সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে
রাস্তায় এক পা দেয়া মাত্রই মনে হলো ওমন একটা মিথ্যা কথা শিলাকে না বললেও হতো। শিলা আমার স্ত্রী। মিথ্যা কথা গাছের শিঁকড়ের মতো, ভেজা মাটি পেলেই শাখা প্রশাখা বাড়াতে
থাকবে। অপরিকল্পিত মিথ্যা নিয়ে শেকড়ের শাখা
গজানো বেশিক্ষণ ঠেকানো যাবে না। কল দিয়েই দিলাম। দিয়েই মনে হলো আরও একটা ভুল হলো। মাত্র সকাল ৮টা, ছুটির দিন, ওর ও ক্লাশ নিতে যেতে হবে না। আমারও অফিস নেই। স্বভাবতই আমি সিঁড়ি দিয়ে চারতলা হতে
নামতে নামতে ও আবার ঘুমিয়ে পড়তেই পারে। সেই ঘুম ঘুম
অবস্থায় যখন শুনালাম, শিলা তোমাকে আসলে মিথ্যে বলে এসেছি,
তুমি তো জানো আমার অনিদ্রা রোগটা বেড়েছে। স্বপ্নের পরিমাণও বাড়ছে। তোমাকে না বলেই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গিয়েছিলাম। তারই চিকিৎসার অংশ হিসেবে এই সাত সকালে ছুটির দিন বেড়িয়ে পড়া। আমার মোবাইল বন্ধ থাকবে। তুমি কিন্তু চিন্তা করো না।’
হ! আশ্চর্য
তো। চিরচেনা শিলা তো নয়। বৃষ্টির মানে আমার মেয়ের কোচিং মনে আছে কিনা- ওটুকু! আহারে ঘুম। ঘুম মানুষের মাঝে কত পরিবর্তনই না আনে। আর আমার সেই ঘুম নেই। চোখ বুঁজে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা,
একটু ঢুলু ঢুলু ভাব যেই এল এল ভাব অমনি
আর একের পর এক স্বপ্ন। গভীর ঘুমের স্বপ্ন নয়,
সব যেন স্পষ্ট। না ঘুম, না স্বপ্ন। এ এক ভীষণ
অস্থিরতা। প্রতিটা স্বপ্ন ভয়াবহ ভীষণ। এ যেমন, আমি অফিসের ক্যাশ কাউন্টারের ভেতর আমার আসনটিতে বসে আছি। চেক আসছে। পাস করে দিচ্ছি। হঠাৎ চোখ টা একটু কাউন্টারের দিকে ফেরালাম। একটা মহিলা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা কালো ব্যাগ। বোরকার আড়ালে
তার চোখ দুটো একটু দেখা যাচ্ছে
কেবল। ভীষণ সুন্দর দুটি চোখ। আমার সাথে
চোখাচোখি হলো। হঠাৎ মহিলা কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে
কাউন্টারের দিকে ছুঁড়ে দিলো। মুহূর্তে ভীষণ
শব্দ, সব
অস্পষ্ট। আর আমার চোখ খুলে গেলো। ঘুম টলে গেলো। আবার ঘুমের
চেষ্টা করলাম। আবার স্বপ্ন-
এবার পট ভিন্ন;
আমি আর শিলা হাঁটছি। তার সুন্দর হাত দুটো আমার হাতে বন্দি। একটা বাগান পেরিয়ে আমরা একটা বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটছি। সরু বাঁধ। হঠাৎ বাঁধের দুদিক থেকে দুটি বড় বাঘ
দৌঁড়ে আসতে দেখলাম। শিলা কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে তার হাত ছুটে গেলো । সে নিচের
জলাধারে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। আর একটা বাঘ
আমাকে কামড়ে পেটে পুড়ছে। আমি বাঘের পেটে থেকে বের হবার জন্য
চিৎকার করতেই, চোখ খুলে গেলো। কিংবা হয়তো
স্বপ্ন এমন, আমি দুপুরের লাঞ্চ করতে অফিস থেকে বের হয়েছি। রেষ্টুরেন্টে খেয়ে হেলে দুলে একটা সিগারেটে আয়েশ করে টান
দিতে দিতে (যদিও
আমি সিগারেট খাইনা) অফিসের গেটের কাছে যেই পৌঁছালাম ওমনি ম্যানেজারের গলা শুনতে
পেলাম। দরজা খুলে সে এগিয়ে আসছে। তার সাথে কালো পোশাকের দুজন ভয়ংকর লোক। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে ফেললো। ম্যানেজার বলছে, এই এই ব্যাটাই ক্যাশ থেকে ১ লাখ সরিয়ে
একটু আগে বাইরে পাচার করেছে। আমি কেঁদে উঠি,
চোখ খুলে যায়। এমনি শত শত স্বপ্ন।
এসবই পরশু সাইকিয়াট্রিস্টকে বলেছি। সব শুনে তিনি
বলেছেন, পারিবারিক
ব্যস্ততা, অফিসের
অমানুষিক কাজ আর পত্রপত্রিকায় ও অনলাইনে অস্থির সব খবরাখবর বারংবার পড়তে পড়তে আমার
ব্রেন অতিরিক্ত পরিমাণ চাপ সহ্য করছে। এর একটাই সমাধান-
নিজের জন্য
সকল প্রকার সোশাল মিডিয়ার ঘোরফেরা এবং
মোবাইল বন্ধ রেখে কেবল নিজের জন্য নিজের মত করে কিছুটা সময় হলেও ব্যয় করতে হবে।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন সকালে সেই একক কিছুটা সময় ব্যয় করার জন্যই বের হয়েছি। বড় রাস্তায় পৌঁছানোর আগেই মোবাইলটা বন্ধ করেছি। এটুকুন পথ আসতে আসতে ভেবে নিয়েছি কোথায় যাব। ছোট বেলায় খুব প্রিয় জায়গা ছিলো চিড়িয়াখানা। পশুপাখী বন্দি বিষয়টা আমার ভালো লাগে না যদিও তবু ওদেরকে
বন্দি না করলে তো আমরা ওদের সান্নিধ্য পাবো না। মানুষ হবার এটাই লাভ, নিজের স্বার্থে আমরা জগতের সব স্বার্থকে হত্যা করতে পারি। জ্যাম এর পরিমাণ ২৫ শতাংশ হলেও আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে
পৌঁছে যাব। ঐ তো বাস আসছে। বাসটার দিকে তাকিয়ে আছি।
হঠাৎ একটা শব্দ। আঁতকে ওঠার মত। ডানের গলিটা থেকে একটা গাড়ি বের হচ্ছিলো। বাসটাও গলিটা পার হচ্ছিলো সজোড়ে চালিয়ে দ্রুত স্ট্যান্ডে আসার জন্য। ওটার পেছনে একই সিরিজের আরেকটা বাস ওটাকে ওভারটেক করে আগে
আসতে চাচ্ছিলো। এই তাড়াহুড়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষ। বাসটা ব্রেক করে কুলাতে পারে নি। পাঁচ হাত সামনে ছিটকে পড়লো সাদা প্রাইভেট টা। আঁতকে উঠলাম। স্বপ্নে বুঝি নতুন মাত্রা যোগ হলো। ছুটে গেলাম। ড্রাইভার একা
মনে হলো। তার তখনও জ্ঞান আছে।
কিন্তু একি, এযে আমার সাইকিয়াট্রিস্ট! নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। এই সাত সকালে এখানে। দূর কত কাজেই আসতে পারেন এই আদাবরে। ওনার তখনও ভালোই জ্ঞান আছে। আমাকে চিনতে
পারলেন। আরে এহাস সাহেব না। আমি হ্যাঁ বলে আরও এক দুজনের সহায়তায় ওনাকে একটা সিএনজি ডেকে হাসপাতালের
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
আমাকে চিনতে পারলেন। আরে এহসান
সাহেব না। আমি হ্যাঁ বলে আরও এক দুজনের সহায়তায় ওনাকে একটা সিএনজি ডেকে হাসপাতালের
উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
নিজের জন্য নিজের মতো করে একটা
দিন কাটানো হলো না। হাসপাতালে কতক্ষণ লাগে থাকতে হয় কে জানে। তার উপর পুলিশ এসে যদি
আরও সময় কিছু ছিনিয়ে নেয়। তিনটার আগে ফিরতে পারবো তো?
ফিরতে পেরেছিলাম তিনটার আগে। তবে
একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে। ডাক্তারের দু'হাতেই
হালকা ফ্রাকচার হয়েছে আর মাথায় গালে কপালে কিছুটা কাটাকুটি। সিরিয়াস তেমন কিছু
হয়নি, বেঁচে গেছেন সে যাত্রায়। সিএনজিতে বাম হাতটা একটু নাড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের
করে দিয়ে বলেছিলেন, এহসান সাহেব দয়া করে দুটো কল
করে দিবেন। একটা দেখেন ‘বউ’ নামে সেভ করা আছে। ওকে কল করে বলবেন সিরিয়াস এক্সিডেন্ট
করেছি, হাসপাতালে আসতে বলবেন। আর পরেরটা কল দিয়ে একটু আমার কানে ধরেন। ওর নামটা পিএটিয়াইইএনটি-১ নামে সেভ করা আছে।
পরের নম্বরটিতে কল দিয়ে যখন ডাক্তারের
কানে দিলাম, উনি ফিসফিসিয়ে বললেন, তোমার বাসা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় আসতেই একটা বাসের
ধাক্কায় এই সামান্য একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে । তেমন কিছু না। রিয়া আসছে। তুমি চিন্তা
করো না। রিয়া চলে গেলে আমি জানাবো।
আমি বুঝলাম যা বোঝার। বুঝলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরই তো নিজের কোন সময় নেই। ঘর ওয়ালি আর বাহার ওয়ালির চক্করে তা তার জীবনই
নির্ঘুম।
No comments:
Post a Comment