21 May 2017

সুনীতি দেবনাথ




কবি সমকালে বাঁচেন, অতীতের মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে বর্তমানকে পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করেন, ভবিষ্যতের রূপরেখা বর্তমানেই এঁকে ফেলেন বেশ স্পষ্ট করে। আর এই জন্যই কবিকে বলা হয় বুঝি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, দার্শনিক। ছাপোষা সাধারণ মানুষ নিত্য নৈমিত্তিক টানাপোড়েন যেখানে হিমসিম খেয়ে নাকানিচুবানি খেতে খেতে জীবনটা নিয়ে সারাকাল হাহুতাশ করতে করতে একদিন টুপ করে মরে যায়, কবির ক্ষেত্রে সেটা হয় না। গায়েগতরে গড়পড়তা দশজনের মত হয়ে প্রত্যক্ষগোচর হলেও কবি সাহিত্যিকেরা মানসিক শক্তি আর বিচারে অতিমানবিক। কথাগুলো বলা হলো কবি হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে আলোচনার মুখবন্ধ হিসেবে। কবি আজাদ নিঃসন্দেহে অতিমানবিক আখ্যায় আখ্যায়িত হতে পারেন। তাঁর জীবনের সুবিস্তৃত বিষয়-আশয়, ভাবনা- চিন্তা, সমাজ- রাষ্ট্র-জীবন সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত অভিমত আলোচনা সংক্ষিপ্ত পরিসরে অবশ্যই অসম্ভব। তাই একটা নির্দিষ্ট পরিসরে বর্তমান নিবন্ধে আলোচনা করা হবে।
কবি, ভাষাবিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক, গবেষক, কিশোর সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ আশির দশক থেকেই বিশাল সংখ্যক পাঠকের  মনোযোগ  আকর্ষণ করেন । যুক্তিনির্ভর , মননশীল ,আন্তরিক , ঋদ্ধ ও প্রাজ্ঞ সৃষ্টি সম্ভারের জন্যই তাঁর অপরিসীম জনপ্রিয়তা। প্রথা, প্রতিষ্ঠান, সংস্কার বিরোধিতা, নারীবাদী, রাজনৈতিক বক্তব্য ও নির্মোহ সমালোচনার জন্য তিনি আলোচিত ও সমালোচিত ছিলেন। হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুর রাশেদ প্রথমে শিক্ষকতা করলেও পরে পোস্টমাস্টারের চাকরিতে যুক্ত হন। মা জোবেদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয়টিতেই প্রথম স্থান অধিকার করেন ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে। এরপর স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'বাংলা ভাষার সর্বনামীয়করণ' বিষয়ের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে। পশ্চিমা ভাষাবিজ্ঞানী চমস্কি উদ্ভাবিত তত্ত্ব নিয়ে তিনি বাংলা বাক্যতত্ত্বের গবেষণা করেন। 'অলৌকিক ইস্টিমার', 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে', 'আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে' ইত্যাদিসহ তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০। ১৯৯২ সালে তাঁর নারীবাদী গ্রন্থ 'নারী' ব্যাপক আলোড়ন তোলে। পরে সরকার বইটি পাঁচ বছর নিষিদ্ধ রাখে। 'পাক সার জমিন সাদ বাদ' উপন্যাসের জন্যও তিনি সমালোচিত হন এবং মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন। প্রায় ৭৫টি বইয়ের লেখক বহুভাষাবিদ বহুমাত্রিক এই লেখক ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হন। সুস্থ হয়ে জার্মানিতে একটি বৃত্তি নিয়ে গেলে ওই বছরই মারা যান।

হুমায়ুন আজাদ ছিলেন প্রথাবিরোধী, বহুমাত্রিক ও মননশীল ব্যক্তিত্ব। এমনকি ধর্ম, ধর্মীয় সংস্কার, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতির প্রতি তাঁর কোন আসক্তি ছিলো না। বরং ৭০ টিরও বেশী তাঁর লিখিত নানাপ্রকার বইয়ে এসবের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ লক্ষ্য করা যায়। তাঁর কন্যা মৌলি আজাদের লেখা বই থেকেও এমনটা জানা যায়।
“. . .কাউকে তোয়াক্কা করতেন না…। মাঝে মধ্যে তাকে বলতাম, ‘তুমি এমন কেন, সবার মুখের উপর ঠাসঠাস করে কথা বল? তিনি বলতেন, ‘এসব বলতে সাহস লাগে, আমার কারো কাছে কোন চাওয়া নেই, আমি যা হব/করব তা নিজেই করব তাই কাউকে তোয়াক্কা করি না।’"  (পৃষ্ঠা-১৬) মৌলি আজাদের বই ।
“তার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ না থাকলেও তিনি আমাদের খুশি রাখার জন্য প্রতিবার কোরবানীর আগের দিন বাসার সামনের রাস্তা থেকে দুইটা সুন্দর ছাগল কিনে আনতেন, বেঁধে রাখতেন বারান্দায়। আমার ছোট দুই ভাইবোন ব্যস্ত থাকতো ছাগলগুলোকে নিয়ে।” (পৃষ্ঠা-১৮) [মৌলি আজাদের বই]
[অর্থাৎ সন্তানের জন্য হলেও ধর্মীয় আচারকে কিছুটা হলেও ধারণ করেছিলেন বা প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি ! অথচ তাঁর বইয়ে ছিল সকল ধর্ম -সংস্কার -প্রথার প্রতি চরম বিরোধিতা।]

“আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে
আমার খাদ্যে ছিলো অন্যদের আঙুলের দাগ,
আমার পানীয়তে ছিলো অন্যদের জীবাণু,
আমার নিশ্বাসে ছিলো অন্যদের ব্যাপক দূষণ।
আমি জন্মেছিলাম, আমি বেড়ে উঠেছিলাম,
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি দাঁড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি হাঁটতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো,
আমি পোশাক পরতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি চুল আঁচড়াতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো ক’রে,
আমি কথা বলতে শিখেছিলাম অন্যদের মতো।
তারা আমাকে তাদের মত দাঁড়াতে শিখিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো হাঁটার আদেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে তাদের মতো পোশাক পরার নির্দেশ দিয়েছিলো,
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত চুল আঁচড়াতে,
তারা আমার মুখে গুঁজে দিয়েছিলো তাদের দূষিত কথামালা।
তারা আমাকে বাধ্য করেছিলো তাদের মত বাঁচতে।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম,
আমি হাঁটতে চেয়েছিলাম নিজস্ব ভঙ্গিতে,
আমি পোশাক পরতে চেয়েছিলাম একান্ত আপন রীতিতে,
আমি চুল আঁচড়াতে চেয়েছিলাম নিজের রীতিতে,
আমি উচ্চারণ করতে চেয়েছিলাম আমার আন্তর মৌলিক মাতৃভাষা।
আমি নিতে চেয়েছিলাম নিজের নিশ্বাস।
আমি আহার করতে চেয়েছিলাম আমার একান্ত মৌলিক খাদ্য,
আমি পান করতে চেয়েছিলাম আমার মৌলিক পানীয়।
আমি ভুল সময়ে জন্মেছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
আমি ভুল বৃক্ষে ফুটেছিলাম। আমার বৃক্ষ কখনো অঙ্কুরিত হয় নি।
আমি ভুল নদীতে স্রোত হয়ে বয়েছিলাম। আমার নদী তখনো উৎপন্ন হয় নি।
আমি ভুল মেঘে ভেসে বেরিয়েছিলাম। আমার মেঘ তখনো আকাশে জমে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমি গান গাইতে চেয়েছিলাম আমার আপন সুরে,
ওরা আমার কন্ঠে পুরে দিতে চেয়েছিলো ওদের শ্যাওলাপড়া সুর।
আমি আমার মতো স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো ওদের মত ময়লাধরা স্বপ্ন দেখতে।
আমি আমার মতো দাঁড়াতে চেয়েছিলাম.
ওরা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলো ওদের মত মাথা নিচু ক’রে দাঁড়াতে।
আমি আমার মতো কথা বলতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমার মুখে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলো ওদের শব্দ ও বাক্যের আবর্জনা।
আমি খুব ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলাম,
ওরা আমাকে ওদের মতোই দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলো বাইরে।
ওরা মুখে এক টুকরো বাসি মাংস পাওয়াকে ভাবতো সাফল্য,
ওরা নতজানু হওয়াকে ভাবতো গৌরব,
ওরা পিঠের কুঁজকে মনে করতো পদক,
ওরা গলার শেকলকে মনে করতো অমূল্য অলঙ্কার।
আমি মাংসের টুকরো থেকে দূরে ছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি নতজানু হওয়ার বদলে বুকে ছুরিকাকে সাদর করেছিলাম।
এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি গলার বদলে হাতেপায়ে শেকল পরেছিলাম। এটা ওদের সহ্য হয় নি।
আমি অন্যদের সময়ে বেঁচে ছিলাম। আমার সময় তখনো আসে নি।
ওদের পুকুরে প্রথাগত মাছের কোন অভাব ছিলো না,
ওদের জমিতে অভাব ছিলো না প্রথাগত শস্য ও শব্জির,
ওদের উদ্যানে ছিলো প্রথাগত পুষ্পের উল্লাস।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো দিঘি খুঁড়েছিলাম ব’লে
আমার দিঘিতে পানি ওঠে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মত চাষ করেছিলাম ব’লে
আমার জমিতে শস্য জন্মে নি।
আমি ওদের সময়ে আমার মতো বাগান করতে চেয়েছিলাম ব’লে
আমার ভবিষ্যতের বিশাল বাগানে একটিও ফুল ফোটে নি।
তখনো আমার দিঘির জন্যে পানি উৎসারণের সময় আসে নি।
তখনো আমার জমির জন্যে নতুন ফসলের সময় আসে নি।
তখনো আমার বাগানের জন্যে অভিনব ফুলের মরশুম আসে নি।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার সব কিছু পর্যবসিত হয়েছে ভবিষ্যতের মতো ব্যর্থতায়,
ওরা ভ’রে উঠেছে বর্তমানের মতো সাফল্যে।
ওরা যে-ফুল তুলতে চেয়েছে, তা তুলে এনেছে নখ দিয়ে ছিঁড়েফেড়ে।
আমি শুধু স্বপ্নে দেখেছি আশ্চর্য ফুল।
ওরা যে-তরুণীকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, তাকে জড়িয়ে ধরেছে দস্যুর মতো।
আমার তরুণীকে আমি জড়িয়ে ধরেছি শুধু স্বপ্নে।
ওরা যে নারীকে কামনা করেছে, তাকে ওরা বধ করেছে বাহুতে চেপে।
আমার নারীকে আমি পেয়েছি শুধু স্বপ্নে।
চুম্বনে ওরা ব্যবহার করেছে নেকড়ের মতো দাঁত।
আমি শুধু স্বপ্নে বাড়িয়েছি ওষ্ঠ।
আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে।
আমার চোখ যা দেখতে চেয়েছিলো, তা দেখতে পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার পা যে-পথে চলতে চেয়েছিলো, সে-পথে চলতে পারে নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমার ত্বক যার ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলো, তার ছোঁয়া পায় নি।
তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি যে-পৃথিবীকে চেয়েছিলাম, তাকে আমি পাই নি।
তখনো আমার সময় আসে নি। তখনো আমার সময় আসে নি।
আমি বেঁচেছিলাম
অন্যদের সময়ে”।
“আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে”
-হুমায়ুন আজাদ


আধুনিকতা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের মানসিকতা কেমন ছিলো তা আলোচনা করে  দেখা যেতে পারে। তিনি আধুনিকতামনস্ক ছিলেন নিঃসন্দেহে, আধুনিকতা সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট স্বকীয় মতামত ছিলো। তিনি যা ভাবতেন বা বলতেন তাই ছিলো তাঁর আচরণীয়। আধুনিকতা বিশেষ করে ইউরোপীয় আধুনিকতা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেন,
"ইউরোপীয় আধুনিকতা পদটি বিভ্রান্তিকর। কারণ আধুনিকতা মানেই হচ্ছে ইউরোপীয়। ইউরোপ ছাড়া কোথাও আধুনিকতা ছিল না। শুধু আধুনিকতা কেন, রোমান্টিসিজমের জন্মও ইউরোপে। ইউরোপ সবসময়ই স্রষ্টা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে রোমান্টিক কবি-তিনি শেলি দ্বারা প্রভাবিত। বোদলেয়ার,  মালার্মে, এলিয়ট, পাউন্ড এদের চেতনা গ্রহণ করেই বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে। এই আধুনিকতা ইরানে, মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যায় না। ১৯৪০-৫০ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান আধুনিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়নি। বাঙালি মুসলমানেরা ওমর খৈয়ম, হাফিজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমরা যখন আইয়ুব খানের দ্বারা পীড়িত ছিলাম তখন খুঁজে নিয়েছি শুদ্ধ বাঙলা ভাষা। যে ভাষা বাঙালি মুসলমানের মধ্যে ছিল না। আধুনিকতা ইউরোপ ও আমেরিকা ছাড়া নেই। মুসলমান জগতে তো নেই-ই। শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মগজ যে জ্ঞান ধারণ করে তা ইউরোপীয় ও মার্কিনী জ্ঞান। আমরা যে কোন চিন্তাবিশ্বের কথাই বলি না কেন তা পেয়েছি ইউরোপ থেকে। আমি নিজে ইউরোপীয় আধুনিকতার খুব অনুরাগী আমাদের আধুনিক কবিদের প্রভাবে। আমি নিজে ভাষার ক্ষেত্রে শুদ্ধতাবাদী। আমি বাংলা ভাষায় বাংলা শব্দই দেখতে চাই। আমি আরবি, ফার্সির কাছে হাত পাতিনি। এক গবেষক হিসাব করে দেখিয়েছেন বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম যে পরিমাণ ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন আমি তার থেকে কম ব্যবহার করেছি। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ সম্পর্কে দু’একটি কথা বলা যেতে পারে। কোন   একটি ভাষার বিপুল পরিমাণ শব্দ ঢোকার প্রক্রিয়াকে বলে ভাষা সাম্রাজ্যবাদ। আমি যেহেতু সব ধরনের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেহেতু ভাষা সাম্রাজ্যবাদের শিকার হতে চাইনি।"

যুক্তিবাদী এই আলোচনায় মুগ্ধ হতে হয়,  চমকে উঠতে হয়। একথা সত্য হুমায়ুন আজাদ সাব সর্বদাই তাঁর বক্তব্যকে চিন্তাগর্ভ ও যুক্তিনির্ভর করে প্রকাশ করেছেন। তাঁর ভাবনা মৌলিক এবং স্বকীয়তা যুক্ত। বর্তমান প্রসঙ্গে একটি বিশেষ সূত্রের প্রতি পাঠক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। হুমায়ুন আজাদের বক্তব্য ভাষায় বিপুল পরিমাণ বিদেশী শব্দ ঢোকার প্রক্রিয়া হচ্ছে ভাষা সাম্রাজ্যবাদ। মানলাম, তিনি স্পষ্ট বললেন যেহেতু তিনি সব ধরনের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সেহেতু ভাষা সাম্রাজ্যবাদের শিকার হতে চাননি। ঠিক এখানটায় একটা প্রশ্ন ওঠে। ভাষায় ভিন্ন ভাষার শব্দ  বিপুল পরিমাণে গ্রহণে তাঁর আপত্তি। সাধারণভাবে বলা চলে তিনি যথার্থ বলেছেন, প্রত্যেক ভাষার স্বকীয়তার মৌল শর্তের বিশিষ্ট শর্তই হচ্ছে তার শব্দভাণ্ডার। কিন্তু ভাষাতাত্ত্বিকগণ অভিমত প্রকাশ করেন যে, যে ভাষা বিদেশী ভাষা থেকে প্রচুর পরিমাণে শব্দ গ্রহণ করে সাবলীলভাবে আত্তীকরণ করে নিতে পারে সেটি সমৃদ্ধ ভাষা  হয়ে ওঠে। প্রসঙ্গক্রমে এও বলা হয় বর্তমান বিশ্বের সমৃদ্ধতম ভাষা ইংরেজি, এই ভাষা গড়ে প্রতি বছর আড়াই হাজার নতুন শব্দ পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থেকে গ্রহণ করে আত্তীকরণ করে নিচ্ছে। এতে এই ভাষার শব্দভাণ্ডার বিশাল হচ্ছে যেমন, তেমনি ভাষাও সমৃদ্ধতম হয়ে উঠতে পারছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় আজকের বিশ্ব জ্ঞানে- বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নিত্য নতুন আবিষ্কারও হচ্ছে। তাই; বাংলা ভাষায় এসব জ্ঞান - বিজ্ঞান, প্রযুক্তির শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অকাট্য সমস্যা উপযুক্ত পরিভাষার, সেক্ষেত্রে পরিভাষার এই সমস্যা বাংলা প্রতিবর্ণীকরণের মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে বলে মনে হয়। তাই ভিন্ন ভাষার শব্দগ্রহণে কট্টর না হয়ে উদার হওয়া সঙ্গত মনে করি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য হুমায়ুন আজাদ সাব একজন ভাষাবিজ্ঞানীও ছিলেন। তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ' বাংলাভাষার সর্বনামীয়করণ ' বিষয়ের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে ভাষাবিজ্ঞানীদের এসব ভাবনাচিন্তা তাঁর অজানা ছিল ভাবা যায় না। তাই সজ্ঞানে এই অভিমত প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বাংলার আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি ও বাংলা ভাষার সমৃদ্ধিই তাঁর কাম্য ছিলো অনুমান করা যায়।

হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে কারো কারো অভিমত এই যে, তিনি যে নৈরাজ্যবাদী দর্শন থেকে কথাগুলো বলেন তা কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর মতো ভয়ংকর শোনালেও শাসককুলের পক্ষেই আসলে তা কাজ করে। কারণ তাঁর  দর্শনের নিরর্থকতার তত্ত্ব স্থিতাবস্থায় বাতিলের তাগিদকে নষ্ট করে। তিনি রাজনৈতিক স্বার্থে কিছু বলেন না। এই অভিযোগের প্রত্ত্যুত্তরে হুমায়ুন আজাদ বলেন যে, অভিযোগটা খুব বাজে কথা। কারণ স্থিতাবস্থা রক্ষা করার জন্য তিনি কিছু লিখতেন না বরং স্থিতিবস্থাকে অস্থিতিশীল করা তাঁর লেখার একটি প্রধান লক্ষ্য ছিলো । নৈরাজ্যবাদী শব্দটি  ভুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে,  ওটা রাশান দর্শন। অধিকাংশ এর সঙ্গে পরিচিত নয়। তাছাড়া তিনি আরো জানালেন যে, তিনি রাজনৈতিক লেখক ছিলেন না,তাঁর কাজ নতুন সরকার আনা বা নতুন রাষ্ট্র স্থাপন করা নয়। এই দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। তাঁর সমস্ত লেখার অভিমুখ ছিলো প্রথাগত বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করার দিকে এবং নতুন আবেগ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করার প্রেষণায়। সাহিত্যিক সমালোচক হিসেবে প্রথানুগত্য বর্জন করে নতুন ধ্যান ধারণা তথা মতাদর্শ উপস্থাপন করেছেন তিনি। এখানে সাহিত্য সমালোচনাও একধরনের রাজনীতি।সমারোচকরা সমাজ মানসিকতার দিকে তাকিয়ে লেখকদের উৎকর্ষ-অপকর্ষ নির্ণয় করেন। যেমন রবীন্দ্রনাথের সীমাবদ্ধতা নিয় কেউ কথা বলবেন না, কারণ এতে রবীন্দ্র অনুরাগীরা ক্ষিপ্ত হতে পারেন। আর নজরুলের সমালোচনা করলে তো তাঁর অনুরাগীরা প্রচণ্ডভাবে মারমুখো হয়ে উঠবেন।  হুমায়ুুন আজাদ একবার নজরুলের কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন যে, নজরুলের  অধিকাংশ কবিতা প্রতিক্রিয়াশীলতার জয়গানে মুখরিত। তাঁর এই উক্তিকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয় এবং তদানীন্তন একনায়ক তাঁর বিরুদ্ধে মসজিদে মসজিদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এমনকি সেই অবস্থায় প্রগতিশীলরা মাথা নত করে নিশ্চুপ  থেকেছেন। একনায়ককে সবাই ভয় পেলেও তিনি পেতেন না। পারিবারিক গল্প বলা  ও বিশেষ সীমার মধ্যে বিচরণ প্রথাগত উপন্যাসের ধর্ম ছিল। তিনি সেই  সীমানা ভেঙ্গে দেন এবং তাঁর লেখা কিছুতেই স্থিতাবস্থার পক্ষে ছিলো না। যারা এসব বলে তারা ভাল করে তাঁর লেখা পড়েনি এবং স্থিতাবস্থা নৈরাজ্যবাদ সম্পর্কে তাঁদের অজ্ঞানতাই আছে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।

“আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানব মুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ পরিষদ;-চ’লে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ সভ্যতা-সমস্ত দলিল-
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ’লে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর গ্রাম ধানখেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ নির্জন প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার রাত
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙ্গুল
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চ’লে যাবে সেই সব উপকথা: সৌন্দর্য প্রতিভা-
মেধা;-এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বোধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাস ভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুই হাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট
গদ্যপদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্কস-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্ত সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক-
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে”।

“সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে”
-হুমায়ুন আজাদ


কবি হুমায়ুন আজাদ হয়তো ত্রিকালদর্শী, সত্যদর্শী,  দার্শনিক কবি যেজন্য এমন একটি কবিতা উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। কবিতাটিকে কবির কাম্য বিশুদ্ধ বাংলায় বলা যেতে পারে তাঁর কাব্যসম্ভারের শ্রেষ্ঠ উচ্চারণ! অথবা বলা যেতো ' The master piece of his works '। কবি যেন তাঁর দার্শনিক সত্তা দিয়ে তাঁর যুগকে, তাঁর সমকালকে সর্বান্তকরণে অনুধাবন করে গ্রানাইট প্রস্তর খণ্ডে রাতদিন ছেনি দিয়ে খোদাই করে শাশ্বত এক মহাকাব্যিক চিত্রশালা নির্মাণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে যে আশা, স্বপ্ন মূর্তিলাভের প্রত্যাশায় আকুল আকুতি নিয়ে প্রতীক্ষায় ছিলো, তার এমন করুণ পরিণতি যে একেবারে বাস্তব, বিভীষিকাময় তা যেন হৃদয়কে, মনন- চিন্তনকে বিধ্বস্ত করে সর্বরিক্ত শ্মশানভূমিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। কিছু নষ্ট মানুষের অধিকার সবকিছু কেড়ে নিয়ে একটা দেশের আপামর মানুষকে একটা গভীর খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। হুমায়ুন আজাদ যে ভয়াবহ অন্ধকারের চিত্র এই কবিতায় অঙ্কন করেছিলেন তা যেন বর্তমান বাংলদেশের ছবি। এখানেই দার্শনিক কবির সার্থক সৃষ্টির সাক্ষর বহন করছে তাঁর কবিতা ' সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে '।
  
বইমেলায় জঙ্গীদের হাতে আক্রান্ত হবার পরে হুমায়ুন আজাদ সুস্থ হলে ৩ জুন, ২০০৪ সালের বিকেলে তাঁর বাসভবনে যুগান্তরের পক্ষে সাক্ষাৎকারে হুমায়ুন আজাদ আবারও দ্ব্যর্থহীনভাবে তাঁর বিশ্বাস ও মতামতগুলো বলেছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়-
নারী, প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে, শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার, আমার অবিশ্বাস, পাকসার জমিমন সাদবাদ এসব বই লিখে আপনি আসলে কি নিশ্চিত নিরুপদ্রব জীবনের বিপরীতে নিজেকে নিযে যেতে চেয়েছেন? নিটশের মতোই আপনি কি আপনার নিয়তি জানতেন এবং বলবেন I am not a man, I am dynamic?
এই প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন আজাদের জবাব হুবহু তুলে ধরে বর্তমান আলোচনার সমাপ্তি টানা হবে। তাঁর জবাব- "নিটশে এরকম বলেছে নাকি? নিটশের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে god is dead। বইগুলো লেখার অর্থ কি নিজের জীবনকে উপদ্রব কবলিত করে তোলা? যদি কেউ উপদ্রব কবলিত জীবন চায় তাহলে বই লেখার চেয়ে অন্য অনেক জিনিস রয়েছে যা দিয়ে মানুষ তার জীবন উপদ্রুত করে তুলতে পারে। তুমি অসুস্থ হিংস্র সমাজে বাস করো বলেই বইগুলো এবং আমার সম্পর্কে এ ধারণা জন্মেছে। আমি যে বইগুলো লিখেছি, যা লিখেছি তা প্রথাগত চিন্তাভাবনার সঙ্গে খাপ খায় না। আমি আতঙ্কগ্রস্ত সমাজের মধ্যে বাস করতে চাই না বলেই এই বইগুলো লিখেছি। আমি মানুষের জন্য মুক্ত জীবন চেয়েছি- যে জীবন উদার সৃষ্টিশীল যা মানুষকে বিকশিত করে। এই বইগুলো এই বন্ধ সমাজ থেকে উত্তরণের জন্যই লেখা হয়েছে। যেমন চারপাশে যে প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখতে পাচ্ছি এবং এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংস্র হয়ে উঠেছে এবং কিছু বদ্ধ মানুষ কিছু মুক্ত মানুষকে হনন করার জন্য উদ্যত হয়েছে। এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্যই ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নীচে’ বইটি লিখেছি। ‘শুভ্রব্রত ও তার সম্পর্কিত সমাচার’ উপন্যাসটি বদ্ধ সমাজ থেকে মুক্তির জন্য রচিত একটি বিশাল উপন্যাস। এই উপন্যাসটি একজন ধর্মপ্রবর্তককে নায়ক হিসাবে নিয়েছি যে ক্রমশ তার উন্মত্ততার মধ্য দিয়ে এক বিধাতার সন্ধান পায় এবং সমস্ত সমাজ রাষ্ট্রকে তার বিশ্বাসের অনুগত করতে চায় এবং একটি মৌলবাদী সমাজ স্থাপন করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠিত সমাজে, রাষ্ট্রে তারও দম বন্ধ হয়ে আসে এবং সে ঘোষণা করে যে, বিধাতা আমার মনেরই সৃষ্টি। তখন ক্ষমতা ও ধনলিপ্সু সেনাপতিরা তাকে হত্যা করে এবং দেশের পর দেশ জয় করতে বেরিয়ে পড়ে। এটি একটি মহৎ উপন্যাস। এই বইগুলো আমি লিখেছি একটি মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন থেকে এবং শিল্প সৃষ্টি করার জন্য। কোন অন্ধ মৌলবাদীর হাতে নিহত হওয়ার জন্য নয়। "

এই উক্তি থেকে সম্পূর্ণ হুমায়ুন আজাদকে চিনতে অসুবিধা হয়না। তাঁর লেখা ও শিল্প সৃষ্টির অনুপ্রেরণাকে বুঝতেও অসুবিধা হয় না। আলোচনা থেকে আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা, মুক্তমনা ও স্বদেশপ্রেমী হুমায়ুন আজাদের পরিচয়ও সহজেই পাওয়া যায়। একথা সত্য বাংলা সাহিত্যে হুমায়ুন আজাদ একক ও অনন্য।

No comments:

Post a Comment