25 May 2017

মামুন আব্দুল্লাহ





রাতে ঘুমাক বা না ঘুমাক, সকালে ঘুমাতে হবেইহলের অন্য সবার মতই অভ্যাসটা হয়ে গেছে আরমানেরসকাল নয়টা, তখনো ঘুমাচ্ছিল ওঅবশ্য ওর ঘুম খুব পাতলাঘুমালে কান একটা যেন সব সময় সজাগ থাকে ওরআশেপাশে মৃদু আর হালকা কোন শব্দ হলেই ওর ঘুমটা চলে যায়তবে সময়টা আসলেও আরমানের ঘুমানোর সময়রুমে আর কেউ নাইঅনুজ গেছে বাড়িতে হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায়রুপাই পুরান ঢাকায় ওর মামার বাসায় গেছেরোকনের পরীক্ষা শেষ, সেই সুবাদে বাড়ি থেকে ঘুরে আসার একটা সুযোগ হাতছাড়া করেনি সেআর দুদিন ধরে বাবুর কোন পাত্তা নাইপরে জানা গেল তাড়াহুড়া করে মৌলভি বাজারে চলে গেছে ওআসবে কয়েক দিন বাদেতাই রুমে একাই ঘুমিয়েছিলো আরমান 
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল ওরচোখ মেলে দেখলো ও, একটা ঘুঘু পাখি পড়ে আছে ওর নাগালের কাছেইজানালার ফাঁক গলে কেমনে যেন ঘরে ঢুকে পড়েছে ঠিক ঠাহর পেলনা আরমানপাখিটা আহত, কয়েক জায়গায় রক্তাক্ত হয়ে আছেউড়তে পারছেনা ঘুঘুটা, সে চেষ্টাও করছেনাখালি কেমন যেন মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকেদুনিয়ার তামাম পাখিদের মধ্যে থেকে ঘুঘুই হচ্ছে ওর সবচেয়ে প্রিয়আর সেই পাখিই কিনা আহত হয়ে পড়ে আছে ওর নাগালের কাছেইমুহূর্তেই ঘুম চলে গেল চোখ থেকেঘুঘুটাকে আলতো করে ধরে দেখার চেষ্টা করলো আরমান আসলে কি সমস্যা হয়েছে ওরদূরে যাবার কোন লক্ষণ দেখা গেলনা পাখিটার মধ্যেযেন আরমানের হাতে ধরা দেবার জন্যই আহত হয়েছে সেমুহুর্তেই পাখিটার মায়ায় পড়ে গেল আরমানমায়া! বড় খারাপ জিনিসহুঁহুঁ করে শুধু বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে, কমেনামায়ার আরেক পীঠের নাম হয়তো ভালোবাসাকি জানি, সঠিক জানেনা আরমানছোট্ট ঘুঘুটার একটা নামও দিল ওযেহেতু আসমান থেকেই মনে হয় পাখিটা নেমে এসেছে, তাই ওর নাম রাখলোআসমানী
 জীবনে ভালো মন্দ যাই কিছু ঘটুকনা কেন প্রথমেই সব ভাইয়াকে জানানোর অভ্যাস আছে আরমানেরঝটপট পাখিটার কয়েকটা ছবি মেইল  করে পাঠিয়ে দিল ভাইয়ার কাছেসেই সাথে পরামর্শ চাইলো এখন তার কি করা উচিৎআরো জানালো ঘুঘুটাকে সে বাড়ি নিয়ে আসতে চায়পারমানেন্টলিভাইয়া খুব ঘাগু লোকভদ্র ভাষায় বলতে গেলে খুব দূরদর্শী আর ঠাণ্ডা মাথার লোক সেআবেগ অনুভুতি সবই আছে তার তবে আবেগে সে কখনো বিবেক হারা হয়নাসব কিছু হিসাব কিতাব করে তবেই সে ডিসিশন নেয় সেবেশ সময় নিয়ে সে ঘুঘু বৃত্তান্ত শুনলো, তারপর বললো যে ঠিক আছে, পাখিটাকে বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে সেতবে ঘুঘুটা যদি উড়ে যায় কখনো তখন যেন প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান না করে আরমানআর সময় ও লাগবে কিছুমাকে বলতে হবেতবেই আসল বিষয়টা জানা যাবে
বিকেলের দিকে রুপাইকে ফোন করলো আরমানরুপাইটা শুধু ওর বন্ধুনা, তারচেয়েও বেশ খানিকটা বেশী কিছুঅনেকটা ওর ভাইয়ের মতইসিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও দুজনের অনেক মিল পাওয়া যায়প্রায় ভাইয়ার মতই পরামর্শ দিল সেএকে একে বিষয়টা সবাইকে জানালো ওঅনুজ, বাবু, রোকন, সবাই
রাতে মা ফোন দিল
-বাবা কেমন আছো? (মা কখনো ফোনে আরমানকে নাম ধরে ডাকেনা)
-ভালো আছি মাতোমরা?
-আমরাও ভালো
-কি করো এখন? (মার এটা কমন প্রশ্ন)
-কিছুনা মা, মাত্র খেয়ে আসলাম মেস থেকে
-কি দিয়ে খাইছো?
-মাছ, ডাল আর সাথে কি যেন একটা সবজি দিয়েছিলএই সব দিয়ে
-খাওয়া দাওয়া ঠিকমত কর, সময়ের খাবার সময়ে খাবা
-তাইতো খাই, মা
-বাবা; কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল মা
-হুম?
-তুমি যে ঘুঘু পাখিটার ছবি পাঠাইছোনা!
-হুম মা
-পাখিটাতো খুব সুন্দর!
-জী মা, মনে মনে খুব খুশি হয়ে গেল আরমান
-ঐটাকে বাড়ি নিয়ে আসতে চাও নাকি তুমি, রানা বললো; (রানা ওর ভাইয়া)
-জী মা
-কোথাকার পাখি এটা
-ঢাকার মা, আমি যে জায়াগাতে থাকি এর আশে পাশেরই
মা যেন একটু অস্বস্তিতে পড়লো কথাটা শুনেআরমান জানে ঢাকার কোন কিছুই মা র পছন্দ নাএমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ভালো একটা জিনিষ কেন ঢাকায় বানানো হয়েছে এটা নিয়েও তার আপত্তি আছে
-শোন বাবা;
-হুম বলো
-শহুরে পাখি গুলো খুব একটা ভালো হয়না বাবা, আমার ঠিক পছন্দ না এই সব
আরমান কিছু বললোনা, শুধু শুনে গেল কি কি বলে মা
এমন না যে মা ওকে বাধ্য করবে তার কথা শুনতেপরিবারের কেউই ওকে কখনো কোন কিছু করতে চাপ দেয়নিওর উপর খুব বিশ্বাস আছে সবার, আস্থা আছেসেই বিশ্বাস আর আস্থা থেকে একপ্রকার দায়বদ্ধতা জন্মে গেছেমনে চাইলেই যাচ্ছেতাই করতে পারেনা আরমানঅবশ্য ওর মা হলো জগতের শ্রেষ্ঠ ভালো মানুষদের একজনঅনায়াসে বিষয়টা নিয়ে মাকে ম্যানেজ করতে পারবে ওমার কাছে গিয়ে যদি বলা যায় ; মা, পাখিটা আমার খুব পছন্দ, আমার ওটা চাই-মা কখনোই মানা করবে না, করতেই পারবেনাকিন্তু তবু, কেমন যেন কষ্ট লাগতে শুরু করলো কথা গুলো শুনে
এমনি ঘুম কম হয় আরমানের, সে রাতে ঘুমই এলোনা ওর
দীর্ঘ আর বিলম্বিত কয়েকটা দিন কেটে গেল আরমানের, কষ্টদায়কও বটেআসমানী ঘুঘুটার মায়ায় বিপর্যস্ত এক ছন্নাছাড়া যেন সেকিছুতেই বিষয়টার নাগাল খুঁজে পেলনা সে, আসলেই তার কি করা উচিৎতবে বরাবরই সে খুব অভিমানীমার উপর খুব অভিমান লাগলো ওরজীবনে কখনোই অন্যায় কোন জেদ করেনি ও কারো সাথেমনে হয় এইবার করা উচিৎ, যদিও এটা মোটেও অন্যায় কিছু নাতবু দোটানায় পড়ে মহামূল্যবান আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল অযথাইপাখিটার জন্য কোন খাঁচা বানানো হলোনা আরমানেরহয়তো সে ইচ্ছে ছিলোওনা ওরপাখি সত্যিকারের ওর হলে খাঁচার কোন দরকার পড়েনাএখন আর আহত নেই পাখিটাধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছেএইসব গোলমালের মধ্যে পড়ে ওর খোঁজ খবরই তেমন নেয়া হয়নি আরমানেরহয়তো অবহেলাও করা হয়ে গেছে খানিকটা, যত্নও নেয়া হয়নি ঠিকমতএতে আসলে আরমানকেও দোষ দেয়া যায়না খুব একটাকারন ঘুঘু পাখির মন বোঝাবুঝি আর যত্ন আত্তির বিষয়টা নিয়ে আসলে  তেমন কোন ধারণাই নেই ওরসহজ ভাষায় যাকে আনাড়ী বলা চলে
তবে এতসব বুঝলো না ঘুঘুটাএকদিন ঠিকই উড়াল দিল আকাশেআরমানের সাধের আসমানী ঘুঘু, ছোট্ট ঘুঘুযার জন্য কোন খাঁচা বানায়নি আরমান, খুব ভালোবেসে ওকে বুকের মাঝখানটায় জায়গা করে দিয়েছিলো
মা ফোন করলো আবারএই কয়েকদিনের মধ্যে অবশ্য অনেক বারই কথা হয়েছে মার সাথেতবে পাখিটার কথা দুজনই সযতনে এড়িয়ে গেছে
-খাইছো বাবা? মা জিজ্ঞেস করলো ওকে
-হুম মা; বললো বটে আরমান, তবে দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেলেও এখনো খাওয়া হয়নি ওরপনের তারিখের পরে ক্যান্টিনের নতুন সেশন চালু হয়এখনো টাকা জমা দেয়নি ওতাই গরিমসি করে দূপুরটা পারই হয়ে গেলতবে এখুনি বের হবে ওখেতে তো হবেই
-কি দিয়ে খাইছো?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আরমানমিথ্যে কথার এই এক যন্ত্রনাএকবার শুরু করলে কথাটা প্রতিষ্ঠিত করতে আরো কতযে মিথ্যে বলতে হয়!
-তোমার সেই পাখিটা কেমন আছে? বেশ কিছু সময় মামুলি কথাবার্তা বলার পর মা হঠাৎ জানতে চাইলো
-পাখি, পাখিটা উড়ে গেছে!
কালো ছেলে আরমানের কালো চোখদুটো ছলছল করে উঠলো যেনতবে ভয় নেই, কান্না করবে না ওসে অভ্যাস খুব একটা নেইছোটবেলাতেও যখন ভাইয়ার সাথে একজোট হয়ে পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে মারামারি করতো তখন মাঝেমাঝে খুব ব্যথা পেলেও কান্না করতোনা ওবড় হওয়ার পরেও একদিন মাথা ফেটে গিয়েছিল ওরচারটা সেলাই লেগেছিলো সেবারতখন মাথা দিয়ে বেশ রক্ত বেড়িয়েছিল কিন্তু চোখ দিয় কোন পানি আসেনিআসলে কান্না করতেও মনে হয় মনের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সুখ থাকতে হয়এই মুহুর্তে তা মোটেও নেই ওর মনেফোনে তো, তাই মা মনে হয় কিছু টের পেলনাকিন্তু মা-তো মা-ফোনের বাইরেও যোগাযোগ করার একটা অদ্ভুত মাধ্যম আছে তাঁরমা-ও যেন হঠাৎ থমকে গেলো কথাটা শুনে
-উড়েই  গেল?
-হুম মা
-যাক, আমি তোমাকে আরেকটা ঘুঘু পাখি এনে দেব বাবা!
-আমার আর কোন ঘুঘু পাখির দরকার নেই মা; হাজার চেষ্টা করেও কন্ঠ থেকে অভিমানের ছাপ মুছতে পারলো না আরমান
মা কেমন যেন থেমে গেলআরমান ঠিক ধরতে পারলো অপরাধবোধে ভুগতেছে মা এখন
-ঠিক আছে তাইলে পাখিটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসো!
-ঘুঘু পাখি একবার উড়ে গেলে আর ফিরে আসেনা মা
-বিষয়টা কেমন হয়ে গেল তাইলে?
-তুমি মিছেই চিন্তা করোনা মা, এইসব পাখি টাখি ছাড়াই আমি খুব ভালোই আছি, কি দরকার?
মাকে কৃত্তিম অভয় জানাতে শব্দ করে হাসতে গেল আরমানওটাই ভুল হলো ওরবেয়াদব চোখদুটো হঠাৎ ঝাপশা হয়ে এলো ওররুপাই বলে মাঝে মাঝে হাসি আসলে কান্নারই একপ্রকার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আসেমনে হয় ঠিকই বলে ওতবে হাসি তো হাসিইহাসতে গিয়ে পেটে খিল লাগলে, চোখ ভরে পানি চলে আসলে তবুও এটাকে কান্না বলা যাবেনা মোটেওপুরুষ মানুষ কাঁদেনা
তারপর অনেক দিন কেটে গেছেআরমানের ছন্নছাড়া আকাশটাতে অনেক পাখিই উঁকি দিয়েছেকিন্তু তাঁর ছোট্ট, আসমানী সেই ঘুঘুটার মায়া সে কেমনে ভুলে থাকবে !
বহুদিন আগে একজন বলেছিলো ওকে, তোমার চোখদুটো বড্ড বেশী বিষণ্ণ;
-বিষণ্ণ না, আমার চোখ দুটোই আসলে অমনহেসে জবাব দিয়েছিলো আরমানতারপর আয়নায় দাঁড়িয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলো ও, তখন কিছুই খুঁজে পায়নিকিন্তু এখন জানে, দুচোখের বিষণ্ণতা গুলো হৃদয়েও ঠাই করে নিয়েছে এইবারআসমানি ঘুঘুটা ওর হৃদয়ে ঘর বেঁধেছিল, কি খেয়ালে আবার উড়েও চলে গেছেকিন্তু তার ডানার অবিশ্রান্ত ঝট্‌পটানি এখনো বুকের মধ্যে টের পায় আরমান  
(সংক্ষেপিত)


No comments:

Post a Comment