একচিলতে সুখ ও একসমুদ্র নোনাজল
মতি মিয়া‘র মাথায়
আজ খুন চেপে গেছে। চেলা কাঠ আজ বউয়ের পিঠে ভেঙ্গেছে। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে এসে
উল্টা পাল্টা কথা শুনলে কি মেজাজ ঠিক থাকে? বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ক্যান যে বিয়া করছিলাম! গত শীতে আলেয়া‘কে ঘরে তুলেছিল
মতি। বেশ কিছু পয়সা জমিয়েছিল দুবছর রিক্সা চালিয়ে। বিয়েতে খরচ করতে একটুও কার্পন্য
করেনি, আলেয়াকে চুলের ফিতা থেকে শুরু করে স্বর্ণের একজোড়া কানের দুলও
দিয়েছিল। পাশের বাড়ির নজীর আলী‘র মেয়ে আলেয়া। ছোট বেলা থেকে তাকে দেখছে কিন্তু কিভাবে জানি
তাকে হঠাৎ মনে ধরে গেলো! আলেয়া‘র চাচার একটা
ধানি জমি ছিল মতিদের ঘরের পেছেন। আলেয়া প্রতিদিন মোরগ–হাঁস পাহারা দিত
যাতে ধানের জমিতে ওরা কোন অনিষ্ট করতে না পারে। কিযে সুন্দর লাগত তখন তাকে! চুলগুলো হাঁটু পার গেছে—গায়ের রং ও বেশ।
বাবা নজীর আলী বছর পাঁচেক আগে মারা গেছে আর মা ও আরেকটা বিয়ে করেছে। তখন থেকেই
আলেয়া চাচা‘র সংসারে মানুষ। আলেয়া‘র বয়স মাত্র
সতের হল গত মাসে।
মতি
মিয়া‘র মনের কোনে ধীরে ধীরে আলেয়া বসত গড়ছিল। কিন্তু কোনদিন আলেয়াকে বলার
সাহস পায়নি আর বলবেইবা কিভাবে কারন মতি মিয়া‘র সংসারে দশ জন
লোকের ভরন পোষনের দায় তার মাথার উপর। মতি‘র বাবা আমজাদ
মিয়া দুটো বিয়ে করেছেন, দুসংসারে মোট সাতজন ভাইবোন। মতিই সবার বড়। বয়স বিশের কোঠা ছুঁই ছুঁই
করছে। সারাদিন ঘরে দুই মায়ে‘র মোরগ যুদ্ধ লেগেই থাকে। প্যারালাইসিস বাবা বসে বসে মনের
সুখে সে যুদ্ধ দেখে দিন পার করে কারন তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়। মনে হয় যেদিন
যুদ্ধ না বাঁধে সেদিনই মতি মিয়ার মেজাজ বিগড়ে যায়। রিক্সা চালিয়ে মতি তার তিনটি
বোনকে বিয়ে দিয়েছে। তিনটি বোনের জামাইকেই তিনটি রিক্সা যৌতুক দেয়া লেগেছিল। কিন্তু
বোন তিনজন যে সুখে আছে তা বলা যাবেনা কারন বছরের ন‘মাসই যাদের
বাপের বাড়িতে কাটে।
আলেয়াকে
নিয়ে সে রাশি রাশি স্বপ্নের জাল বুনে আবার সে জাল নিজেই সজ্ঞানে ছিড়ে ফেলে কারন কি
লাভ এমন স্বপ্ন দেখে! কখনো কখনো ভেবেছিল আলেয়া‘র চাচাকে বিয়ের প্রস্তাবটা না হয় দিয়েই দেবে কিন্তু নিজের
সংসারের অবস্থা দেখে আর সাহসে কুলায়নি। চারদিকে থেকে কথা ভেসে আসছে মতি‘র কাছে -“আলেয়া‘র বিয়ে ঠিক
হয়েছে।” মতি‘র বুকের ভেতরটা
কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠল! চিনচিনে ব্যথা নিয়ে রিক্সা‘র গলা ধরেই
আনমনে কাঁদে। যাক তবুও আলেয়া‘র ভাল ঘরে বিয়ে হোক, ভাল থাকুক তাতেই সে খুশি। আলেয়ার বর দুবাই
থাকে। ছুটিতে আসছে বিয়ে করতে তিন মাস থেকেই চলে যাবে আবার।
আলেয়ার
চাচা ছোট–খাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে তাতে মতিকেও থাকতে বলেছিল। মতি
কাজের বাহানা দেখিয়ে সরে এসেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের কালিমা পড়ানো হবে। খাবার–দাবার পর্ব শেষ।
দেখতে দেখতে বিয়ের পর্বও শেষ। আলেয়া‘র চাচা জামাইকে
সম্মান করার জন্য একটা ঘড়ি নিয়ে বরের হাতে পড়িয়ে দিল সাথে নিয়ে এল একটা সাইকেল। কি
জানি কি হল বর মহাক্ষ্যাপা। হাত থেকে ঘড়িটা ছুড়ে ফেলে দিল—এবং বলল,
“আমি কি রিক্সাওয়ালা
যে আমাকে ঘড়ি সম্মান করে!সাইকেল সম্মান করে! আমি ভেবেছিলাম মটর সাইকেল সম্মান করবে –আমার নিজের একটা
ইজ্জত আছে আর আমি মানুষের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবো!”
আলেয়া‘র চাচা রমিজ আলী খুব
আঘাত পেলেন বরের ব্যবহারে, তিনি কারো সাথে কোন আলোচনা না করেই ঘোষনা দিলেন যে এই মূহুর্তেই আলেয়া‘র সাথে বরের
ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা করা হোক। আর সে ডিভোর্সনামায় সই না করে বর এখান থেকে একপাও
নড়তে পারবেনা। ছেলে পক্ষ ওনাকে বুঝাতে চাইলেন , আলেয়া‘র আত্মীয়
স্বজনরা বুঝাতে চাইলেন কিন্তু ওনি কারো কথাই শুনবেননা। রমিজ আলী‘র একটাই
কথা যে ছেলে বিয়ের আসরেই শ্বশুড়ের দেয়া উপহারের এমন অসম্মান করতে পারে, মটর সাইকেলের স্বপ্ন দেখে তার সংসারে গেলে আমার
ভাস্তি কখনো ভাল থাকবেনা। বেয়াদব ছেলে সারাজীবনই ওর সাথে বেয়াদবি করবে। সবাই বলল, আলেয়াকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখলে হয়না? রমিজআলী আলেয়াকে
বিস্তারিত সব বললেন এবং আলেয়ার মত জানতে চাইলেন। আলেয়া বলল, আমার চাচকে যে ভরা বিয়ের মজলিসে অসম্মান করে তার
সংসারে আমি যাইতে চাইনা।
কিন্তু
ছেলে এখন তার বউ ছাড়বেনা। রমিজ আলীও অনড়। শেষ পর্যন্ত রমিজ মিয়ারই জয় হলো। কিন্তু
আলেয়ার মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেল। বাতাসের বেগে এখবর গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে
গেলো। আলেয়া খুব কাঁদছে সাথে তার চাচা রমিজ আলীও।
রমিজ আলী‘র বউ সালেহা বেগম গলা ছেড়ে গালিগালাজ করছেন
আলেয়াকে আর রমিজ আলীকে। অনেকে তাকে চুপ থাকতে বলছে,কিন্তু সে গলা হাঁকিয়ে বলছে–“ক্যান চুপ থাকুম? পরের মাইয়া নিজের ঘরে পালতাছি, বড় করছি, পয়সা খরচ কইরা বিয়া দিলাম কিন্তু ওরা চাচা
ভাতিজির কোন আক্কেলই নাই। এই বাজারে বিয়ার পাত্র খুঁইজা পাওয়া কত কঠিন আর এখন এই
মাইয়ার তালাক হইছে , কে ওরে বিয়া করবো? নবাবজাদী‘রে এখন ঘরে বসাইয়া বসাইয়া খাওয়াও আর কি করবা!” রমিজ মিয়া জানে সালেহাকে কিছু বলার মানেই হয়না।
আজ এত্তগুলান বছর এই সালেহাকে সে কিছুই বুঝাতে পারেনা কারন সালেহা কখনো কিছু বুঝতে
চায়না। আলেয়া নিয়ে প্রতিনিয়ত সংসারে অশান্তি হয়েছে কিন্তু রমিজ ভাবে এই এতিম
মেয়েটাকে কিভাবে অস্বীকার করবে! রমিজ পারেনা কখনোই পারেনা। নিজের সন্তানের চেয়ে
বেশি স্নেহ দিয়ে আলেয়াকে মানুষ করেছে সে।
রমিজ আলী‘র তিনটা ছেলে , কোন মেয়ে নাই। কিন্তু সালেহা‘র মনে এই নিয়ে কোন ক্ষোভ নাই। সে বলে মেয়ে নাই
ভালই হয়েছে। মেয়ে মানেই আপদ, মেয়ে মানেই যন্ত্রণা! রমিজ মুখ টিপে হাসে আর ভাবে তুমি নিজেই একটা
মাইয়া কিন্তু নিজের মাইয়া নাই বইলা নিজেরে বেশ ভাগ্যবান মনে করছো? কিন্তু সালেহার সাথে রমিজ কখনো লাগতে যায়না।
জমিজমা আছে বেশ এগুলো দিয়েই রমিজ আলী‘র বেশ চলে যায়। কিন্তু আজ সালেহার কথাগুলো শুনে
রমিজের রক্তে আগুন ধরে যাচ্ছে—মনে মনে ভাবছে আজ এই বিয়ের আসরে আরেকটা তালাকের ঘটনা যদি
ঘটে সেইটার জন্য সালেহা কোনদিন তাকে দোষ দিতে পারবেনা। প্রতিটা মানুষের একটা
সহ্যের সীমা থাকে কিন্তু সে সীমা অতিক্রম হইলে মানুষ আর তার নিজের মইধ্যে থাকেনা।
মতি ঝড়ের বেগে ছুটে এল
আলেয়া‘র খবর শুনে। এসে রমিজের
কাছে গেল, জিজ্ঞাসা
করল, চাচা এসব
কি শুনছি? রমিজ বলল হ–ঠিকই শুনছস। তুই ‘ক‘ এমন পোলার কাছে আমার আলেয়া কি ভাল থাকব? নাকি ভাল থাকতে পারব? যা হইসে এটা নিয়া আমার কুনু আক্ষেপ নাই।
আলেয়ারে আমি আবার ভাল ছেলে দেইখ্যা বিয়া দিমু। কিন্তু আলেয়া‘র জন্য কষ্ট হইতাছে আসলে মাইয়াডার কপালডা এমন
ক্যান? চুডু বেলায়
বাপ মরলো, মা আবার
ওরে ফালাইয়া অন্য জায়গায় বিয়া করল আজও মাইয়াডার কোন খোঁজ নিলনা। আর আজকে বিয়া হইয়া
বিয়ার আসরেই বিয়া ভাঙ্গল! মতি বলল, সবই আল্লার ইচ্ছা চাচা। আপনি চিন্তা কইরেননা সব
ঠিক হইয়া যাইব।
মতি মনে মনে যেটা ভাবছিল
ভাবল সেটা বলেই দিবে কিন্তু কেন যে সাহস করতে পারছিলনা! এমন সময় রমিজ বলল, আর কিছু কইবি? বাড়ি যা অনেক রাত হইসে। মতি বলল, “চাচা আমি কিছু ভাবছিলাম কিন্তু আপনি অভয় দিলে
বলতাম!” রমিজ বলল, ভয় পাইবার কি আছে —বল। মতি সাহস করে বলেই ফেলল, আমি আলেয়ারে বিয়া করতে চাই। রমিজ অবাক হয়ে চেয়ে
রইল মতি‘র দিকে। এমন কথা মতি দুদিন
আগে বললেও রমিজ মতির গাল কষে দুটো চড় দিত কিন্তু আজ চড় দিতে ইচ্ছা করছেনা আজ মতিকে
জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। এমন অবস্থায় যে ছেলে এই মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায় সে সাধারণ
মানুষ হতে পারেনা।
কেন জানি রমিজ আজ বেশ মানুষের মনুষ্যস্বত্বা ও
পশুস্বত্বা দুটোকেই চিনতে পারছে। বিয়ের পাত্র হিসেবে মতি‘র হয়ত কোন যোগ্যতা নেই কিন্তু মানুষ হিসেবে তার
ভিতর আছে মানবিকস্বত্বা। আর যার সাথে আলেয়া‘র বিয়ে হয়েছিল তার পাত্র হিসেবে বেশ যোগ্যতা
ছিল কিন্তু তার ভিতর বসত করছিল একটা পশুস্বত্বা। তার মানে মতি‘র চেয়ে ভাল ছেলে আলেয়া‘র জন্য মিলবেনা —এমনটাই ভাবছিল রমিজ। এমন সময় সালেহা‘র গলার শব্দে রমিজের ভাবনার ঘুম ভাঙ্গল। সালেহা
বলল, “এত ভাবাভাবির কি আছে —এখনই বিয়ে পড়াইয়া দাও। আলেয়ার সাতজনমের কপাল যে
মতি ওরে বিয়া করতে চাইছে।এই বিয়ায় যদি তুমি অমত কর তাইলে আমি গলায় দড়ি দিব কইলাম
কিন্তু!” রমিজ
নিজেরে ঠিক রাখতে পারলনা সালেহা‘র উত্তেজিত কথায়। রমিজের হাতের কাছেই একটা ইটের অর্ধেকটা
পড়েছিল—সেটাই সে ছুঁড়ে মারল সালেহা‘র দিকে। সালেহা‘র মাথায় গিয়ে সেটা পড়ল। মূহুর্তের মধ্যেই সব
কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেল।
সালেহাকে সবাই মিলে
হাসপাতালে রওনা হল।কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণে রাস্তার অর্ধেক যেতেই সালেহা মারা
গেল। থানা থেকে পুলিশ আসল, রমিজ আলী বিনাবাক্য ব্যয়ে পুলিশের কাছে নিজের
ভাগ্যটাকে সপে দিল। যাবার সময় শুধু এতটুকু বলল, “আমার আলেয়া‘র খেয়াল রাখিস, তারে বিয়া করিস।” মতি অপ্রত্যাশিত এসব ঘটনায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, রমিজের কথায় তার বোধশক্তি মনে হয় নড়ে উঠল। সে
বলল, চাচা আপনি
আলেয়ারে নিয়া ভাইবেননা, আমি তার খেয়াল রাখব।”
আলেয়াকে খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছেনা কোথাও, বাড়ির আত্মীয় স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী সবাই খুঁজছে কিন্তু কোথাও নাই। রাত
প্রায় শেষ –ভোরের মোরগ ডাক শুরু হয়েছে।টিনের ঘরের চালে
শীতের কুয়াশা পড়ার শব্দ শুনা যাচ্ছে। মতি রমিজের ঘরের দাওয়ায় ঝিম মেরে বসে আছে। কি
করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সালেহার লাশের পোষ্টমর্টেম বাকি আছে। রমিজের ছেলে তিনজন
মায়ের লাশের সৎকারের বন্দোবস্ত করছে।
সালেহার বাপের বাড়ির লোকজন বিলাপ করে সালেহা‘র জন্য কাঁদছে আর রমিজ আলী ও আলেয়াকে গালভরে
অভিশাপ দিচ্ছে। বিশেষ করে আলেয়াকেই দায়ী করছে সকলে– অপয়া, অলক্ষী হাজারো নামকরণে ভূষিত হচ্ছে আলেয়া।
কিন্তু সে আলেয়া এসবের কোন কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা।
মতি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল– এভাবে বসে থাকলে আলেয়া‘র সন্ধান সম্ভব নয়, অনেকেই খুঁজছে কেউই বলতে পারছেনা। নিজের ঘরে
গিয়ে দরজাটা ফাঁক করে ঘরে ঢুকল মতি, ঢুকেই সে অবাক দেখে আলেয়া জড়োসড়ো হয়ে তার
বিছানার এককোনে বসে আছে। মতি বলল, “তুমি এইখানে আর সারাদুনিয়ার মানুষ তোমারে
খুঁজতাছে! আলেয়া বলল, “আমি জানি কিন্তু তুমি আমারে বাঁচাও মতিভাই। ওই
বাড়িতে আমি এতক্ষণ থাকলে আমারে সবাই মিলা মাইরা ফালাইব। সবাই আমারে দোষী করব।”
মতি বলল, “ তোমার কুনু ভয় নাই, আমি আছিনা। আমি চাচারে কইছি তোমার দায়িত্ব নিমু, তুমি চিন্তা কইরোনা। সবকিছু একটু ঠাণ্ডা হোক ,ভাল দিনক্ষণ দেইখ্যা তোমারে আমি ঘরে তুলুম। এখন
চল তোমারে বাড়ি দিয়া আসি, সবাই তোমারে খুঁজতাছে। কেউ তোমারে কিছু করবোনা, আমি সবাইরে বুঝাইয়া কমু।
আলেয়া মতিকে জড়াইয়া ধরে হু–হু করে কেঁদে বলে, মতি ভাই তুমি এত ভালা ক্যান? মতি বলে ভালা মন্দ জানিনা তবে বুঝ হইবার পর
তোমারে নিয়াই স্বপ্ন দেখছি কিন্তু বলতে পারি নাই আর বলবইবা ক্যামনে! নিজের পেটই চলেনা আর বউ আনব কোন সাহসে?তাই ভাবছি তোমার ভাল একটা বিয়া হোক, সুখে থাকবা। কিন্তু দেখনা কি থেকে কি হইল! আমি কিন্তু তোমারে এইভাবে পাইতে চাই নাই আলেয়া! রমিজ চাচার জন্য খুব কষ্ট লাগতাছে, ওনার সংসারটা তছনছ হইয়া গেল! চল তোমারে দিয়া আসি।” মতি আলেয়াকে নিয়ে তার চাচার বাড়িতে দিয়ে আসল এবং সবাইকে বুঝিয়ে বলল যে
এখানে আলেয়ার কি দোষ ছিল এবং এতে আলেয়ারই ক্ষতিটা বেশী হল। কেউ যেন আলেয়াকে
গালমন্দ না করে এবং গায়ে হাত না তুলে। লাশ নিয়ে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল— এশা‘র নামাজের পর লাশ দাফন করা হল। আলেয়া চাচী‘র জন্য অনেক কাঁদছে, বার বার চাচী‘র কাছে মাফ চাইছে। নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায়
দাঁড়িয়ে বিলাপ করে কাঁদছে। মতি তাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। এভাবে দেখতে দেখতে দুমাস
পার হয়ে গেল, আস্তে
আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এল।
এরই মধ্যে মতি তার
পরিবারকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাল কিন্তু কেউই মত দিলনা। বলল, এই মাইয়া সংসারে আইলে সংসার তছনছ হইয়া যাইব।
মতি কাউকে রাজী করাতে না পেরে নিজেই কাজী ডেকে মাঘ মাসের চার তারিখ আলেয়াকে বিয়ে
করে বাড়ি নিয়ে এল। পরিবারের সকলেরই মুখটা কালো হয়ে গেল কিন্তু মতি‘র আয়ে সংসার চলে বলে কেউ আর কিছু বললনা কিন্তু
প্যারালাইসিস বাপের মুখ থামানো গেলনা। ঘরের দাওয়ায় শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণই বলছে, “সব শেষ হইয়া যাইব—এমুন অলুক্ষুণে মাইয়ারে ঘরে আনছে! ছারখার হইয়া যাইব সব ছারখার হইয়া যাইব!”
মতি আলেয়াকে বলে, “তুমি এগুলান কানে তুইলনা।বাবা এমুনই, অসুস্থ মানুষ কি বলে কি না! আর অন্যেরা কিছু বললেও তুমি জবাব দিওনা। আমি
তোমারে খুব ভালবাসি, আমি তোমারে সুখে রাখতে চেষ্টা করব। আলেয়া
সংকুচিত হয়ে বলে ,আমি কিছু মনে করবনা তুমি চিন্তা কইরোনা দুজনার
নিঃশ্বাষ আস্তে আস্তে গাঢ় হয়ে আসে-আবেগে গলে যায় দু‘জনার শরীর, কুপিটা নিভিয়ে দেয় মতি। ভালবাসাটা তাদের এভাবেই
শুরু হয়। মতি‘র কাজে
যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়ে, সারাক্ষণ আলেয়ার আশেপাশে থাকতেই তার ভাল লাগছে।
আলেয়ারও একই অবস্থা—এরই নামই বুঝি প্রেম দুজনই দুজনকে জিজ্ঞাসা করছে। একটু পর
পর দরজায় টোকা দিয়ে যাছে মা রমিজকে কাজে যাওয়ার জন্য আর আলেয়াকে ও বলছে রান্নাঘর
সামলাবার জন্য। কিন্তু তাদের কোন সাড়া না পেয়ে মায়ের গলা বেড়ে যাচ্ছে দেখে মতি উঠে
পড়ল, আলেয়াকে
উঠতে বলল।
এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিন।
অভাবের মাঝেও সুখ ছিল বেশ। পরিবারটাকে আপন করে নিতে আলেয়া‘র চেষ্টার কমতি ছিলনা কিন্তু এত কি সহজ! এতগুলো মানুষের সংসার, অভাব লেগেই থাকে, মতির ছোট তিনটা ভাইকেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছে চা
দোকানে আর হোটেলে। কিন্তু তারপরও কুলায়না। প্যারালাইসিস বাবা এখনো অভিশাপ দেয়—দুই মায়ের ঝগড়া অনবরত চলছেই। এখন ইস্যু আবার আলেয়ার অতীত! সারাক্ষণই কথা শুনতে হয় কিন্তু আর কত!
আলেয়া মা হতে যাচ্ছে
কিন্তু মতি‘র মুখটা কালো হয়ে গেল। সে
চায়না এমন অভাবের সংসারে আর একজন সদস্য বাড়ুক। সদস্য না বাড়িয়ে কি ভালবাসা নিয়ে
বেঁচে থাকা যায়না? নিজের মনকেই প্রশ্ন করে বারে বারে। আলেয়াকে অবশেষে মনের কথা
বলেই ফেলে ,শোন একটা কাজ করলে কেমন হয় ? আমরা আমাদের বাচ্চাটারে ডাক্তারের কাছে গিয়া
নষ্ট কইরা ফালাই! আলেয়া‘র চোখ মুখ দিয়ে আগুন বের হয়–সে কোন কথা বলেনা সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে
পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। মতিও পেছন পেছন আসে,বুঝাতে চেষ্টা করে। আলেয়া একটি কথাও বলেনা, কেন জানি সে মতিকে একমূহুর্তের জন্যও সহ্য করতে
পারছেনা। দিন দিন মতি‘র কাছ থেকে আলেয়া নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। সে চোখের ভাষায়
মতিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে অনাগত সন্তান নিয়ে মতির নির্মম চিন্তাকে সে কোন ভাবেই
সমর্থন করবেনা।
আজকাল মতি‘র মেজাজ বেশ বিগড়ে থাকে সাথে আলেয়ারও। আলেয়াকে
নিয়ে কে জানি কি বলেছে আবার সেটা নিয়ে আজ আলেয়া বেশ ঝগড়া করেছে। শ্বাশুড়ি ও
প্যারালাইসিস শ্বশুরকে সে আজ বেশ করে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছে। মতি বাড়ি এসে দেখে
বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড, কাউকেই থামানো যাচ্ছেনা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে
হাতের কাছে একটা চেলা কাঠ পেয়ে সেটা দিয়ে বেশ করে পিটিয়েছে আলেয়াকে। আলেয়ার উপর
এমনিতেই কিছুদিন ধরে রেগে আছে মতি তার উপর বাড়িতে এসে এমন অবস্থা কে সহ্য করতে পারে! মতি ভাবছে আসলে কাজটা করা ঠিক হয়নি! অন্য সবার রাগ, অভাব, কষ্ট সব আলেয়ার উপর ঝেড়েছে। যাক রাতে বউকে
বুঝিয়ে বলে দিলেই হবে, দরকার হলে মাফ চাইবো। মতির কেন জানি আলেয়া‘র উপর ভালবাসাটা বেড়ে যাচ্ছে। বেশ আদর করতে
ইচ্ছা করছে! কি জানি
আলেয়াকে সহজেই মানানো যায় কিনা!
মতি ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল, ঢুকেই যা দেখল সেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
সারাঘরে কীটনাশকের গন্ধে ম–ম করছে। আর আলেয়া কীটনাশকের খালি বোতলটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখের নদী প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। মতি দৌড়ে গিয়ে আলেয়াকে ধরে চিৎকার দিল, আলেয়া কোন কথা বললনা খালি মুখ চেপে বিদ্রুপ
হাসি হাসছে। এই হাসি দিয়ে মতিকে বুঝাতে চাচ্ছে অভাবের এই সংসার থেকে দুটো মানুষ
কমে গেলে কি এমন ক্ষতি! মতি পাগলের মতো কাঁদছে, আলেয়া সে কান্না শুনতে পাচ্ছেনা। আকাশ জুড়ে
পূর্ণিমা চাঁদ উঠেছে আজ, কিন্তু কেন জানি চাঁদটাও আজ বড় বেশি অচেনা—।
No comments:
Post a Comment