রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা এমনি বিচিত্র ছিলো যে, বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে সর্বব্যাপি আলোকদ্যুতি নিয়ে তা একাই যেন একশো হয়ে তাঁর সমকালকে সুদূর ভবিষ্যতে প্রসারিত করেছে। রবীন্দ্রনাটকের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। নাট্যব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ যখন নাট্যসাহিত্যে সৃষ্টিকর্মে ব্যাপৃত হলেন চমকে দিলেন বিশ্বের নাট্যামোদী সম্প্রদায়কে। প্রথানুসারী সৃষ্টি নয়, একেবারে নতুন এক সৃষ্টির ধারা। রূপক ও সাংকেতিক এই ধারার উদ্গাতা তিনি স্বয়ং। সৃষ্টি করলেন একেবারে নতুন কালজয়ী এই ধারায় অনবদ্য কিছু নাটক, বিশ্ব মোহিত হলো বিস্মিত হলো। প্রসঙ্গত স্বীকার করে নিতে হয় তাঁর সৃষ্ট এই নাট্যধারার উত্তরসূরি কিন্তু আর পাওয়া যায়নি। তাতে শুরু হয়ে তাতেই থেমে রইলো তাঁর সৃষ্ট নাট্যরীতি। তাঁর নাটকগুলির মধ্যে রক্তকরবী অনেকানেক নাট্য সমালোচকের মতে শ্রেষ্ঠ সাংকেতিক নাটক। বহু সমালোচিত, বহু অভিনীত, বহুজন বন্দিত রক্তকরবী আজো এই একুশের শতকে জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে আছে।
সাহিত্যের নানা বিভাগের মধ্যে নাট্যসাহিত্যের একক মহিমা হচ্ছে এটি দৃশ্যকাব্য। তাই এই সাহিত্যের আস্বাদন একক ব্যক্তিত্বের সীমানায় আবদ্ধ নয়, গণসমষ্টির দ্বারা অভিনয়ের, মঞ্চায়নের নানা কলাকৌশলের মাধ্যমে অভিনেতা - অভিনেত্রীর সক্রিয়তায় তা আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে। তাই নাটক জটিলতর সাহিত্য মাধ্যম।
'রক্তকরবী’ নাটকের পটভূমি ধরা হয় ইউরোপ জুড়ে
মহাযুদ্ধের পরবর্তী অবস্থাকে কেন্দ্র করে। এ যেন যুদ্ধপরবর্তী পৃথিবীর এক
মানচিত্র। নাটকটি প্রথম রচিত হয় ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে। ‘রক্তকরবী’র প্রথম নামকরণ
হয় ‘যক্ষপুরী’। নামকরণ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে, বর্তমান আলোচনায় এই প্রসঙ্গ বর্জিত
হবে। কারণ প্রসঙ্গটি বহুল আলোচিত। এই আলোচনার উদ্দেশ্য অন্য। শিলংয়ের
শৈলাবাসে একবার বাসকালে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন এই কিংবদন্তী সদৃশ নাটকটি।
নাট্যসমালোচক শিশির কুমার দাশের ভাষায়, মানুষের প্রবল লোভ কিভাবে জীবনের সমস্ত
সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে
পরিণত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কী রূপ ধারণ করেছে তারই রূপায়ণ
‘রক্তকরবী’ নাটকে।অভিনেতা শম্ভু মিত্র ও তাঁর পত্নী তৃপ্তি মিত্রের ক্লাসিক
অভিনয়ধন্য 'রক্তকরবী ' নাটক রবীন্দ্রসৃষ্ঠ শ্রেষ্ঠ নাটক বলে বহু সমালোচক মনে
করেন।
গীতিধর্মী এ নাটকে একটিমাত্র বিষয় নাটকের কেন্দ্রীয়
পাঠ। একটি কারাগার। রাজার নাগপাশে বন্দী একদল লোক। এরা প্রত্যেকেই প্রচলিত সমাজের
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-গোত্র আর স্তরে স্তরায়িত। প্রকৃতির নিয়ম কিংবা সমাজের
অপরিহার্য বাস্তবতায় এ নাগরিকবৃন্দ যেন প্রত্যেকেই লোভ-লালসা-প্রথা-সংস্কার আর
ভয়ের জালে আটকা পড়া একেকটি জীব। যক্ষপুরীতে শ্রমিক দল মাটির তলা থেকে সোনা তোলার
কাজে নিযুক্ত। চালানো হচ্ছে তাদের ওপর চলে নির্বিচারে নির্যাতন। জটিল আবরণের
আড়ালে থেকে রাজার নির্দেশ পালনে ব্যস্ত সেনাপতি সহ অন্যরা। এই অন্ধ ভূমিগর্ভ
জীবনের মধ্যেই হঠাৎ ফুঁড়ে উঠে প্রেম। এই প্রেম আসে নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র
নন্দিনীর রূপ ধরে। নন্দিনী সকলকে হাতছানি দিয়ে আলোর পথে ডাকছে, ‘তোমরা চলে এসো,
চলে এসো।’ নন্দিনী ও সুড়ঙ্গ খোদাই বালক-কিশোরের কথোপকথন দিয়ে শুরু হয়
রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী নাটক ‘রক্তকরবী’।
যে সময়ে রক্তকরবী রচিত ও মঞ্চস্থ হয় সে সময়টা
গণনাট্য আন্দোলনের প্রখর কাল। নাটকে রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রসভ্যতার অমানবিক নির্যাতিত
মানুষের মুক্তি সম্পদের পর্বততুল্য আহরণে নয়, মানবপ্রেমে এটাই যেন প্রকাশ করতে
চেয়েছেন। সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে তাই নন্দিনী প্রেমের প্রতিমূর্তি হয়ে আবির্ভূত।
সবাই তাকে চায়। রবীন্দ্রনাথ যন্ত্র সভ্যতার বিপক্ষে গিয়ে কৃষিসভ্যতার জয়জয়কার
গেয়েছেন। শ্রমিকের আত্মঘাতী শ্রমের বিকল্প কৃষিসভ্যতা, তার প্রতীক রক্তকরবী ফুল। সমকালের
প্রেক্ষিতে তাহলে তিনি কি গণনাট্য সৃষ্টি করেছেন রূপক ও সাংকেতিক আঙ্গিকে
প্রশ্ন জাগে। সহজ কথায় কোন কোন সমালোচকের অভিমত অনুসরণে প্রশ্ন ওঠানো যায়
রক্তকরবী কি গণনাটক? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে প্রথমে জানতে হবে গণনাটকের সংজ্ঞা
কি, বৈশিষ্ট্যই বা কি।
গণনাটক বলতে কি বুঝায় তা বলতে গিয়ে অধিকাংশ
নাট্যতত্ত্ববিদ্ বলেন, শ্রমিক কৃষকের দুঃখ বেদনা আশা আকাঙ্ক্ষা আনন্দ ও সর্বোপরি
তাদের সংগ্রাম যে নাটকে রূপায়িত হয় তাই গণনাটক। কেউ আবার বলেন যেভাবেই হোক জনগণের
স্বার্থ যে নাটকে প্রতিফলিত হয় তাই গণনাটক। আবার ভিন্ন মতে গণনাটকের নায়ক হবেন
আদর্শ কমিউনিস্ট। অন্যমতে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের যে চরম অবক্ষয়
পরিলক্ষিত হয়, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের স্ফুরণ দেখায় যে নাটক তাই গণনাটক। এই বিচারে
এই মতাবলম্বীরা রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীকে একটি সার্থক গণনাটক বলেন। অবশ্যই একথা
যাঁরা বলেন তাঁদের সম্পর্কে সবিনয়ে বলা যায় অন্ধ রবীন্দ্র-ভক্তিই এখানে প্রাধান্য
পেয়েছে, বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণী ক্ষমতা নয়।
গণনাট্যের লক্ষণগুলি বিচার না করলে তার স্বরূপ
নির্ণয় সম্ভব হবে না। বিশিষ্ট তাত্ত্বিকগণ এর লক্ষণনির্ণয় করতে গিয়ে বলেন,
গণনাট্যের লক্ষণ হবে — ১. শোষিত বা সর্বহারা শ্রেণীর
দৃষ্টিভঙ্গি, ২.শ্রমজীবী মানুষের নিজ অভিজ্ঞতার উপর প্রযুক্ত বোধগম্য বিষয়বস্তু,
৩.এই শ্রেণীর বোধগম্য আঙ্গিক এবং ৪. তাদের বোধগম্য ভাষা। এই লক্ষণগুলো নিয়ে
সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যেতে পারে।
শোষিত বা সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে নাট্যকারের
সেই বোধ যার দ্বারা তিনি অনুভব করতে পারেন সমাজের মূল দ্বন্দ্ব কি এবং সেই
দ্বন্দ্বের দুপক্ষে কাদের অবস্থান। অর্থাৎ কোন শক্তি কোন অবস্থানে আছে। কেনই বা
সমাজের শোষিত শ্রেণী শ্রমিক কৃষক এবং এই জোট কেন সমাজের জীর্ণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে
নতুন ব্যবস্থা গড়ার চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। কিভাবেই বা শোষণ বিহীন নয়া সমাজ ব্যবস্থা
গড়ে উঠতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, উৎপাদন ও বণ্ঠণব্যবস্থা, শাসকশ্রেণীর চরিত্র
এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর চরিত্র না জানলে নাট্যকারের স্বচ্ছ বোধ গড়ে ওঠে না।
তীব্র সংকটপূর্ণ বর্তমান সমাজব্যবস্থা আর ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র
অবক্ষয়ের যুগে সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধ না থাকলে সৃষ্টিকর্ম মাত্র আবর্জনা হতে
বাধ্য। চেতনা সমৃদ্ধ নাট্য সৃষ্টি জনমানসে চেতনা ও বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে।
বিষয়বস্তু হতে হবে জনসমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে
সাযুজ্য যুক্ত। গণনাটকের বিষয়বস্তু জনজীবন থেকেই আহৃত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নাহলে তা
গণমানসে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে কৃত্রিম পণ্যে পর্যবসিত হয়। তাই গণনাটকের বিষয়বস্তু
গণমানুষের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে।
গণনাট্যে বিশাল পুঁজিপতি নায়ক হতে পারে কিনা প্রশ্ন
উঠতে পারে। যেহেতু পুঁজিপতি সমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তি নয়, তাই অবশ্যই হতে
পারে। সাধারণ মানুষ ও পুঁজিপতির জীবনে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গণমানুয ও
পুঁজিপতির যুগ্ম সম্পর্কে একটা উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এতে পুঁজিপতি সমস্ত
সম্গদের অধিকারী হয় আর জনজীবনে আসে চরম দুর্গতি ও বিড়ম্বনা। আর এই অভিজ্ঞতা
সাধারণ মানুষের জীবন বহির্ভূত নয়।
গণনাট্যের আঙ্গিক সহজ সরল হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু
গণমানুষের জন্য নাটক, তাদের শিক্ষার মান নিম্ন, তাই আঙ্গিকে সহজ সরলতার দরকার।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে ' Form reflects a way of life ' অর্থাৎ শিল্পের আঙ্গিকের
মাঝেই আছে এক বিশেষ জীবনধারার প্রতিফলন। তাই. আঙ্গিক জটিল হলে জনমানসে তার প্রভাব
তেমন মর্মস্পর্শী হতে পারে না।
গণনাটকের ভাষাও হবে সহজ সরল অনাড়ম্বর। সহজ সরল
অনাড়ম্বর আটপৌরে ভাষা, এই ভাষা সহজবোধ্য হবে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ জটিল ভাষা জনমানসে
বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট ভাষা বর্জনীয়। সৃজনশীল
ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ ও তাৎপর্যবহ সুমিত ভাষার ব্যবহার সহজ সরল হলেও জনমানসে অর্থবহ ও
আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। তখন নাট্যকারও শিল্প সৃষ্টিতে সার্থক হবেন।
উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়
গণনাট্য সম্পর্কিত লক্ষনসমূহের সার্থক প্রয়োগের মাত্রার উপরই নির্ভর করে গণনাট্যের
সর্বোচ্চ সফলতা বা ব্যর্থতা। রক্তকরবী গণনাট্য কিনা, এর সাফল্য বা ব্যর্থতা কেমন
তা বিচার করার আগে এই নাটক নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা প্রথম শুনে নেওয়া যাক। এই
নাটকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, " কর্ষণজীবী ও আকর্ষণজীবী এই দুই
জাতীয় সভ্যতার মধ্যে একটা বিষম দ্বন্দ্ব আছে এ সম্বন্ধে বহু মহলে আমি প্রায়ই
আলোচনা করে থাকি। কৃষিকাজ থেকে হরণের কাজে মানুষকে টেনে নিয়ে কলিযুগ কৃষিপল্লীকে
কেবলই উজাড় করে দিচ্ছে। তাছাড়া শোষকজীবী সভ্যতার ক্ষুধা তৃষ্ণা স্বেদ হিংসা
বিলাসবিভ্রম সুশিক্ষিত রাক্ষুষেরই মত।...নবদূর্বাদল
রামচন্দ্রের বক্ষলগ্ন সীতাকে স্বর্ণপুরীর অধীশ্বর
দশানন হরণ করে নিয়েছিল,সেটা কি সেকালের কথা, না একালের? সেটা কি সেকালের কবির কথা,
না একালের? সেটা কি ত্রেতাযুগের কবির কথা, না আমার মত কলিযুগের কবির কথা? তখনো কি
সোনার খনির মালিকরা নবদূর্বাদলবিলাসী কৃষকদের ঝুঁটি ধরে টান দিয়েছিল? "
“আর একটা কথা মনে রাখতে হবে। চাষী যে দানবীয় লোকের
টানেই আত্মবিস্মৃত হচ্ছে , ত্রেতাযুগে তারই বৃত্তান্তটি গা - ঢাকা দিয়ে বলবার
জন্যেই সোনার মায়ামৃগের বর্ণনা আছে। আজকের দিনের রাক্ষসের মায়ামৃগের লোভেই তো
আজকের দিনের সীতা তার হাতে ধরা পড়েছে। নইলে গাঁয়ের পঞ্চবটচ্ছায়াশীতল কুটির ছেড়ে
চাষীরা টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসবে কেন? " রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্য
অনৈতিহাসিক ও অবাস্তব বলাটা অসঙ্গত হবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ ' রক্তকরবী'র
বিষয়বস্তু আলোচনা করতে গিয়ে অন্যত্র বলেছেন, আধুনিক সমস্যা বলতে কোন পদার্থ
নেই, মানুষের সব গুরুতর সমস্যাই চিরকালীন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন রামায়ণ ও
'রক্তকরবী'তে একই সমস্যারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সহজ কথায় কৃষিসভ্যতা আর
যন্ত্রসভ্যতার মধ্যেকার সতত বিরাজমান এক জটিল দ্বন্দ্ব। এক্ষেত্রে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন
অনুভূত হয়। সেটা মেনে নিলে বলতে হয় 'রক্তকরবী' র নন্দিনী কৃষি সভ্যতার প্রতীক এবং
যক্ষপুরীর মকররাজ যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক। ঠিক তেমনি রামায়ণের রাম ও রাবণ যথাক্রমে
কৃষিসভ্যতা ও যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক। 'রক্তকরবী ' আধুনিক নাটক বলে এতে
যন্ত্রসভ্যতার কথা আসা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু রাবণ যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক হতে পারে
না। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর যন্ত্রসভ্যতা বা ধনতান্ত্রিক
সভ্যতার উদ্ভব হয়। তাই রাবণকে যন্ত্রসভ্যতার প্রতীক বলা ইতিহাস বিকৃতি। রাবণ
কৃষিসভ্যতার অগ্রবর্তী সভ্যতা দাস সভ্যতার প্রতীক। অনুন্নত দাস ব্যবস্থা
ধ্বংস করে রামচন্দ্র আপেক্ষিক উন্নত ভূস্বামীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাই বলা যায়
মানব ইতিহাসের সমস্যা চিরকালীন এক নয়। রামায়ণ যুগের সমস্যা আর বর্তমান যুগের
সমস্যার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।
ইতিহাস বলে উন্নত সভ্যতার পাশে যদি অনুন্নত সভ্যতা
অবস্থান করে তাহলে উন্নত সভ্যতা কালক্রমে অনুন্নত সভ্যতাকে গ্রাস করে, পরাজিত করে।
দুটি ভিন্নধর্মী সমাজব্যবস্থা পাশাপাশি অবস্থান করলে তাদের মধ্যে নিয়ত সংঘর্ষ ঘটে
এবং কালক্রমে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা বিজয় লাভ করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যন্ত্রসভ্যতা
কৃষিসভ্যতার চেয়ে উন্নততর সভ্যতা। কৃষিসভ্যতায় সামন্তবাদী প্রভুরা তাদের জমিতে
কৃষকদের ক্রীতদাসদের মত কাজ করাতো। অপেক্ষাকৃত উন্নত যন্ত্রসভ্যতায় সেই দাস
কৃষকেরা মুক্তি পেলো এবং তাদের কলে কারখানায় নিযুক্ত করা হলো। তাদের পরিচয় দাস
থেকে শ্রমিক হলো। তাদের পরিচয় হলো মানুষ। 'রক্তকরবী' তে কৃষিসভ্যতার কাছে
যন্ত্রসভ্যতার যে পরাজয় অঙ্কিত হয়েছে তা ঐতিহাসিক সত্যকে বিকৃত করে, সভ্যতার
ক্রম পর্যায়ের বিন্যাসকে অবিন্যস্ত করে।
যন্ত্রসসভ্যতা রবীন্দ্রনাথের কাছে মানবজীবনের
অভিশাপ। যন্ত্র মানুষের সকল অনুভূতিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে তাকে, শ্রমিককে একটি
সংখ্যায় পরিণত করে। মনুষ্যত্বহীন নিষ্প্রাণ কতগুলি সংখ্যা। তাদের বসবাসের স্থান
কতগুলি বর্ণ চিহ্নিত মাত্র। কিন্তু যন্ত্র মানুষকে অমানুষ করে না, তা করে বিশেষ
সামাজিক পরিকাঠামো। যে সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু লোক উৎপাদনের সকল উপায়গুলিকে
করায়ত্ত করে সকল সম্পদ ভোগ করে। যন্ত্র আসলে মানুষের অতিরিক্ত শ্রম কমিয়ে তাকে
অবসর দেয়, শিক্ষাদীক্ষা, শিল্পচর্চার সুযোগ দেয়। মনে হয় শ্রেণী বিভক্ত সমাজের আসল
অসুখটি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এতে বিস্ময় জাগে। যে সময়ে ' রক্তকরবী '
লেখা হয়েছে তখন রবীন্দ্রনাথের কাছে সমাজের প্রকৃত সত্য ধরা না পড়াটা বিস্ময়কর
বটে।
শ্রেণী সংঘর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের
ধারণা অস্পষ্ট ছিলো অনুমান করা যায় যখন দেখা যায় নাটকটির রাজা ও শ্রমিককে একই
যন্ত্রব্যবস্থায় পীড়িত ও যন্ত্রণাহত হতে। শোষক ও শোযিতকে তিনি একই সারিতে
প্রতিস্থাপন করেছেন। রাজা ও শ্রমিক উভয়েই একই যন্ত্র শাসন থেকে মুক্তির জন্য সে কী
প্রাণপন ছটফট করে। যন্ত্রসসভ্যতা শ্রমিক শ্রেণীর কাছে শোষণ নিপীড়নের যন্ত্র হলেও,
মালিকশ্রেণীর কাছে তা বিলাস বৈভব, অফুরন্ত সুখের উৎস, শিক্ষা দীক্ষা লাভ, শিল্পকলা
সৃষ্টি ও আস্বাদনের উৎস। সুতরাং নাটকটির শেষে রাজা শ্রমিক সকলের শোষণ ব্যবস্থাটিকে
ভেঙ্গে চুরমার করার ঐক্যবদ্ধ অভিযান অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক ভাববাদী ভাবনা বললে
অত্যুক্তি হবে না।
রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন কৃষিকাজে
শ্রী ছিলো, শান্তি ও সমৃদ্ধি ছিলো। কলিকালের যন্ত্রসভ্যতা কৃষকদের যন্ত্রসভ্যতার
সর্বনাশা নিপীড়নের মাঝে জোর করে টেনে আনা হয়েছে। ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে।
হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় কৃষক জমিদার, জোতদারের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও শোষণে
নিপীড়িত হয়েছে, ঋণভারে কুঁজো হয়েছে, মিথ্যা মামলায় ভূমিহীন হয়েছে। ক্ষুধার্ত
অন্নহীন কৃষক একমুঠো ভাতের আশায় নগরমুখীন হয়ে কল কারখানার শ্রমিক হয়েছে। ইতিহাস
এমনি সত্যের প্রমাণ দেয়।
'রক্তকরবী'কে গণনাটক বলা সঙ্গত হবে
না। তত্ত্বগত দুর্বলতা এর পরিপন্থি হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর এই দুর্বলতার
কারণ বুঝতে হলে রবীন্দ্র - মানসের স্বরূপ সংক্ষেপে হলেও বুঝতে হবে।তিনি আজন্ম
ঔপনিষদিক আবহাওয়ায় লালিত, পালিত ও বর্ধিত। মানবমুক্তির বিষয় তিনি সমাজ সংসার থেকে
মানুষকে বিশ্লিষ্ট করে বিচার করেন। তাঁর ভাবনায় রাজা প্রজা সকল মানুষই মুক্তি
পিপাসু। তিনি ভাবেন বিশ্ব সংসারের সবাই আত্মোপলব্ধির জন্য পিপাসার্ত। মানুষের
চিত্ত বন্ধনহীন, প্রাণ চিরমুক্ত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কোন ব্যবস্থাই তাকে
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সাময়িক শোষণ পীড়ন পেরিয়ে তা রক্তকরবীর চারার মত আলোর
প্রার্থনায় ঊর্ধ্বমুখী হবেই। পৃথিবীর মাটির সঙ্গে প্রাণের কোন বন্ধন নেই। এই
ভাববাদী আধ্যাত্মিক দর্শন নাটকটিতে যেন এক কৃত্রিম বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে।
রবীন্দ্রনাথের সর্বহারা বা শোষিত শ্রেণীর
দৃষ্টিভঙ্গি না থাকায় ' রক্তকরবী'র বিষয়বস্তু গণনাট্যের বিষয়বস্তু হয়নি। এর আঙ্গিক
ও ভাষাও গণনাট্যের উপযোগী নয়। জালের আড়ালে সোনা সঞ্চয়কারী এক রাজা থাকেন, কোথা
থেকে আসে নন্দিনী নামে এক মেয়ে, সে কে? সাধারণ মানুষ সব বুঝতে চায়, পারে না। এই
রূপক -সাংকেতিক নাটক তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পাত্র - পাত্রী, ভাষা সবই তাদের
নাগালের বাইরে। কাজেই কোন অবস্থায় ' রক্তকরবী ' গণনাট্য নয়।
লেলিন বলেছিলেন যে, সাহিত্য
ক্ষেত্রে সব যুগের শ্রেষ্ঠ রীতিগুলিকে আমাদের জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং
মর্যাদা দিতে হবে। সন্দেহ নেই রবীন্দ্র সাহিত্য তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিছু
কিছু বিষয়ে তাঁর সীমাবদ্ধতা থাকলেও, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি যে স্তরে উন্নীত
করেছেন এবং তাঁর লেখায় স্বতোৎসারিত যে শক্তি তা নিঃসন্দেহে শ্লাঘার বিষয়। তাই
সর্বস্তরের মানুষেরই তাঁর সৃষ্টিকে পড়তে হবে, জানতে হবে, প্রগতির স্বার্থে গবেষণা
ও বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে।
_______________
কাজরী,
৬ মার্চ, ২০১৭
No comments:
Post a Comment