08 May 2017

অম্বিকা মজুমদার জেনি




চেনা অচেনার উপাখ্যান
আমি নীল লোহিতের জলাবৃতা কিংবা জলদেবী বলছি,
চিনতে পেরেছো কি?
তোমাকেই কিন্তু চিনে নিতে হবে এই নীল লোহিতকে,
চিনে নিতে হবে জলাবৃতা কিংবা জলদেবীকে!
অবাক হচ্ছো?
অথচ, তুমিই কিন্তু এ যুগের ইন্টেলেকচুয়াল!
তোমার সমালোচনায় সমালোচিত ক্ষুদ্র পিঁপড়ে থেকে বিদেশী বঙ্গ-বাহাদুর;
অথচ, নীল লোহিতকে চিনতে পারছো না?
এতো ক্ষুদ্র জ্ঞানে তুমি আবার অন্যের ভালো-মন্দে থাকো!
আমিই নীল লোহিতের জলাবৃতা কিংবা জলদেবী বলছি।
তুমি কিংবদন্তী বোঝো?
বোঝো সংগ্রাম কিংবা সম্মান?
তুমি ন্যায়-অন্যায় চেনো?
সৎ পথ কেমন হয় দেখেছো কোনোকালে?
বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানে কি জানো?
তুমি সমুদ্রের তাৎপর্য জানো?
জানো আকাশের কাছে কী দীক্ষা পাওয়া যায়?
তাহলে নীল লোহিতকে চিনবে আর কীভাবে!
জলাবৃতার ব্যাথা বা জলদেবীর ছলনা তো দূরেই থাক;
মানুষ চেনো তুমি?
দু'টো চোখ, দু'টো কান, দু'টো হাত, দু'টো পা, একটা নাক, একটা মুখ
ঠিক তোমার মতোই দেখতে হলেই বুঝি,
তাকে মানুষ ভাবো?
অথচ, এই তুমিই আমায় চেনো না!
হ্যাঁ, আমি নীল লোহিতের জলাবৃতা কিংবা জলদেবীই বলছিলাম। 


মৃত সত্ত্বায় অন্তঃস্থ
নীর,
তোমার জলদ স্পর্শে আমি নীরা, না হয় জলাবৃতা;
কখনো এই আমি বরুণানী ;
তুমি হয়ে ছিলে সুনীল!
আর এক তমসায় আমি হলাম দীপাবলি।
প্রলাপিনী হই যখন তখন, যেমন তুমি হয়ে থাকো বিশ্বাসহন্তা।
নীর,
সমুদ্র দেখেছিলে কখনো নীরার চোখে?
যে সমুদ্রে দু'টো পূর্ণ চাঁদে শুধু তোমার মুখ ভাসে;
সুনীল ছিলে যখন তখন তো জানতে
বরুণার বুকে শুধু সুগন্ধি রুমালই নয় পোড়া মাংসের গন্ধও থাকে!
অথচ তুমি নীর,
নীরার চোখে নিজেকে খোঁজেনি কখনো!
আমি বরুণা হয়ে আসেনি নীর,
আমিই ছিলাম তোমার নীরা,
আলোকিত পৃথিবীর এক সজীব খণ্ডাংশ!
নীর,
'ভালোবাসো?' জিজ্ঞেস করে মনভোলানো কথায় তুমি যেমন সিদ্ধ,
তেমন আমিও বুঝি তোমার ছল, আর দেখে নিয়েছি
নীরার অশ্রুতে নীরের বুকের শত সপ্তদল!
মৃত সত্ত্বায় অন্তঃস্থ নীরার বুকে পোড়া মাংসের গন্ধ নেই, নীর
আছে শুধুই শূন্যতা।
যেখানে রয়ে গেছে শুধু শুধুই ভালোবাসার ক্ষমতা।
নীর,
পদ্মপাতায় শিশির জমে জানি,
কিন্তু নীরার চোখে জমে মুক্তোদানা;
যে মুক্তোদানার কাছে সমগ্র জাগতিক দুর্লভ রত্নাদি নগণ্য।
নীরা তবু সর্বদাই সামান্যা,
তোমার আপন অসাধারণ সব প্রেয়সীদের মাঝে!
নীর,
সুনীলবাবু বেঁচে থাকলে একটা গল্প লিখতে বলেই ফেলতাম,
হ্যাঁ, উনার প্রিয় অন্তরালবর্তিনী এক নীরার গল্প।
যার কিনা কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিনী থেকে যায়,
তোমার মতো কিছু সাদৃশ্য খোঁজায় ব্যস্ত নীরের কাছে;
সেই গল্পে হয়তো লেখকের উদারতায় নীরাকে চিনে নিতো নীর।
ভয় নেই,
এই শুধুই অপারগতায় নরম পালকের স্পর্শ বুলানো মাত্র!
নীরারা কখনো বরুণা হয় না।



শ্রাবণসমুদ্র
সমুদ্র দেখিনি কোনোদিন,
দেখিনি তার ফেনিল ঢেউ;
কিন্তু আমি দেখেছি,
অন্তিম শ্রাবণের ফেনিল মেঘ হতে
সদ্য প্রস্ফুটিত কিশোরী ন্যায় উজ্জ্বল এক চাঁদ।
কী নেই আজ আকাশ নামের বিশাল অবয়বে!
নীলচে-কালচে মেঘের ঢেউ,
সূর্যালোকে আলোকিত চাঁদ,
রাতের সমুদ্রের বুকে জ্বলা ফসফরাসের মতো নক্ষত্রেশ!
আর নিঃসঙ্গ গাঙচিলের অভাবটা পূর্ণ করতেই বুঝি,
আগমন ঘটেছে আমার-
উত্তাল বাতাসে এমন ফেনিল সমুদ্রের নিচে-
মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে এই অসহ্য সুন্দর মুহূর্তে!
তবুও তো সমুদ্র দেখা হলো,
এই মিল-অমিলের দেখা-অদেখার মাঝে।
এইতো ঢের পাওয়া হলো;
হে ঈশ্বর,
আর কত?
এবার তো নিজের বুকটা চিরে দাও!
তোমার কৃপণতায় আমি মুগ্ধ!
শেষমেশ কিছু তো দিলে অপূর্ণতার খাতায় আংশিক পূর্ণতা বলে;
যথেষ্ট, এবার শান্তিতে ঘুমাতে চাই তোমার বুকে।



অকালবোধনে পূর্ণতা
তাকে দেখেছিলাম মধ্যবসন্তে;
আর কথা বলেছিলাম ঠিক দেখা হওয়ার,
দু'দিন দু'রাত পরেই।
সে বলেছিল,
কৃষ্ণচূড়া ফুল প্রিয় বুঝি তোমার?
আমি তো হেসেই আকুল,
তবে অবাকও হয়েছিলাম সেদিন!
ঠিকই সে এনেছিল,
শেষবসন্তে রক্তিম কৃষ্ণচূড়া।
ফুল গুলো আমার হাতে দিয়ে
সে চলে যাচ্ছিল-
আর আমি দেখছিলাম অবাক চোখে!
সেই যে গেল সে
গ্রীষ্ম গেল প্রখর রোদে,
কালবৈশাখীতেও তার পথ চেয়েছিলাম!
শুষ্ক ঝড়ো হাওয়ার রুক্ষতায়
শুধু ছুঁয়ে গেছে আমায়।
এরপর এলো বর্ষা,
কি আশ্চর্য!
বর্ষাতেও তার কোন খোঁজ নেই;
রিমঝিম বৃষ্টি আমার চোখে,
আর মনে বইছিল উত্তাল বাতাস;
তবুও তার দেখা নেই!
যেদিন আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে গেল,
সেদিন বুঝেছিলাম এই বুঝি শরৎ এলো।
এবারো বুঝি মিলবে না,
অপেক্ষার অবসর আমার!
শরতের প্রথম পূর্ণিমাও
ম্লান হয়ে গেল আমার কাছে;
তার পথ চেয়ে শুরু হল কৃষ্ণপক্ষ।
মহালয়াতে যখন পেলাম তার উড়ো চিঠি,
মনে হল এবার বুঝি হয়েই যাবে অকালবোধন!
পঞ্চমীতে তাই আমি তার প্রতীক্ষায় বসে ছিলাম;
ষষ্ঠীর চাঁদের বাঁকা ঠোঁট যেন বিদ্রুপ করে আমায়,
সপ্তমীতে তার আশায় নীল বেদনাতে সাজলাম;
তবুও নেই তার দেখা!
অষ্টমীতে লাল টুকটুকে পেড়ে সাদা শাড়িতে ম্লান আমি,
কেন করে সে এতো ছলনা আজও?
বিসর্জন যে এসে গেল!
তবে কি শুধু বিসর্জনের পালাই বাকী?
নবমীতে আমি শোকে পাথর,
কালো আঁধারের মেঘে আজ আমি ঢাকা;
কালই তো এই অকালবোধনের বিসর্জন,
তবুও এলো না সে!
আজ আমি লাল বেনারসিতে সিক্ত,
আলুলায়িত খোলা চুলে
কাজল চোখে আজ আরো আঁধার আমার।
আজ যে আমার বিসর্জনের সমন!
সায়াহ্নে তাই নদী তীরে
পাগলিনী আমি একেলা,
বিসর্জনেই বুঝি পাব আমি পূর্ণতা!
অপেক্ষার হবে অবসান;
তবে অকালবোধন কার তরে আজ?
হঠাৎ বাতাসে যেন চেনা সুবাস!
দু' হাত ভর্তি শিউলি ফুলে,
দাঁড়িয়ে সে সম্মুখে আমার!
সেই তো এলে বিসর্জনের প্রাক্কালে?
অবান্তর প্রশ্নে না হয় পেলাম হাসিমুখের দেখা!
অবশেষে তবে আজ বিসর্জনেই
পূর্ণতা পেয়ে যাক অকালবোধন!



অদ্ভুত উপাখ্যান
সোচ্চার ভালোবাসা ছিল জন লেনিনের,
আর এক বুক অভিমান ছিল বব ডিলানের;
প্রেম নিকষিত হেম অনলঅন্তর নিয়ে প্রতিনিয়ত জ্বলে যাচ্ছে ভিসুভিয়াস;
উত্তরে হিমালয়ের হিমেল বাতাসে সহস্রাব্দে কম্পিত পায়ে দাঁড়িয়ে বিজয়!
অগণিত না বলা দুঃখ নিয়ে শতাব্দীর অতলে প্রবাহিত হচ্ছে হোয়াংহো,
পাশেই দাঁড়িয়ে যুগ বিজয়ী অথচ নিরব কান্নায় সহস্র যোদ্ধার বিখ্যাত সমাধি প্রাচীর!
বিশ্বকবিকেও একদিন বিক্রিত হতে হয়েছিল সভ্যতার অতলে, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হয়ে!
আর বিদ্রোহী, সে তো অস্পৃশ্য ছিল দিনের পর দিন নিজ মনে;
জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতেই তাই ট্রামের চাকায় কোনো প্রতিভা আনন্দ খুঁজেছিল একদিন,
দুর্দান্ত আঠারো বছরের তরুণটি, কোনোদিন তারুণ্য হারাবেনা বলেই একুশ বছরে চলে গেল পরপারে!
আর প্রাচীনে ছিল খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে নিজের দেশে অশুচি হওয়ার নিদারুণ যাতনা ;
আর এখন যেদিকেই দৃষ্টি ফিরে সেদিকেই কা'কের কবিত্ব।
বিখ্যাত সবাই আজ স্বীয় প্রতিভায়!
একদিন অনেকেই ছিল, আজ নেই;

বিখ্যাত হয়েছিল অনেকেই জীবন ছেড়ে।
আজকাল দেখি বিখ্যাত হতে বিরল কিছু লাগে না!
আগে থেকেই তো ছিল-
ভালোবাসা, অভিমান, প্রেম, দুঃখ, তারুণ্য, কবিত্ব, কা'ক প্রভৃতি,
আর তাই এই একবিংশের অদ্ভুত উপাখ্যানে,
কেউ নতুন কিছু নিয়ে বিখ্যাত হচ্ছে না!

No comments:

Post a Comment