তাকালো। দুইজনের চোখেই অবিশ্বাস যেন ভর করেছে সর্বশক্তি দিয়ে। দুজনের কেউই বিশ্বাস করতে পারছেনা নফিস তারুর বিয়ের রাতেই মারা গেছে। এমন সময় সমাবেশে কেউ একজন বলে চলেছে-
“আমাদের মেধাবী মুখ নফিস আর আমাদের মাঝে নেই। গত পরশু রাতে সে নিজের বাসায় ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সে এভাবে আত্মহত্যা করবে আমরা ভাবতেই পারিনি।কি কারনে মারা গেছে সেটাও জানা যায়নি। আমরা চাইনা আর কেউ এভাবে মৃত্যু বরন করুক...”
No comments:
Post a Comment