05 July 2016

দেবাশীষ ধর



বসন্তের চমকার বিকেল। আকাশের কোল জুড়ে শীতের অত্যাচার থেকে রেহায় পেয়ে শহরের গাছেরা একটু ভাল করে নি:শ্বাস নিচ্ছে যেন অনেক দিনের জড়তা ভেঙ্গে সতেজ হওয়ায় একটু পরিপাটি হল। ফুটপাতের কোণায় টঙ এর সেই ছোট্ট দোকানে ভিড়। পাশের কাঠের বেঞ্চটায় বসলো বিকাশ আর তার বন্ধু হাসান। হাসান দোকানিকে চা এর কথা বলে একটি সিগারেট ধরালো।
‘আজ একটু ভীড় বেশি’- সে সিগারেট এক টান দিয়ে বলে, ‘হু বলে চেয়ে আছে বিকাশ খানিক দূরে সেই ভীড়ের দিকে যেখানে বই মেলা হচ্ছে।

অনেকেই বই দেখছে, কিনছে, এদিক-ওদিক হাটছে, কেউ কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে। ওদিকে একপাশে গোল হয়ে বসে ছেলে মেয়েদের একটি গ্রুপ গিটার বাজিয়ে গান করছে। ও মামা চা নেন- দোকানি চা এর কাপ দুটি বাড়িয়ে দেয়। চা এক চুমুক দিতেই বিকাশের ভাবনায় এলো গত বছরের বই মেলা। ‘সারাটা বিকেল সে আর শ্যামা একসাথে ঘুরা আর কত আড্ডা! সেবার সে একটা বই গিফ্ট করেছিল শ্যামাকে, কবিতার বই শ্যামা, কবিতা খুব একটা পড়ে না। প্রথম প্রথম বিকাশ বই থেকে আবৃত্তি করে শোনাত। এরপর একসময় শ্যামার আর আবৃত্তি শুনতে ভাল লাগে না। কারণ তখন এটা সে বুঝতে পেরেছিলো যে কবিতা নিজে পড়ে যে অনুভূতির আনন্দ তা শুনে কখনো পাওয়া যাবে না...হঠা তার ভাবনায় ছেদ পড়লো। একটা শব্দ শুনলো...অস্পষ্ট হালকা- নাহ! হয়ত ভূল। গত রাতে তার ভাল ঘুম হয়নি। তাই হয়ত উল্টা-পাল্টা কিছু শুনছে। না এবার একটু স্পষ্ট। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একবার মেলার ভিড়ের দিকে, আবার রাস্তার শেষ মাথার মোড়ের দিকে ‘কই! কোথাও তো কিছু নেই!

গত কয়েক দিন আগে শ্যামার সাথে প্রায় ৬ মাস পর দেখা। তখন বিকেলটা একরকম ফকফকা ছিলো। সেবার তাদের মধ্যে বেশ আড্ডা হয় কিন্তু কোথাও যেন একটা শূন্যতা ছিল। সেদিন শ্যামা অবাক করে একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়, যা তার চলে যাবার পরেও বিকাশের কানে বাজতে থাকে। ‘নে টান দে- হাসান সিগারেটটা তার মুখের কাছে এনে বলে। বিকাশ হাতে সিগারেট নিয়ে এক টান দিয়ে আনমনে বলে, ‘শব্দটি কিসের রে?  -শব্দ? হাসান ফিরে জিজ্ঞেস করে। ‘হ্যাঁ, একটা ডাক শুনতে পাচ্ছিস না!’ পাল্টা প্রশ্ন করে বিকাশ। হাসান শোনার চেষ্টা করে বলে, ‘হ্যাঁ একটু একটু’।

বিকাশ বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল। ডাকটি ক্রমাগত বাড়ছে। সে খেয়াল করলো, পথচারীরা হাঁটাচলা বন্ধ করে দাড়িয়ে গেছে। এমনকি সামনের আইল্যান্ডের উপর বসে যার আড্ডা দিচ্ছিল ওরাও কি যেন খুঁজছে। ‘মনে হয় উপর থেকে শব্দটা আসছে’-হাসান আইল্যান্ডের মাঝখানের গাছগুলোর দিকে হাত দেখিয়ে বলে। সিগারেটের শেষ টান দিয়ে বিকাশ সবুজ পাতার আড়ালে চোখ রেখেছে। আবছা অন্ধকারে কি যেন নড়ছে। সে অবাক হয়ে আরও লক্ষ্য করলো, মেলার ভিড়ের সমস্ত কোলাহল একেবারে থেমে গেছে। সব মাথাগুলো বেশ আগ্রহ ভরে সেই দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। গানের সেই গ্রুপটি গান বন্ধ করে কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করছে। আশে-পাশের বিল্ডিংগুলোর ছাদ থেকে কিশোরীরা, বেলকনির বুড়োরা, হকাররা, দোকানিরা এবং ধীরে ধীরে সকলেই সেই ডাকে
নিস্তেজ। বিকাশের মনে হচ্ছে সে ঘোরের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে। মাথাটা বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে আবার তাকাল, না এটা স্বপ্ন নয়। তার পেছনে, সামনে, ডানে, বায়ে সবকিছুই স্থির। তার হঠা মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।


শেষ বিকেল, গোধূলির হলুদ ছায়ায় আকাশ ঢাকছে। বিছানায় ঘুম ঘুম চোখে বিকাশ জানালার বাইরে তাকায়, অনেক্ষণ ধরে সে একটি ডাক ঘুমের মধ্যে শুনছিল।

No comments:

Post a Comment