তেইশ-চব্বিশ
বছরের দাম্পত্য জীবন। এখন মনে হচ্ছে কত ঠুনকো। সেই কথা শোনার পর সারারাত
ঘুমে-আধো-জাগরনে পার করে ঘড়ি দেখে সোয়া তিন। নিস্তব্ধ গভীর রাত। ভোর রাত। মশারির
বাইরে মশার ভন ভন গান। তখনো কানে বাজছে ভয়ংকর শব্দরাশি।
‘তার নাম
কী ছিল?’
‘নাম কি
ছিল জানা নেই, আমি দিয়েছিলাম। আমাদের পাড়ায় এক বদ ছোড়া ছিল, আলম; ওর নামে নাম
রেখেছিলাম। বুঝলে আমাদের আলম কিন্ত বেশ শান্ত। একদিন ওর সাথে ভাব হয়ে গেল খুউব।
আমাকে ভালবাসত।’
‘যেমন?’
‘এই ধরো
স্কুল থেকে আসার পর গা ঘেষে দাঁড়াত। গল্প করত। এইসব আর কি?’
‘কত দিন
মানে কত বছর ছিল তোমাদের বাসায়?’
‘বছর
নয়...দু-আড়াই মাস।’
‘তুমি
কোন্ ক্লাসে পড়তে তখন?’
‘সেভেন
এইট...এত জিজ্ঞেস করছ কেন? গাধা কোথাকার?’
তারপর গল্পে গল্পে সেই গল্প বের হয়ে আসে। রমযান শেষের কোনো এক বিকেল। বাবা বাড়িতে নিয়ে আসে ওকে। বড় লাজুক। চোরা চোখে সকলকে চিনে রাখে। বাড়ির উত্তর দিকে একলা ঘর। সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। ওই ঘরে প্রায় যাই। কথা বলি। গল্প করি। বড় মায়াবী চোখ তার। গভীর। দীঘির কালো জল। একদিন ওর সাথে বেশ ভাব হয়ে গেল।
‘ও
তোমাকে ভালবাসত না?’
‘হ্যাঁ।
তা তো ভালবাসত।’
‘তখন
তুমি কিশোরী। দেখতে শুনতে নতুন গোলাপ কুঁড়ি।’
‘আ রে
গল্প শোনো না। দু-মাসের মধ্যে সেই শুকনো পাতলা আলম বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেল। আমার
সঙ্গে গল্প করে। হেসে হেসে কথা বলে।’
‘কী
কথা?’
‘এই রুমা
চল দিঘির দিকে যাই। ওখানে অনেক পদ্ম ফুটে আছে।’
‘তারপর
যেতে?’
‘হ্যাঁ।
গাছের ছায়ায় বসে বসে গল্প করতাম। খেলতাম। বিকেল পর্যন্ত থাকতাম। ও না আদর করে গালে
চুমু খেত। চেটে দিত।’
‘আর কি
কি করতে?’
‘বলব না।
তোমার মন খারাপ হবে।’
তারপর
নিশ্চুপ সময়। একটি কথায় এত কাছের মানুষ কত দূরের হয়ে গেল! রাত পেরিয়ে গেল হাজার
চিন্তায়। দুশ্চিন্তায়। সে ঘুমিয়ে থাকে। নিশ্চিন্ত। নাকডাকার মিহি সুরে বরে যায়
ঘরের চারপাশ। এদিকে রাত্রি জাগরণ। সকাল হয়। পাখি ডাকে। রুমা স্টোভে আগুন জ্বালে।
সেই আগুন বুকে এসে ধাক্কা মারে। মাথা থেকে কিছুতেই গল্প যায় না। বুকের মধ্যে জমে
উঠছে সন্দেহ ক্ষোভ। আগুনের লেলিহান শিখা। বাকিটুকু কীভাবে শুনি বুদ্ধিও পাই না।
নিশ্চল পড়ে আছি আলোকিত দিনের অন্ধকার ঘরে। রুমা একসময় কিচেন থেকে ফিরে এসে বলে
উঠে।
‘কি
ব্যাপার...এখনো শুয়ে আছো? অসুখ করল না তো?’
সে কপালে
হাত রাখে। বুকের উপর। চোখে-মুখে উদ্বেগ। কখনো দুষ্টুমি হাসি।
‘কই না
তো! শরীরে তো তাপ তেমন নেই। শোনো এখন সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। সাবধানে থাকবে। আচ্ছা মাথা
ধরেছে নাকি? টিপে দেব?’
‘না না
শরীর ঠিক আছে, মন ঠিক নেই।’
‘মনের
আবার কী হলো?’
‘আচ্ছা
রুমা একটা কথা বলি। আমাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় তেইশ-চব্বিশ বছর তাই না?
‘হবে
হয়তো। আমার মনে নেই। কেন?’
‘কোনোদিন
সেই লোকের কথা বলো নাই। তোমার ভালবাসা ছিল। ওকে বিয়ে করলে না কেন? আমাকে ঠকালে।’
‘কি বলছ?
কার কথা বলছ?’
‘সেই
তোমাদের বাড়িতে যে ছিল, আলম।’
‘ও তাই
তো! তুমি জানতে না?’
‘না একদম
না...জানলে তোমার সাথে বিয়ে হয়?’
‘কেন
তুমি তো পাশের বাড়ির মেয়ের সাথে কত ভাব জমিয়েছিলে। আর আমি একটু করলেই দোষ?’
‘এ কথা
তোমাকে কে বলল? সে তো কোনো প্রেম নয়। এই একটু চোখাচোখি...জানাশোনা। তুমি যে কী
ভাবো?’
‘তুমিই
বলেছিলে। মেয়েটি নাকি কাঁদছিল তোমার বিয়ের কথা শুনে।’
‘কি জানি
হবেও বা...আমার মনে নেই। কিন্ত তোমার কথা জানলে...।’
‘বিয়ে
করতে না। তোমরা এই পুরুষরা বিয়ের আগে দশটি গার্লফ্রেন্ড রাখবে। প্রেম করবে। আর
স্ত্রীর একটি ফ্রেন্ড থাকলেই দোষ। কেন?’
‘তোমার
সাথে তর্ক করতে চাই না। ইশ্ আমার জীবন শেষ করে দিলে। আমার শুধু নয়, তিনটা জীবন।
আমি-তুমি ও সে।’
‘আসলে
পুরুষ মানুষ বিয়ের আগে কতগুলো লটরপটর করবে কোনো দোষ নেই। তারপরও ভার্জিন বউ চাই।
তাই না?’
‘তোমার
সাথে দর্শনের গল্প করতে চাই না। আমার রাগ হচ্ছে কিন্তু।...বলো তো লোকটা কোথায়
থাকে? ঠিকানা দাও। নিশ্চয় দেখা-টেখা হয়। না হলে কথাবার্তা?’
‘তুমি
কিন্ত ক্ষেপেছ। জেলাস।’
‘আমাকে
ঠকানো হয়েছে। হতাশ লাগছে। মনে হচ্ছে ট্রাকের নিচে জীবন দিয়ে দিই।’
‘এই
তোমার তেইশ বছরের সংসার! সত্যি ভেরি স্যাড...ভেরি স্যাড। উফ্!’
‘তুমি
বুঝবে না কি যন্ত্রণা হচ্ছে। তোমরা শালা ঠক। চিটারের গুষ্টি।’
‘হি হি
হি! চিটার...ভালো বলেছ।’
রুমা
আঁচলে মুখ চেপে রাখে। বাইরের উজ্জ্বল সকাল ম্লান-বিষাদ। মানুষের মন বড় সন্দিগ্ধ।
রহস্যময়। এত সুফি সুফি চেহারা মানুষের...ভেতরে গরল। এমন দুনিয়ায় বেঁচে থেকে কি
লাভ? সে বের হয়ে যায়। রুমা দরজার কাছে। হাসতে হাসতে বলে, -
‘আরে
যাচ্ছ কোথায়? চা খাও। আলম তো গরু। বাবা কোরবানির জন্য এনেছিল। তুমি কি ভেবেছিলে?
গাধা কোথাকার!’
____________
No comments:
Post a Comment