25 May 2017

শাকিল রনী





ছোটবেলায় কতো আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজিয়ে আমাদের ভাত খাওয়ানো হতোছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম বউ পাগলমা প্লেটে ছোট ছোট বলের মতো করে ভাত গুলোকে রেখে বলতো, "দেখ কত্তো গুলা বউসব গুলা বউ খাইতে হবেনা খাইলে বউ কষ্ট পাবেকান্না করবে" আমি বেঁচে থাকতে কি বউকে কান্না করতে দিতে পারি গপাগপ খেয়ে ফেলতাম বউ সাজানো ভাত
 কিছুদিন পরে বুঝতে পারি এইসব হলো আম্মুর ধাপ্পাবাজিআমি বলতাম, "মিথ্যা কথাবউ তো শাড়ি পরেএই গুলা বউ না" আমি কি আর মায়ের সাথে পারি সেই ছোট্টবেলায়মা আমি নতুন টেকনিকে মাইগ্রেট করলোসারা প্লেটে আবার ভাতের বল রেখে বলতো, "এইটা আমার জন্য খাবি, এটা তোর আব্বার জন্য, এটা আপুর জন্য, এটা বড় মামার জন্য, এটা ছোট মামার জন্য, এটা... না খেলে আমরা কষ্ট পাবো!" আমি মনে মনে ভাবতাম আমার আত্মীয়স্বজন এতো বেশি কেনতিন চারটা কম হলে কি সমস্যা হতোকাউকে কষ্ট দিতে সায় দিতো না কচি মন
এই টেকনিকও বেশিদিন চালাতে পারে নাই মাতখন ধরলো আরেকটা টেকনিকবারোটা ভাতের বল বানিয়ে প্লেটে রেখে বলতো, "তোর বুকের ভিতরে বারোটা চড়ুইপাখির বাচ্চা আছেতুই না খেলে পাখির বাচ্চা গুলাও খেতে পারবে নাওরা না খেয়ে মারা যাবে" আমিও চড়ুইপাখির বাচ্চা গুলাকে বাঁচানোর জন্য নাক মুখ খিঁচে খেয়ে ফেলতাম
আমাদের খাওয়ানোর জন্য মা কতো কিনা করেছেএকটাই কারণ, যেন অভুক্ত হয়ে না ঘুমাইযেন ক্ষুধা পেটে কষ্ট না পাইযেন বাড়ন্ত শরীরে পুষ্টি পায়আস্তে আস্তে ক্যালেন্ডারের সাথে সাথে আমিও বড় হতে থাকলামনিজের মতো চলতে ফিরতে শিখলামচাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমালামমা ফোন দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতো ভাল আছি কিনাঅবিধারিত ভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নটা থাকতো খেয়েছি কিনা
পৃথিবীতে এমন কোন মায়ের জন্ম হয় নাই যিনি তার সন্তানের অভুক্তের কথা সহ্য করতে পারবেনসম্ভবও নাশুধু মা না পুরো মেয়ে জাতিটাই এমন মায়ার বুনোটে গড়াকোন প্রেমিকাও তার প্রেমিকের অভুক্ত থাকা সহ্য করতে পারে নাকোন বোন ভাইয়ের অভুক্ত থাকাকেএই মেয়ে জাতিটা যদি না থাকতো এই পৃথিবীতে তাহলে হয়তো মায়া মমতা, পারিবারিক বন্ধন সবই উঠে যেতোআমরা পুরুষরা কতোটুকুই বা এই সংসারকে টিকিয়ে রেখেছি!
আজ আমি দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুইয়ে পরে আছিকেমন আছি? এই প্রশ্নে সবসময় বলার চেষ্টা করি, "আলহামদুলিল্লাহ্ভাল আছি" কিন্তু আসলে কেমন থাকি সেটা আমরা যারা দেশ ছেড়ে বাইরে থাকি তারা ছাড়া এটা আর কারো জানা কথা নয়মা ফোন দিলে প্রায়ই ফোন রিসিভ করা হয় নাযতোই বলি, "আলহামদুলিল্লাহ্ভাল আছি" মা কি করে যেন টের পেয়ে যান যে ভাল নাইএখন তাই প্রায় সময় ফোন রিসিভ না করেই ইমোতে ম্যাসেজ দিয়ে বলে দেই, "ভাল আছি মা"
মিথ্যা কথা মহাপাপএই মহাপাপটাই অনেক সময় দিনের পর দিন করে যেতে হয় মায়ের সাথেঅনাহারী দিন গুলোতে বলতে হয়, "বেশ পেট ভরে খেয়েছি" ঈদের দিন নামাজ পরে এসে বলতে হয়, "অনেক মজা করছি, ভাল আছি" শুধু মা নাকোন বোনের সাথে বা বান্ধবীদের সাথে বা সামান্য পরিচিত কোন মেয়ের সাথে কথা বললেও তারা কি করে যেন বুঝে যায় অনেক কিছুএই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েই মনে হয় মেয়েদের দুনিয়াতে পাঠানো হয়
আগে এটা মজা হয় নাই, ওটা মজা হয় নাই বলে খাবার প্লেট সরিয়ে রাখতামএটা খাবো না, ওটা খাবো না বলে মায়ের সাথে কতো না রাগ দেখাতামআজ বুঝি মা কতোটা কষ্ট পেতেনকষ্ট পেতেন না খেয়ে থাকতাম বা কম খেতাম বলেকতো মায়া নিয়ে আমাদের জন্য বছরে বারোটা মাস তিন বেলা রান্না করতেনআর আমরা কতোনা আঘাত দিতাম মাকে সেই খাবার খেতে না চেয়ে
আজ এমন দিন এসেছেযা পাই তাই ই অমৃত লাগেভিনদেশে অতো বাহানা চলে নানিজের রান্না নিজেই করতে হয়এইখানে আপনার কাজ কেউই করে দেবে নারান্না পারতাম দুই তিনটাতাও কোন রকমকিন্তু ঐ যে বললাম মেয়ে জাতিটাই মায়ার জাতিমমতাময়ীর জাতিএমন মমতাময়ীর কাছেই টুকটাক রান্না করা শিখানানান বাহানায় তার আশেপাশে থাকি এই স্বার্থপর আমি একটু শান্তির আশায়সেইসব রান্নার ছবি তুলে মায়ের কাছে পাঠাইমা যে কতোটা খুশি হয় সে শুধু আমিই জানিমাকে বলি এবার দেশে এলে রান্না করে খাওয়াবোমা খুশি হনঅনেক খুশি হন
প্রতিদিন একবেলা রান্না করে দুই একদিন খাইবিরক্ত লাগে খুব রান্না করতেআর মা কি করে যে বছরের পর বছর বিরতিহীন আমাদের তিন বেলা রান্না করে খাওয়াচ্ছেন বুঝি নাঠিক করি মনে মনে, এবার দেশে গেলে যতোটা পারি মাকে খাওয়াবো রান্না করেযাই রান্না করি মা বাবা যে তৃপ্তি নিয়ে খাবেন খুব করে জানি
এখনো মনে আছে এক মা দিবসে মাকে, পাশের বাসার, নিচতলার আন্টিদের নুডলস বানিয়ে খাইয়েছিলামসবাই বলল মজা হয়েছেমায়ের জাতিবলবেই তোঅখাদ্য হলেও কি বললে যে ভাল হয়নিএক আন্টি জিজ্ঞেস করলো, "এতো মজা হলো কি করে" বললাম ভালবাসার রেসিপি দিয়ে বানিয়েছিসবাই হাসলো
বুকের ভিতরে এক সাগর ভালবাসার রেসিপি নিয়ে বসে আছি কবে ফিরবো দেশেকবে দেখবো বাবা মাকে, আপুকেপ্রিয় মানুষ, বন্ধুবান্ধবদেরকবে বাবা মাকে তৃপ্তি করে ভালবাসার রেসিপি দিয়ে রান্না করে খাওয়াবোকতোদূর? আর কতোদূর সেই দিনটা! আরো কতো বছরে পরে...

No comments:

Post a Comment