নিষিদ্ধ গন্দমের জন্ম
বুড়ো মরা না আধমরা দেখে বোঝার উপায় নেই।
শীতাতপ দুপুরে রাস্তার ধারে এমনভাবে শুয়েছিল যে আকস্মিক কেউ ভুল করতে পারে। নিঃসাড়
নিস্পন্দ। তার চোখে-মুখে কয়েকটি মাছি বিকারগ্রস্তের মতো আছড়ে পড়ছে। হলুদ পিঁচুটি জমে
গেছে দু-চোখের কোণায়। বীভৎস। বুড়ো শুয়েছিল। বলা যায় শুইয়ে রাখা হয়েছিল। পিচকালো রাস্তার
ফুটপাতে। পুবদিকে মাথা। পা-দুটো পশ্চিমে। সটান...একেবারে লাশ। শুয়েছিল চিৎ হয়ে। মুখ
আকাশের সঙ্গে সমান-রাল এবং খোলা। বুড়ো তার মুখের বড় হাঁ’তে আকাশ গিলে খাবে। আধবোজা
চোখ। ঘন কাঁচাপাকা ভুরু। সাদা-কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত। পরিষ্কার অযোগ্য ছিন্ন পাঞ্জাবি
বুকের উপর উঠে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে পেট। চুপসে পড়া বেলুনের মতো সেঁধিয়ে গেছে ভেতরে।
একেবারে মেরুদণ্ডের কাছে। অথবা পাকস্থলী নিজেই উঠে গেছে গলায়। কেন? ক্ষুধা? কিসের?
পেটের উপর এক টাকার কয়েকটি নোট আর কিছু খুচরো পয়সা। বুড়োর সামনে
এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। ঢ্যাঙ্গা মতো কালো লম্বা। বয়স ত্রিশ-বত্রিশের কাছাকাছি। ভাবলেশহীন
হলুদ দু-চোখে অব্যক্ত বর্ণিল চাহনি। সেখানে কখনো ধূর্ততা কখনো অসম্ভব ব্যথা লুকোচুরি
খেলছে। সে ছোট-ছোট গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠোঁট চেপে হাত নেড়ে নেড়ে হাঁক দেয়। সে ডাকে
বিউগলের করুণ সুর বেজে ওঠে। সেখানে চিৎকার আর অনুনয় মিলেমিশে একাকার। তার ঠোঁটের দু-কোণায়
মাছির মলের মত কশ জমে গেছে। ধূসর সাদা হলুদ। সে কখনো হাঁক থামিয়ে সামনে একদলা থুতু
ফেলে। তারপর ঠোঁট ডান হাতের উলটো পিঠে মুছে নেয়।
‘ভাইজান...ও আফা, বুইড়া লোকটার অসুখ। কিছু সাহায্য করেন। চিকিস্যা
করামু। ভাইজান পরকালের কাম করেন। ও ভাই...আফা...আফা।’
এক পিনে আশি রেকর্ড বাজায় শক্ত সামর্থ কালো লম্বু। বাজাতে থাকে।
অদ্ভুত বিবর্ণ আর বিরক্তিকর হয়ে ওঠে মধ্যদুপুর।
তমাল ফাস্টফুড দোকানের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তার সামনে
মুন্নি। একটু আগে পেটিস্ খেয়েছে। এখন স্ট্র দিয়ে চুমুক দিচ্ছে সবুজ বোতলের ভেতর। হাল্কা
শিশির জমে আছে ঠাণ্ডা বোতলের গায়ে। সামনের সিনেমা হলে প্রচণ্ড ভিড়। সে কখনো বিশাল ব্যানারে
তাকায় কখনো মুন্নির দু-চোখে। কোনো গভীরতা খোঁজে কিনা কে জানে! সহসা মুন্নি চোখ নামিয়ে
নেয়। তার অদ্ভুত শিহরণ অনুভূতি হয়। মনে হয় তমাল তাকে ন্যাংটো করে ফেলছে। সে তার দিকে
চোখ রাখে। তমাল এবার ব্যানার দেখছে।
বিরাট ঝলমলে জমকালো পোস্টার। নায়িকার কাপড়ের বড় টানাটানি। সব
ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মুন্নি লজ্জা পাচ্ছিল। হয়তো অহেতুক, যে এই ছবি এঁকেছে তার
রুচির কথা ভেবে নাকি যারা দেখে তাদের কথা চিন্তা করে? আসলে ছবি আঁকার বিষয় নয়। যারা
দেখছে...গিলছে তাদের জন্য। তমালের জন্য। সকালে ওর কাছে কিছু টাকা চেয়েছে। ফরম ফিলআপ
করতে হবে। নিজের কাছে তেমন টাকা নেই। যা আছে
কিছু হবে না। তমাল সময়ে অসময়ে টাকা দেয়। এবারও দেবে বলেছে। তাই দুপুরে আসা। ভালো ছেলে।
বাধ্যগত। ভবিষ্যতে সঙ্গী হিসেবে আদর্শ। ঠিক যেমনটি চাই। তার মনের ভাবনার পালে পদ্মার
বাতাস এসে ঢেউ তুলতে শুরু করে। সেইসঙ্গে চাপা উল্লাস।
‘ও ভাই...আফা এই বুইড়ার আলসার। কিছু সাহায্য করেন...চিকিস্যা
করামু। আফ্নের একটাকা আখেরাতে সাত শ গুন হইব। দশ লাখ হইব।’
‘আমারে থুইয়া আইসেন ভাই। চিকিস্যা করাই কী হইব? বাড়ি যামু।
আল্লা আমারে বাঁচা...এই শুয়ারগুলানের হাত থেইকা বাঁচা।’
‘ওই বুইড়া চুপ! পারা দিয়া ওইহানে পাঠামু! হালা কতা কয়...!’
বুড়ো চুপ করে হাঁপায়। চুপসে যাওয়া পাঁজরের বেলুন ফুলে ফুলে
ওঠে আবার চুপসে চুপসে যায়।
তমাল একটি নীল নোট দোকানির দিকে এগিয়ে ধরে। বড় করে শ্বাস বাতাসে
ছেড়ে দেয়। পেটিস আর সেভেনআপ পেটের কোণায় পড়ে আছে। একটু পর বিমিশ্র ঢেঁকুর উঠতে শুরু
করবে। তার মধ্যে অতৃপ্তির ধূম্রজাল তৈরি হতে শুরু করে। বেঁচে থাকা আর উদ্দেশ্যের জন্য
কতকিছু না করতে হয়! সে মুন্নির দিকে ভাবলেশহীন অথবা দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকাল। প্যান্টের
বাঁ-পকেট থেকে অফহোয়াইট রঙের রুমাল বের করে মুন্নিকে দেয়। রুমালের এককোণায় গোলাপ কুঁড়ির
নকশা আছে। লাল আর গোলাপি সুতোয় তোলা। নিচে ইংরেজি আদ্যাক্ষর এম। এম মানে মুন্নি। দিন
পনেরো আগে পেয়েছে। আজ তার কাজে লাগল। মুন্নি রুমালে আলতো করে ঠোঁট মুছে ফেরত দেয়। তমালের
হাতে। তমাল দোকানির কাছে থেকে ফেরত টাকা নিয়ে পকেটে রাখে। এরপর রুমাল নিয়ে লিপস্টিকের
গোলাপি দাগ ভাঁজের ভেতর লুকোয়।
ফাস্টফুডের দোকান থেকে রাস্তায় নামল দু-জন। ছবি আরম্ভ হতে আরও
পাঁচ মিনিট বাকি। বাইরে শেষ অগ্রহায়ণের রোদ। মিঠেল শীত-শীত তাপ-তাপ। সামনে ট্রাফিক
আইল্যান্ড। ডিউটির লোক নেই। ওটার গোড়ায় গাট্টাগোট্টা এক কুকুর কুঁজো হয়ে প্রাকৃতিক
কাজ সারছে। কনস্টিপেশন। তমাল কিছুক্ষণ নিজের কথা ভাবল। সে বুদ্ধিজীবী হতে শুরু করেছে।
তাকেও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। লাভ তেমন হয় না। তবে সমসাময়িক চিন্তার সুযোগ পাওয়া যায়।
ওই একটি ছোটঘর সমস্ত পৃথিবীকে ধরে রাখে। সে বেশ গাঢ় দৃষ্টিতে মুন্নির দিকে চোখ ফেরাল।
মুন্নি এরমধ্যে কখন ঠোঁট রাঙিয়েছে? সে খেয়াল করেনি।
‘কত লাগবে তোমার? লাস্ট ডেট কবে?’
‘সামনের তেইশ। সাত শ আছে। আমাকে দুই হাজার দাও। বাসা থেকে এলে
দেব।’
‘আ রে দুর! ফেরত দেয়ার কথা ভাবছ কেন? আমি কি তোমার কাজে আসতে
পারি না?’
‘না না সে কথা নয়। প্লিজ অন্যভাবে নিয়ো না।’
‘ছবি শেষে কী করবে? হলে ফিরবে? চলো আজ একটু ঘুরি...তারপর একসাথে
ডিনার করব। ম্যান্ডোলিন-এ চমৎকার কাচ্চি-বিরিয়ানি করে।’
‘সে তো অনেক কস্টলি। টাকা বেশি হয়েছে না?’
‘আ রে দুর! তুমি তো এখন থেকেই শাসন শুরু করেছ। হা হা হা!’
‘সে তো করতে হবেই...নাকি?’
‘আজ আমরা একসাথে কিছু সময় কাটাতে চাই। বুঝতে পারছো কি বলছি!
ম্যান্ডোলিন-এ চমৎকার প্রাইভেসি আছে।’
‘চলো ছবি শুরু হলো বোধহয়।’
‘ও হ্যাঁ।’
বুড়োর চোখ আধখোলা। সচল ঠোঁট। ঠোঁটের দু-কোণের কশ ফেটে চৌচির
ছড়িয়ে পড়ে। তার মাঝখান দিয়ে সরু ফ্যাকাসে জিহ্বা বের হয়। একটু থেকে জোরে নড়ে-চড়ে।
‘চুপব ক্যা...ক্যা চুপব? আমারে গেরাম থেইক্যা আনলি। চিকিস্যা
করাবি। আর এখন ব্যবসা ফাঁদছোস। বান্দিরপুত। জারুয়া।’
‘হালায় খাইছে রে! বুইড়ার রক্ত গরম হইছে রে! বানচোৎ। ডেইলি পঞ্চাশ
ট্যাহা লও না?’
‘আরও বিশ ট্যাহা ধইরা দিবি।’
‘মাগনা...মাগনা?’
‘কিই-ই!’
‘আচ্ছা দিমুনে...দিমুনে।’
বুড়োর পিঁচুটি পড়া চোখে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। মুখ হাঁ করে জিহ্বায়
বাতাস টেনে ধরতে চায়। হাপরের মতো পাঁজর ওঠানামা করে। কিছুক্ষণ। কথা বলতে ক্লান্ত হয়ে
গেছে। লম্বু তর্জনী দিয়ে বারকয়েক নাকের ময়লা বের করার চেষ্টা করে।
‘ভাইসাব বুইড়া খুব দুঃখী মানুষ। সাহায্য করেন। পরকালের ছোয়াব
কামান। বুইড়ার চিকিস্যার জন্য একটা টাকা দেন।’
ডার্ক লাইট। আলোছায়া অন্ধকার। তমাল আর মুন্নি দু-জনে এখানে-
বসেছে। তাকিয়ে আছে সামনের স্নোহোয়াইট পর্দায়। স্লাইড শো শুরু হলো। ধুমপান নিষেধ। নিষিদ্ধ।
ইট ইজ ইনজুরিস টু ইয়োর হেল্থ। কিছুক্ষণ আজগুবি সব স্লাইড দেখাল। তার কোনোটিই তেমনভাবে
দেখল না। ছবি আরম্ভ হয়েছে। এ প্লাস রেটেড আর্টফিল্ম। জমবে ভালো। তমাল বাঁ-হাত বেশ ধীরে
মুন্নির কাঁধের পেছনে নিয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে আড়ষ্ট মুন্নি একটু কাছে এগিয়ে এলো। আদুরে
ভঙ্গি। পোষা বেড়ালের মতো দুর্বোধ্য মৃদু কুঁই কুঁই শব্দ উঠল? তমাল পাত্তা দিল না। মুন্নির
শ্যাম্পু করা চুলের সৌরভ তাকে মিষ্টি বন্য করে তুলেছে। সে আরও আলগোছে ওর ডানহাতে কয়েকটি
নোট গুঁজে দিল ।
‘আমার খারাপ লাগছে জানো। তোমার কাছে আবার টাকা নিতে হচ্ছে।
এবার একসাথে ফেরত দেব। প্রমিজ।’
‘আবার? তুমি আসলে আমাকে কী ভাবো বলো তো?’
তমাল ওর কাঁধে একটু চাপ দিল। চোখের মণি ঘুরিয়ে তাকাল অপাঙ্গে।
সবকিছু আবছা। মনে হয় রাত। রাতের মতো অন্ধকার। রহস্যময়। সেও রহস্যময় এক মানুষ। মুন্নি?
কে জানে? সবাই তো রহস্যময়। সে গভীর স্বরে বলে উঠল, -
‘আমার কথা মনে আছে তো? আজ আমরা একসাথে ডিনার করব। তার আগে একটু
ঘুরব। কিছু কেনাকাটা করবে?’
‘কি?’
‘এই ধরো কসমেটিক্স ইমিটেশন কিংবা ভালো কাজ করা...।’
‘উঁহু! এমনিতেই অনেক খরচ হলো তোমার।’
‘হোক খরচ আরও খরচ করব।’
তমাল বুকের বাঁ-ধার ঘেষে মুন্নিকে আরও ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছে। সামনে
পর্দায় একপলক তাকিয়ে দেখল। ছবি চলছে। নায়িকা হাতে দোতারা নিয়ে সুর তুলেছে। আবেশে আধবোজা
চোখ। টপনট খোঁপা। ব্লাউজ নেই। গেরুয়া রঙের শাড়ির উপরে বুক উদ্ভাসিত। দুলছে। মুন্নি
অন্যমনস্ক। তমাল কপালের মৃদু ঘাম রুমালে মুছে ফেলল। তারপর ঠোঁট। অসম্ভব গন্ধ। দুর্গন্ধ।
মানুষের মুখে এত দুর্গন্ধ হয়! তখন পশ্চিমের দরজা সামান্য খুলে যায়। কোনো দর্শক হয়তো
ভেতরে ঢুকছে। সেই মুহূর্তে রাস্তার চিৎকার ভেসে এলো।
‘ও ভাই...আফা...গো...এই বুইড়াকে বাঁচান। বুইড়ার...।’
শব্দ আর আসতে পারল না। পর্দায় আলো ঝলমল দৃশ্য। নৃত্যগীত চলছে।
কিশোরী সাজে আধবুড়ি নায়িকা ধুমধাম নাচছে। তমাল দুলুনির দিকে হাঁ তাকিয়ে রইল। তার চোখ
সরু হয়ে গেছে। অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই। সব দূরে সরে গেছে। মুন্নির চোখ-মুখ পর্দার
প্রতিফলিত আলোয় ধূসর। একটু ভাবনা...আনমনা...রহস্যময়।
তখন হলুদ এক প্রজাপতি বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরোবার পথ খুঁজে
চলেছে।
No comments:
Post a Comment