05 July 2016

মাসুম বিল্লাহ



চোখ
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আদনান সাহেবের। স্ত্রী রুকসানাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বললেন, শোনো রুকু, রিয়ার জন্য একটা ভালো ছেলের খোঁজ পেয়েছি-।
রুকসানা আকাশ থেকে পড়লেন। ঘুম কেটে গেল। স্বামীর ওপর মেজাজ চড়িয়ে বলেন, রাতদুপুরে ঘুম ভাঙিয়ে মেয়ের বিয়ের কথা বলছো! মাথাটাথা গেছে নাকি?
- সরি। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম...
- তা এখনই কী বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করবে?
- প্লিজ রুকু, মজা কোরো না, তুমি কাল সকালে রিয়ার সঙ্গে কথা বলে জেনে নিও, ওর কোনো পছন্দ টছন্দ আছে কিনা!
- থাকলে আমরা বুঝতে পারতাম না? ঠিক আছে সকালে কথা বলে তোমাকে জানাবো। এখন ঘুমুতে চলো।
.
রিয়ার কোনো পছন্দ নেই। আদনান সাহেব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। থাকলেও তিনি অবাক হতেন না। মেয়ের পছন্দকে গুরুত্ব যেমন দিতেন, তেমনি মেয়ের খুশিতে ও সহায়তা করতেন বাবা হিসেবে। পাত্র তার ছেলেবেলার বন্ধুর একমাত্র ছেলে। বন্ধুর তরফ থেকেই প্রস্তাব এসেছে। দুই বন্ধুই রাজি।
.
শুক্রবার সন্ধ্যায় রিয়াকে দেখতে এল পাত্রপক্ষ। রিয়া আর পাত্রকে আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হলো। রাতের খাবার সেরে পাত্রপক্ষ বিদায় নিল। রিয়া তার মাকে জানিয়ে দিল, ছেলে তার পছন্দ হয়নি। কারণটাও মাকে জানিয়ে দিল। কিন্তু আদনান সাহেব মানতে চাইলেন না। তিনি ভাবলেন মেয়ের নিশ্চয়ই কোনো পছন্দ আছে। এখন টালবাহানা করছে। মনে মনে মেয়ের ওপর অসুখি হলেন। তবুও তিনি মেয়েকে ধরলেন, পছন্দ না হওয়ার কারণটা আমাকে আবার বলবি মা?
- মাকে তো বলেছি বাবা।
- আবার বল-
- ছেলের চোখ ভালো না...
- চোখ ভালো না বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছিস?
- আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না, তবে মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের চোখের ভাষা পড়তে পারে! আমাকে ভুল বুঝো না বাবা, প্লিজ...
.
রুকসানা বেগম মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর স্বামীকে বললেন, যেমন বাবা তেমন ছেলে!
চমকে উঠলেন আদনান সাহেব, মানে? কী বলছো তুমি?
- যা সত্য তাই বলছি। তোমার বন্ধুতো আর আমার অচেনা না। সেই স্কুল থেকে চিনি...
- হুম। তা রুকসানা ম্যাডাম, আমার চোখে কোনো সমস্যা নেই তো?
- নেই আবার...

রুকসানা কথা শেষ করেন না। তারা তিনজন মিলে হো হো করে হাসতে লাগলেন।





দায়বন্ধন

অফিস থেকে আধ ঘণ্টা আগে বের হলো সুমনা। রাস্তায় পা রাখতেই হঠা ঝুম বৃষ্টি। রাস্তার একটা দোকানের দিকে ছুটে যেতে যেতে ভিজে শরীর প্রায় জবুথবু । এরই মধ্যে দোকানের সামনে লোকজনের ভীড় জমে গেছে। গা বাঁচিয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়াল। বৃষ্টির জোর কমতেই বাস স্টপেজের দিকে জোর পায়ে হেঁটে গেল সুমনা।
অনেকদিনের চেনা গন্তব্য। টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে দ্রুত বাসে উঠে বসে। অর্ধেক সিট এখনো ফাঁকা। বুক কেঁপে ওঠে। সময় মতো বাস না ছাড়লে পৌছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে। মিসিরকে ফোন করে বাস স্ট্যাণ্ডে অপেক্ষা করতে বলা যায়, কিন্তু তা সে চায় না মিসিরকে এ কষ্টটুকু দিতে। সারাদিন বেচারা অফিস করে বিকেলে সাইকেলে অতদূর থেকে ফিরে আবার সবজি বাগানে পড়ে থাকে। মিসিরকে অযথা এত রাতে টেনে আনার কোনো মানে হয় না।
বাস ছাড়ল ঠিক এক এক ঘণ্টা পর। ভেতরে ভেতরে সুমনার রাগ জমতে শুরু করেছে। এমনিতে সে চুপচাপ শান্ত স্বভাবের। তবু আজ এবেলায় তাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে।
সুমনা বসেছে জানালার পাশে। তার পাশের সিট এখন অবধি ফাঁকা। আজ আর কোনো যাত্রী উঠবে বলে মনে হচ্ছে না। জানালার কাচ পুরো খুলে দেয় সে। ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ার এসে তার মুখে লাগে। মুহুর্তে সব অস্থিরতা ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ে গেল। চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। মনটাও বেশ চনমনে হয়ে উঠল। সুমনার মনে হলো, এভাবে পুরো রাত বসে থাকতে পারলে মন্দ হয় না। ভাবল-যদি ঘুমিয়ে পড়ি? যদি চেনা স্টপেজ পেরিয়ে যায়? যদি অচেনা স্টেশনে এসে নেমে পড়ি? তখন? তাহলে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে?সুমনার চোখ বন্ধ। তার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে অন্ধকার ভেদ করে। ভাবনটা মাঝপথে কাটা পড়ে মোবাইলটা সুর তুলে বেজে উঠতে। মিসিরের কল। মিসির বাস স্ট্যাণ্ডে তার জন্য অপেক্ষা করছে। সুমনার কণ্ঠে মিথ্যে রাগ ঝরে পড়ে। এসব ছেলেমানুষির দরকার ছিলো না। মিসির সুমনার কথা গায়ে মাখে না। মনে মনে খুশি হয় সুমনা। মনে অন্যরকম এক ভালোলাগা এসে ঘিরে ধরে। আবারো চোখ বোজে এবং ভাবনার অতলে হারিয়ে যায় সে।
বাস স্ট্যাণ্ডে মিসিরকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। মিসির ছুটে এল। সুমনার চোখ পুরনো মিসিরকেই যেন দেখছে। প্রতিদিন চার মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসে। ছুটির পর আবার সে সাইকেলে চেপে ফেরা। তারপর সবজি বাগান নিয়ে সন্ধ্যা অবধি ডুবে থাকা। এই হলো মিসির। সুমনা মুখ খুলল, তোমার ক্ষেত-খামার কেমন চলছে?
- অফিস থেকে ফিরে যেটুকু সময় পাই তাতে কী আর ক্ষেত খামার হয়!
মলিন দেখালো মিসিরকে।
- তাহলে করো কেন? এত পরিশ্রম করে খাওয়াবে কাকে?
- তুমি আছো। ভাই, ভাবী, ভাইপো, ভাইজিরা আছে...
- আমার চিন্তা করো না। ভারী শোনায় সুমনার কণ্ঠ।
- হু।
মিসিরের পাংশুটে মুখ অন্ধকারের বন্ধ খাঁচায় আটকা পড়ে।
বাকি পথটুকু কেউ আর কথা বলে না। ঘরে ঢোকার আগে কলতলা থেকে ঠাণ্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে স্বস্তি ফিরে পায় সুমনা। এত রাতে ভাত মু্খে তুলতে ইচ্ছে না করলে মিসিরের এখনো খাওয়া হয়নি বলে তাকেও দুটো খেতে হয়। খাওয়ার সময় মিসির আচমকা প্রশ্ন করে, এবার কয়েককটা দিন থেকে যাও না?
- মানে?
- ছুটি নাও।
- সপ্তাহে একদিন ছুটি তাও তোমার কাছে এসে থাকি...
- মানে বলছিলাম...। মিসির কথা শেষ করে না।
- তুমি নাও না! পারবে অফিস থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে আমার কাছে গিয়ে থাকতে? জানি পারবে না, কারণ এখানে তোমার ভাই-ভাবীকে রয়েছেন, তাদের ছেড়ে তো যাওয়া চলে না; দায়িত্ব কর্তব্য বলে কথা-
- আচ্ছা থাক। মিসিরের গলা খাদে নেমে আসে।
খাওয়া শেষ হয়। দুইজনে খাটের ওপর পা ভাজ করে মুখোমু্খি এসে বসল। মিসির মুখ নিচু করে রেখেছে। সুমনা বলল, তুমি তোমার বউকে ছেড়ে থাকতে পারো কিন্তু আমি পারি না, আমি যে মেয়ে মানুষ!
- আবার পুরনো কথা তুলছো কেন সুমনা?
- কথা পুরনো হলেও ঘটনা তো আর পুরনো হয়নি। সুমনার কণ্ঠে খেদ ঝরে পড়ে।
- এবার কী তুমি এ সব কথা তুলে ঝগড়া করতেই এসেছো?
- আমি ঝগড়া করতে পারি না তুমি জানো, আর ঝগড়া করতে পারলেও হয়ত শান্তি পেতাম-
- আমার সব কথাই তুমি জানো সুমনা, তাই বলছিলাম আজ আবার এ সব কেন...
- যতদিন তুমি তোমার সিদ্ধান্ত না পাল্টাবে ততদিন...
- ছোটবেলা থেকে যে বড় ভাই আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন তাকে ছেড়ে দূরে যাওয়া, আলাদা সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
- বেশ তো কে তোমাকে মানা করেছে! তাই বলে তুমি তোমার স্ত্রী, নিজের সংসারের কথা ভাববে না? এতটা মহামানব হবার কারণে যে আমার জীবনও তুমি নষ্ট করে দিচ্ছো!
- আমি নিরুপায় সুমনা। আমি দায়বন্ধনে আটকে আছি, যে দায়, যে বন্ধন ছিন্ন করার শক্তি আমার নেই।
- ঠিক আছে। কিন্তু তোমার সঙ্গে আমি কোন বন্ধনে আটকা পড়ে আছি? বিয়ের এত বছর হয়ে গেলেও আমাদের এখনও কোনো সন্তান হয়নি, সে কথা তুমি ভেবেছো কখনো? ভুল আমারই বার বার একই প্রসঙ্গ সামনে টেনে আনি! পৃথিবী উল্টেপাল্টে গেলেও তুমি তোমার...
সুমনা হাঁপাচ্ছে। কথা শেষ করতে পারে না। বাস্তবে ফেরে। সবি
ফিরে পায় বাসের কনন্ট্রাকটরের ডাকে, আপা, নামেন বাস আর যাইবো না।


No comments:

Post a Comment