আড্ডা, নাম না বদনাম
সর্বতোমুখী শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান আড্ডা। এই বর্ণময় শব্দটির ঠিকঠাক কোনও প্রতিশব্দ এর বিকল্প হতে পারে বলে জানা নেই। সভাসমিতি, আখড়া, ঠেক, চক্র, আসর থেকে শুরু করে ইংরেজি শব্দ ক্লাব, কর্ণার, পার্টি কখনও কখনও আড্ডায় মুখরিত হয়ে উঠলেও সর্বার্থে আড্ডা আখ্যা পেতে পারে না। দুটি মাত্র শব্দকে পেয়েছি যারা আড্ডার নিকটাত্মীয়। এক-বৈঠক, দুই-মজলিশ। আড্ডাবাজ মানুষদের সঙ্গে মজলিশি মানুষদের কিছু মিল পাওয়া যায়। তা ঠিক প্রতিশব্দ না হোক, তা নিয়ে মাথাব্যথা অভিধান প্রণেতার। আড্ডা একটি অবিকল্প মনের জানালা। স্পর্শকাতর, উচ্চমানের অসাধারণ শিল্প এই আড্ডা। যৌথ শিল্প বললে আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ার কথা নয়। মহাকাশ থেকে মহিলা, মেশিন থেকে মন, বিজ্ঞান থেকে বিরহ, তত্ত্ব থেকে দেহতত্ত্ব, শিল্পচর্চা, পরচর্চা এই মিল-গরমিলের এজেন্ডাহীন অনুদ্দেশ আসরের স্বাদ পাই আড্ডায়।
বঙ্গসংস্কৃতির উৎসভূমিই হলো আড্ডা। আমাদের সাহিত্য এবং সাহিত্যিককে আড্ডাই বাঁচিয়ে রেখেছে। সাহিত্যের জগতে সর্বত্র আড্ডার শতরঞ্চি বিছানো। লেখক এবং কবিরা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন, অনেক চিন্তাভাবনার শুরু এই আড্ডা থেকে। আশ্চর্যরকম প্রাণবন্ত সে আড্ডা, যেখানে হাসি-মজার মধ্যেও নানান লেখা নিয়ে আলোচনা, পান্ডুলিপি শোনা, লেখার প্রুফ দেখা, কোথায় লেখা ছাপানো হলো বা হলো না কেন, এসবই আড্ডার অনায়াস মুহূর্তে চলে আসে। এমনও দেখা যায় এই আড্ডার মধ্যে থেকে কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে ভালো লেখক বা কবি হয়ে উঠেছেন ।
চায়ের দোকানের আড্ডা নিয়ে গবেষণা করতে পারলে প্রারম্ভ পর্ব থেকে প্রসার পর্ব পর্যন্ত একটা ইতিহাস তৈরি হবে। ইংরেজদের গোড়ার আমলে রাজারানির যুগে মহিলাদের প্রসব হবার পর বেদনা বিনাশক ঔষধ হিসাবে চা খাওয়ানো হতো। এমন একটি দৃশ্য আজ কল্পনা করতে গেলে হাসি পায়। তখন চা আসত চীন থেকে। রাজতন্ত্র থেকে যেমন গণতন্ত্র, সেইরকম বাবু আভিজাত্যের ফিকে ছায়া থেকে সাধারণতন্ত্রে নেমে আসার প্রথম লক্ষণ চায়ের দোকানের আড্ডা। স্বামী বিবেকানন্দ ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন, একদিন কলকাতার রাস্তার মোড়ে মোড়ে চা-চপ- কাটলেটের দোকান হবে। শুনেছি ফরাসিরা কাফেকে নিজের বৈঠকখানার এক্সটেনশন বলে মনে করে। ভাবনাটা এইরকম - এক কাপ গরম পানীয়কে সাক্ষী রেখে সৃষ্টিশীল মানুষের সামনে খুলে যাবে নতুন নতুন সৃষ্টির দ্বার |
কফি হাউস, নন্দন, রবীন্দ্র সদন, বইমেলা চত্বরের বা কলেজ স্ট্রিটের চায়ের দোকানে দোকানে মফস্সলের কবিরা কি একটু সান্নিধ্য-সুখের জন্য যান না? নামমাত্র দামের উষ্ণ চা সামনে রেখে তুমুল ঝড় তোলা আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে নিজেকে বারবার আরও একটু আবিষ্কার করা - ভাবের আদান-প্রদান পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য রোজকার নিয়মের মধ্যে থেকে পালিয়ে যান কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, আমারও প্রায়ই এধরনের আড্ডায় হাজিরা দিতে ইচ্ছা করে, অবশ্য সুযোগ পেলে যে যাই না, তা নয়।
এবার, আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে - আড্ডার মূলে কি আছে কর্মবিমুখতা? ফাঁকি আর আড্ডা কি হরেদরে সমার্থক? বিশ্বের উন্নত ও সুসভ্য রাষ্ট্রের লোকেরা কি আড্ডা দেয় না? কর্মযোগীদের কি আড্ডা দেওয়া নিষেধ? আমরা জেনেছি গ্রিক পন্ডিতেরাও নাকি পতিতালয়ে বসে পরস্পর আড্ডা দিতেন। আবার আমরা এও জানি, সে আমলে রাজারা আড্ডা দেওয়ার জন্য মাসমাইনে দিয়ে পর্ষদ রাখতেন। বড়ো বড়ো রাশভারী ব্যক্তিত্ব তাঁদের অমূল্য সময়ের কিছুটা ব্যয় করতেন বৈঠকখানায় নিয়মিত আড্ডা দিয়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও প্রিয় সঙ্গে সময় কাটাতেন। তাই বলছি, আড্ডা শুধুই কর্মবিমুখতা নয়। অলসের অবসর বিনোদন বলেও চিহ্নিত করা যাবে না, আসলে আড্ডায় ভাবের বিনিময়, জ্ঞানের আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক বন্ধুত্ব ঘটে। আমি খুব বিশ্বাস করি, মানুষের পেশায় যতটা চেনা যায় তার চেয়ে ঢের বেশি চেনা যায় তার নেশাতে।
আড্ডার গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বয়স। বয়সের সাথে সাথে বাছাবাছি আসতে থাকে সমমানসিকতা, সমপর্যায়,
সমরুচি, সভ্যতা, শিক্ষা। তবে, পিতৃ অন্নে
লালিতপালিত, পড়াশোনা ছেড়ে বা স্কুল, কলেজ থেকে পালিয়ে মুখের ভাষা আলাদা করে, অন্য ঢঙে
কথা বলে যে আড্ডা, তাকে নিশ্চয়ই আমরা সুস্থ মানসিকতার আড্ডা বলব না। সমাজে এগুলি মেনে নিতেই হবে। ভালোর পাশাপাশি মন্দ থাকবেই। উষ্ণ, আন্তরিক, নিঃস্বার্থ, নিরবচ্ছিন্ন আড্ডাতে অংশ
নিতে পারেনি বা তেমন কোনও আড্ডায় উপস্থিত থাকার যোগ্যতা যে মানুষের নেই তার পক্ষে আড্ডা
সম্বন্ধে ধারণা হবে কি করে? আসলে আড্ডা তো উঠে আসে যাপিত জীবন থেকে। তাবৎ আঁতলামি আর নতুন ভাবনার দেখনদারির নীচে
চোরাবালির মতো হারিয়ে না গিয়ে আমরা নতুন কনসেপ্টে বিশ্বাস করি। মনে করি দেশ, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মানুষের চিন্তা
মানুষের সম্পত্তি। দেখুন না, কি
মিষ্টি নাম 'সুনামি', অথচ এরই মধ্যে ঠাসা আছে মৃত্যুর ভয়াল থাবা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝাতে পেরেছি সাহিত্যের সাথে আড্ডার
যোগসূত্র কোথায়।
নিজেদের মধ্যে রেষারেষি, কলহ, মতান্তর এসব কোনও কারণে আড্ডা যেন না ভাঙে। বন্ধুত্ব, প্রীতির সম্পর্কই তো 'আড্ডা'কে বাঁচিয়ে রাখবে। তার সঙ্গে গত দিনকে কয়েক ঘন্টার জন্য ফিরে পাবার ব্যাকুলতা।
ভাবতে ভয় হয়, একদিন আড্ডা হয়তো আমাদের কাছে নষ্টালজিয়া হয়ে ফিরে আসবে।
আড্ডার জাত মেরেছে বাংলা ভাষার প্রতিশব্দের অভাব। এই আড্ডার বেজায় তারিফ করেছেন বিদগ্ধ আড্ডা রসিকেরা। বার্লিনে বিখ্যাত দিলীপ কুমার রায় ও তাঁর বন্ধুরা মাঝেমধ্যে সন্ধ্যায় কয়েকজন রুশ বান্ধবীর গৃহে এসে জুটতেন। বন্ধুদের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ডাকসাইটে অধ্যাপক শাহেদ সুরাবর্দিও ছিলেন। বান্ধবীরা ছিলেন বিদুষী, সুরসিকা, গান-বাজনা, হাসি-গল্পের সমঝদার। চলত আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক। এই বান্ধবীরা একদিন বাঙালিদের জিজ্ঞাসা করলেন বাঙালির বৈশিষ্ট্য কী? সুরাবর্দির হাজির জবাব, যা আর কারও নেই-- 'আড্ডা'। কথাটার অর্থ কী তা বোঝাতে দুই বাঙালি পন্ডিত মানুষের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল।
সেকালের সাহিত্য আড্ডা বলতে গেলেই বলতে হয় পত্রপত্রিকার কথা। প্রমথ চৌধুরীর 'সবুজপত্র', সুধীর সরকারের 'মৌচাক', সজনীকান্ত দাসের 'শনিবারের চিঠি' আর প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সম্পাদিত 'বেতার জগৎ'। ১৯২৭-২৮ সালের কথা, কলকাতা বেতারকেন্দ্রের নাম ছিল 'ইন্ডিয়ান ষ্টেট ব্রডকাষ্টিং কোম্পানি। ঠিকানা ছিল ডালহৌসি পাড়ার গার্ষ্টিন প্লেস। কেন্দ্রের প্রোগ্রামারের কর্তা ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁর সঙ্গে এসে জুটতেন রাইচাঁদ বড়াল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বানীকুমার ও প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তাঁর লেখা 'মহাস্থবিক জাতক' একটি অসাধারণ গ্রণ্থ। আসতেন হাসির গানের বিখ্যাত গায়ক নলিনীকান্ত সরকার, হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট যোগেশ বসু, যিনি গল্পদাদুর আসরের প্রতিষ্ঠাতা। নৃপেন মজুমদার, বীরেন ভদ্র, বানীকুমার তো থাকতেনই, আর প্রায়ই থাকতেন পঙ্কজ কুমার মল্লিকও। রোজকারের এই জমাটি আড্ডা ছিল সংস্কৃতি ও সংগীতের আড্ডা, সৃষ্টিশীল আড্ডা।
ইন্টারনেট, ফেসবুক আমাদের জীবনকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বিশ্বাসী করে তুলছে ভার্চ্যুয়াল জগতের জীবনধারাকে। জীবন্ত আড্ডা হারিয়ে স্বপ্নরাজ্যে বাস করছি সবাই ।
No comments:
Post a Comment