24 March 2016

ফারাহ্ সাঈদ



রুদ্রাক্ষের মালা

বৈষ্ণবীর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। কাপ-পিরিচের ঠুকাঠুকি বন্ধ করে দিয়ে সে কান পেতে শোনে। দোকানঘরের হারিকেনটা হাতে নিয়ে উঁচু করে রাস্তায় দিকে ধরে। আবছা আলোয় খুব বেশি দূর দেখা যায় না। গেরুয়ারঙের আদলে একটা কিছু হেঁটে আসছে বলে মনে হয়।
বদি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, এতোদিন কই আছিলেন দিদি?
মাধবী ফিরে তাকায়, কেগো তুমি?
-আমি কুসুমপুরের বদিউল।
মাধবী ভ্রু কুচকে ওর তাকিয়ে থাকে।
-পান আছে তোমাগো দোকানে? পুরাটা পথ পান খাইতে পারি নাই। আকাল পরলো নাকি?
-দুইদিন ধর্মঘটের কারণে হয়তো বাজারে পান ওঠে নাই।
-গেরামেগঞ্জে আবার কিয়ের ধর্মঘট?
-দিদি কী যে কন, আইজকাল শহরের বাতাস গেরামেও লাগছে। দিদি আমার লগে কুসুমদুপুর চলেন, অনেকদিন ঐদিকটায় দেখি নাই আপনারে।
-তোমাগো গেরামে ক্যান যামু? কী আছে অইখানে?
-আমার সঙ্গে চলেন, দিদি। আপনার পছন্দের আছে একজন।
-আমারে পান খাওয়াইতে হবে কিন্তু!
ওরা পাশাপাশি হাঁটে। বদি মাধবীর পুটলিটা কাঁধে নেয়!
-এইবার কদ্দিন থাইকবেন দিদি?
-আমারতো ঘরবাড়ি নাই। যতদিন ইচ্ছা থাইকতে পারি।
পেছনে কে যেনো হেঁটে আসছে। ওরা সরে দাঁড়ায়। সরু রাস্তা। লোকটা তবু এগিয়ে আসে না। বদি পেছনে ফিরে তাকায়। - দিদি কেউ ছিলো কি আমাদের পেছনে?
-ছিলোতো, কোথায় গেলো মানুষটা?  বদি বারবার পেছন ফিরে তাকায়।
-কুসুমপুর আর কতোদূর বদিমিয়া? টর্চের আলো ফেলে পূবের দিকে ইশারা করে, এইতো আর কিছুদুর।
-তুমি কুসুমপুরের কার কথা কইতাছো?
বদি দরজায় কড়া নাড়ে, দরজা খোলো সুরুজ, দরজা খোলো। ১০ মিনিট পেরিয়ে যায়।
-এ তুমি কার বাড়িতে নিয়া আসলা বদি?
কুপি হাতে দরজা খুলে দাঁড়ায় সূর্যনা। মাধবী চমকে ওঠে, সূর্য তোর কি হইছে? সে জড়িয়ে ধরে মেয়েটাকে। ও কোনো কথা বলে না। ভাবলেশহীন সূর্যনা বেগমের সুশ্রী মুখখানা কালোমেঘের বন্যা ঢেকে আছে! বদিউল নীরবে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। মাধবী ঘরে আসতে বলে।
-নাহ্ দিদি ঘরে ডাইকো না, বিপদ হবে।
-তুমি যাও আমার ঘরের সামনে থাইকা। সূর্যনা বলে। মাধবীর পুটলিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় বদিউল।
-সূর্য তোর কী হইছে, আমারে বলবি না?
-তুমি বদিরে জিগাইতে পারো না? ও তোমারে কিছু কয় নাই? সূর্যনা রান্নাঘরের দিকে মাধবীকে নিয়ে যায়। ভাত তরকারি থালাতে সাজিয়ে বলে, চাইরডা খাও দিদি। পোড়ামরিচ আর পেঁয়াজকুচি থালাতে রাখে সে।
-তুই খাবি না?
-নাহ্, আমার গলা দিয়া কিছু নামেনা গো দিদি।
-সূর্য একটা কথা... তোফাজ্জল কই? তোদের বিয়েটা...? মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সূর্যনা, তফু আর নাই গো দিদি। মাধবীর মনে পড়ে যায় সেইসব দিনের কথা। হাইওয়ের দুপাশে সবুজক্ষেত। কাকতাড়ুয়া ছিলো। সেই মেয়েটি আইলের পাশে বসেছিলো।
-তোমার গলায় ঐটা কি দিদি?
-ঐটা মালা, রুদ্রাক্ষের মালা, তুই চিনোসনা সুরুজ? তোফাজ্জল বলে ওঠে।
-তোমার নাম সুরুজ?
-না, আমার নাম সূর্যনা। চাচাজান রাখসেন।
-ভারি সুন্দরতো!
-ছোটোকালে আমি অনেক সুন্দর ছিলাম। সূর্য থিকাও বেশি ফকফকা।
-সূর্য না, সূর্য থিকাও বেশি সুন্দর! মাধবী হাসে। অট্রহাসিতে ওর দুচোখে জল। মাধবী, আইলের উপর বসে পড়ে। বাটা খুলে পান সাজায়।
-পান খাবি পাগলি?
-আমারেও একটা পান দেন দিদি। তফু হাত বাড়ায়। তারপর থেকে গ্রামে এলেই ওরা দু'জন বৈষ্ণবীকে ঘিরে রাখে।
'প্রণামি বৈষ্ণব তোমারে পরজনমে মোরে রাখিও রাধার আদলে...' গান ধরে মাধবী। সূর্য আর তফুও গান গায়। সূর্যের দুঠোট লাল, ওর খোঁপায় গাঁদাফুল। তফু আড়চোখে ওকে দেখে। কিছুই মাধবীর নজর এড়ায় না। পুজোর সময় লালরঙা পাতলা কাগজ ঠোঁটে ভিজিয়ে লাল করে বীরেণদের বাড়ি যেতো মাধবী। মায়ের লিপিস্টিক হাতের নাগালে পেতো না তখনো।
  
সূর্য বিছানা ঠিক করে দেয় মাধবীর। মার হাতে বানানো কাঁথাটা পাশে রাখে। সূর্য মাদুর পেতে মেঝেতে শোয়। ঘুম আসে না মাধবীর। সূর্য আর তোফাজ্জলের কথা ভাবে। মাধবী বলেছিলো, তোমরা বিয়া করবা না?
-শিরীষ গাছ সাক্ষী রাইখা আমরা কবেই মালাবদল করছি। তফু বলে।
-আল্লার কিরা দিদি আমাগো বিয়া হইয়া গেছে, তুমি বিশ্বাস করো! সূর্য কথাটা বলেতে গিয়ে লজ্জায় মাধা নিচুঁ করে রাখে।
-বদি, ওরে ঘরে তুলে নাও, আর কতোদিন দুইজনে বনে বাদারে ঘুইরা বেড়াইবা?
-দিদি, আমার সংসার ভালা লাগে না।
-আমি আর বদি তোমার সাথে গেরামে গেরামে যামু, তুমি গান ধরবা "আমার চক্ষু নাই... কে আমার পথের পানে চায়.." -পাগলি তুই কী বলস, তোর সংসার হইবে, ছাওয়াল হইবে, ধানের মৌসুমে তোদের উঠানে গানের জলসা হইবে। আমি আসমু। এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে মাধবী। গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। সূর্য কাঁদে, ডুকরে কাঁদে। ওঠ সূর্য, ওঠ। তোর কী হইছে? মাধবী গ্লাস খোঁজে, কোথায় রাখলি জল? সূর্য তুই উঠে বস! আলো ফোটেনি আকাশে। দরজা খুলে দাওয়ার বসে থাকে সূর্য। ঘরের পাশে উঠোনের নিমগাছটা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশায় নিমজ্জিত তাদের গ্রাম। সমুদ্র তলদেশে ডুবে থাকা একটি পুরোনো জাহাজের মতোই। শ্যাওলা আর মাছেদের দেশে নাবিকহীন এ জাহাজবাড়িতে একাকী বসে আছে এক বিমর্ষ মসকন্যা, সূর্যনা। জাহাজের মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। কিসের অপেক্ষায়? আসবে কি সে ডুবুরীবেশে! হাত ধরে নিয়ে যাবে সূর্ষস্নানে। ঘন হয় কুয়াশার ভোর, আরো ঘনীভুত। কোথায় উদ্ধারকারী?
-সূর্য, আমার দিকে তাকা! কথা বল, ঘরে আয় সুরুজ। ঘরে নিয়ে এসে মাধবী সূর্যের এলোচুলে চিরুনি দেয়।
-দিদি, তফু আমারে ছাইরা চইলা গেছে!
-কই গেছে ঐ হারামজাদা?
-বদি সব জানে, ওরে জিগাও। আমি কি কিসু জানি না।
-বদি সব জানলে তোরে কইবো না কেন?
-তুমি জানো, বদি আমারে বিয়া করতে চায়, চাচাজানের কাছে প্রস্তাব দিসে। তুমি ওরে কয়া দিও, ও যাতে আমার সামনে না আসে। ও আমার তফুরে গায়েব করসে। মাধবী স্নান সেড়ে দিঘির পাড়ে শাড়ি শুকোতে দেয়। বদি আসে, সুরুজ কেমন আছে দিদি, কিছু কইসে আপনেরে?

-তফুর কী হইসে বদি, এইসব কী কয় মাইয়াডা?
-তুমি ওরে বিয়া করতে চাও?
-দিদি সূর্যের মাথা ঠিক নাই। তফু কোথাও যায় নাই। ওরে আপনি এই গেরামে দেখতে পাইবেন। সূর্যের কি যে হইসে আমি জানি না। বাপমা নাই চাচার কাছে বড় হইসে, চাচিও বাইচা নাই, বাড়িতে একলা মাইয়ামানুষ। আমার চিন্তা লাগে দিদি, ও যে কখন কী করে!
-বদি, তুমি আমারে তফুর কাছে নিয়া যাইতে পারো? পারুম না কেন? নিয়া যামু আপনেরে। আমি ওর লগে কথা কইনা, আপনেরে দেখলে কথা কইবো তফু। পুকুরঘাটে ওজু করছিলেন তিনি। শাদা লম্বা কোর্তায় খুব সহজে চিনে ফেলা যায় মানুষটিকে। মাধবী লম্বা ঘোমটা টানে। চাচাজানের সাথে দেখা হয়।
-তুমি ভাল করসো বৈষ্ণবী আমাগো বাড়ি আইসা। সুরুজের শরিলটা ভালা না। তুমি ওর লগে কয়টা দিন থাকো। সুরুজরে নিয়া আমি আর পারি না। আমার বয়স হয়া গেসে।
সূর্যের ঘরের দাওয়ায় জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে কজন।
-কী হইসে এখানে? - ওরে জ্বীনে ধরসে দিদি, দেহেন কেমুন করতাসে! সূর্য উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পাশে তারাবিবি কোরান শরিফ পড়ছেন। গোঙানির শব্দ যে আর থামে না! তজবি হাতে চাচাজান নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন নিমগাছটার দিকে। -বদি, মনুরে খবর দে, এই নিমগাছটাই সব শয়তানের জড়। আমার সুরুজরে শেয কইরা ফালাইসে। মনুরে ক গাছটা কাইটা ফালাইতে। মনুরে এখনি খবর দে তোরা! তারাবিবি সুর করে কোরান শরিফ পড়েন। সূর্যের মুখ ফেনা ওঠে। তারাবিবি কোরান রেহেলে রেখে সূর্যের মাথায় ফু দেয়। গোঙায় সূর্যনা। ডাক্তারের কাছে নিয়া যান চাচাজান, কে যেনো বলে ওঠে, ওরে জ্বিনে ধরসে।
-খারাপ জ্বিন, ডাক্তার কবিরাজে কাজ হবে না, তারাবিবি বলে ওঠেন। পানিপড়া গায়ে ছিটায় তারাবিবি। ভিজে যায় হলুদিয়া শাড়ি। বাধা দেয় সে। প্রচণ্ড এক চড়ে বসে পড়ে সূর্যনা বেগম। মাধবী আর দাঁড়াতে পারে না। বদির হাত টেনে নিয়ে রাস্তায় নামে, আমারে তোফাজ্জলের কাছে নিয়া চলো বদি। ওরা ঘুরে বেড়ায় পথে পথে একটা মানুষের খোঁজে। দুপুরের খরারোদে। বিকেলের নিমরোদে। কোথাও দেখা মেলে না তোফাজ্জলের। সন্ধ্যে নেমে এলে চৌধুরীদের রাইসমিলে ঢোকে। ছেলেটা অনেকবছর এখানে কাজ করতো। একবার খোঁজ নিয়ে দেখতে চায় বদিউল। সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে মাধবী।
-তোফাজ্জল আপনার কী হয়?
-না কিছু না। ওর সাথে আমার কয়ডা কথা আসিলো।
-ওরে সকালে পাইবেন, এইখানেই কাজ করে। বদি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শোনে। মাধবী বাটা খুলে একটা পান সুপারভাইজারের হাতে দিয়ে বেড়িয়ে পরে।
-দিদি চলেন কাইল সকালে আপনারে নিয়া আসুম। নাহ আমি যামু না। তফুরে না নিয়া আমি সূর্যের কাছে ফেরত যামু না বদিমিয়া। রাত বাড়ে। বাজারের দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ হয়ে যায়। রিক্শা স্ট্যান্ডে গোটাকয়েক মানুষ। বদি বুঝতে পারে না। এতোরাতে মাধবীকে কোথায় নিয়ে যাবে সে? সারারাত এখানে কেমন করে থাকবেন মাধবী?
-বদিমিয়া তুমি চইলা যাও, মানুষ তোমারে খারাপ কইবো আমার সাথে এখানে দেখলে, তুমি যাও, বাড়ি যাও।
-না আমি যামু না। সুরুজের অবস্থা দেইখা আমার আর ভাল লাগে না। মাধবী কোনো কথা বলে না। ডাক্তারখানার বারান্দায় বসে পড়ে। বদি চা নিয়ে আসে।
-এতরাতে চা কই পাইলা বদিমিয়া?
-দোকান বন্দের সময়, জোর কইরা দুইটা চা নিয়া আইসি। দিদি, পান কি শেষ?
-না, খাইবা? বদি মাধবীর দিকে তাকায়। আজ ওকে সূর্যনার মতো লাগছে। সবুজ বুটিদার শাদাশাড়ি। আবিরমাখা ঠোঁট। রুদ্রাক্ষের মালা। কে এই মানুষটা, কিসের টানে বসে আছে বদি? সুরুজের জন্যে, নাকি রুদ্রাক্ষের মালার?
-তোমারে একটা কথা জিগাই বদিমিয়া! তুমি কি সূর্যরে ভালবাসো না?
-সুরুজের আমি কেউনা বৈষ্ণবী, সুরুজ আর তফুর কথা আপনেতো সবই জানেন।
-আমার দিকে তাকাও! সে তাকাতে পারেনা। বৈষ্ণবী নীরবতার মানে বোঝে। কলতলায় হাতমুখ ধুয়ে নেয় মাধবী। সারারাত ঠায় জেগেছিলো সে। সকাল হতেই রাইসমিলের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে সে। লোকজন আড়চোখে তাকায়। মাধবী চোখ মেলায় না কারো সাথে! ও কি চিনতে পারবে তোফাজ্জলকে? এতোদিন পরে? সুপারভাইজার সামনে এসে দাঁড়ায়, আপনি আমার সাথে আসেন। মাধবী পেছন ফিরে তাকায়, নাহ বদিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
-দিদি, আপনি এইখানে?
-তোফাজ্জল তুমি কেমন আছো? তোমারে দেখতে আসছি! তুমি এতো রোগা হয়া গেছো কেন? তোমারেতো আমি চিনতেই পারি নাই।
-মাধবীদি আপনিতো অনেকদিন পড়ে এই গেরামে আইসেন, কিছুই জানেননা। সুরুজ আমারে ছাইরা গেছে...।
-কী কথা কও? আমিতো ওর ঘরেই আছিলাম। তুমি আমার সাথে চলো তফু, ওর শরিলটা ভালা না।
-কি কন দিদি, ওতো ওর বাড়ি থাকে না, ওরে জ্বীনে ধরছে, ঐ ইতর বদির সাথে জ্বীন আছে। ও আমার সুরুজরে...
- তুমি আমার সাথে চলো তফু। ও তোমার শোকে পাথর হয়া গেছে। তোফাজ্জলের চোখ গড়িয়ে দুফোটা জল, ও আমার সুরুজ না। জ্বিনে কাবু করসে ওরে। ও আর মানুষ নাই দিদি । আপনি ফিরা যান। সে হাঁটতে শুরু করে উত্তরের দিকে। মাধবী ফিরে আসে। বদি দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়, দিদি তফুরে পাইসেন? ওরে সাথে কইরা আনেন নাই কেন? বদি, ও জ্বিনের কাছে যাইবো না। জ্বিনের বেটি সূর্যনা, ও আর মানুষ নাই। গলার মালাটা বদির হাতে গুজে দেয় মাধবী, ওরে তুমি বিয়া করো বদিমিয়া। সূর্যরে। তোমার সাথে জ্বিন আছে বদিমিয়া। তোমার ডরের কিছু নাই। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বৈষ্ণবী।


No comments:

Post a Comment