পাঠ প্রতিক্রিয়া
একটি গল্প ও কিছু কথা
মাহমুদ সিদ্দিকী
গল্পঃ স্বাধীনতার চেতনা
ধরনঃ ছোট গল্প
লেখকঃ জাকিয়া জেসমিন যূথী
গল্পটি প্রথম পড়ি মাসখানেক
আগে ফেসবুকে। সাধারণত
কবিতা বাদে অন্য কোন সাহিত্য
ফেসবুকে আমি পড়ি না। ধৈর্য আমার কম তাই। নিউজফিড ঘাটতে গিয়ে গল্পটিতে
চোখ আটকে যায়। গল্পের
শুরুটা বেশ চমৎকার। প্রথমবার পড়লে
একটা রহস্যময় আকর্ষণ গল্পের
বাকী অংশ পড়তে বাধ্য
করে। গল্পের চমৎকার সূচনা অজান্তেই আমার
অনীহাকে আগ্রহে রূপান্তরিত করলো। পড়তে শুরু করি মনযোগ
দিয়ে।
“প্রথমেই
একটা নিউজপ্রিন্টের পুরনো
পৃষ্ঠায় ধুসর হতে হতে প্রায়
বিলীন হতে চলা নীল রঙা কালিতে
একটা হাতের লেখা রক্তের
ছোপ ছোপ দাগে লেখার
বিষয়বস্তু উদ্ধার করা সম্ভব
হয় না পুরোপুরি। লাইনের
শুরুর শব্দ আছে তো শেষ নেই। অথবা শুরু নেই তো শেষ আছে।”
গল্পটা শুউর হয় এভাবেই। এটুকু পড়ে মনে হলো বাকীটা
পড়া উচিত। গল্পের
চরিত্রে একটি মেয়ে। নাম সাবিহা। বর্তমান প্রজন্মের একজন তরুণীর
কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ
কিভাবে ধরা দেয় এবং মনজগতে
কি অদ্ভূত এক ভাবাবেগের
সৃষ্টি করে- লেখিকা তার লেখনীতে
এই চিত্রটিই ফুঁটিয়ে তুলতে
চেয়েছেন। কতটুকু সফল হয়েছেন
তিনি তা বিচার করবে
বিজ্ঞ পাঠকেরা।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে
স্বাধীনতার ইতিহাস ঘোলাটে ও ধোঁয়াটে। নির্দিষ্ট কোন বইকেই মুক্তিযুদ্ধের
প্রকৃত ইতিহাস নির্দ্বিধায় বলতে
পারিনা। দলীয় কারণে
ও ব্যক্তিস্বার্থে আমাদের কাছে প্রকৃত
ইতিহাস ধামাচাপা দিয়ে রাখা
হয়েছে কিংবা বিকৃত করা হয়েছে। এত কিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধের
ইতিহাস আমাদেরকে আলোড়িত ও দেশপ্রেমে
তাড়িত করে। গল্পে
সচেতনভাবে লেখিকা তার চরিত্রের
হাতে বিতর্কের উর্ধ্বে থাকা
প্রকৃত সত্য সম্বলিত একটি
বই তুলে দিয়েছেন। একাত্তরের
রণাংগনের যোদ্ধাদের পাঠানো চিঠির
সংকলন-একাত্তরের চিঠি। কোনটা
মায়ের কাছে, কোনটা সঙ্গিনীর
কাছে, আবার কোনটা অবুঝ সন্তানের
কাছে পাঠানো দৃঢ়পদ বাবার
চিঠি। সুকৌশলে লেখিকা
বইয়ের বিস্তারিত বিবরণও তুলে
ধরেছেন। মর্মস্পর্শী চিঠিগুলো
পড়ে গল্পের সাবিহা যেমন
আন্দোলিত হয়, গল্পের পাঠকও কেঁপে
কেঁপে ওঠে উদ্বেলিত আবেগে
মাঝেমাঝেই। সাবিহা একটার
পর একটা চিঠি পড়ছে
আর পৃষ্ঠা উলটাচ্ছে। সাবিহা
যখন শহীদ রুমীর দৃঢ় মনোবলের ‘আমরা
একটা ন্যায়সংগত যুদ্ধ করছি, আমরা
জয়ী হবো’-কথাটি পড়ছে, দূর্বল
চিত্তের পাঠকও তখন অজান্তেই
তেজোদ্দীপ্ত হয়ে উঠছে।
“কয়েক
পাতা পড়ার পরে আবার
দেখে পুরনো পাতাই দেখাচ্ছে। এ অবশ্যই বিন্যাসের সমস্যা। পিডিএফ
ফাইলটা এভাবেই করা হয়েছে।”
লাইনগুলো পড়ে একটা ধাক্কা
খেলাম। এতক্ষণ ধরে বইটা
হার্ডকপি ভাবছিলাম। কয়েকবার
পড়েও বুঝিনি এটা পিডিএফ। এটা অবশ্যই লেখিকার মুন্সিয়ানা
ও বর্ণনার চমৎকারিত্ব। কিন্তু এ জায়গাটায় তিনি
পাঠককে আশাহত করেছেন। পিডিএফ
না বলে এটাকে অনুক্ত
রাখাই ভালো ছিলো। এতে পাঠকের
সুন্দর কল্পনাটা নষ্ট হতো না। তাছাড়া হার্ডকপির আবেদন-বলা বাহুল্য
পিডিএফ ধারণ করতে সক্ষম
নয়।
জাকিয়া জেসমিন যূথীর লেখার
সাথে আমার পরিচয় তিন-চার মাসের। ইতিমধ্যে তার ভক্ত পাঠকে
পরিণত হয়েছি আমি। অসম্ভব
সুন্দর ও শক্তিশালী লেখনীর
প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আদায় করে নিয়েছেন
অসাধারণ কিছু গল্পের মাধ্যমে। এই গল্পের রথম অর্ধেকের
পরে কিছুটা আশাহত হয়েছি। তৃতীয় পুরুষে লেখা তার অন্য
গল্প পড়েছি কিনা মনে পরছে
না। তবে এটা পড়ে মনে হয়েছে
নাম আর সর্বনাম ব্যবহার
করতে গিয়ে বার বার দ্বিধান্বিত
হয়েছেন। অতিরিক্ত সর্বনামের
ব্যবহার গল্পের সাবলিলতার ব্যাঘাত
ঘটিয়েছে কিছুটা। অকপটেই
বলছি, এই জায়গাটায় খানিক দূর্বলতা
আছে লেখিকার। পাঠক
হিসেবে আমার কাছে তাই মনে হয়েছে।
এটাকে গল্পের প্রথম অংশের
বর্ণনা বলা যায়। অঘোষিত
দ্বিতীয় অংশে লেখিকা তার চরিত্রের
তাৎক্ষনিক মনোজগতের
অবস্থা তুলে ধরেছেন। যাতে
ফুঁটে উঠেছে বর্তমান প্রজন্মের
একজন তরুণিও মুক্তিযুদ্ধের কথা পড়ে কতটা
উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত হতে পারে। তার এই আবেগের বহিঃপ্রকাশ
ঘটিয়েছেন ‘লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত’ অনুষ্ঠানে
সহপাঠী ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে
অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এই ব্যাপারটিতে
লেখিকা নিজেও হয়তো আবেগ
দ্বারাই পরিচালিত হয়েছেন। বাধাপ্রাপ্ত
হলে মাকে বলা সাবিহার
কথাগুলো থেকে তাই মনে হয়। একথাগুলোতে একজন তরুণীর মনজগতের
আন্দোলনরত ভাবাবেগ উঠে আসলেও
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত
তরুণ প্রজন্মের মনোবল উঠে আসেনি। একজন তরুণীর চেতনা হয়তো
শুধু ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা
পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার মনোজগত
আরো বিস্তৃত। দেশকে
নিয়ে তার যে স্বপ্নজগত, নব চেতনায়
উজ্জীবিত হবার পর তার বিস্তৃতি, চিন্তা, পরিকল্পনা
এবং বন্ধুমহলকে সংগে নিয়ে
বড় উদ্যোগের সূচনা করা- এসবের
মাধ্যমে লেখিকা গল্পটিকে আরো প্রাণবন্ত, অর্থবহ
ও বার্তাবাহী করে তুলতে পারতেন।
এক্ষেত্রে বলতে হয়, নিজের
শক্তিশালী লেখনীর প্রতি লেখিকা
কিছুটা অবিচারই করেছেন। তার স্বভাবসুলভ
মসৃণ বর্ণনা, শব্দের সৌকর্য, বাক্যের
সুনিপূণ গাঁথুনি, ভাব ও মর্মের
প্রাচূর্য- এর কোনটিরই যেন সরব উপস্থিতি
নেই এই গল্প। প্রথমদিকের
রহস্যময়তাটিই গল্পটির চমৎকার সৌন্দর্য। তবে কিছু
বানান ভুল ও টাইপিং
মিসটেক ছিলো একেবারেই বেমানান।
পুনশ্চঃ ভালো দিকের
চেয়ে মন্দ দিকের আলোচনাই
হয়তো বেশি হয়ে গেছে
এই লেখায়। লেখিকার
কলমের কাছে আমার প্রত্যাশা
একটু বেশিই করে ফেলেছি- কারো
ধারণা হতে পারে, বিষয়টা মোটেও
তা নয়।
আমি তার কলম সম্পর্কে
যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বলেই কিছুটা
বাড়াবাড়িরকমের মন্তব্য করেছি। লেখিকা
জাকিয়া জেসমিন যূথীর কলম থেকে
তার স্বভাবসুলভ শক্তিশালী ও মজবুত
লেখাই সদা কামনা করি।
No comments:
Post a Comment