05 July 2016

মির্জা মোনালিসা


বিষুবচক্র

আব্দুল খালেক নদীর ধারে বসে আছে। অন্ধকারের জন্য। তখন সে বাড়ির পথে রওনা হবে; লোকচক্ষু এড়িয়ে। তার খোঁড়া পা-টা খুব টনটন করছে। কবে যে পায়ের মধ্যে পেরেক ঢুকে গজাল পা হয়ে গেছে তার। গজাল পা নিয়ে এখন তার হাঁটতে একটু কষ্টই হয়। আর কষ্ট হয় দিনের আলোয়।  দিনের আলোয় সে সবকিছু তাল গোল পাকিয়ে ফেলে। তখন না আকাশ, না পথ, না ঘর কিছুই ঠিকমতো চিনতে পারে না। যেন চিনতে চায় না। যেন চিনলেই বিপদ। যেন কারো চোখে পড়ে গেলে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তা সে দিতে চায় না। তাই সে বসে থাকে। এতদূর পথ হেঁটে এসেছে সে। না গিয়েও উপায় ছিল না। যতদূর সম্ভব সে নিজ গ্রামের মানুষজন এড়িয়ে চলে। বিশেষ করে নায়েব সাবকে। নায়েব সাবের সামনে পড়লেই মনে হয় তার সবকিছু তিনি বুঝে যাচ্ছেন।

এবার শীত পড়েছে জাঁকিয়ে। এমন শীত গত দশ বছরেও পড়েনি। গাছের পাতা ঝরে পড়েছে। চুলপড়া ন্যাড়া বুড়ির মতো দেখাচ্ছে গ্রামটাকে। আলো নিভে যাবে এখনই। হাটুরেরা ফিরে যাচ্ছে। সে আলগোছে হাতের মুখের রক্ত ধুয়ে নেয়। নদীর খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে গিয়ে অনেকটাই ছড়ে গেছে হাত-পা। রক্ত বেরুচ্ছে। চোখে মুখে জল দিয়ে তার একটু ভাল লাগতে থাকে।

একটু আগেও রোদ তার যাদু বিস্তার করে রেখেছিল বংশাইয়ের বুকে। এখন আলো-আঁধারির খেলা। শীত বিকেলের নিভে আসার আলোর পাশে থমকে আছে নদীটি। একলা পড়ে আছে বিধবার থানের মতো বালুচরের বুকে।
বংশাই, বঙ্গশ কিংবা গাঙ্গ যার যা খুশী সে নামেই ডাকে তাকে। শুকনার দিনে সে নিশ্চল বয়ে যায়, কিন্তু  ভরা বর্ষায় বঙ্গশ তো গাঙ নয় যেন দরিয়া। আজদাহার মতো সবকিছু গ্রাস করতে উঠে পড়ে লাগে। একসময় এটি কেবল বর্ষায় নয়, সব সময়ই প্রমত্তা ছিলো। বড়ো বড়ো সওদাগরী স্টিমার ভিড়ত গ্রামের পশ্চিম ঘাটে। স্টিমার থেকে বস্তায় বস্তায় নামত চিনি, টিনে-টিনে নামত ঘি। সরকার গিন্নির তো মাথার সামনের চুল সাদাই হয়ে গেছিল আঙুলের ঘি মুছতে মুছতে। আর ছোটো বাচ্চারা কান্না করলে তাদের হাতে চিনির দলা ধরিয়ে দেয়া হতো। বড় সরকারের দুই মেয়ে হোমসে থেকে পড়া শোনা করত। বড় ছেলে বিএ পাশ করে গ্রামের স্কুলে পড়ানো শুরু করে। তবে বড় সরকার মারা যাওয়ার পর বাড়ির সব ঠাঁট বাট শেষ হয়ে যায়। মেয়ে দুটিকে স্কুল ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন বড়বোনের স্বামী। এমনিতেই সরকার বাড়ির মেয়েদের বউ করে নেয়ার জন্য ছেলের বাবারা হা পিত্যেশ করে বসে থাকত। কেননা রূপে-গুণে চালচলনে ওই বাড়ির মেয়দের তুলনা হয় না। তবে রূপ না থাকলেও গুণের অভাব নেই কাজীবাড়ির মেয়েদের।  বাড়িতে একজনও অশিক্ষিত নেই। ছেলেমেয়েরা কলেজ পাশ দিয়ে যার যার মতো অবস্থান করে নিয়েছে। কাজী সাহেব স্বয়ং দিল্লী থেকে আলেম পাশ করেছেন। তারপর দীর্ঘদিন সরকারি নায়েব ছিলেন। পরে সিও রেভিনিউ হলেও তার নামের সঙ্গে নায়েব সাহেব সারাজীবনের জন্য  জড়িয়ে গেছে । সরকার বাড়ি এবং কাজী বাড়ি দুটোই বংশাইয়ের পাড়ে- আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে।

বংশাই ঘেষা এ জনপদের নাম কালীয়ান। তবে ভাঙতে ভাঙতে কালীয়ানের অর্ধেক নদীগর্ভে আর ওপাড়ে কাউলজানীর ভূমিতে জেগে উঠেছে। নদী ভাঙনে অনেকেই বাড়ি বানিয়েছে গ্রামের পূবদিকে পাহাড়ের ওপর। কালীয়ান গ্রাম এখন দুই ভাগ- টানপাড়া আর দুফাপাড়া। একদিকে নদীর পলিতে শস্যের  প্রাচুর্য, অন্যদিকে আম আর কাঁঠালের বাগান। নামাজ, বাজার-সদাই, জলের জন্য টানপাড়ার মানুষ নেমে আসে দুফাপাড়ায়। আর দুফাপাড়ার মানুষ প্রিয়জন বিয়োগ হলে নিশ্চিন্তে টানপাড়ার মানুষদের জিম্মায় কবর দিয়ে বাড়ি ফেরে। কাজীবাড়ির তিন স্তর। বাইরবাড়ি, ভেতরবাড়ি আর তারও পেছনে শরীকবাড়ি। সরকার বাড়ির ঠাঁট কমে যাওয়ায় কাজী বাড়িই এখন বলতে গেলে গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করে। কাজী বাড়ির বাইর বাড়িতেই গ্রামের একমাত্র মসজিদ, পানীয় জলের জন্য টিপকল। আর আছে বাংলা ঘর, বিশাল দহলিজ সেখানে চেয়ার টেবিল, আর গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য লম্বা বেঞ্চ। বাড়িতে মেহমান এলে তাদের জায়গা হয় বাংলা ঘরে। বাংলাঘরের পেছনেই ফুলের বাগান। তারপর দুটো বড় ঘর। পেছনেই ফুলের বাগান। তারপর বড়ো দুটো ঘর। তারপর উঠোন। উঠোন পেরিয়ে টালি ছাওয়া রান্না ঘর। পশ্চিমে ফলের বাগান আর পূবে লেবুর বাগান।

বড়ো সরল এই গ্রামের মানুষ। এইখানে অশ্রু আছে, হাসি আছে, জীবনের হল্লা আছে। আছে নারীর চুলে গন্ধরাজ তেলের ঘ্রাণ, টিব্বত স্নো’র সুবাস। ঘাড়ে গলায় পাউডারের প্রলেপ মেখে পুরুষেরা বাইর বাড়িতে মজমা বসায়। নারীরা স্বাভাবিক আব্রু মেনেই ঘরে-বাইরে কাজ করে। তাদের ওপর অনাবশ্যক কালো বোরখার ঘেরাটোপ চাপিয়ে দেয়া হয়নি। নিজ পালানে জল দিতে দিতে তারা শ্লোক বলে, বিয়ে বাড়িতে কাউকে ঠকানোর জন্য ঠল্লক বলে। গ্রামে বিদ্যু নেই, তবে অন্ধকারে তারা ভূতের ভয় করে না। উসব পার্বণে গ্রামের ধনী গরীব সবার বাড়িতে একই আনন্দ। ঈদের আনন্দ ভাগাভাগির পাশাপাশি বর্ষার নৌকা বাইচ, পৌষে ফাইলা পাগলার মেলা কিংবা চৈত্র সংক্রান্তির মেলার আনন্দ আছে। পরিবারের মুখে হাসি দেখলেই তারা খুশী। কেননা বছরের বীজ তো নারীর হাতেই থাকে। কাচের বৈয়ামে বীজ ভরে সিকার মধ্যে ঝুলিয়ে রাখে বিছুইন। যে মরসুমের যে বিছুইন তা হিসেব করে তুলে দেয় পুরুষের হাতে। আর পান্তা খেয়ে লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে হাসিমুখে মাঠে চলে যায়।

কালীয়ান গ্রামের ঠিক উল্টো বড় বাসালিয়া। বংশাই নদীর উজানে এই গ্রামটিতে কোনো আলো নেই, না শিক্ষার না অন্তরের। বড় বাসালিয়ার সব কিছুতেই অন্ধকার। ঝাড়ফুঁক, তাবিজ তাদের নিত্য সঙ্গী। কয়েকদিন আগে করিম বক্সের তের বছরের মেয়ে- যে কোনো কথাই বলে না, পর্দা ছাড়া হাঁটে না, ঘরের বাইরে যায় না, তারই খিলখিল হাসিতে গ্রামসুদ্ধ মানুষ তাজ্জব বনে যায়। মেয়েটি এই হাসে তো এই কাঁদে। চান্দের দিকে চাইয়া চাইয়া কান্দে। শিকলি দিয়া কান্দে, বিনুনি দিয়া কান্দে। এতেই সবার ধারণা হয়, করিম বক্সের মেয়েকে ভূতে ধরেছে।

বাঁশঝাড়ের ঝোঁপ, বিন্না ছোবার ঝোঁপ থেকে সম্ভবত মাইছা দেও করিম বকশের ইলিশ মাছের মধ্যে দিয়া বাড়িত আইছে। ওই মেয়ে নাকি মাছ কাটতে গিয়াই অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর থিকাই নাকি সুরে কথা কয়, আঁমারে ভাঁত দেঁও, আমারে মাছ দেও, আমি মাছ খামু। মেয়েটির শরীর থেকে ইলিশ মাছের গন্ধ আসতে থাকে। বড় বাসালিয়ার সবচেয়ে বড়ো কবিরাজ আনা হলো। উঠোন ভরে গেছে উৎসুক জনতায়। কালীয়ান গ্রামের  হাটিপাড়া থেকেও মানুষ এসেছে। উঠোনের মাঝখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মেয়েটিকে রাখা হয়েছে। কবিরাজ প্রথমে ঝাড়– দিয়ে মেয়েটাকে ঝাড়ফুঁক করে। তারপর ঝাড়– দিয়ে আঘাত করতে থাকে। প্রথমে আস্তে , তারপর আরো জোড়ে। মেয়েটি কাঁদে না। কবিরাজ ঘেমে গেছে ।
অথচ মেয়েটি কাঁদে না।
কবিরাজ ঘেমে উঠে
বল কে তোকে পাঠিয়েছে।
কেউ না।
বল কউ থিকা আসছস।
কথা নেই।
বিন্না ছোবার ঝোঁপ থিকা আসসছ না!
হ!
উপস্থিত জনতা অবাক হয়। এবার কবিরাজ খাঁটি সরিষার তেল মেয়েটির নাকে ঘষে দেয়। তারপর আঘাতের পর আঘাত চলতে থাকে।
একসময় ক্লান্ত হয়ে কবিরাজ বসে পড়ে। মেয়েটি নিথর পড়ে থাকে।

করিম বকশের বউ তাকে ঘরে নিয়ে যায়।
দোকানদার সামসু বলে গ্রামে যে ভূত ঢুকেছে তা নাকি সে আগেই টের পেয়েছে। তার দোকানে যে কুকুরটি বাঁধা থাকে রাতে হঠাৎ করে চিৎকার করতে থাকে। সামছু দোকান বন্ধ করে ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কুকুরের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে বের হয়, তারপর দেখে বাঁশঝাড়ের ভেতর চিকন আলো জ্বলছে। আর সেই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কুকুরটি ডেকে চলেছে। সে বুঝে যায় সেখানে তেনারা এসেছেন। সে তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে পড়ে দোয়া ইউনূস পড়তে থাকে।

বড়বাসালিয়া গ্রামের মানুষ ফাঁপরে পড়ে যায়। তাদের গ্রামে চারদিকে বান দিতে হইব। রাতে দল বেধে তারা গ্রামের সীমানা জুড়ে মশাল জ্বালিয়ে রাখে। ভূত তাড়ানোর জন্য টিনের কৌটায় শব্দ করে। গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস কোনো বিয়ে সাদি লাগলেই গ্রামে ভূতের আছর হয়। করিম বক্সের মেয়ের বেলায়ও তাই হয়েছে। যেদিন থেকে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই দিন থেকেই তার উল্টা-পাল্টা আচরণ। একবার নাকি মোহর আলীকেও মাইছা দেও প্রায় আটকিয়ে ফেলছিল। ভরা বর্ষাকাল তখন। মাছ পড়েছে আজ জালে অনেক। নৌকা থেকে নেমে গ্রামের পথ ধরেছে, হঠাৎ তার মনে হয় কে যেন পিছন পিছন আসছে।  পেছনে ফিরে সে কাউকে দেখতে পায় না।
সে দ্রুত পা চালায়।
-দেঁ দেঁ এঁকটা মাঁছ দেঁ।
এবার সে বুঝে যায় মাইছা দেও পিছে পিছে আসছে। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ায় আর দোয়া পড়ে। দৌঁড়ায় আর দোয়া পড়ে। কেমন করে সে বাড়ি আসে বলতে পারে না।সে রাতে তার অসম্ভব জ্বর আসে। কালীয়ান গ্রামের মানুষ বড় বাসালিয়াকে ডাকে ভূতের গ্রাম বলে। বাড়িতে হাট বাজার পাঠিয়ে দিয়ে হাটখোলায় বসে যখন তারা গল্প করে, তাদের সেই গল্পের অর্ধেক জুড়ে থাকে বড় বাসালিয়ার ভূতের গল্প।




___দুই___
ফজরের নামাজের পর জমি-জমা পরিদর্শন শেষে বাইর বাড়িতে বড়ো মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসে আছেন কাজী সামসুর রহমান। সামনে ছোট্ট কাঠের টেবিলে একটি বই। কিন্তু তিনি উদাস হয়ে তাকিয়ে আছেন নদীর দিকে। জোহরের নামাজের অক্ত তখনও হয়নি। ভেতর থেকে করিমন এক কাপ চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট রেখে যায়। এবার রবিশস্যের ফলন খুব ভালো হয়েছে। কালিজিরা ধানও হয়েছে বেশ। তার ছোটো মেয়ের ঘরের নাতনিটা পোলাও খেতে খুব ভালোবাসে। ওর মা সকালে হলুদ রঙের পোলাওয়ের সঙ্গে হাঁসের ডিমভাজি বা ভুনা করে দেয়। মেয়েটা মনে আনন্দ নিয়ে খায়। এবার সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। তিনি ঠিক করেছেন নাতনির জন্য এক মণ চাল পাঠাবেন। কিন্তু পাঠাবেন কাকে দিয়ে? আবদুল খালেককে ডাকতে হবে। তবে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে! নদী ভাঙনের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে সে! মান্নু থাকলেও এখন আর ভাবতে হতো না। গাছের আম কাঠাঁল নিজের কাঁধে বয়ে সে বোনদের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।
 সেবার এ বছরের মতো এতো শীত পড়ে নাই। মান্নু মেট্রিক পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কাজী সাহেব ছেলেদের মধ্যে এই ছেলেটাই একটু ডানপিটে।  লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলায় মনোযোগ তার বেশি। হা ডু ডু খেলায় তার মতো খেলোয়াড় সাত গ্রামে নেই।  ছেলেটা সুন্দর বাঁশিও বাজায়। কিন্তু তিনি এসব পছন্দ করেন না। তিনি ঠিক করলেন তার মেজো ছেলে যে শহরে একটি কলেজে পড়ায় তার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। পাঠানোও হলো। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে মান্নুকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করেন প্রভাষক সাহেব। কয়েকদিন বড়োছেলের কাছে কাটিয়ে জ্বরে ভুগে ছেলেটা বাড়ি ফিরে আসে। এ ঘটনায় কাজী সাহেব  রাগ হন, ব্যথিত হন কিন্তু কাউকে কিছুৃ বলেন না। বাড়িতে রেখে ছোটো ছেলেকে পড়াশোনার জন্য সুযোগ করে দেন। ছেলেটার আবার বাদাম টানা খাওয়ার খুব শখ। আর সেই বাদামটানাই তার কাল হলো। বাদাম টানা খাওয়ার কথা বলেই বন্ধুরা তাকে ঘরের বার করে। রাত তখন দশটা । গ্রামের পৌষের রাত দশটা মানে গভীর রাত । সারা গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ গ্রামের পশ্চিম দিকে নদীর পাড় থেকে অনেকগুলি কুকুরের আওয়াজ ভেসে আসে। মান্নুর মা কী মনে করে মান্নুর ঘরের সামনে যান। দরোজা লাগানো, ভেতর  থেকে হ্যারিকেনের আলো আসছে।  ছেলে তার পড়ছে! তিনি ছেলেকে বিরক্ত না করে বিছানায় ফিরে আসেন।
নায়েব সাহেব ধমক দেন- এতোবার উঠা-নামা করতাছ ক্যান?
কেমুন য্যান ডর ডর করতাসে।
ঘুমাও। তুমার ডর ডর স্বভাব আর গেল না!
কুত্তাগুলা এতো জোরে জোরে ডাকতাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মান্নুর মা।
সন্তানের কিছু হলে মায়ের মন বোধহয় আগে জানান দেয়। কই তার তো উথাল পাথাল লাগে নাই। ফজরের পর পর হাল বাইতে গেছিল রহম আলী। সেই ছুটতে ছুটতে আসে। ক্যারা য্যান মান্নুরে জব কইরা মাইরা ফালাইছে। পাগলের মতো ছুটলেন তিনি। তার এই ছেলেটা কার কী ক্ষতি করেছিল! কোন সীমার তার ছেলের বুকে ছুরি বসাল। চোখ ভিজে ওঠে তার।
ও বাবাগো ও মাগো আমার এতবড় সর্বনাশ কেমনে হইল?
আবার কার কী সর্বনাশ হলো! নায়েব সাহেব চমকে ওঠেন। হালটের দিক থেকে সন্টুর মার কান্দনের আওয়াজ আসছে। তা নিকটবর্তী হচ্ছে বাইর বাড়ির দিকেই। কান্নার সঙ্গে কথা মিলে মিশে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
রতন!
হাঁক দেন নায়েব সাহেব।
রতন দ্যাখতো সন্টুর মার আওয়াজ না!
হ নায়েব সাব।
ডাকো তারে।
সন্টুর মা মাথার কাপড় ঠিক করে বাইর বাড়ির কাঁচামিঠা আমগাছটার নিচে দাঁড়ায়। তারপর হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দেয়। তার কান্না থেকে কথাগুলো উদ্ধার করলে দাঁড়ায়, কালকে তার ছোট যে ছেলেটা পানিতে ডুবে মারা গেল, গ্রামের সবাই মিলে  যার জানাজা পইরা পাহাড়ে কব্বর দিয়া আসল , সকালে সে ছেলের কব্বর জিযারত করতে গিয়ে দেখে  বেশুমার কারবার। কব্বর তো আর কব্বর নাই, সমান হইয়া গ্যাছে। শিয়াল থিকা বাঁচানোর জন্য খেজুরের ডাল দিয়া বেড়াও দেয়া হইছিল। সেগুলাও অনেক দূরে পইরা রইছে। কেমনে তার পোলার কবর সুমান হইয়া গেল!
মাইনষের কাম না, নায়েব সাব। তয় জংলী জানোয়ারের কামও না। কেমনে হইল নায়েব সাব!
কালীয়ান গ্রামে কোনো কুসংস্কারের জায়গা নেই। মুসলমানদের লাশ কখনো ভূত হয় না। নয়েব সাহেব কোনো দিন কাউকে বলেননি, এটা জীনে করছে, এটা ভূতে করছে। তিনি বিশ্বাস করেন মানুষের হাত ভূতের হাতেও চেয়েও বড়। আপাতত সায়েব সাহেব সন্টুর মাকে ছেলের জন্য দোয়া করতে বললেন। আর তিনি দেখবেন বিষয়টা কি?
রতন গ্রামের সবাইরে খবর দাও জোহরের নামাজের পর সবাই গোরস্তানে যাবো। খালেক কই, ওরেও ডাইকা পাঠা। আইজ-কাল তার দেখন পাওয়া যায় না।
খালেকরে তো সকালে বয়রাতলীর দিকে যাইতে দেখলাম। মনে হইল কাপড় বেচতে যাইতাছে। তাইলে তো রতন তোমারে একটু শহরে যাইতে হয়। আমার ছোটো মেয়ের মেয়েটা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইছে ওর জন্য কিছু কালিজিরা চাউল পাঠাবো। আর তোমার মামানিরে বলো পিঠাও বানাইতে। মান্নু বাইচা থাকলে আর কাউরে কিছু কওন লাগতনা।
হ নায়েব সাব কি থিকা যে কী হইয়া গেল? মান্নুর খুনীরা বুক চিতাইয়া ঘুইরা বেড়ায় কিছু কইতে পারি না।
নায়েব সাহেব ভেতর বাড়িতে যান। আজকে তিনি বাড়ির তোলা পানিতেই গোসল সারবেন। ততোক্ষণে বাইর বাড়িতে পুরো গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সবাই নদীতে ডুব দিয়ে পাক সাফ হয়ে এসেছে।
জোহরের নামাজ শেষ করে গ্রামসুদ্ধ পুরুষরা চলে পাহাড়ের দিকে, তাদের পূর্বপুরুষদের কবর সেখানে। বড়ো কাঁঠাল গাছটার নিচে ইসমাইল মাওলানার কবর। তার পাশে তার স্ত্রীর কবর, তার পাশে নায়েব সাহেবের বড়ো ভাইয়ের কবর। আর ইসমাইল মাওলানার কবরের পাশে নায়েব সাবের ছেলে মান্নুর কবর। দাদী তাকে খুব আদর করত। তাই দাদীর কবরের পাশেরই তাকে কবর দেয়া হয়েছে।
তাড়াতাড়ি পা চালায় সবাই। কবরস্থানের পাশে ঈদগা মাঠে আসরের নামাজ শেষ করে আলো থাকতে থাকতে ফিরতে হবে। অন্ধকার হয়ে গেলে মুরুব্বীরা আবার চোখে দেখতে পারবেন না।
নায়েব সাহেব সবাইকে হাত তুলতে বলেন, ‘ইয়া পরোয়ারদিগার, আমরা তোমার নাখান্দা বান্দা, তুমি আমাদের সকলের গুনাখাতা মাফ করে দাও। ইয়া আল্লাহ এইখানে আমাদের বাবা, দাদা, পরদাদা, আমাদের প্রিয় মানুষেরা শুয়ে আছেন, তাদেরকে তুমি শান্তিতে রাখো। হে কবরবাসী আপনারা আমাদের প্রতি রুষ্ট হইয়েন না। আমাদের গ্রামকে আপনাদের ক্রোধ থেকে মুক্ত রাইখেন। ইয়া আল্লাহ, তুমি আমাদের গ্রামকে রক্ষা কইরো, কোনো কালো ছায়া আমাদের গ্রামে পড়তে দিও না।’ দোয়া পড়তে পড়তে তার গলা ধরে  এলে সবার কণ্ঠেই প্রিয়জন হারানোর বেদনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা ক্রন্দন করে, তারা দোয়া করে। অতঃপর তারা গ্রামের ফিরতি পথ ধরে।
শীত বিকেলের আলো প্রায় মরে এসেছে। সেই সময় ক্ষীণ একটি অবয়ব ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে। অন্ধকারে সে মানুষ নাকি বুনো জানোয়ার ঠিক বোঝা যায় না। নায়েব সাহেব বুঝতে পারেন না, তিনি কি ঠিকই দেখেছেন নাকি তার চোখের ভুল। আজকাল চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তার।




___তিন___
আবদুল খালেকের ঘুম ভেঙে যায়। সে আলগোছে বিছানা থেকে শরীরকে বিযুক্ত করে। জাইরা শীত! সে ইচ্ছে করলেই আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে পারত। এই রকম হাড় কাঁপানো শীতে বউয়ের উম্ ছেড়ে যে উঠে সেতো বোকার হদ্দ বোকা না হয়ে পারে না। ঘরের বেড়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে মাঘের হাওয়া সূক্ষè হয়ে ঢুকে যেতে তার হাড়ে। সে গলার মাদুলীটার মধ্যে হাত রাখে। ঝড়, বৃষ্টি, ঘাম ধুলো আর সময়ের দাগ লেগে মাদুলিটা যেমন পুরু হয়েছে তেমনি তার শরীরের অংশে পরিণত হয়েছে। মাদুলি হারালে তার বউ তার বশে থাকবে না, মাদুলি হারালে সে আর আবদুল খালেক থাকবে না। তার গুরু বলেছে এই মাদুলী নির্জন পথে, জঙ্গলপূর্ণ পথে তাকে বদজীন, পরী আর সাপ-খোপ থেকে বাঁচায়। মাদুলিটা ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শীতভাব তিরোহিত হয়ে যায়। শিয়রের কাছ থেকে সবুজ চাদরটা দিয়ে ভালো করে মাথাটি মুড়ে সে বাইরে বের হয়। নিকষ অন্ধকার কেটে কেটে সে পথ চলে। মাঘের শীত, সাপের ভয় কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারে না। লোক হয়তো ঝরা পাতার আওয়াজ শোনে কিন্তু তার পায়ের আওয়াজ কেউ শুনতে পায় না। অন্ধকারে লেপ্টে যেতে ভালো লাগে তার। মাঘের উত্তুরে হাওয়াও ভালো লাগে। গ্রামের সুনসান ভাবের ভেতর ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে নিজেকে সে রাত্রির মাঝে মিশিয়ে দেয়।
আব্দুল খালেক আগে এমন ছিল না। সে নদী ভালোবাসত। নদীর ঘ্রাণ ভালোবাসত।

আব্দুল খালেকের বাড়ি একসময় দুফা পাড়ায় ছিল- বঙ্গশের গা ঘেঁষা বাড়িটা ছিল তাদের। গেল বর্ষার আগের বর্ষায় হঠাৎ করেই বাড়িটা মাঝরাতে নদীর গর্ভে চলে যায়। তিনদিন তিনরাত ধরে বৃষ্টি। এমন ঝুম বৃষ্টি এ এলাকার মানুষ বহুদিন দেখেনি। শ্রাবণের ভরা গাঙ তখন বঙ্গশ। আসমানে পূর্ণ চাঁদ। কোথাও থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে। মনে হয় কে যেন বৃষ্টির মধ্যে ঘুনঘুন করে কাঁদছে। এটা নদীর কান্দন। কান্নার বিনুনি ধরেই গ্রামের মানুষ বুঝতে পারে তাদের কপালে দুর্ভোগ আছে। খালেকের ছোটো ভাইটাই প্রথম নদীভাঙন দেখে। তারা প্রথমে খুব একটা গা করে না। কিন্তু তার মা দরিয়া বেগম ঠিকই মুড়িটা, চিড়াটা বেঁধে ফেলেন । পাশের বাড়িতে রেখে আসেন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খালেক গরুগুলিকে খাবার দেয়। খালেক ভাবে পাড় ভাঙলেই আর কতটুকু ভাঙবে! দুপুরবেলা যখন মায়ের কান্দন শুরু হয়  সে মাকে সান্ত্বনা দেয়। দরিয়া বেগম কোনো কিছুই শুনেন না। নদীর তোড়ের সাথে মায়ের কান্দনও বাড়তে থাকে। ধুপধাপ আওয়াজে তারা কেউ ঘুমায় না। কিন্তু কখন যেন তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। পূবের আকাশে আলো ফুটলে খালেক দরোজা খুলে দেখে দরিয়াটা একেবারে ঘরের দুয়ারে। ঘরের পেছনের বেড়া কেটে তারা পাশের বাড়ি যায়। সারাদিন দুইভাই মিলে মালপত্র সরায়। দুইটা গরু , মা, তার বউ কুলসুম আর ভাইটাকে নিয়ে পাহাড়ে এসে ওঠে। মা আর বউকে কাজীবাড়িতে দিন সাতেক থাকতে দেন নায়েব সাব। দুই ভাই পাহাড় পরিষ্কার করে একটা ঘর বান্ধে- মা-বউকে নিয়ে আসে। শুধু আব্দুল খালেক না, বাড়ি ভেঙেছে রহিম বক্সেরও। রহিম বক্স কিছুই বাঁচাতে পারে নাই। এক কাপড়ে টাউনে চলে গেছে বউটারে নিয়া। খালেকের বউ কুলসুম খুবই  গোছানো । সব পরিস্থিতিই সে মেনে নিতে পারে। আবদুল খালেকই কেবল অকম্মার ঢেকি। ছোটো ভাইটাও শহরে গিয়ে চাকরি জুটিয়েছে। মাকে নিয়ে গেছে। সে যায়নি। তার খালি মনে হয় শহরে গেলেই গাড়ির তলে পড়ে মারা যাবে সে। আর যাই হোক, গাড়ির তলে সে পড়তে চায় না। আর এই গ্রাম, নদী, গাছপালা, ঝোঁপ জঙ্গলে কেমন যেন নেশা আছে। দিনের আলোয় একরকম। আর রাতে অন্যরকম। রাত হলেই গ্রামের জঙ্গল যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে।



___চার___
আবদুল খালেক বাইরে বের হয়। এমনভাবে যে বাতাসও টের পায়নি। খুব দ্রুতই সে জায়গামতো পৌঁছে যায়। একহাতে টর্চ চেপে শাবলের দুই ঘাই দিতেই সরে যায় মাটি। কাফনটা সরিয়ে নিতেই মাথাটায় ঝিম ধরে যায় তার।
এ যে লতিফ সিকদারের ষোল বছরের মেয়ে রাফেজা! সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। হাত থেকে টর্চ পড়ে যায়।  পেছন থেকে কে যেন তাকে টেনে ধরে! তার সবুজ চাদরটাও কোথায় পড়ে যায়! দমবন্ধ করে সে যে কখন নায়েব সাহেবের বাইর বাড়িতে এসে পড়েছে বলতে পারবে না!
জ্ঞান হারাবার আগে সে দেখে নায়েব সাহেবের দীর্ঘদেহ।
‘মানুষের যে হাত আমি আগেই বুঝছিলাম খালেক।’

...আমারে মাফ দেন নায়েব সাব... 






পরজীবীর সঙ্গে বসবাস

গভীর স্বপ্নোচ্ছ্বাস নিয়ে জেগে উঠলাম। কাল রাতে শিথানের পাশে একে একে দাঁড়ালেন পূর্বপুরুষেরা। তাহাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব স্পষ্ট। এই সন্ধ্যা, এই সারস সময় অবিমিশ্র ক্ষমা ও ঘৃণায় বাক্সময়। এইখানে একদিন হরিণ জননীরা খুলেছিল দ্বিধার বসন। আর কোনো অঙ্গীকার নেই। হেঁটে যাই শ্যাওলা রঙিন পথ ধরে। পদপ্রান্তে পুষ্প ও পাথর পড়ে থাকে...

পুষ্প ও পাথর খুঁজে খুঁজে হয়রান ইশাররাত শবনম। কোথায় পুষ্প আর কোথায় পাথরের সন্ধান পাওয়া যাবে তারই তালাশ করতে থাকে। দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেটে যায়। পার হয় একেকটি কুয়াশা ঋতু। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়ও সে দেখতে পায় দূর মাঠে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। একথা মনে হলেই তার ভালো লাগতে থাকে। ভালো লাগতে থাকে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি। সে বলেছিল, সন্ধ্যা মানেই সুন্দর, সন্ধ্যা মানেই আলো-আঁধারির মিলন। সন্ধ্যা মানেই সন্ধি। সন্ধ্যা দুটো জানো তো, সায়ন সন্ধ্যা আর প্রাতঃসন্ধ্যা! ইশাররাত মুগ্ধ হয়ে শোনে । সন্ধ্যা দু-রকম। দুটোই সুন্দর। কিন্তু সেই সুন্দরকে দেখার চোখ তার কোথায়! নিজেকে ফিরে দ্যাখো, ইশাররাত। বুদ্ধ বলেছেন, বারবার নিজের দিকে তাকাতে হয়। এই যে সময় সময় নিজের দিকে তাকানো তা আসলে নিজেকেই পরখ করা। নিজেকেই উদ্ধার করা। মানুষ তো নিজেই নিজের প্রভু। মানুষ নিজেই নিজের আশ্রয়।’ সে লেখার টেবিল, বারান্দা, ঘর কোথাও শান্তি খুঁজে পায় না। আলো-আঁধারি ধরে হাঁটতে থাকে। জীবনের আলো-আঁধারি- কী আলো, কী অন্ধকার! অনন্ত কাল ধরে তো এর মধ্যেই সে হাঁটছে। তবু তার মনে হয় সে কখনো সন্ধ্যা দেখেনি। তাহলে জীবনে কি কোনো সন্ধি নেই তার!
কী লেখেন ইশাররাত শবনম?
চমকে ওঠে সে। যেন একটানে কেউ তাকে সদর রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিল। যেন মুহূর্তে সমস্ত অনুভূতি বিবর্ণ, বিস্বাদ হয়ে গেল। যেন একটা কটু স্বাদ পাকস্থলী থেকে বেয়ে বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে তা তার গলার মধ্যে আটকে রইল। 
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সালাম দুররানি। দ্রুত লেখার কাগজটি সরিয়ে ফেলে সে।
আরে সালাম ভাই! আপনি? কখন এলেন? আমারে খবর দিতেন। আমি নিজে গিয়া আপনার সঙ্গে দেখা কইরা আসতাম।
সালাম দুররানি হাসেন।
আরে আইছি কি সাধে? আমি হইলাম সালাম দুররানি, ‘হরির লুটের বাতাসা’র সম্পাদক। আমারে হুমকি দেয় টেলিফোনে?
এইজন্য আপানাকে ছুটতে হবে? দেন নাম্বার দেন- দেখি কি করতে পারি।
এইজন্যই তো আপনের কাছে আইছি। আমি জানি আপনেই পারবেন এর ফয়সালা করতে। আপনারে দেখলেই তো আমার শান্তি লাগে। পৃথিবীর কোনো বেডা মানুষ যা পারে না আপনি মুহূর্তের মধ্যে তা কইরা দেখান।
সালাম দুররানি টিভির রিমোট হাতে নেন, টিভির ভলিউম বাড়িয়ে এক পা, দু’পা করে তার দিকে আসতে থাকেন।
আপনে আরাম কইরা বসেন সালাম ভাই, আমি কফি বানাইয়া আনি। এই যে, এইডাও আপনি আমার মনের মতো কথা কইছেন। হ, কফিই লইয়া আসেন। এক লগে বইসা কফি খাই।

দুররানিকে পাশের ঘরে বসিয়ে সে কফি বানাতে যায়। কেটলিতে জল ফুটছে। সে ক্রিস্টালের মগে কফি ব্লেন্ড করতে থাকে চামচ দিয়ে। জল ফুটছে, কফি ব্লেন্ড হচ্ছে। সবকিছু ঠিক আছে, তার অফিস কক্ষে ‘হরির লুটের বাতাসা’র সম্পাদক বসে আছেন। কিন্তু কী যেন ঠিক হতে হতেও ঠিক মনে হয় না তার কাছে। আচ্ছা, এই কফি বানানো নিয়েই তো সে একবার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল বোধহয়। আর ওই ‘হরির লুটের বাতাসা’র চাকরি তো ছেড়েছে দশ বছর আগে। প্রতিদিন তার অ্যাসাইনমেন্ট নতুন নতুন মানুষের সাক্ষাকার নেয়া।
আপনি একটা কাজ করেন, যাগোর ইন্টারভিউ নিবেন তার একটা তালিকা বানাইয়া ফালান।
ইশাররাত তালিকা বানায়। দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী। ফুটনোট দিয়ে লেখে: বৃক্ষের দাগ লাগা মানুষদের সাক্ষাকার নিতে চায় সে। সালাম দুররানি তার তালিকা দেখে খুশী হন। জানতে চান, বৃক্ষের দাগ লাগা মানুষ বলতে ইশাররাত কী বুঝিয়েছে?
ইশাররাত আনন্দের সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে থাকে। এই যেমন ধরেন, শতবর্ষী মানুষ। বিচিত্র পেশার মানুষ। তাদের জীবনবোধ। তাদের দর্শন নিয়ে ইন্টারভিউ করতে চাই।
ঠিক আছে করবেন। এই তালিকা থাকুক আমার কাছে। আমি একটা তালিকা করছি। এইডা লন। আগে এই মানুষগুলার ইন্টারভিউ নেন। পরে আপনার তালিকা ধরবেন। মানুষ বুইঝা ইন্টারভিউ করবেন- এই ডা তো আপনেরে কইয়া দিতে হইবো না। তবে একটা কমন প্রশ্ন বেবাকতেরে করবেন, আপনার কি কিছু বলার আছে?
ইশাররাত তালিকা দেখে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারে না। তালিকায় সব রাজনীতিবিদদের নাম। এমনসব রাজনীতিবিদ তারা যে ওইসব মূর্খ-ভাঁড়দের নাম পর্যন্ত সে মনে রাখতে চায় না। এই নামগুলো কখনো তার মস্তিষ্কের হার্ডডিস্কে ঢুকবে এও সে চায়নি।
নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যায় ওই লোকদের সাক্ষাৎকার নিতে। তার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে থাকে। মস্তিষ্ক হাতরে হাতরে শব্দ বের করে। একশটি সাক্ষাৎকার নেয়ার পর একদিন অফিসে যেয়ে দেখে তালা ঝুলছে। কোথাও কাউকে পাওয়া যায় না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারে সালাম দুররানি মালয়েশিয়া না মালদ্বীপ কোথায় যেন চলে গেছে। কিন্তু আজ কোত্থেকে এলো? সে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর মগে জল ঢালে, দুধ ঢালে। কফি প্রস্তুত। নিজের জন্যও এক কাপ বানায়। মগ দুটো নিয়ে তার কক্ষে আসে।
 সালাম দুররানির মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে। ইশাররাত তো জানে না, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়।
আপু আপনি কত্তো ভালো, কখন থেকে মনে মনে চাইছি এক কাপ চা বা কফি দরকার।
-তুমি কখন এলে?
-কখন এলাম মানে? আমি তো সকাল থেকেই অফিসে । আপনি যখন ঢুকলেন তখন গুড মর্নিং বললাম। আপনি বললেন রুমা ভালো আছো?
-তাই?
-কী হয়েছে আপা মন খারাপ? আজ আপনের মন খারাপ, আমারও অনেক মন খারাপ। সেই কথা বলতেই তো এলাম।
-হায় ঈশ্বর! তার সঙ্গে কী হচ্ছে এসব! রুমা কেন এসেছে?
-কী হয়েছে রুমা? তোমার বাচ্চা কেমন কেমন আছে?
-বাচ্চা! আমার আবার বাচ্চা হলো কবে? তবে একটা বাচ্চা নেয়ার জন্য অনেক কিছু করছি। কিন্তু কী করবো আমার স্বামীর স্পার্ম দুর্বল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ আমার কোনো অসুবিধে নেই। কী করবো আপু, একটা বাচ্চা না হলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো?
ইশাররাত ভেবে পায় না, মেয়েটি বাচ্চার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? একটা মানব শিশুকে পৃথিবীতে এনে এতো অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলার কী মানে হয়, তা সে বোঝে না। নিজেদের জীবনেরই নিরাপত্তা নেই, কে কখন কোথায় লাশ হয়ে যাবে, গুম হয়ে যাবে। তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আর এই মেয়ে বাচ্চার জন্য লাফাচ্ছে।
আমি যাই আপু, কাজল এসেছে। বাসায় যাবো।
-কাজল? মানে তোমার স্বামীর বন্ধু!
-হ্যাঁ।
-ওই যে ছেলেটি তোমাদের বাসায় থাকে?
-হ্যাঁ।
-আসলে ও আমার বন্ধু। ও না থাকলে তো এই শহরে আমার থাকার জায়গায়ই থাকত না। আজ যাই আপু, কাল দেখা হবে।
সমস্ত আালো নিয়ে রুমা ঝলমল করতে করতে চলে যায়। ইশাররাত ধন্ধে পড়ে যায়।

‘খাঁটি সোনায় যেমন গয়না হয় না, তেমনি নিরেট সত্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন চলে না, জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে চাই সত্যের সঙ্গে মিথ্যের মিশেল; একটু প্রলেপ। আর নিজের সম্পর্কে কখনো পুরোপুরি ইনফরমেশন কাউকে দিতে হয় না।’ এ দর্শন রুমার। ইনফো প্রাইভেট এর ফ্রন্টডেস্ক এক্সিকিউটিভ। ফর্সা, সুন্দর মুখে সবসময় ঝকঝকে একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে ব্রাউন আই পেন্সিল দিয়ে ভ্রু দুটোকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।
ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে বাইরে চলমান বিড়ম্বিত মানুষকে রেখে অফিসে ঢুকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইশাররাত শবনম। রুমা ওকে ঘাম মোছার জন্য টিস্যু এগিয়ে দেয়। বসতে বলে। এসির ঠান্ডা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। তার ভালো লাগে। রুমাকে তার সহোদরার মতো মনে হয়। যদিও তার কোনো সহোদরা নেই, সহোদরা থাকলে তার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হয় সে জানে না, তবে প্রীতির সম্পর্ক হয় নিশ্চয়ই।
প্রতিষ্ঠানটিকেও তার ভালো লেগে যায়। অবশ্যই তা ইনটেরিয়র ডেকোরেশনের জন্য। অফিসসজ্জাকে এরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে! এটা অবশ্য এজন্য যে, অফিসকে যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে পূর্ণ করো, যারা এখানে কাজ করতে আসবে তাদের যেন বাড়ি যেতে ইচ্ছে না হয়।
ইশাররাতের মনে হয় সে এখানে চাকরি করতে নয়, এসেছে রুমার সঙ্গে দেখা করতে। কিংবা রুমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই এখানে আসা। কোনো পরিচয়কেই তার অযৌক্তিক মনে হয় না, নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হলেই মনে হয় তার সঙ্গে দেখা হবে বলেই সে এ পর্যন্ত এসেছে। সেদিন তো কথায় কথায় একজনকে বলেই ফেলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই তো বেঁচে আছি। বিষয়টি কি পাগলামীর পর্যায়ে পড়ে! কী জানি! তার কাছে এটাই সত্য। ‘তোমার মাঝে অনেক কথা আছে রুমা।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সে লাফিয়ে ওঠে। ‘তুমি কী করে বুঝলে আপু। আসলেই ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়ের মধ্যে অনেক গল্প থাকে।’
‘শুধু ফ্রন্ট ডেস্ক নয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কিছু না কিছু গল্প থাকে।’
‘ফ্রন্ট ডেস্কে বেশি থাকে।’
‘কারণটা কি?’
‘কারণ অসংখ্য। যে মেয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করে তার জীবনটা অভিশপ্ত। হয় সে, না হয় তার পূর্বপুরুষ অনেক পাপ করেছে। সেই পাপে মেয়েটিকে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করতে হয়।’
পাপ! হবে হয়তো!
ইশাররাত বিস্মৃতির ঘ্রাণ পায়!
‘মেঝেতে ময়লা, কাপ-পিরিচে ময়লা, এগুলো খেয়াল করো না কেন?’ বসের রাগ। ইশাররাতের জানা ছিল না রিসিপশনিস্ট এগুলো খেয়াল করতে হয়।
‘আপনাকে  কেন রাখা হয়েছে? আমার টয়লেটের তোয়ালেটা ময়লা, এটা দেখবেন না ’
‘স্যার আপনার টয়লেটে তো আমি ঢুকি না। তাছাড়া টয়লেটের তোয়ালে অপরিষ্কার কিনা তা দেখবে আপনার ব্যক্তিগত সহকারী কিংবা জমাদার।’
‘ঠিক আছে আমার কফিটাতো বানিয়ে দেবে!’
‘চা-কফি বানানোর জন্য তো আমি অফিসে আসি নাই, অফিসে এসেছি অফিসিয়াল কাজ করতে।’
বস অবাক। তার মুখের ওপর কোনো কর্মচারী এভাবে কথা বলতে পারে!
ইশাররাত এক মুহূর্তও দেরি করে না। বসের সামনে পদত্যাগপত্র রেখে চলে আসে। যাই হোক, সে সালাম দুররানির জন্য কেনই বা কফি বানাল আর তার বানানো কফি কেনইবা পান করল রুমা ভেবে পায় না সে। রুমার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল গত বছর;  নিউমার্কেটে। দেখা হওয়ার পর জেনেছিল সে মা হতে যাচ্ছে। আর কাজলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বাচ্চাটা কাজলের কিনা জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি। কারণ সন্তান মায়ের এটাই সে বিশ্বাস করে।  বাবা তো কেবল হয়ে ওঠা, যেমন নারী ও পুরুষ উভয়কে মানুষ হয়ে উঠতে হয়।

ইশাররাত শবনম হঠাৎই আবিষ্কার করে তার ঘরের মধ্যে একটি বোলতা উড়ছে। বোলতাটিকে সে তাড়াতে চায়, যেমন করে একাকীত্ব তাড়াতে চায় জনাকীর্ণ নগরীর বাসিন্দারা। অবশেষে ইশাররাত শবনম বুঝতে পারে সে আসলে বিছানায় শুয়ে আছে।
‘আমার কী হয়েছে?’ কাকে প্রশ্ন করে ঠিক বোঝা যায় না। তবে একটা উত্তর আসে ঠিকই। যেন তার মাথার ভেতর থেকে কেউ কথা বলছে। ‘তুমি ২০ দিন ধরে অসুস্থ।’
বিশ দিন! অথচ কেউ আমাকে দেখতে আসে নাই?
হ্যাঁ, কেউ তোমাকে দেখতে আসে নাই। তুমি একা একা ডাক্তারের কাছে গেছ, ওষুধ এনেছ, খাবার খেয়েছ। একবার ভেবেছিলে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কাপড় চোপড়ও গুছিয়ে ছিলে কিন্তু যেতে পারো নাই।
কেন বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল সে? মনে পড়েছে, কয়েকদিনের জ্বরে তার মনে হলো সে মরে যাচ্ছে। একা একা মরে গেলে কেউ জানবে না, ঘর থেকে দুর্গন্ধ বের হবে। তার চেয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া ভালো, সেখানে অন্তত মানুষের মধ্যে মরতে পারবে।
-আচ্ছা কেউ তোমাকে দেখতে এলো না কেন পিপুলের পাতা?
পিপুলের পাতা!
‘তুই হবি পিপুলের পাতা।’ নানীজান বলত তাকে। সেই ছোটোবেলায় নানীজান তাকে প্রায়ই লেবু বাগানের ভেতর নিয়ে যেত, গাছগুলোর যত্ন করার জন্য। বিশাল বাগানের ভেতর সারি সারি গাছগুলো বাঁশের খুঁটি দিয়ে সোজা করে রাখা। ঈষৎপেকে যাওয়া লেবুগুলো থেকে হলুদাভ আভা ছড়াচ্ছে। নানীজান একটা আগাছা জাতীয় গাছ থেকে কয়েকটি পাতা তুলে তার হাতে দেন, এর নাম হইল পিপুলের পাতা।
পিপুলের পাতা দিয়া কী হয় নানীজান?
মাছ রান্ধে, তরকারি রান্ধে। ধর, কোনো মাছ একটু নরম হইয়া গ্যালো, তাইলে কি তা ফালাইয়া দিমু? না, অপচয় করণ যাইবো না, তখন ওই মাছটা পিপুলের পাতা দিয়া রানলে খাইতেও সোয়াদ লাগে আর অপচয়ও হইল না। পিপুলের পাতার আরেক নাম হইল বিশুদ্ধীকরণ পাতা, বুজছস! জীবনে চেষ্টা করবি পিপুলের পাতা হইতে। বড়ো হইলে কতো রকম মানুষের লগে তর দেখা হইব। তুই যদি পিপুলের পাতা হস তাইলে তার নিজেরে নিয়া তর চিন্তা করতে হইবো না।’ ইশাররাত মাথা কাত করে নানীজানের কথায় সায় দেয়। সে পিপুলের পাতা হইতে চায়, সে পিপুলের পাতা হইতে চায়- এই রকম জপ করতে করতে সে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়। তার প্রিয় মানুষদের কাছে সে বিশুদ্ধীকরণ হয়ে থাকতে চায়।
কিন্তু এতোদিন হয়ে গেলো কেউ তাকে দেখতে আসেনি কেন? তার কি কোথাও কেউ নেই! তার বন্ধুরা কোথায়! তার আত্মীয় স্বজন কোথায়! এতো বড়ো নগরে কেউ কি নেই তার! কী এক অব্যক্ত বেদনায় সে শুয়ে থাকে। নির্জন নক্ষত্রের মতো হেমন্তের শেষ রাতে হিম জাগানিয়া ভয় তাকে ঘিরে ধরে। সেই ভয় তার উদভ্রান্ত চেতনায় আছড়ে পড়তে থাকে।
আজ তো তার আসার কথা ছিল। কিন্তু এলো না। আজ, কাল করে কতো দিন পার হয়ে গেলো!
‘কেন প্রত্যাশা করি আসলে কেউ আমার পাশে থাকবে?’
‘কেন থাকবে না; পৃথিবীতে হতভাগ্য মানুষ সেই যে তার প্রিয়জনের পাশে থাকে না। তুমি অবশ্যই প্রত্যাশা করতে পারো।’
‘না পারি না, আমি পিপুলের পাতা। তাছাড়া ও হয়তো অনেক ব্যস্ত! বৃহত্তর জীবনের জন্য তার ব্যাপ্তি। আমাকে তো তা মেনে নিতে হবে।’ 
‘তুমি হলে কী করতে?’
‘ ছুটে যেতাম। এক নজর হলেও দেখে আসতাম।’
‘এইটাই, তুমি কি তার কাছে সামাজিক মর্যাদা চেয়েছ, অর্থবিত্ত চেয়েছ, চাওনি। চেয়েছ সহমর্মিতা, চেয়েছ পাশে থাকার অঙ্গীকার। পাশে থাকা মানে তো গায়ের সঙ্গে গা লেপ্টে বসে থাকা নয়।  পাশে থাকা মানে, সুখে না হোক দুখে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো।’
‘তুমি কে? এতো কথা বলছ কেন?’
‘আমি হলাম পরজীবী। তোমার শরীরের ভেতর পাকাপাকি অবস্থান করে নিয়েছি।’
ক্লান্ত ইশাররাত ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে বসে বসে নতুন ছক তৈরি করে। বেঁচে থাকার জন্য যেন ‘ভ্যানগগের লাস্ট লীফ’। নতুন করে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সাজাতে থাকে সে। হাঁটা-চলা-খাবার-ঘুম-পড়াশোনা-লেখালেখি। ঘড়ি ধরে খুব ভোরে উঠতে হবে। ঘুম ভাঙলে আর শুয়ে থাকা যাবে না।
কী লিখছ, কোনো লাভ নেই, যা পারবে না তা নিয়ে স্বপ্ন দেখে লাভ কি?
তুমি কেন আমার পেছনে লেগেছ, ব্লাডি প্যারাসাইট! এতোদিন ধরে আমার রক্ত পান করে নিজেকে জিইয়ে রেখেছ!
যতোই গালি দাও আমাকে, অতো সহজে তাড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এখনো ভাবছ সে আসবে? তোমার মতো বোকা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। ভাল, অপেক্ষা করো। অপেক্ষা করে করে কী লাভ হয়েছে দেখেছ? আমি একটি পরজীবী পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছি।

ইশাররাত হতাশ হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে দেয়াল বেয়ে বেয়ে যতো কীটপতঙ্গ সব তার ঘরে উঠে আসছে। সে কি তবে মরে যাচ্ছে! ইশাররাত শবনম নামের মেয়েটি মরে যাচ্ছে! পৃথিবীর সমস্ত অণুজীবরা টের পেয়ে গেছে সে মরে যাচ্ছে!  কোথাও কোনো ভালোবাসা নেই, তার জন্য। কে যেন বলেছিল, প্রেম-ভালোবাসা-মায়া এগুলো অভিধানিক শব্দ। ‘আমি বিশ্বাস করি না।’ শুনেছ, ইশাররাত শবনম বিশ্বাস করে না, এগুলো কেবল আভিধানিক শব্দ। প্রেম, ভালোবাসা, মায়া- এই প্রত্যেকটি শব্দের অনেক অনেক ক্ষমতা। সে আসবেই, অবশ্যই আসবে। ‘আমি জানি যতক্ষণ পর্যন্ত সে এসে আমার হৃৎপিন্ডে মুখ না রাখবে ততক্ষণ আমার মরণ হবে না।’
ঝিম ধরা নিস্তব্ধতা চারদিকে। সে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে। যেন সমস্ত শরীর ভাঁজ হয়ে তার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইছে। বাইরে পাহাড়াদারের বাঁশি আর ফ্যানের একঘেয়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রান্নাঘরের কল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। সেই সঙ্গে চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে তার সমস্ত শরীরে। অজ্ঞান হয়ে যাবে নাকি! তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হতে থাকে। তারা ঘরের মধ্যে সাঁতার কাটছে। তার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাঙচাচ্ছে।

‘না, আমি অতো ভীড়ে যেতে পারবো না, ভীড়ের মধ্যে গেলে আমার ভয় লাগে। ভীড়ের মধ্যে গেলে মনে হয় হারিয়ে যাবো। বাবা, আপনি কোথায়? আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েন না।’
তার ঘুম পেতে থাকে। কিন্তু জানালার পাশে কী একটা মুখ থুবরে পড়ল! সাদা বিশাল ডানার অ্যালবাট্রস! সবাই দৌড়াচ্ছে কেন? অ্যালবাট্রসে আগুন ধরে গেছে। বোমারু বিমান এটি! রেডিয়েশন ছড়াচ্ছে! ধুপধুপ পায়ের আওয়াজ চারদিকে কান্না, শিশুর, নারীর । তার চোখের সামনে দাউ দাউ অগ্নিশিখা । পোড়া মাংসের গন্ধ বেরুচ্ছে- সে আরো ভালো করে দৃশ্যগুলো দেখতে চায়- ওহ গড!
একটি নারীর পোড়া কটিদেশ দেখা যাছে। ওই পাশে কী?  পোড়া মুরগীর রোস্ট! বিয়ের কনে ছিলো মেয়েটি। স্বপ্ন সমেত পুড়ে গেছে।
ইশাররাত শবনম!
কে একজন তাকে ডাকে। কণ্ঠস্বরটি তাকে ডেকেই যাচ্ছে। সে কি সাড়া দেবে!


No comments:

Post a Comment