প্রজাপতির নির্বন্ধ
শীতকালটা ছোটবেলা
থেকেই ললিতা’র ভাল লাগে । লেপের ভেতর থেকে উঠার পর উঠোনের এক কোণে আগুণ পোহানোর কথা
এখনো তার মনে পড়ে। ঠাকুরদার আমলে পাড়ার মধ্যে ঠাকুরবাড়ির মানসম্মান ছিল আলাদা। ঠাকুরবাড়ির
বড় গোঁসাইকে লোকে গন্নিমন্নি করার কথা ললিতা এই বয়সেও মনে আছে। সে সময় ললিতা ভাবত,
ঠাকুরবাড়ির বড়গোসাই আমার ঠাকুরদা, তাই আমাদের একটা আলাদা সম্মান আছে।
আমরা একভাই, দু’বোন। আমার ঠাকুরদা
ঠাকুমার দু’ছেলে, বিরিঞ্চি ও শীতল। আমার বাবা শীতল ছোট, আমার জেঠু বিরিঞ্চি ঠাকুর।
জেঠুকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। দেশভাগের পরপরই আমার জেঠু দেশ ছেড়ে ওপারে চলে যান। নরেন
বাবুর পাঠশালায় মাইনর ক্লাস পর্যন্ত নাকি তিনি
পড়াশোনা করেছিলেন। ওপারে গিয়ে কলকাতার গঙ্গার ওপারের উত্তরপাড়ার হিন্দমোটর কোম্পানীতে
চাকরী পাওয়ার পর বিয়ে থা করে কোন নগরে বসবাস করছেন। তাঁর এক ছেলে আর এক মেয়ে। জেঠু’র বিয়েতে ঠাকুরদা ঠাকুমার ওপারে যাওয়ার ইচ্ছে
থাকলেও শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি পাসপোর্ট ভিসা না থাকায় । ঠাকুরদার বড় বোন সৌদামিনী
, আমারও সম্পর্কের ঠাকুমা ,ওখানে আমার জেঠু’র বিয়ে থা দিয়েছিলেন। সৌদামিনী ঠাকুমাকে
আমি দেখিনি। সৌদামিনী ঠাকুমা প্রায়ই নাকি আমার ঠাকুরদাকে এখানকার পাঠ চুকিয়ে ওদেশে
চলে যাওয়ার জন্য চিঠি দিতেন। বাবা’র মুখে শুনেছিলাম,ঠাকুরদা নাকি বলতেন- নিজের ভিটেমাটি
ছাড়ে, পরবাসে যাতি হবি ক্যানে ! ও-দ্যাশে গেলি পারে কি আমারে ঠাকুরবাড়ির বড় গোসাই কেইবা
বলবি। এত জমিজিরেত রাখে পরের দ্যাশে ক্যানে যাব।
সত্যি সত্যি ঠাকুরদা’র জমিজিরেতের
সঙ্গে মানসম্মান ছিল অগাধ, ব্রিটিশ আমলে আমাদের গয়েশপুর ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন
বিনা নির্বাচনে। সেই বংশের মেয়ে আমি ললিতা আর আমার দিদি মালতি। মালতি আমার চেয়ে বছর
ছয়েকের বড়। ঠাকুরদা আমাকে বেশি ভালবাসেন বলে আমার দিদি আমাকে হিংসেয় মরে যেত। মাইল
খানেক দূরের হাইস্কুলে ভর্তির আগের বছরে আমাদের পরিবারে একটা অঘটন ঘটে গেল।
সেদিন সকাল সকালই মহকুমার উকিলের
সেরেস্তা থেকে বাড়ি ফিরে এসে তিনি বাবাকে যা বলেন তা থেকে বুঝলাম তার মনের অবস্থা ভাল
না। - শীতল কেসে আমাগেরেই জিত হবেনে, তাহলি কী ওরা তো গুন্ডাপান্ডা! আমরা জিততি পারলিও
জমি কি ওরা ছাড়ে দেবেনে। আমি এটুকুই শুনেতে পেলাম। সে রাতের খাওয়া একটু সকাল সকালই হল। খাওয়ার পরে
ঠাকুরদা রোজকার মত পান খেয়ে হকোয় কুড়ুত কুড়ুত শব্দ করে ঠেস বেঞ্চে বসে তামাক খাচ্ছেন
দেখে আমি আর দিদি শুতে গেলাম। শুতে না শুতেই আমাদের চোখে ঘুম জড়িয়ে এল। হঠাৎ পরপর বাজির শব্দের মতো শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল।
দিদি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল- বাবুপাড়ায় ছোটবাবুর ছেলের বিয়ে, তাই হয়তো বাজি ফুটাচ্ছে।
বারান্দা থেকে কান্নার রোল কানে আসার আমরা দু’বোন বিছানা থেকে উঠে পড়িমড়ি করে বারান্দায়
গিয়ে দেখি ঠাকুরদা ঠেস বেঞ্চের সামনে মাটিতে পড়ে আছে শরীর থেকে রক্ত ঝরে বারান্দাটা
রক্তের নদী হয়ে যাচ্ছে। ঠাকুমা, বাবা ও মা তাকে ঘিরে কান্নাকাটি করছে। প্রথমে বুঝতে
না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম , ঠাকুরদাকে কাছ থেকে গুলি করেছে। দিদি ঠাকুরদার নাকের
কাছে হাত দিয়ে বলল- নি:শ্বাস পড়ছে না। আমি নাড়ির গতি দেখার চেষ্টা করে বুঝলাম , ঠাকুরদা
বেঁচে নেই। পরে আমি বুঝতে পারি জমিজিরেত রক্ষা
করার জন্যই ঠাকুরদাকে জীবন দিতে হয়েছে। ভারতে বসবাস করা আমার জেঠু ঠাকুরদাকে বারবার
ভিটেমাটি ছেড়ে ওদেশে চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু ঠাকুরদা তার কথায় তিনি সে সময় নিজের
জন্মভূমি ছেড়ে যাননি।
ঠাকুরদা আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার
পর থেকেই আমাদের পরিবারে নেমে এল দু:খের দিন। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে বাইরের কোন লোকই
আমাদের বাড়ির ভেতরে আসার সাহস করতো না। ঠাকুরদা বেঁচে থাকাকালে বাবা সংসারের দিকে নজর
দেননি। আমার বড়দা পড়াশোনায় মন বসাতে না পারায় আমার ঠাকুমা ও মা খুবই কষ্টে ছিলেন। বড়দিও টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ায়
আমিই বেশি কষ্ট পেলাম, ও স্কুল ফাইনালটা পাশ করলে ওর দেখাদেখি আমিও পড়াশোনা চালিয়ে
যেতে পারতাম।
ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পর আমাদের
অনেক জমিজমা কালু মুন্সি দখল করে নিল। আমার বাবার পক্ষে তা উদ্ধার করা সম্ভব হল না।
আমার বাবা শীতল ঠাকুর খুবই শান্ত মানুষ। মা আমার বড়দাকে বললেন- বাড়িতে দুটো সোমত্ত
মেয়ে, তাদের মধ্যে বড়টা তো তোর মতোই পড়াশুনা করল না। ওর তো বিয়ের বয়স হয়ে উঠেছে। তাকে
তো ব্রাহ্মণ পরিবারে বিয়ে দেওয়ার জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করা উচিত। মায়ের কথা শুনে বড়দা
মাকে বলল- ঠাকুমা বলের বিয়ে হচ্ছে প্রজাপতির নির্বন্ধ । সময় হলেই ওর বিয়ে হবে।
মা বড়দার কথা থামিয়ে দিয়ে বলেন-
শ্বশুর ঠাকুর বেঁচে থাকতে কেউ আমাদের বাড়ির ভেতরে আসার সাহস করতো না। এখন তো দেখছি
তুই ইয়ারবন্ধুদের নিয়ে তোর শোওয়ার ঘরে আড্ডা দিচ্ছিস্। তুই তো জানিস্ শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতে কায়েতপাড়ার ঠান্ডু কায়েতের
ছাওয়াল মদনটা তোর বোন মালতিকে বিয়ে করার জন্য
কিভাবে লেগেছিল! তিনি ওর বাবাকে বলে
হরিহরপুরের শ্যামা দাসের লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে সাধনার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার পর আমি ভাবলাম,
যাক মদনের হাত থেকে আমার মালতিকে বাঁচাতে পেরেছি।
মায়ের কথা শুনে আমার মনটা থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। যদিও আমি জানতাম আমার
দিদি মালতি স্কুলে পড়াকাল থেকেই মদনকে ভালবাসতে শুরু করে। সে তার বাবা মার পছন্দ করা
মেয়ের সাথে বিয়ে করতে বাধ্য হলেও তার মনটা
যেন এখনো পড়ে আছে আমার দিদির কাছে ।
আর দিদির কথা না বললেই নয়!
দিদি ও দাদা পড়শোনা ছেড়ে দিলেও
আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকলাম। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল।
কিন্তু আমার ঠাকুরদা আততায়ী’র হাতে
মারা যাওয়ার পর থেকেই আমাদের ঠাকুরবাড়ির অতীত গৌরব দিনে দিনে ম্লান হয়ে যেতে থাকছে,তা
ঠাকুমা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলেন। ঠাকুরবাড়ির বিধিবিধান আর ভবিষ্যতে থাকবে না, তিনি
তাও বুঝতে পারছিলেন। আমার মা ও ঠাকুমা দিদির বিয়ের জন্য আমার বাবাকে বারবার তাগাদা
দিতে লাগলেন । মামা ফরিদপুর শহর সংলগ্ন পেয়ারপুর ঠাকুরবাড়ির ছেলে প্রদীপ রায়ের সঙ্গে
বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। গ্রামের গন্নিমান্নি মানুষ চন্ডিচরণবাবু বড়ছেলে প্রদীপ
,হাইস্কুলের টিচার। কিন্তু দিদি বেঁকে বসল। সে কোন স্কুল মাস্টারকে বিয়ে করবে না। দাদার
বন্ধু মদনগোপালের বিয়ের পরেও কিন্তু তার সঙ্গে আমার দিদির প্রেম ভালবাসা সমান তালে
চলছিল, আমি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম। এমন খবরও আমার কানে এলো মদনগোপাল তার বউ এর সঙ্গে
ভাল ব্যবহার করে না।
সে বিয়ের পর থেকেই একটা মোটর সাইকেল
দাবী করে আসছিল যৌতুক হিসাবে। সাধনার মতো একটা সুন্দরী মেয়েকে মদনগোপাল কেন ভাল চোখে
দেখতে পারে না তা আমি বুঝতে পারছিলাম। মাঝে মাঝেই সে তার বউকে মারধর করে। আমার আশংকা
হল মদনগোপাল যে করেই হোক তার জীবন থেকে সাধনা বৌদিকে সরিয়ে দেবে না তো। পুজোয় সাধনা বাপের বাড়িতে যাওয়ার আগে মদনগোপাল তার
বউ সাধনাকে বলল- এবার বাপের বাড়ি থেকে ফিরে আসবার সময় মোটর সাইকেল বাবদ কমপক্ষে ষাট
হাজার টাকা নিয়ে আসবে, তা না হলে তোমার কপালে দু:খ আছে। স্বামীর কথায় সাধনা বুঝল তার
কপালে দু:খই আছে। সাধনার বাবা বাড়ি বাড়ি পুজো করে কয় পয়সাই বা পান , তিনি ষাট হাজার
কোথা থেকে দেবেন? স্কুলে যাওয়ার পথে মদন গোপালদের বাড়ি, সাধনা বৌদির সঙ্গে আমার প্রায়
দেখা হয়। সে চাপা স্বভাবের মেয়ে, সে আমাদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলত। তার মনের মধ্যে
একটা দু:খ কুড়ে খাচ্ছে তা সে কাউকে বুঝতে দিত না। সাধনা বৌদির সঙ্গে আমার খুব ভাব হওয়ার
কথায় একদিন দিদিকে বললে সে বলল- মাকে বলে তোর স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে। স্কুলে
যাস না পাড়া বেড়াতে যাস্।
দিদির কথা শুনে আমি বললাম- মদনদার
সঙ্গে বিয়ে করতে পারিসনি বলে তার বউ সাধনার উপর তোর এত রাগ! দিদি আমার কথা শুনে রেগে
বলল- তোর মদন দা'কে বিয়ে করতে বয়ে গিয়েছিল আমার।
- পাগল তো তুই হয়েছিলি এক সময়!
– ঠাকুমা আর মাকে দু’চোখে আমার
দেখতে ইচ্ছে করে না। ঠাকুমা উঠতে বসতে বলে বিয়ে হচ্ছে প্রজাপতির নির্বন্ধ। মানুষ যদি
বাধ সাধলে প্রজাপতির নির্বন্ধ কোথায় থাকে। তবে শোন ললিতা, আমি প্রজাপতির নির্বন্ধের
উপরই ভরসা করে থাকব যতদিন পারি । দিদির কথা শুনে আমার মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। দিদি
আর মদনগোপাল এর মাঝে আবার কী মতলব ফাঁদছে কে জানে! আমি টের পেয়েছিলাম মদন দা সাধনা বৌদিকে বিয়ে করার
পরও আমার দিদি তার সঙ্গে মিলমহব্বত রেখে চলছিল।
সেদিন একটু আগে বাড়ি থেকে বের হেই
সাধনা বৌদি'দির সঙ্গে দেখা করে যাব জন্য। তাকে সেদিন দেখে মনে হল তার মুখটাতে বিষাদের চিহ্ন লেগে আছে। আমি আগেই তার মুখ থেকে শুনেছিলাম
, সাধনা বৌদি মা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন সে যা বলল তা শুনে মদনদা'র উপর আমার বেজায়
রাগ হল। সব বিবাহিতা মেয়ে মা হতে চায়। আর সাধনা বৌদির স্বামী তার বউ এর পেটের বাচ্চাকে
নষ্ট করে দিতে চাচ্ছে। সাধনা বৌদির কথা শুনে আমার মনে পড়ল, মদনদা কে গোপালের মায়ের
কাছে যেতে দেখেছি। গোপালের মা কুজোবুড়ি কী গাছটাছ খায়িয়ে গর্ভপাত করিয়ে থাকে। তাকে
একবার এ কাজের জন্য পুলিশ ধরেও নিয়ে গিয়েছিল এক মহিলার গর্ভপাত করানোর অভিযোগে। আমি
সাধনা বৌদিকে বললাম- তুমি পেটের বাচ্চা নষ্ট করে দিও না।
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর সাধনা
বৌদির গর্ভপাতের কথা ভেবে আমার মনে দু:চিন্তার দেখা দিল। মদন'দা যে ধরনের শয়তান প্রকৃতির
লোক তাতে সাধনা বৌদির কপালে কী আছে কে জানে ! আমার দু:চিন্তাটাই বাস্তবে ঠিক হল। পরীক্ষার
পর মামাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় সাধনা বৌদির সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেশিদিন ছিল না। একদিন
খবর পেলাম যে সাধনা বৌদিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এক নাগাড়ে ব্লিডিং হচ্ছে। বাঁচার
কোন আশা নেই। ওখান থেকেই জানতে পারলাম অতিরিক্ত
ব্লিডিং এর ফলে সাধনা বৌদি হাসপাতালেই মারা গেছে। এ খবরে আমি খুবই কষ্ট পেলাম। আমার
দিদি মালতি আর মদনদা কষ্ট পেয়েছিল কিনা আমি সে মুহূর্তে বুঝতে পারিনি। জানুয়ারিতে ক্লাস
শুরু হলে আমি বাড়ি ফিরে এসে সবই জানতে পারলাম। বুঝতে পারলাম মদন'দা মতবল করেই কুজোবুড়ির দেওয় গাছগাছড়ার রস খাবারের মধ্যে মিশিয়ে
সাধনা বৌদিকে খাইয়ে মেরে ফেলেছে।
একদিন বিকালে ঠকুমাকে জিজ্ঞেস করলাম-
একে তো বলবেন নিয়তি, আর মদনগোপাল আবার বিয়ে করলে বলবেন তো প্রজাপতির নির্বন্ধ, তাই
না?
-হ্যাঁলো নানতি, তাছাড়া আর কী বা বলব!
সাধনা বৌদি এভাবে মারা যাওয়ায় ললিতার
মনে কোন প্রকার ভাবান্তর দেখা গেল না। একদিন মদনগোপালের বউ সাধনা বৌদি ওই ভাবে মারা
যাওয়ার কথা উঠলে মালতি দি বলেই ফেল- জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিলে এমনই হয়। ঠাকুমা পাশেই
ছিলেন তিনি বললেন- ওটা প্রজাপতির নির্বন্ধ। দিদি এবার রাগত কন্ঠে ঠাকুমাকে বলল- এবার
দেখি তোমার প্রজাপতি কী করে!
সাধনা বৌদি মারা গেছে বছর খানেক।
এর মাঝে নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। আমার মনে হল আমার মালতি দি এবার তার মনোবাঞ্ছা
পুরণ করতে চাইছে। আমি স্কুলে গেলে মদন দা প্রায় প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে, আর আসবার সময়
এটা-ওটা সাথে করে আনে।
ফরিদপুরে কাজ পাওয়ার পরে বাবা মাসে
একদিনের বেশি বাড়িতে আসতে পারেন না। মালতি দি ও মদন দা আমার দাদার মাধ্যমে মায়ের কাছে
তাদের বিয়ের প্রস্তাব রাখে। মা কুলিন ব্রাহ্মণের মেয়ে এ প্রস্তাবকে তিনি মেনে নিতে
চান না। ঠাকুমা এ প্রস্তাব শুনে বলেন – প্রজাপতির নির্বন্ধ থাকলে তো হতেও পারে।
তারপরের ঘটনায় মা ভেঙে পড়লেন। মদনের সঙ্গে যে ভাবে মালতি
দি মেলামেশা করছিল তার মধ্যেই এ ঘটনাটা ঘটার ঈঙ্গিত ছিল। মা একদিন বুঝতে পারলেন তার
বড় মেয়ে মাস দেড়েকে অন্ত:সত্ত্বা! মালতি ও মদন এমনকি আমার দাদাও এটাই চাইছিল।
এ কথাটা আমার দাদার কানে গেলে সে
বলল - আগের বারে তাদের বিয়েতে ব্রাহ্মণ ও কায়েতের ধুয়ো তুলেছিলে মা । এবার কী করবে
ভেবে দেখ মা। আমি ইচ্ছে করলে মদনগোপালের সঙ্গে মালতির বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারি। বড়
গোসাইয়ের নাতনির সঙ্গে ওরা মদনের বিয়ে দিতে এক পায়ে খাড়া। মানসম্মান রক্ষার খাতিরে মা ও বাবা তাদের বড় মেয়ে মালতিকে অসবর্ণে বিয়ে দিতে
রাজি হলেন। ঠাকুমা শুধুমাত্র বললেন- সবই প্রজাপতির নির্বন্ধ ।
মালতিদির বিয়ের সময় আমি নয় ক্লাস
থেকে দশ ক্লাসে উঠেছি। আর একটা ক্লাস শেষ করতে পারলেই স্কুল ফাইনালে বসতে পারব। কিন্তু
আমার আশা পূরণ হল না। সত্যি কথা বলতে দিদির চেয়ে আমার চেহারা ভাল আর বয়সের তুলনায় আমি
দিদির চেয়ে ডাগর হয়ে উঠেছি। এক সময় মনে হল, এর মাঝে দিদির বিয়ে অন্যখানে হয়ে গেলে মদনগোপালের
টার্গেট আমাকেই হতে হত।
ক্লাস টেনের মাঝামাঝি ফরিদপুর থেকে
বাবা বাড়ি এলে মা তাকে বললেন- ললিতাকে আমি আর পড়াতে চাইনে, আমার ভয় লাগে এ মেয়েটারও
একই অবস্থা না হয়!
বাবা বললেন-মাস ছয়েক পরে স্কুল
ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই ললিতার বিয়ে দিয়ে দেব , তোমাকে কথা দিলাম।
বাবার কথা শুনে আমার মনটা খারাপ হল, আমার ইচ্ছে স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর কলেজে ভর্তি
হয়ে আরো পড়াশোনা করা।
আমি এক সময় বুঝতে পারলাম যে স্কুল
ফাইনালটা দেওয়াই হয়ে উঠবে কিনা। ক্লাস এইটে পড়াকালে একদিন আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবী সুমনা
বলেছিল- মোবাইল ফোন সস্তায় বাজারে আসছে, গঞ্জের বাজারে একটা টাওয়ার বসিয়েছে। আমাদের
স্কুলের দোতলার ছাদে টাওয়ার বসাবে নাকি শুনলাম হেডস্যারের মুখ থেকে। মাস দুই যাওয়ার
পর আমি বুঝতে পারলাম সুমনা ঠিক কথাই বলেছিল। মদন দা আর আমাদের মধ্যে দূরত্ব মাত্র মাইল
খানেকের। মদন দার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর আমি আর ওদের বাড়ি হয়ে সোজা পথে স্কুলে যাই না।
শ্রাবণ মাস বৃষ্টি বাদল বেশই হচ্ছিল। পাকা রাস্তা ধরেই স্কুলে যাচ্ছিলাম। মদন জামাইবাবু
দুপুরের আগে ঝড় জলের মধ্যে বিলের কৈ, মাগুর মাছ নিয়ে হাজির। দিদি তাদের বাড়িতে , রেইনি
ডের জন্য আমি স্কুলে না যেয়ে বাড়িতেই ছিলাম। দাদা বাবার কাছে ফরিদপুরে। বাড়িতে আমরা
মাত্র তিনটে মানুষ, তার মধ্যে আমি আর মা মাছ খাই।
মাছগুলো দেখে মা জামাইবাবুকে বললেন-
এত মাছ এনেছ কেন,বাবা?
– জলে জিইয়ে রাখেন, মদন জামাইবাবু
বলল।
-মাছ রাঁধছি , বাবাজী খেয়ে দেয়ে
বাড়ি যাবে।
মায়ের কথায় মদন জামাইবাবু এক কথায়
রাজি হয়ে গেল। পা ধুয়ে, গা ও পা মুছে জামাইবাবু
আমার সাথে সাথে আমার ঘরে এসে বলল- ছোট গিন্নি, তুমি স্কুলে যাওনি।
- বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে স্কুলে
যাব? ছাতা তো একটাও বাড়ি নেই। আপনার ছাতাটা রেখে যাবেন কালও যদি বৃষ্টি লেগেই থাকে
তবে।
আমার কথা শেষ করার আগেই জামাইবাবু
বলল - একটু চা দিতে পার ললিতা, ঠান্ডায় জমে যাবার মত অবস্থা হয়েছে। জামাইবাবুর কথা
শুনে মা নিজেই চা আর মুড়ি ও চানাচুর পৌঁছে রান্নাঘরের বারান্দায় মাছ কুটতে বসলেন। রান্নাঘরটা
আমার রুমের অপজিট সাইডে। আমাকেও চা মুড়ি খাওয়ার জন্য মদন জামাইবাবু পিড়াপিড়ি করলেও
আমি তা খেলাম না। জামাইবাবু চা মুড়ি শেষ করার পরপরই মুসলধারে বৃষ্টি নামল। জামাইবাবু
বলল- এমন বৃষ্টি নামলে আমি তোমাদের এখানে আসতাম না।
আমি তার কথা শুনে বললাম- এক সময়
তো বৃষ্টি ধরবে , তার মধ্যে মায়ের রান্নাবান্না হয়ে যাবে।
-বাড়ি থাকলে রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে
তোমার দিদির সঙ্গে মজা করে একটা গেম খেলা যেত।
আমি জামাইবাবু’র কথার মাথামুণ্ড কিছু না বুঝে আমি আমার পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে বসে
পড়ায় মন দেওয়ার কথা ভাবছি এমন সময় জামাইবাবু আমার হাতটা ধরে একটা হেঁচকা টান দেওয়ায়
হাতা বিহীন চেয়ার থেকে ছিটকে জামাই বাবু’র গায়ের উপর পড়লাম। আমার বুক ওর বুকের উপর
পড়ায় আমি লজ্জা পেয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। জামাইবাবু বিছানা থেকে
উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার গোলাপী গালে
জোর করে একটা চুমু দিয়ে বলল-দিদি নেই তাতে
কী! কেউ কেথায়ও নেই,এস আমরা একটা গেম খেলি। আমি
দৌড়ে পাশের রুমে চলে যাওয়ার সময় জামাইবাবুকে বলতে শুনলাম- গোলাপী গালে একটু চুমু দিয়েছি
তাতেই এত ভয়! বিয়ের আগে তোমার দিদি’র সঙ্গে চুমু’র সঙ্গে টুমুটাও খেয়েছি কত! এবার আমি জামাইবাবুর
মতলবটা বুঝতে পারলাম। আমি ভিজতে ভিজতেই রান্নাঘরে মায়ের ঘরে চলে গেলাম। তারপর থেকে
আমি জামাইবাবুর ছায়া না মাড়ানোর চেষ্টা করে নিজেকে তার লালসা থেকে নিজেকে বাঁচালাম
।
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার
পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ের ব্যাপারে মায়ের কথাই আমি মেনে নেব। বিয়ে না করে বাড়িতে
থেকে পাশের কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে গেলে জামাইবাবু আমাকে কুড়ে খাবে , শেষ পর্যন্ত ও এমন
অবস্থাও করতে পারে যাতে সে আমাকে বিয়ে করে আমার দিদি’র সতীনও বানাতে পারে । আসলে ও
একটা বদমায়েশ । আমি বিয়ে করতে রাজি আছি সে কথা আমি একদিন মাকে বললাম। আমার কথা শুনে
মা খুশি হলেন। একথা জেনে দিদিও খুশি হল, কিন্তু মদনজামাইবাবু খুশি নয় তার কাথাবার্তায়
আমি বুঝতে পারলাম। বাবা মানিকগঞ্জের শহরতলীর আমাদের পাল্টি ঘর নারায়ণ গোস্বামীর একমাত্র
ছেলে নির্মাল্য গোস্বামী সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। বাবা ফরিদপুরে মামাবাড়িতে
নিয়ে আমাকে পাত্রপক্ষকে দেখালেন। মা ও মামী বললেন – ছেলেটা শরীর স্বাস্থ্য আর চেহারা
খুবই সুন্দর। মদনজামাইবাবুও দিদি ওখানেই ছিল। ছেলে দেখে দিদি’র পছন্দ। কিন্তু মদনজামাইবাবু
যে সব কথা বলল তা থেকে বোঝা গেল ছেলে তার পছন্দের নয়। মদনজামাইবাবু দিদিকে বোঝানোর
চেষ্টা করল এই বলে- ছেলেটা বাবার সঙ্গে পুজোটুজো করে বেড়ায়,আর মোবাইল, টেলিভিশন মেরামত
করে। জামাইবাবুর কথা শুনে আমি মনে মনে বললাম- জামাইবাবুতো এটা বলবেই, কারণ সে তো ভবঘুরে
কোম্পানীর ম্যানেজার।
নির্মাল্য এর সঙ্গে আমার বিয়ে সমারোহের
সঙ্গেই হল। স্বামী হিসাবে নির্মাল্য সত্যিই আদর্শবান। আমার ঠাকুমা আমার বিয়ের পরে বললেন- ললিতে তোর বিয়ে পদ্মা ওপাড়ে হল , এটা প্রজাপতির
নির্বন্ধ ছিল । আমি স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে সুখেই ছিলাম। দু’বছর পরে আমার প্রথম
কন্যা সন্তান জন্মাল। তার ফুটফুট চেহারার জন্য আমার শাশুড়ি তার নাম রাখলেন রূপমতী।
নির্মাল্য মোবাইল মেরামতের সঙ্গে দু’একটা করে দোকানে নতুন মোবাইল সেটও তুলতে লাগল ।
এখন লোকের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। রূপমতির জন্মের এক বছর পরে মালতি দিদির প্রথম ছেলে
হওয়ার খবর ললিতা মোবাইল ফোনেই জানতে পেরে সে ভাবল দিদি’র তো বাচ্চাকাচ্চা আগেই হওয়া
উচিত ছিল, কিন্তু জামাইবাবু তো দিদি’র সঙ্গে গেমের পর গেমে খেলে কয়েক বছর কাটিয়ে দেওয়ায়
আমার রূপমতি’র জন্মের পরে দিদি প্রথম ছেলে হলো!
রূপমতী পাঁচ বছরে পড়লে আমি আবার অন্ত:সত্ত্বা হলাম। একদিন আমার শাশুড়িমা আমাকে বললেন – একটা ছেলে না হলে বংশে প্রদীপ দিতে
তো কেউই থাকবে না। মা শাশুড়ির কথা শুনে আমি মুখে কাপড় দিয়ে শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে সরে
পড়লাম।
শাশুড়ি মায়ের আশাই পূরণ হল। একটা
ফুটফুটে ছেলে জন্ম দিলাম। এবার শ্বশুর মশাই তার নাতির নাম রাখলেন নিরূপম। আমাদের সংসার
সুখেই চলছিল। রূপমতী প্রাইমারী স্কুলের পাঠ চুকিয়ে পাশের গার্লস’ স্কুলে ভর্তি হল।
আমি জানতাম মেয়ে আমার অপূর্ব সুন্দরী, টিকালো নাক, ডাগর ডাগর দুটো চোখ, গা গতর সুঠাম।
স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর আমার শাশুড়িমা রূপমতির বিয়ে জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। পাড়ার ছেলেরাও
রূপমতির রূপে যেন পাগল হয়ে প্রথমে টিজ করতে , বিয়ের প্রস্তাব দিতে শুরু করল। আমিও শাশুড়িমার
কথায় রাজি হলাম। ভরতপুরের প্রকাশ দেবরায়ের একমাত্র ছেলের সরোজ দেবরায়ের সঙ্গে রূপমতির
বিয়ে পাকাপাকি হল। ছেলে দেখতে সুপুরুষ। গ্রামের বাজারে ওষুধের ফার্মেসি আছে, বেচাবিক্রিও
ভাল। ওর বিয়ের সময় আমার মা, ঠাকুমা ও দিদি মদন জামাইবাবু এল। এ বিয়েতেও ঠাকুমা বললেন-
এ বিয়েটাও প্রজাপতির নির্বন্ধ।
রূপমতির বিয়ের তিন মাস পরে ভাদ্র
মাস। বিয়ের পরের প্রথম বর্ষাকাল বাপের বাড়িতে কাটাতে হয়, সেই নিয়ম পালন করতেই রূপমতিকে
ওর বাবাই ওকে আমাদেরে এখানে নিয়ে এল। আমি লক্ষ করলাম রূপমতি জামাইয়ের সাথে মোবাইল ফোনে
কথা বলে না। এমন সুন্দর জামাই ভাগ্যের কথা। একদিন
আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম- জামাইবাবজীকে ফোন করিস না? আমি ফোন করে বাবাজীকে
আসতে বলেছি। জামাইবাবাজী খুব ব্যস্ত তাই হয়তো কয়েকদিন পরে আসবে।
আমার কথা শুনে মেয়ে বিরক্তির সঙ্গে
বলল- ওকে আসতে বারণ করে দাও, কয়েকদিন যেতেই রূপমতী মুখ খুলল। ও বলল- আমি ওখানে আর ফিরে
যাব না।
-মেয়ের কথা শুনে আমি তো থ! বলে
কী মেয়ে! আমাকে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে দেখে রূপমতী বলল- রাঙা মূলোর সঙ্গে তোমরা
আমার বিয়ে দিয়েছ, আমি ওর সঙ্গে ঘর সংসার করবো না। আমি ভাবলাম, তবে কি ও বিয়ের আগে অন্য
কোন ছেলেকে ভালবাসতো! ভালবাসলে বিয়ের আগে তো তা আমাকে বলতে পারত!
রপমতির বাবা বাড়ি এলে আমি সব কথা
খুলে বললাম। সে মেয়েকে কাছে ডেকে জামাই সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইল। রূপমতী একই
কথা বলল- আমি ওকে ডিভোর্স দেব। তারপর অনেক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সত্যি সত্যি প্রকাশের
সঙ্গে রূপমতির ডিভোর্স হয়ে গেল। আমার শাশুড়িমা পুরনো কালের মানুষ, তার যুগে এ সব ঘটনা
তিনি দেখেননি , তাই তিনি বড়ই কষ্ট পেলেন।
কয়েকমাস কেটে যাওয়ার পর শাশুড়িমা
আমাকে বললেন- মা, আমার নাতনি’র একটা গতি করতে হবে। নির্মাল্য বাবাজীকেও রূপমতির বিয়ের
জন্য ছেলে দেখতে বলেছি। আমার মতে তোমার বাপের বাড়ির এলাকার একটা চাকুরে ছেলেকে খোঁজ
করলে হয় না?
আমি আমার শাশুড়িমায়ের কথা রাজি
হয়ে তাকে বললাম- আমি আমার বাপের বাড়ির দেশের একটা চাকুরে ছেলের সঙ্গে রূপমতিকে বিয়ে
দেব, আর বিয়েটাও হবে ওখানেই।
আমি এ বিষয়ে বাবা ও দাদাকে ফোন
করলাম। দাদা কুষ্টিয়া শহরে একটা ছেলের খোঁজ দিলেন। ছেলেটির নাম অনুপম ভাদুরী। একটা
এনজিও তে চাকরী করে । ও ছেলেটির আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। তার প্রথম স্ত্রী বাচ্চা হওয়ার
মারা যায়। দাদা জানাল যে ছেলেটি সু শ্রীমান ও চরিত্রবান। রূপমতিকে অপছন্দ করার কথাই
উঠে না। আমরা রূপমতিকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়িতে গেলাম। রূপমতিকে দেখে অনুপমের বাবা
মা পছন্দ করলেন। তারা জানালেন তাদের দেখাই ফাইনাল। এবার আমি রূপমতিকে জিজ্ঞেস করলাম-
ছেলের ফটো তো দেখেছিস। এ ছেলেকে কি তুই পছন্দ করিস, না ছেলে আসবার কথা বলব।
আমার কথা শুনে রূপমতী বলল- তোমাদের
পছন্দই আমার পছন্দ। আমাদের বাড়ি থেকে সবাই আমার বাপের বাড়িতে এল। অনুপম ভাদুরীর সঙ্গে
সাড়ম্বরে রূপমতির বিয়ে হল। আমি স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম। আমার ঠাকুমা এবারও বললেন-
এটা তো প্রজাপতির নির্বন্ধ । আমাদের বাড়ির সবাই বাড়ি ফিরে গেলাম, শুধু আমি থাকলাম অষ্টমঙ্গলা
সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য। মা আমার শাশুড়িকে
বললেন- ললিতাকে এ মাসটা এখানেই থেকে যাওয়ার কথা বলছি। মায়ের কথায় আমার শাশুড়িমা রাজি
হলেন। অষ্টমঙ্গলার পরে জামাই মেয়ে কুষ্টিয়া ফিরে গেল। আমি কল্পনাও করতে পারিনি আমার
সুন্দরী মেয়ে রূপমতি আমাদেরকে আরো জ্বালাবে!
পনেরো দিন হল রূপমতির বিয়ে হয়েছে,
আমারও বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন এগিয়ে এল। সেদিন
সন্ধ্যার পরে ফোনে জামাইয়ের কথা শুনে আমার যেন জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা হল।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে যে কথা ভেসে এল তা আমার বুকে শেলের মত বিঁধল। আমার মা এগিয়ে
এসে বললেন- কী হল ললিতা!
আমি আমার মাকে কী বলব! শেষ পর্যন্ত
আমি তাকে বললাম- সন্ধ্যার দিকে তোমার নাতনি রূপমতী একটা ছেলের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি থেকে
পালিয়ে গেছে।
- সে কী কথা! মা নিজের মাথায় থাপ্পর দিয়ে বসে পড়লেন। আমার মাথার
উপর যেন পাথর ভেঙে পড়ল।এক সপ্তাহ হয়ে গেল রূপমতির কোন খবর না পেয়ে আমরা দিশেহারা। তার
ফোন বন্ধ।
মদনজামাইবাবু আট দিন পর আমাকে জানল
যে ফোনে আলাপ করে ভালবেসে একটা বেকার ছেলের সঙ্গে রূপমতী ভেগে গেছে। সে আমাক বলল- ললিতা,
তোর মতো সতীলক্ষ্মীর পেটের মেয়ে কান্ডকারখানা দেখে মরে যাই! তোর দিদি’র আমার মতো মদন
কায়েতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে তুই কেঁদে মরিস । এবার দেখগে তোর মেয়ে কার সঙ্গে ভেগেছে,
জেলের ছেলের সঙ্গে। সে কাটাঘাঁয়ের উপর নুনের ছিটো দিয়ে চলে গেল। রূপমতিকে খোঁজাখুজি
করে জানতে পারলাম মদনের কথা ঠিকই। বিশ্রি চেহার একটা বেকার ছেলের সঙ্গে গরশু বিয়ে হয়ে
গেছে। ঠাকুমা এ খবরটা শুনে এবারও বললেন- প্রজাপতির নির্বন্ধ ।
No comments:
Post a Comment