রাতে ঘুমাক বা না ঘুমাক, সকালে ঘুমাতে হবেই। হলের অন্য সবার মতই অভ্যাসটা হয়ে গেছে আরমানের। সকাল নয়টা, তখনো ঘুমাচ্ছিল ও। অবশ্য ওর ঘুম খুব পাতলা। ঘুমালে কান একটা যেন সব সময় সজাগ থাকে ওর। আশেপাশে মৃদু আর হালকা কোন শব্দ হলেই ওর ঘুমটা
চলে যায়। তবে সময়টা আসলেও আরমানের
ঘুমানোর সময়। রুমে আর কেউ নাই। অনুজ গেছে বাড়িতে হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায়। রুপাই পুরান ঢাকায় ওর মামার বাসায় গেছে। রোকনের পরীক্ষা শেষ, সেই
সুবাদে বাড়ি থেকে ঘুরে আসার একটা সুযোগ হাতছাড়া করেনি সে। আর দুদিন ধরে বাবুর কোন পাত্তা নাই। পরে জানা গেল তাড়াহুড়া করে মৌলভি বাজারে চলে গেছে ও। আসবে কয়েক দিন বাদে। তাই রুমে একাই ঘুমিয়েছিলো আরমান।
জীবনে ভালো মন্দ যাই কিছু
ঘটুকনা কেন প্রথমেই সব ভাইয়াকে জানানোর অভ্যাস আছে আরমানের। ঝটপট পাখিটার কয়েকটা ছবি মেইল করে পাঠিয়ে দিল ভাইয়ার কাছে। সেই সাথে পরামর্শ চাইলো এখন তার কি করা উচিৎ। আরো জানালো ঘুঘুটাকে সে বাড়ি নিয়ে আসতে চায়। পারমানেন্টলি। ভাইয়া খুব ঘাগু লোক। ভদ্র ভাষায় বলতে গেলে খুব দূরদর্শী আর ঠাণ্ডা মাথার লোক সে। আবেগ অনুভুতি সবই আছে তার তবে আবেগে সে কখনো
বিবেক হারা হয়না। সব কিছু হিসাব কিতাব করে
তবেই সে ডিসিশন নেয় সে। বেশ
সময় নিয়ে সে ঘুঘু বৃত্তান্ত শুনলো, তারপর বললো যে ঠিক আছে, পাখিটাকে
বাড়িতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে সে। তবে ঘুঘুটা যদি উড়ে যায় কখনো তখন যেন প্যানপ্যান ঘ্যানঘ্যান
না করে আরমান। আর সময় ও লাগবে কিছু। মাকে বলতে হবে। তবেই আসল বিষয়টা জানা যাবে।
বিকেলের দিকে রুপাইকে ফোন করলো আরমান। রুপাইটা শুধু ওর বন্ধুনা, তারচেয়েও
বেশ খানিকটা বেশী কিছু। অনেকটা
ওর ভাইয়ের মতই। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও
দুজনের অনেক মিল পাওয়া যায়। প্রায় ভাইয়ার মতই পরামর্শ দিল সে। একে একে বিষয়টা সবাইকে জানালো ও। অনুজ, বাবু, রোকন, সবাই।
রাতে মা ফোন দিল।
-বাবা কেমন আছো? (মা
কখনো ফোনে আরমানকে নাম ধরে ডাকেনা)
-ভালো আছি মা। তোমরা?
-আমরাও ভালো।
-কি করো এখন?
(মার এটা কমন প্রশ্ন)
-কিছুনা মা, মাত্র খেয়ে আসলাম মেস থেকে।
-কি দিয়ে খাইছো?
-মাছ, ডাল আর সাথে কি যেন একটা
সবজি দিয়েছিল। এই সব দিয়ে।
-খাওয়া দাওয়া ঠিকমত কর, সময়ের
খাবার সময়ে খাবা।
-তাইতো খাই, মা।
-বাবা; কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল
মা।
-হুম?
-তুমি যে ঘুঘু পাখিটার ছবি পাঠাইছোনা!
-হুম মা।
-পাখিটাতো খুব সুন্দর!
-জী মা, মনে মনে খুব খুশি হয়ে গেল
আরমান।
-ঐটাকে বাড়ি নিয়ে আসতে চাও নাকি তুমি, রানা
বললো; (রানা ওর ভাইয়া)
-জী মা।
-কোথাকার পাখি এটা।
-ঢাকার মা, আমি যে জায়াগাতে থাকি এর
আশে পাশেরই।
মা যেন একটু অস্বস্তিতে পড়লো কথাটা শুনে। আরমান জানে ঢাকার কোন কিছুই মা র পছন্দ না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত ভালো একটা জিনিষ
কেন ঢাকায় বানানো হয়েছে এটা নিয়েও তার আপত্তি আছে।
-শোন বাবা;
-হুম বলো।
-শহুরে পাখি গুলো খুব একটা ভালো হয়না বাবা, আমার
ঠিক পছন্দ না এই সব।
আরমান কিছু বললোনা, শুধু শুনে গেল কি কি বলে মা।
এমন না যে মা ওকে বাধ্য করবে তার কথা শুনতে। পরিবারের কেউই ওকে কখনো কোন কিছু করতে চাপ
দেয়নি। ওর উপর খুব বিশ্বাস আছে সবার, আস্থা
আছে। সেই বিশ্বাস আর আস্থা থেকে
একপ্রকার দায়বদ্ধতা জন্মে গেছে। মনে চাইলেই যাচ্ছেতাই করতে পারেনা আরমান। অবশ্য ওর মা হলো জগতের শ্রেষ্ঠ ভালো মানুষদের
একজন। অনায়াসে বিষয়টা নিয়ে মাকে
ম্যানেজ করতে পারবে ও। মার
কাছে গিয়ে যদি বলা যায় ; মা, পাখিটা আমার খুব পছন্দ, আমার
ওটা চাই-ই। মা
কখনোই মানা করবে না, করতেই পারবেনা। কিন্তু তবু, কেমন যেন কষ্ট লাগতে শুরু
করলো কথা গুলো শুনে।
এমনি ঘুম কম হয় আরমানের, সে রাতে ঘুমই এলোনা ওর।
দীর্ঘ আর বিলম্বিত কয়েকটা দিন কেটে গেল আরমানের, কষ্টদায়কও
বটে। আসমানী ঘুঘুটার মায়ায়
বিপর্যস্ত এক ছন্নাছাড়া যেন সে। কিছুতেই বিষয়টার নাগাল খুঁজে পেলনা সে, আসলেই
তার কি করা উচিৎ। তবে বরাবরই সে খুব অভিমানী। মার উপর খুব অভিমান লাগলো ওর। জীবনে কখনোই অন্যায় কোন জেদ করেনি ও কারো সাথে। মনে হয় এইবার করা উচিৎ, যদিও
এটা মোটেও অন্যায় কিছু না। তবু দোটানায় পড়ে মহামূল্যবান আরো কয়েকটা দিন কেটে গেল অযথাই। পাখিটার জন্য কোন খাঁচা বানানো হলোনা আরমানের। হয়তো সে ইচ্ছে ছিলোওনা ওর। পাখি সত্যিকারের ওর হলে খাঁচার কোন দরকার পড়েনা। এখন আর আহত নেই পাখিটা। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এইসব গোলমালের মধ্যে পড়ে ওর খোঁজ খবরই তেমন নেয়া হয়নি
আরমানের। হয়তো অবহেলাও করা হয়ে গেছে
খানিকটা, যত্নও নেয়া হয়নি ঠিকমত। এতে আসলে আরমানকেও দোষ দেয়া যায়না খুব একটা। কারন ঘুঘু পাখির মন বোঝাবুঝি আর যত্ন আত্তির
বিষয়টা নিয়ে আসলে তেমন কোন ধারণাই নেই ওর। সহজ ভাষায় যাকে আনাড়ী বলা চলে।
তবে এতসব বুঝলো না ঘুঘুটা। একদিন ঠিকই উড়াল দিল আকাশে। আরমানের সাধের আসমানী ঘুঘু, ছোট্ট
ঘুঘু। যার জন্য কোন খাঁচা বানায়নি
আরমান, খুব ভালোবেসে ওকে বুকের মাঝখানটায় জায়গা করে দিয়েছিলো।
মা ফোন করলো আবার। এই
কয়েকদিনের মধ্যে অবশ্য অনেক বারই কথা হয়েছে মার সাথে। তবে পাখিটার কথা দুজনই সযতনে এড়িয়ে গেছে।
-খাইছো বাবা? মা জিজ্ঞেস করলো ওকে।
-হুম মা; বললো বটে আরমান, তবে
দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেলেও এখনো খাওয়া হয়নি ওর। পনের তারিখের পরে ক্যান্টিনের নতুন সেশন চালু হয়। এখনো টাকা জমা দেয়নি ও। তাই গরিমসি করে দূপুরটা পারই হয়ে গেল। তবে এখুনি বের হবে ও। খেতে তো হবেই।
-কি দিয়ে খাইছো?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল আরমান। মিথ্যে কথার এই এক যন্ত্রনা। একবার শুরু করলে কথাটা প্রতিষ্ঠিত করতে আরো কতযে মিথ্যে
বলতে হয়!
-তোমার সেই পাখিটা কেমন আছে? বেশ
কিছু সময় মামুলি কথাবার্তা বলার পর মা হঠাৎ জানতে চাইলো।
-পাখি, পাখিটা উড়ে গেছে!
কালো ছেলে আরমানের কালো চোখদুটো ছলছল করে উঠলো যেন। তবে ভয় নেই, কান্না করবে না ও। সে অভ্যাস খুব একটা নেই। ছোটবেলাতেও যখন ভাইয়ার সাথে একজোট হয়ে পাড়ার অন্য ছেলেদের
সাথে মারামারি করতো তখন মাঝেমাঝে খুব ব্যথা পেলেও কান্না করতোনা ও। বড় হওয়ার পরেও একদিন মাথা ফেটে গিয়েছিল ওর। চারটা সেলাই লেগেছিলো সেবার। তখন মাথা দিয়ে বেশ রক্ত বেড়িয়েছিল কিন্তু চোখ
দিয় কোন পানি আসেনি। আসলে
কান্না করতেও মনে হয় মনের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ সুখ থাকতে হয়। এই মুহুর্তে তা মোটেও নেই ওর মনে। ফোনে তো, তাই মা মনে হয় কিছু টের
পেলনা। কিন্তু মা-তো
মা-ই। ফোনের
বাইরেও যোগাযোগ করার একটা অদ্ভুত মাধ্যম আছে তাঁর। মা-ও যেন হঠাৎ থমকে গেলো কথাটা শুনে।
-উড়েই
গেল?
-হুম মা।
-যাক, আমি তোমাকে আরেকটা ঘুঘু পাখি
এনে দেব বাবা!
-আমার আর কোন ঘুঘু পাখির দরকার নেই মা; হাজার
চেষ্টা করেও কন্ঠ থেকে অভিমানের ছাপ মুছতে পারলো না আরমান।
মা কেমন যেন থেমে গেল। আরমান ঠিক ধরতে পারলো অপরাধবোধে ভুগতেছে মা এখন।
-ঠিক আছে তাইলে পাখিটাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসো!
-ঘুঘু পাখি একবার উড়ে গেলে আর ফিরে আসেনা মা।
-বিষয়টা কেমন হয়ে গেল তাইলে?
-তুমি মিছেই চিন্তা করোনা মা, এইসব
পাখি টাখি ছাড়াই আমি খুব ভালোই আছি, কি দরকার?
মাকে কৃত্তিম অভয় জানাতে শব্দ করে হাসতে গেল আরমান। ওটাই ভুল হলো ওর। বেয়াদব চোখদুটো হঠাৎ ঝাপশা হয়ে এলো ওর। রুপাই বলে মাঝে মাঝে হাসি আসলে কান্নারই একপ্রকার
বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আসে। মনে
হয় ঠিকই বলে ও। তবে হাসি তো হাসিই। হাসতে গিয়ে পেটে খিল লাগলে, চোখ
ভরে পানি চলে আসলে তবুও এটাকে কান্না বলা যাবেনা মোটেও। পুরুষ মানুষ কাঁদেনা।
তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। আরমানের ছন্নছাড়া আকাশটাতে অনেক পাখিই উঁকি দিয়েছে। কিন্তু তাঁর ছোট্ট, আসমানী
সেই ঘুঘুটার মায়া সে কেমনে ভুলে থাকবে !
বহুদিন আগে একজন বলেছিলো ওকে, তোমার
চোখদুটো বড্ড বেশী বিষণ্ণ;
-বিষণ্ণ না, আমার
চোখ দুটোই আসলে অমন। হেসে
জবাব দিয়েছিলো আরমান। তারপর
আয়নায় দাঁড়িয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলো ও, তখন কিছুই খুঁজে পায়নি। কিন্তু এখন জানে, দুচোখের
বিষণ্ণতা গুলো হৃদয়েও ঠাই করে নিয়েছে এইবার। আসমানি ঘুঘুটা ওর হৃদয়ে ঘর বেঁধেছিল, কি
খেয়ালে আবার উড়েও চলে গেছে। কিন্তু তার ডানার অবিশ্রান্ত ঝট্পটানি এখনো বুকের মধ্যে টের
পায় আরমান।
(সংক্ষেপিত)
No comments:
Post a Comment