05 July 2016

মাহতাব হোসেন




সন্ধ্যায় মিরপুর কমার্স কলেজের কাছে রিকশা খুঁজছিলাম। না, কোনোভাবেই রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। শ্যাওড়া পাড়া যাব। সহজে কেউ যেতে চাচ্ছে না। খুব বেশি যে রাত হয়েছে তাও না।  দুই একজন একটু আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেতে চাইলেও ভাড়া আসমান মুখি। যেন আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি। ওরা হয়তো জানে না আমার হাঁটার রেকর্ড।  একটু হেঁটে সামনে এসে একটা রিকশা পেলাম। বললাম- 'মামা যাবেন?'
-'কই যাইবেন? যামু তো...'
-'শ্যাওড়া পাড়া...'
-'যামু'
-'কত দিতে হবে?'
-'৫০ ট্যাকা...'
-'এত ক্যান? একটু কম নিলে হয় না?'
-'না মামা নিগাল (লিগ্যাল) ভাড়া চাইছি।'
শুধু নিগাল শব্দটা বলার কারণে আর ভাড়া দরদাম করলাম না। রিকশায় উঠে পড়লাম। ভাড়া বেশি হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। বেশি হতে পারে আবার কমও হতে পারে। রিকশায় উঠে বসার পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাড়ি রংপুর অঞ্চলের কোথায়?'
রিকশাওয়ালা সম্ভবত একটু অবাকই হয়েছে। কেন না তিনি তো রীতিমতো ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলছিলেন।
-'মামা কেম্নে জানলেন আমার বাড়ি ওই দিকে?'
-'শোনেন রংপুর অঞ্চলের মানুষকে চেনার জন্য একটা শব্দই যথেষ্ট।'

আমি জানি না আমার কথা বুঝলেন কি না। এরপরে তিনি আমার বাড়ি কোথায় কি করি জিজ্ঞেস করলেন।  ধীরে ধীরে তার কথা বলতে শুরু করলেন। নাম আনোয়ার। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে। এক অভিমানী। বাড়ি থেকে পালিয়েছেন বহু আগে। তার ভাষ্য অনুযায়ী। বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরির এক বছর আগে বাসা থেকে কাউকে না বলে ঢাকা চলে আসেন। চাচাতো বোনের সাথে আনোয়ারের প্রেম ছিল। বিয়ে করার জন্য দুইজনই পরিবারের কাছে জানালে উভয় পরিবারের কেউ রাজি হয় না। বিশেষ করে আনোয়ারের বাবা মা কোনোভাবেই ওই মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। আনোয়ার শেষ চেষ্টা করে, হাতে পায়ে ধরে। কাজ হয় নি। আনোয়ার কাউকে না বলে ঢাকায় চলে আসেন। তার হিসেব মতে ১৯৯৭ সালে। তার মানে ১৯ বছর আগে। প্রথমে ফুটপাতে ঘুমানো, পড়ে থাকার পরে রাজমিস্ত্রীকে সহায়তার কাজ শুরু করেন। পরে রিক্সা চালানো। এরপরে ঠাকুরগাঁও এর এক মেয়েকে বিয়ে করেন। আনোয়ারের এক মেয়ে আছে, স্কুলে যায়। পরবর্তীতে বাড়িতে বাবা-মার জন্য টাকা পাঠানো শুরু করেন। বাবা-মায়ের খোঁজ খবর রাখলেও ১৯ বছরের মধ্যে আনোয়ার একবারের জন্য বাড়ি যান নি।


এমনই এক বসন্তে আমিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। সাথে ছিল একবুক অভিমান আর ইংলিশ প্যান্টের পকেটে জমানো একটাকা বারো আনা। বাবার উপর প্রচন্ড অভিমানে ঘর ছেড়েছি। কেডস ছিড়ে গেছে, না কিনে দেওয়ার অভিমান। একটা ক্রিকেট ব্যাট না কিনে দেওয়ার অভিমান আর বড় ভাইদের ছবিতে দেখা পুলিশের ড্রেসের অভিমান সেই কবে থেকে মেঘাচ্ছন্ন কফের মতো বুকে জমে ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে সুর্য হেলে পড়েছে। প্রচন্ড গা চিড়বিড় করা রোদ উপেক্ষা করে ট্রেনে চড়ে বসলাম। একা কোনো ব্রডগেজ ট্রেনে চড়া সেই প্রথম। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। ইন্টারসিটি ট্রেন। ভিড় কম। হকারের হাকডাক নেই। ট্রেন ছুটে চলেছে কোন স্টেশন আসছে যাচ্ছে আমার খেয়াল নেই.. দুইদিকে সবুজ গাছপালা সরে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে জানালায় গলা বাড়িয়ে দেখছি। কোনো কিছুই খেয়াল নেই শুধু মনে আছে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। মায়ের জন্য একটু খারাপ লাগা। এলোমেলো ভাবনা। টিকেট চেকার চলে আসছে। আশেপাশে সবার টিকেট দেখে আমার কাছে আসলেন-
-'বাবু তুমি কার সাথে?'
-'কারো সাথে না..'
-'তোমার টিকেট কার কাছে?'
হাফপ্যান্টের পকেট থেকে একটাকা বারো আনা বের করে বাড়িয়ে দেই চেকার অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে।
-'তুমি যাবে কোথায়?'
আমি কোথায় যাব আমি নিজেও জানি না। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না। চেকার আংকেল তার সাথে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আর বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে
-'বাড়ি কোথায়'
-'পার্বতীপুর'
-'বাবার নাম কি?'
ট্রেন একটা স্টেশনে এসে থামে। চেকার আংকেল বিপরীত দিক থেকে আসা একটা ট্রেনের ড্রাইভারের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে পার্বতীপুরে নামিয়ে দিতে বলেন...আমার হারিয়ে যাওয়া হয় না। আবার বাড়িতে চলে আসি। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সবার মুখ স্বাভাবিক। এরা কেউ জানেই না আমি এদের ছেঁড়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সব স্বাভাবিক, সব। সবার বাড়ি ছাড়ার গল্পগুলো এক হয় না। যেমন আনোয়ারের। মিরপুর স্টেডিয়াম অতিক্রম করছি। আনোয়ারকে বললাম,
-'বাড়ি তো যেতে পারতেন, এতদিন কেউ রেগে থাকে?'
-'না, আমি বাড়িত গ্যালে সেই মাইয়ারে দেখতে পামু, এইডা সহ্য হইব না। আমরা এক লগে বড় হইছি, খেলাধুলা করছি...'
-'এইটা ভুল ধারণা। আপনি খুব বোকা। আপনি একবার বাড়ি গিয়ে দেখেন, আপনার মধ্যে ওইসব কাজই করবে না। বরঞ্চ আপনার সেই চাচাতো বোনের সাথে দেখা হলে দেখবেন অন্যরকম একটা ভালোলাগা কাজ করতেছে। আপনি একবার কিছু না ভেবেই বাড়ি চলে যান।'


আনোয়ার একটু ঘুরে আমার দিকে তাকালো। রিকশা সেনপাড়া পর্বতা ছেড়ে যাচ্ছে। আমি জানি আমার মুখ দেখা যাচ্ছে না। হয়তো মুখের ওপর দিয়ে নিয়নের কিছুটা ছিঁটেফোঁটা ছিল। রিকশা দ্রুতগতিতে চলছে। আনোয়ারকে ফের বলি- 'শোনেন সময়ের সাথে সাথে সবকিছু একটু একটু করে পরিবর্তন হয়ে যায়। আপনার ভেতরেও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পলিথিনের আবরণের মতো একটা জেদ চেপে আছে। এই জেদ নকল। আপনার মধ্যে কি পরিবর্তন হয়েছে এটা জানতে হলে অন্তত একবার বাড়িতে যেতে হবে...'

শ্যাওড়াপাড়া চলে এসেছি। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ঘুরে চলে আসছি। ভাইজান শব্দে ঘুরে দাঁড়ালাম আবার। দেখি আনোয়ার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। 'আপনার সাথে হাত মিলাইতে চাই...'
আমি হাসি হাসি মুখ করে হাত এগিয়ে দিলাম। আনোয়ার আমার হাত ধরে হ্যান্ডশেকের মতো করে একটা ঝাকুনি দিল। আমি তাঁকে আমার একটা বিজনেস কার্ড পকেটে দিলাম। বললাম আমার ফোন নম্বর আছে। এরপরে আনোয়ার একগাল হেসে রিকশায় উঠে চলে বেল বাজিয়ে চলে গেল।

আনোয়ারের কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম।  প্রতিদিন অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। চোখের সামনে দেখা ভিখিরির আর্তনাদ ভুলে যেতে হয়, না খাওয়া শিশুটির শুকিয়ে যাওয়া চোখমুখের কথা ভুলে যেতে হয়, চরম অমানবিকতার শিরোনাম করা পত্রিকার খবর ভুলে যেতে হয়। প্রায় চারমাস পরে এসব ভুলেই অফিসে মাথা গুজে কাজ করছিলাম। একতা টেলিফোন এলো। রিসিভ করে কানে লাগাতেই আনোয়ার আনোয়ার বলে চেঁচানোর শব্দ কানে পেলাম। মিনিট দেড়েক পরে বুঝলাম সেই আনোয়ার। আনোয়ার জানালো, সে বাড়িতে গেছে।  মা-বাবার কাছে মাফ চেয়েছে। আর এজন্য আমার কাছে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার আনয়ারের সাবেক প্রেমিকার সাথে আনোয়ারের বৌয়ের বেশ হৃদ্যতা তৈরি হয়ে গেছে। তারা আরো মাস খানেক উলিপুরে থাকবে।




No comments:

Post a Comment