14 July 2016

ফ্লোরা সরকার



নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম শর্তই হলো নারীকে শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম করে তোলা। অর্থা নারীকে, কর্মে প্রবেশের সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দেয়া। নারীকে পর্দার আড়াল থেকে বের করার পেছনে দীর্ঘ  যে এক সংগ্রামী ইতিহাস আছে সে সম্পর্কে কম-বেশী সবাই আমরা অবগত। যে সংগ্রাম এখনও চলছে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে আগের চেয়ে নারীরা এখন শুধু এগিয়েই না, নিজের বুঝ নিজে বুঝে নেবার স্বক্ষমতাও অর্জন করেছে এবং করছে অনেক নারী। এই বুঝে নেয়ার ব্যপারটা পাশ্চাত্যে অনেক আগে শুরু হলেও নারীবাদের যে তীব্র স্রোত শুরু হয়েছিলো গত শতাব্দীতে সেই স্রোতের অন্যতম পুরোধা ভার্জিনিয়া উলফ্ (১৮৮২-১৯৪১)। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ব্যক্তিগত ভাবে “নারীবাদ” শব্দটার উপর আমার একটু আপত্তি আছে। কেননা, নারী-পুরুষ সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হলে শুধু নারীদের উপর ভিত্তি করে কোনো ধরণের ‘ইজম’ বা ‘বাদ’ মূলক তত্ত্ব থাকা উচিত বলে আমি মনে করিনা। তবে এই লেখায় সেই আপত্তির বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্ভব না। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। এখানে ভার্জিনিয়া উলফের বিশেষ একটা লেখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার জন্যেই এই লেখার অবতারণা।

১৯৩১ সালে ওমেন্স সার্ভিস লিগ এ, ‘নারীর কর্মস্থল’ শিরোনামে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে সেই বক্তৃতা লিখিত আকারে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা আকারে বের হয়। উলফ গল্পে-উপন্যাসের পাশাপাশি বেশকিছু প্রবন্ধ লিখে গেছেন, যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে “এ রুম অফ ওয়ানস্ ওয়োন ( ১৯২৯ )”, সর্বাধিক পঠিত এবং পরিচিত। বলা যায়, এই প্রবন্ধের মধ্যে দিয়েই বাইরের পৃথিবীতে উলফ্ নিজেকে সর্বাধিক পরিচিত করে তুলেছিলেন। এখানে তার যে লেখাটা নিয়ে আলোচনা করছি, সেটা “ এ রুম অফ ওয়ানস্ ওয়োন ” লেখার বেশ কিছু বছর পরের ঘটনা। ততদিনে উলফ্ তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরো অনেককিছু অর্জন করে ফেলেছেন। এই বক্তৃতার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিলো, কর্মজীবী নারী এবং তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে কিছু বলা। এটা বলতে যেয়ে উলফ্ তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেন। কীভাবে তার লেখার জীবনে আসা এবং আসার পরে কি কি বাঁধার সম্মুখীন হলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

উলফ এখানে শুধু লেখক হবার অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেন নাই, সেই সঙ্গে লিখতে যেয়ে কীভাবে ‘ নারী ’ হিসেবে নিজেকে প্রথমবার আবিষ্কার করেন তার চমকার বর্ণনা দেন। একজন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাসের উপর সমালোচনা ছিলো তার প্রথম লেখা। এবং সেই সমালোচনা লিখতে যেয়ে, উলফ্ আবিষ্কার করেন, কীভাবে সেই উপন্যাস এবং অন্যান্য গল্প-উপন্যাসেও নারীদের “পরী বা এনজেল” করে রাখা হয়েছে। এই পরী করে রাখার পেছনের রাজনীতিটা ধরতে সেই সময়েই উলফ্রে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তখনি তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই উপন্যাস লিখবেন এবং যখন লিখবেন তখন, মেয়ে-রূপী সেই পরীর ডানা দুটো কেটে-ছেটে ফেলে দিবেন। 
এই ডানা কেটে ফেলার ভেতর দিয়ে উলফ্ ভেবেছিলেন, নারীর স্বাধীনতা হয়তো আনা যাবে। কেননা, নারীকে পরী হিসেবে উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে, সুন্দরী নারী, লক্ষী নারী, পয়মন্ত নারী ইত্যাদি বলে বলে এই দীর্ঘকাল যেভাবে তাকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তার উপন্যাসে তিনি এসব ছেটে ফেলে দিয়ে চার দেয়ালের বাইরে নারীকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু যখনি তাকে আনতে গেলেন, দেখলেন আরেকটা সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। যা লিখতে চান, ঠিক সেভাবে তিনি লিখতে পারছেন না। পুরুষ যেভাবে তার শরীরের কথা বলতে পারে, নারী হিসেবে তিনি বলতে পারছেন না, কোথায় যেন প্রতিবন্ধকতা থেকে যাচ্ছে। উলফ্ তাই সেই বক্তৃতায় বলছেন, “কল্পনার পরীর ডানা ছেটে ফেলে দেয়া যত সহজ, বাস্তবের ডানা ছেটে ফেলা অত সহজ কাজ না।” তার মানে পরিবার, সমাজ এসবের ভেতরেই এমন কিছু বাঁধা-বিপত্তি আছে, যেসব বাঁধার কারণে পুরুষ যা লিখতে পারে অবলীলায় নারী তা পারেনা।
বক্তৃতার একদম শেষে, উলফ্ চমকার কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “তুমি একটা ঘর পেয়েছো ঠিক, যদিও সেই ঘরের মালিক পুরুষ, তুমি বছরে পাঁচশ পাউন্ড কামাই করছো ঠিক, কিন্তু এটা তোমার ব্যক্তি-স্বাধীনতার শুরু মাত্র। তোমার ঘর আছে, কিন্তু ছাদ আছে কি? ঘরের আসবাব সাজানো আছে কি? সেসব কি গোছানো হয়েছে ? যার সঙ্গে থাকো সেই অংশীদারের সঙ্গে কতটুকু বোঝাপড়া তোমার আছে? আমার মনে হয় এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে।” উলফ্রে বক্তৃতার এই অংশে আমরা শুধু উলফকেই পূর্ণাঙ্গ রূপে পাইনা, পুরো নারী জগতটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখতে পাই। আমরা বুঝে যাই, একজন নারী, সে যে কাজেই নিয়োজিত থাকুক না কেনো, তার পূর্ণ স্বাধীনতা নির্ভর করছে প্রথমে তার ঘরের মানুষ অর্থা স্বামী ও তার পরিবার এবং দ্বিতীয়ত বাইরের মানুষ তথা গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। যতদিন পর্যন্ত নারীর অন্যান্য স্বাধীনতা, যেমন : কথা বলার, লেখার, চলাফেরার ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেয়া না যাবে, ততদিন পর্যন্ত একজন নারীকে শুধু তার আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীতার দাবি আমরা করতে পারবনা। ১৯৩১ সালে দেয়া ভার্জিনিয়া উলফ্রে প্রশ্নের উত্তরগুলো আমরা এখনো খুঁজে পাই নাই। পাই নাই বলেই নারী এখনো ধর্ষিতা হয়, খুন হয়, রাস্তা-ঘাটে নানা ধরণের হয়রানির শিকার হয়। নারী স্বাধীনতার যে সমস্যা তিনি আশি-পঁচাশি বছর আগে দেখেছিলেন সেই সমস্যা আজও আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এটা শুধু নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের জন্যে কলঙ্কজনক বিষয়।    

   

No comments:

Post a Comment