02 March 2016

আবু উবায়দাহ তামিম


বান্ধবী

আমি জানতাম আমার চেহারা দেখতে ভালো ছিল না। তাই কখনো মুগ্ধ চোখে কাউকে দেখার সাহস করিনি। যখন আপুদের শাদা চামড়ার বান্ধবীরা আমাদের বাড়িতে ঘুরতে আসতো। আমি ওদের সামনে পড়ে যাওয়ার ভয়ে আমার ঘরের দরজা আটকে রাখতাম। পেশাব পায়খানার একান্ত প্রয়োজন না হলে বের হতাম না। মৃত্যু ঘরের মতো নিঃশব্দ পড়ে থাকত আমার ঘর ও আমি। মাঝে মাঝে আমার মা এসে দরজার ছিটকানি নাড়াতো। আমি কোন কথা বলতাম না। কাঁথা মুড়ো দিয়ে লাশ হয়ে শুয়ে থাকতাম। মা আমার কথা না শুনতে পেয়ে ভাবতেন আমি ঘুম। আবার চলে যেতেন। আমি তখন কাঁথার ভেতর শুয়ে শুয়ে একটা লাশের সাথে নিজেকে মেলাতাম। খুব ভালো লাগতো। মনে হত, লাশেরাও কি এভাবে ভাবতে পারে! যে সব লাশদের চেহারা কালো, তারা কি মনে বিষণ্ণতা

নিয়ে থাকে! এইতো সেবার কী শীত! মজিদ চাচা মারা গেছিল। মজিদ চাচার চেহারাটা খুব কালো ছিল। শুনেছি কোন মেয়ে নাকি ওনাকে বিয়ে করেনি উনি কালো বলে। মজিদ চাচা কত ব্যথা পেয়েছিলেন মনে। শুধু বলতো, ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন, তবে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসার জন্য কাউকে বানাবেন। কিন্তু আমি অবাক হয়েছিলাম যখন চাচার লাশ টা মরে যাওয়া ঘর থেকে বের করে উঠোনে রাখা হয়েছিল। তখন গ্রামের কত সুন্দরী মহিলারা এসে মজিদ চাচার মরদেহ দেখছিল, আর বলছিল আহ্ রে খুব ভালো মানুষ ছিলো বেচারা। ভালো মানুষগুলো কিভাবে একেরপর এক চলে যাচ্ছে...।

আমি দুর থেকে শুনতাম আর আফসোস করতাম। মজিদ চাচা যদি জানতেন তার বিদায়ের সময় কত মানুষ তাকে ভালোবাসা নিবেদন করছে। এমনকি এলাকার সবচে শাদা চামড়ার মেয়ে বলে যাকে জানতাম সেও এসে দু ফোটা চোখের জল ফেলেছিল। আমি তারপর থেকে যখনি একা সময় কাটাতাম, শুয়ে শুয়ে নিজের শরীরটাকে শুধু মজিদ
চাচার লাশ মনে করে চোখ বুজে থাকতাম। এমন করে ভাবতে ভাবতে একদিন সন্ধ্যেয় আমার চোখে ঘুম নেমে এলো। দেখি, গাড় স্বপ্নে আমি লাশ হয়ে গেছি। তারপর কত মানুষ আসলো আমাকে দেখতে। আসতে আসতে বেড়ার ঘর ভরে গেলো। হঠা
করে দেখি আপুর সেই শাদা চামড়ার বান্ধবী এসেছে। যার জন্য একদিন পালাতে গিয়ে হুবড়ি খেয়ে পড়েছিলাম মাটির বারান্দায়। ও শুধু আমাকে দেখতে চাইত, আর আমি নিজেকে লুকাতাম। কিন্তু আজ ও কাঁদছে না। অথচ আমি ওর কান্নার অপেক্ষায় ওর দিকে চেয়ে থাকলাম অনেক্ষণ। ও আমার মরা চোখ নাক ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি অথচ ও একটুও বুঝতে পারছে না। শেষে ওর না-কাঁদা দেখে আমারই মরা চোখ থেকে জল নেমে এলো। আর ও তখন আমার কপালে বড় করে চুমু তে ভিজিয়ে দিল। আমি উঠে বললাম, চুমু দেয়ার মানে কি তুমি আমাকে ভালোবাসো?

No comments:

Post a Comment