31 March 2016

আবুল কাইয়ুম


এ জীবন যেন রক্তাক্ত চন্দনের ধূপ, নীলনদ এক, সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি, দীর্ঘ আয়োজন


কবি বীরেন মুখার্জীর কাব্য হেমন্তের অর্কেস্ট্রা
অমর একুশে বইমেলা -২০১৬ উপলক্ষ্যে কবি প্রকাশনী, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত হলো কবি বীরেন মুখার্জীর (জন্ম-১৯৬৯) অষ্টম কাব্যগ্রস্থ হেমন্তের অর্কেস্ট্রাএর আগে প্রকাশিত তাঁর অন্য কাব্যগুলো হচ্ছে- উদ্বাস্তু সময়’(১৯৯৮, কলকাতা), ‘প্রণয়ের চিহ্নপর্ব’ (২০০৯), ‘প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস’ (২০১১), ‘নৈ:শব্দের ঘ্রাণ’ (২০১২), ‘পালকের ঐশ্বর্য’ (২০১৩), ‘মৌনতা’ (২০১৩) এবং জলের কারুকাজ’ (২০১৪)। এছাড়া তিনি চারটি প্রবন্ধ/গবেষণা গ্রন্থ ও একটি ইতিহাসগ্রন্থের লেখক। কিছু ছোটগল্প ও নাটকও লিখেছেন। সাংবাদিকতা তাঁর মূল পেশা। তিনি বর্তমানে ঢাকার দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত আছেনএর পাশাপাশি দৃষ্টিনামে একটি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ছোট কাগজের সম্পাদনা করে আসছেন। তাছাড়া গণমাধ্যম পরামর্শক, বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার ও টিভি প্রোগ্রামের ধারাভাষ্য-লেখক হিসেবেও তিনি কাজ করে থাকেন। কর্মজীবনের এত সব ব্যস্ততার মাঝেও কবি বীরেন মুখার্জী তাঁর উজ্জ্বল সৃজনকর্মের দ্বারা ইতোমধ্যে সাহিত্যাঙ্গনে নিজের একটি আলাদা অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

হেমন্তের অর্কেস্ট্রাকাব্যের একটি বড় অংশ জুড়ে দেখি, জগজ্জীবনের আলোকে বিদীর্ণ করে হন্তারক অন্ধকারের উত্থান কীভাবে অর্জন ও প্রত্যাশাকে বিনষ্ট করছে সে সম্পর্কে কবির নানা অভিব্যক্তি। এই প্রকাশের মাঝে এবং এর বাইরেও কবি উপজীব্য করেছেন দেশপ্রেম, ইতিবাচক মানবিক চেতনা ও ঐতিহ্যসংলগ্নতা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে সেই ঐতিহ্যের রোদেলা দিন’, যা ছিল হৃদয়ের অনুপম প্রাপ্তি, হারানোর যন্ত্রণাটিই কবির অন্তরাত্মাকে প্লাবিত করে। সূচিত উজ্জ্বল সময়টি ক্রমান্বয়ে মৃত্যুময়তার কালো গর্ভে নিপতিত হওয়ার ঘটনাপুঞ্জ তাঁকে করেছে যেন হতবাক ও নৈরাশ্যকাতর । এই দু;সময় কবিমানসে রোদের কঙ্কালহয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি অন্তরে শুঁষে নিয়েছেন প্রগতিমৃত্যুর বেদনা। এই ক্লেশটি তাঁর কবিতায় কখনো এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে-
সময় ব্যর্থ হয়ে যায়, এই জলকণা, এই দীর্ঘ ইতিহাস
মেধার মন্দির থেকে নেমে যায় রক্ত, লোহিতকণিকা
একাকী রাতের কাছে- এই অব্যক্ত হাওয়ায়
অবিরাম লতার কৌশলে ঝরে -জীবনের জল!
-সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি

সময়ের অন্ধকার কবিকে বিপন্নতা ও বিমর্ষতায় ‌আচ্ছন্ন করে তোলে। তিনি উচ্চারণ করেন-
যখন সঘন অন্ধকার, একে একে গলে যায় অন্ত:পুর
কতিপয় আরশোলার হুল ছুঁয়ে যায় তৃষ্ণার ঠোঁট
নিজেকে খুঁজে পাই কাঁচের ভগ্নস্তুপে
আমি কী মৃত্যুর খোলস ঢাকা রয়েছি অনাদিকাল!
-মৃতের খোলস

এভাবে কবিকন্ঠে শুনি প্রতিক্রিয়াশীলতার নখদন্তে আহত এই সময়ের কড়চা। তবে এর মাঝেও কবি যে আলোসন্ধানী তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। আর সেই আকাঙ্ক্ষিত আলোটি হলো শান্তিময় ও বাসযোগ্য স্বদেশ-পৃথিবীর আলো। স্বাধীনতা ও মানবিকতার বিপর্যয়ের দারুণ ছবি আঁকেন কবি-
আমাদের স্বপ্ন, ঘুড়ি আর ওড়ার স্বাধীনতা
ক্লান্ত হয়ে মিশে যায় ঘূর্ণিস্রোতে
বাণিজ্যবাতাস গায়ে মেখে
আমরা হয়ে উঠি সময়ের ক্রীতদাস।
-মাথার ভেতর অন্ধঘুড়ি ওড়ে

সত্য যে, পরিপার্শ্বের এই বিপন্ন দশাগুলো থেকে কবিমনে নৈরাশ্যবোধ জন্মায় ও তা একপ্রকার শূণ্যবোধও বয়ে আনে। সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে এ ধরনের চৈতন্যের উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই এর উদ্রেক। দেশ, দেশের মাটি, মানুষ, নিসর্গ ও লাল-সবুজ পতাকা কবির প্রাণে কতটা মহিমময় অবস্থান জুড়ে আছে তার প্রমাণ এই কবিতাংশ-
পৃথিবীর উর্বরতম এ মাটি আমার পবিত্র স্বাধীন ভূমি
এখানে ঘুরপাক খায় প্রতিদিন সহস্র গানের কলি
সুরের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে কুলি ও মজুর
তাদের চেতনার ভাঁজে এ মাটি বহমান জন্মের সমান্তরাল;
এই হলুদ মাঠ আর শীতপ্রবণ ঘাসের পাঠশালা
দিয়ে যায় পিঠা-উ
সব, লাল-সবুজ পতাকার
গৌরব জড়ানো দিন...
          -পউষের কবিতা

কবি বীরেন মুখার্জী
কবি বীরেন মুখার্জীর কৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি, আমার মনে হয়েছে, তাঁর চিত্রকল্প নির্মাণ-কুশলতা। তাঁর চিত্রকল্পগুলো সরল চিত্রীর আঁকা প্রত্যক্ষ ছবি নয়। দৃশ্যমান শ্রেণীর চিত্রকল্প অনেকের কবিতাতেই থাকে, কিন্তু তাঁর কবিতায় এটা নেই। তাঁর চিত্রকল্পগুলো গভীর অন্তর থেকে উঠে আসা এমন ছবি যাতে রয়েছে অন্তরেরই পুরো ছাপ,-অর্থা শুধু বাস্তবের রংয়ে নয়, অনেকাংশে হৃদয়ের রংয়ে আঁকা। প্রাণ থেকে উসারিত এ সব ব্যতিক্রমী ছবিই তাঁর কবিতাগুলোর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে। চিত্রকল্পগুলো খুব তরতাজা, স্বাদু, দৃষ্টিনন্দন এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব্য। আমি বলবো, এগুলোর সব শুধু বিমূর্তই নয়, কিছু আছে পরাবাস্তবও। তাঁর নান্দনিক চিত্রকল্পমালা থেকে কিছু উদাহরণ তুলে আনছি-
১. শীতকাল ফুটে থাকে কুয়াশাপ্রচ্ছদে
২. চুম্বনক্লান্ত ভোরের মখমলে গতিশীল ঘোড়ার টগবগে ওড়ে লাল ধুলো
৩. অবচেতনের জল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে পাচ্ছে মেঘ/ কাশবনের ধার ঘেঁষে
৪. পূর্বনির্ধারিত বিকেলগুলোর ডানা ভেঙে রোদ/ তুলে ধরে বুকের ঐশ্বর্য; বানান ভুলতে থাকা/ কামপ্রবণ চোখেরা ঢুকে পড়ে ধ্রুপদী নাচশালায়
৫. অবশেষে হাতের তালুতে দেখি পাতাঝরা শীত
৬. ঠোটেঁ প্রসঙ্গ মাখে শিল্পের শিশির
৭. নির্বোধের মতো অনুরণিত স্ক্রিপ্ট খুলে/ বেড়িয়ে আসে ঘোরানো সিঁড়ি, কাঠের ঘোড়া/ মাটির পরী- যুগপ
ছায়া ও নারী

কবি শুধু নিসর্গ থেকেই নয়, মিথ ও ঐতিহ্য সহ জীবনের নানা ভূমি থেকে আহরণ করেছেন তাঁর কবিতার ছবির অনুষঙ্গ। আর সেগুলোকে সাজিয়েছেন গাঢ়বদ্ধ বাণীবন্ধে। ভাষিক বিন্যাসের দিক দিয়ে তাঁর সবগুলো কবিতাতেই রয়েছে দারুণ আধুনিকতার ছাপ। তাঁর শব্দগুলোও ব্যঞ্জনাপূর্ণ, শক্তিমত্তাময়। তিনি প্রচুর অর্থবোধক, বিশুদ্ধ যুগ্মশব্দ নির্মাণ করেছেন। তাঁর ভাবনাগুলো একনাগাড়ে ভাষায় গড়িয়ে চলে, থমকে দাঁড়ায় দাঁড়ায় না কোথাও। এই প্রবমানতা একবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর প্রতিটি কবিতাই আপন ছন্দের মাধুরি মাখা। তিনি অক্ষরবৃত্তের অসমপর্বিক কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন গদ্যছন্দ ও মুক্তগদ্যের কবিতা। যে কোনো বিচারে কবিতাগুলো শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও বিপনন কামনা করি।


[গ্রন্থ পরিচয়:- হেমন্তের অর্কেস্ট্রা (কাব্য)। লেখক- বীরেন মুখার্জি। প্রকাশক- কবি প্রকাশনী, ৪৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম বেজমেন্ট, এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫। ভারতে পরিবেশক : অভিযান পাবলিশার্স, ৬৪/১ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা, ভারত। প্রচ্ছদ শিল্পী- তৌহিন হাসান। মূল্য- ১৪০ টাকা।]



No comments:

Post a Comment