17 May 2017

শাপলা জাকিয়া





প্রতিদিন বহু মানুষের মৃত্যু হয় ।মৃত্যুর দিনটি তাদের কেমন কেটেছিল,তারা সেটা কাউকে বলার আর সুযোগ পান না । তবু কিভাবে যেন দু’টি ঘটনা জানা গেলো ।
ঘটনা –একঃ
মিনহাজ সাহেবের বয়স ষাট। তিনি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। নামিদামী হাসপাতাল নয় ,সরকারি হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ড। ছেলে তাকে কেবিনে রাখতেই পারতো কিন্তু রাখেনি, তিনি এখন বাতিলের খাতায়,তারজন্য টাকা খরচ মানে টাকা পানিতে ফেলা। নেহাৎ বুকে ব্যাথা উঠে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে এনে ভর্তি করে দিয়ে গেছে । তবে ছেলের দোষ তেমন তিনি দেনও না । ছোটবেলা থেকেই ছেলে তাকে লম্পট ও মদ্যপ বলে জানে। সারাজীবন স্ত্রী আর ছেলেকে তিনি আসলে বঞ্চনাই করে গেছেন। স্ত্রীর কথা মনে পড়তেই বিয়ের প্রথম দিককার কথা মনে পড়ে মিনহাজ সাহেবের। স্ত্রী কাবেরী তখন কি মিষ্টি দেখতেই না ছিলো। শান্ত, সরল একটা মেয়ে। কিছু বললে বড় বড় চোখ দু’টিতে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতো,যেন জীবনে প্রথম সে এই কথা শুনছে। সেই মিষ্টি কাবেরী সময়ের সাথে কতো বদলে গেলো। সে এখন একজন মোটাসোটা দজ্জাল রমণী! দোষ কাবেরীকেও তিনি দিতে পারেন না। কারন কাবেরীর সেই শান্ত,মিষ্টি স্বভাবকে তিনি কোন মূল্যই দেন নি বিবাহিত জীবনের শুরুতে। তখন তিনি বন্ধুর বউ এর প্রেমে দিওয়ানা ছিলেন। 

বুকের ব্যথাটা আবার শুরু হওয়ায় মুখ বিকৃত করে শ্বাস নেন মিনহাজ সাহেব। তার মনে হয়,আজ যদি তিনি মরে যান, তো কি হবে? পৃথিবীর কিছু যাবে আসবে না,তিনি এই পৃথিবীর জন্য,পৃথিবীর মানুষগুলির জন্য কিছুই তো করেন নি। সারাজীবন সবকিছু ছাপিয়ে নারীপ্রেম তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। সেই প্রেমও ছিল অস্থির । কেউ তাকে ছেড়ে চলে যেতো আবার তিনিও কারো ব্যাপারে হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সরে আসতেন । এছাড়া টাকার বিনিময়ে যেসব নারীদের পাওয়া যেতো তাদের গুরুত্বও তার কাছে কম ছিলো না।
আচ্ছা, তিনি কি শুধু প্রেম করতে দুনিয়ায় এসেছিলেন , তার আর কিছু করার ছিলো না?
বুকে এই প্রশ্ন আর প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে মিনহাজ সাহেব দুপুর দুইটাই মারা গেলেন। মৃত্যুর সময় যে কোন একটি প্রিয়মুখ শেষবার দেখার জন্য তার প্রাণটা ছটফট করলেও মৃত্যুর সময় তার কাছে তেমন কেউ ছিল না।

ঘটনা দুইঃ
মিনারা বেগমের বয়স পঞ্চাশ। তিনি খুব গুছানো মানুষ। রান্নাঘরের মশলার তাক থেকে শুরু করে বসার ঘরের বই এর আলমারি, শোবার ঘরের আলমারি সব তিনি প্রতিদিন গুছান । আজকাল বয়স হয়েছে , ভারি শরীর আর পায়ে ব্যাথা নিয়ে কাজ করতে সময় লাগে অনেক।তবু কোন কাজ তিনি ফেলে রাখেন না । এই যে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে ছোট ছেলের রুমের দিকে যাচ্ছেন , এইটুকু যাওয়ার পথেও তিনি জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে করতে এগোন। খাবার টেবিলের ওপর রাখা গ্লাসে ঢাকনা দেয়া হয়নি ,সেটা ঠিক করেন। বড় ছেলেটা তার চশমা চেয়ারের ওপর রেখে চলে গেছে , সেটা হাতে করে তুলে নেন , ছেলের পড়ার টেবিলে রেখে আসবেন বলে। তার স্বামী এবং দুই ছেলে ,এই তিনজনই চরম অগোছালো । এই তিন জনের অগোছালো স্বভাব একা সামাল দেন মিনারা বেগম। তিনি ছোটবেলা থেকেই খুব গোছানো ছিলেন। বিয়ের আগে বাবা আর ভাইদের সবকিছু জায়গামতো গুছিয়ে রাখতেন বিয়ের পর নিজের সংসারে এসেও একই কাজ করেন। অতিথিরা সবসময়ই তার এই গোছানো পরিপাটি সংসারের প্রশংসা করেন।
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে পুরো বাড়িঘর ঠিকমতো গুছিয়ে রেখে তবে ঘুমাতে যান মিনারা বেগম। যাতে সকালে তার একটি পরিপাটি গুছানো ঘরে ঘুম ভাঙ্গে । কোথাও একটি কাপড়ও যদি এলোমেলো পড়ে থাকে ঘুম আসে না মিনারা বেগমের। আজ সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিলো না তার। কাজ করতে গেলে কেবলই হাঁফ ধরে যায়। পশ্চিম দিকের ঘরে নতুন একটা আলমারি রেখেছেন শীতের কাপড় চোপড় রাখার জন্য। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সেটাই গুছাতে শুরু করেছিলেন ।কিন্তু হঠাৎ মাথা ঘুরে গেলো। বমিও হলো একবার। স্বামী আর ছেলেরা জোড় করে এনে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে প্রেশার মেপে বললো প্রেশার বেশী । প্রেশারের ওষুধ খাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মিনারা বেগম।
এখন এই অনেক রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তিনি অনুভব করলেন তার প্রচন্ড গরম লাগছে। ঘামে জব জব করছে শরীর। তিনি পাশে শুয়ে থাকা স্বামীকে ডাকলেন, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। তিনি আতংক নিয়ে অনুভব করলেন, হাত বা পা কিছুই নাড়াতে পারছেন না। মিনারা বেগমের মনে হলো, তিনি কি মারা যাচ্ছেন? তিনি মারা গেলে তার সংসারের কি হবে? তার স্বামী আর ছেলেদের কে দেখে শুনে রাখবে? পশ্চিম দিকের ঘরের আলমারিটা এখনো গুছানো হয়নি। মেঝেতে কাপড় চোপড় ডাই হয়ে পড়ে রয়েছে। মারা যাবার আগে আগে মিনারা বেগমের মনে হয়েছিল, আচ্ছা তিনি কি শুধু জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন? করার মতো আর কোন কাজ কি তার ছিল না? এতো বড় পৃথিবীর কিছুই না দেখে তিনি চলে যাচ্ছেন । কোথায় যাচ্ছেন? তার কি আর কিছু করার কথা ছিল?

_________________


No comments:

Post a Comment