ছোটবেলায় কতো আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজিয়ে আমাদের ভাত খাওয়ানো হতো। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম বউ পাগল। মা প্লেটে ছোট ছোট বলের মতো করে ভাত গুলোকে
রেখে বলতো, "দেখ কত্তো গুলা বউ। সব গুলা বউ খাইতে হবে। না খাইলে বউ কষ্ট পাবে। কান্না করবে।" আমি বেঁচে থাকতে কি বউকে
কান্না করতে দিতে পারি । গপাগপ
খেয়ে ফেলতাম বউ সাজানো ভাত।
এই টেকনিকও বেশিদিন চালাতে পারে নাই মা। তখন ধরলো আরেকটা টেকনিক। বারোটা ভাতের বল বানিয়ে প্লেটে রেখে বলতো, "তোর বুকের ভিতরে বারোটা চড়ুইপাখির বাচ্চা আছে। তুই না খেলে পাখির বাচ্চা গুলাও খেতে পারবে না। ওরা না খেয়ে মারা যাবে।"
আমিও চড়ুইপাখির বাচ্চা
গুলাকে বাঁচানোর জন্য নাক মুখ খিঁচে খেয়ে ফেলতাম।
আমাদের খাওয়ানোর জন্য মা কতো কিনা করেছে। একটাই কারণ, যেন অভুক্ত হয়ে না ঘুমাই। যেন ক্ষুধা পেটে কষ্ট না পাই। যেন বাড়ন্ত শরীরে পুষ্টি পায়। আস্তে আস্তে ক্যালেন্ডারের সাথে সাথে আমিও বড়
হতে থাকলাম। নিজের মতো চলতে ফিরতে শিখলাম। চাকরি নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমালাম। মা ফোন দিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করতো ভাল আছি কিনা। অবিধারিত ভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নটা থাকতো খেয়েছি
কিনা।
পৃথিবীতে এমন কোন মায়ের জন্ম হয় নাই যিনি তার সন্তানের
অভুক্তের কথা সহ্য করতে পারবেন। সম্ভবও না। শুধু মা না পুরো মেয়ে জাতিটাই এমন মায়ার বুনোটে গড়া। কোন প্রেমিকাও তার প্রেমিকের অভুক্ত থাকা সহ্য
করতে পারে না। কোন বোন ভাইয়ের অভুক্ত
থাকাকে। এই মেয়ে জাতিটা যদি না থাকতো
এই পৃথিবীতে তাহলে হয়তো মায়া মমতা, পারিবারিক বন্ধন সবই উঠে
যেতো। আমরা পুরুষরা কতোটুকুই বা এই
সংসারকে টিকিয়ে রেখেছি!
আজ আমি দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুইয়ে পরে আছি। কেমন আছি? এই প্রশ্নে সবসময় বলার
চেষ্টা করি, "আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল
আছি।" কিন্তু আসলে কেমন থাকি সেটা আমরা যারা দেশ ছেড়ে বাইরে থাকি তারা ছাড়া এটা আর
কারো জানা কথা নয়। মা ফোন দিলে প্রায়ই ফোন
রিসিভ করা হয় না। যতোই বলি, "আলহামদুলিল্লাহ্ ভাল আছি"
মা কি করে যেন টের পেয়ে যান
যে ভাল নাই। এখন তাই প্রায় সময় ফোন রিসিভ
না করেই ইমোতে ম্যাসেজ দিয়ে বলে দেই,
"ভাল
আছি মা।"
মিথ্যা কথা মহাপাপ। এই মহাপাপটাই অনেক সময় দিনের পর দিন করে যেতে হয় মায়ের সাথে। অনাহারী দিন গুলোতে বলতে হয়, "বেশ পেট ভরে খেয়েছি।" ঈদের দিন নামাজ পরে এসে বলতে হয়, "অনেক মজা করছি, ভাল আছি।"
শুধু মা না। কোন বোনের সাথে বা বান্ধবীদের সাথে বা সামান্য
পরিচিত কোন মেয়ের সাথে কথা বললেও তারা কি করে যেন বুঝে যায় অনেক কিছু। এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েই মনে হয় মেয়েদের দুনিয়াতে
পাঠানো হয়।
আগে এটা মজা হয় নাই, ওটা মজা হয় নাই বলে খাবার
প্লেট সরিয়ে রাখতাম। এটা
খাবো না, ওটা খাবো না বলে মায়ের সাথে কতো না রাগ দেখাতাম। আজ বুঝি মা কতোটা কষ্ট পেতেন। কষ্ট পেতেন না খেয়ে থাকতাম বা কম খেতাম বলে। কতো মায়া নিয়ে আমাদের জন্য বছরে বারোটা মাস তিন
বেলা রান্না করতেন। আর আমরা কতোনা আঘাত দিতাম
মাকে সেই খাবার খেতে না চেয়ে।
আজ এমন দিন এসেছে। যা পাই তাই ই অমৃত লাগে। ভিনদেশে অতো বাহানা চলে না। নিজের রান্না নিজেই করতে হয়। এইখানে আপনার কাজ কেউই করে দেবে না। রান্না পারতাম দুই তিনটা। তাও কোন রকম। কিন্তু ঐ যে বললাম মেয়ে জাতিটাই মায়ার জাতি। মমতাময়ীর জাতি। এমন মমতাময়ীর কাছেই টুকটাক রান্না করা শিখা। নানান বাহানায় তার আশেপাশে থাকি এই স্বার্থপর
আমি একটু শান্তির আশায়। সেইসব
রান্নার ছবি তুলে মায়ের কাছে পাঠাই। মা যে কতোটা খুশি হয় সে শুধু আমিই জানি। মাকে বলি এবার দেশে এলে রান্না করে খাওয়াবো। মা খুশি হন। অনেক খুশি হন।
প্রতিদিন একবেলা রান্না করে দুই একদিন খাই। বিরক্ত লাগে খুব রান্না করতে। আর মা কি করে যে বছরের পর বছর বিরতিহীন আমাদের
তিন বেলা রান্না করে খাওয়াচ্ছেন বুঝি না। ঠিক করি মনে মনে, এবার দেশে গেলে যতোটা পারি
মাকে খাওয়াবো রান্না করে। যাই
রান্না করি মা বাবা যে তৃপ্তি নিয়ে খাবেন খুব করে জানি।
এখনো মনে আছে এক মা দিবসে মাকে, পাশের
বাসার, নিচতলার আন্টিদের নুডলস বানিয়ে খাইয়েছিলাম। সবাই বলল মজা হয়েছে। মায়ের জাতি। বলবেই তো। অখাদ্য হলেও কি বললে যে ভাল হয়নি। এক আন্টি জিজ্ঞেস করলো,
"এতো
মজা হলো কি করে।" বললাম ভালবাসার রেসিপি দিয়ে বানিয়েছি। সবাই হাসলো।
বুকের ভিতরে এক সাগর ভালবাসার
রেসিপি নিয়ে বসে আছি কবে ফিরবো দেশে। কবে দেখবো বাবা মাকে, আপুকে। প্রিয় মানুষ, বন্ধুবান্ধবদের। কবে বাবা মাকে তৃপ্তি করে
ভালবাসার রেসিপি দিয়ে রান্না করে খাওয়াবো। কতোদূর? আর কতোদূর সেই দিনটা! আরো কতো বছরে পরে...
No comments:
Post a Comment