17 May 2017

প্রজ্ঞা মৌসুমী




তুমি এতোই কালো! তবেতো তুমি পুরা রাত। ভালো তো। লোকে পায় ১২ ঘণ্টার রাত আর তোমার বউ পাবে ২৪ ঘণ্টা। সারাবছরই তার বাসর।
-আমি যে কালো এতে তোমার খারাপ লাগে না? আরে এই দেখো! বলতে না বলতেই চোখ ভিজে গেল!
-ফের যদি এরকম বলো! আমার দিকে তাকাও রাত। কিছু বুঝলে?
-কি?
-সবকিছু তোমাকেই চায়। আর আমিই বা কি আহামরি মেয়ে? আমার মত মেয়েকে কেউ কামনা করতে পারে?
-নিজেকে নিয়ে এত আফসোস কেন তোমার?এটা ঠিক না সোনা। তুমি যে আমার তারা...'একা রাতের আকাশে'...

এভাবেই তারার চোখে ভর করে রাত আর রাতের আকাশে তারা। তারার চাহনিতে ভেসে বেড়ায়, ডুবসাঁতার দেয় আত্মবিশ্বাস, আস্থা, মায়া, বিস্ময়, ভালোবাসা। আমার বয়সী চোখ পড়ে রাতের ভাবনা। মনে হয় এইতো সেদিন। সবে এল এ পাড়ায়। ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে বিছানা-পত্রর। বাবা কড়া নজর রাখছে কাঁচের জিনিসপত্রগুলো যেন না ভাঙে। একটু পরপর শোনা যাচ্ছে- সাবধানে আহা সাবধানে। ছেলেও সতর্ক যেন কোন উটকো ছেলে মালপত্রর গায়েব না করে।

পাড়ার ছেলেদের জটলা থেকে আগ্রহী কেউ নাম জিজ্ঞেস করতেই, পদবিতে বিশেষ জোড় দিয়ে- 'আমার নাম গৌরব ভট্টাচার্য! বাবার নাম সৌরভ ভট্টাচার্য! আমি ক্লাস এইটে পড়ি!' নাম বলার ভঙিতে মুগ্ধ হয়ে আবার প্রশ্ন আসে। সেও উত্তর দেয়। নাম কেমনে বলে শিখে নে বাপ! অতি আগ্রহীদের মধ্যে চলে ঠিকঠাক মত দুটো হাত পেছনে ধরে, বুক ফুলিয়ে, থুতনি আধ ইঞ্চি উপরে তুলে 'ভট্টাচার্য' উচ্চারণের চেষ্টা। ব্রাহ্মণ বর্ণের গর্ব বড্ড বেশি নড়েচড়ে এদের পদবিতে। কথায়-আচারে 'উচ্চতম বর্ণ’ ছাপ। হঠাৎ কর্তার 'আহা সাবধানে', গিন্নীমার কড়াই-পাতিলের ঠুকাঠুকি ছাপিয়ে আসে ভয়ার্ত উচ্চারণ 'পুলিশ!' ট্রাকের পেছনে থামে তিনটি গাড়ি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ইউনিফর্মের গৌরব জড়িয়ে নামে পুলিশ। জুতোরও যে গর্ব থাকে সেটা বুঝা যায় তাদের চলার শব্দ-গর্জনে। পুলিশ পদবির কাছে ম্লান যেন 'ভট্টাচার্য' পদবির। বিস্ময়ের পর বিস্ময় ছেলের চোখে। শোনা যায় নারীকণ্ঠ, 'সবই মিথ্যা স্যার। ওরে ছাইড়া দেন। অসহায় বাচ্চাগুলারে চাইয়া দেখেন'। পুলিশের কি 'চাইয়া দেখনের' সময় আছে! সবার চোখ তখন কোমরে জড়ানো দড়ির দিকে।

কেবল গৌরব ভট্টাচার্যের চিন্তা-ভাবনায় তালগোল পাকায় দড়ি নয়, পুলিশ নয়, একজোড়া চোখ। জামরুল গাছটার নিচে ধপ করে বসে পড়া মেয়েটি। নীল উড়নায় চেপে ধরা ঠোঁট। অনবরত কাঁপছে শরীর, চোখে জলের ফোঁটা কাঁচের মত। ছেলের ইচ্ছে হয় বলে- আহা সাবধানে। ভেঙে যাবে কাঁচ। অসাবধানী মেয়ের কাঁচ ভেঙে পড়ে। এক বিন্দু তিলকে ডুবিয়ে নামে নদী। আবার জমে স্বচ্ছ কাঁচ। লাল জামরুলের মাঝ থেকে উঁকি দেয় এক নীলকণ্ঠ পাখি। পাখিও নীল উড়না জড়িয়ে! সমস্ত শব্দ, ভিড় ঠেলে মাথার ভেতর ঢুকে যেতে থাকে এক বৃত্ত- দুটো চোখ, জল-কাঁচ, স্যাঁতস্যাঁতে তিল, নীল উড়না, পাকা জামরুল, নীলকণ্ঠ, আবার চোখ, জল-কাঁচ, স্যাঁতস্যাঁতে তিল... ভিড় থেকে বিলাপ উঠে 'ওহ্ কুসুমের আব্বা'...'আল্লাহ্‌গো এইটা কি করলা'। কাঁচ-চোখে কেন্দ্রবিন্দু ছুট দেয় ঘরের দিকে। কুসুম আহা জলের কুসুম- যার চাহনিতে ছেলে দেখেছিল অচিন পৃথিবী।

ওদের ভালবাসা পারস্পরিক হয় আমার এই দোতলা বাড়ির ছাদে। সেটা নয় বছর পরের কথা। শেষ বিকেলের রোদ, ছাদের কোণ, বাতাসে সদ্য ভাজা পেঁয়াজুর ঘ্রাণ, সাথে ঝালমুড়ি। আমার মেয়ে ত্রপা গাইছে 'বধূ কোন আলো লাগলো চোখে'। শুভক্ষণে চাহনির সংকোচ, দ্বিধা সরিয়ে ভিড় করে এক স্পর্শের বৃত্ত। রবিবাবুর অভিযোগ "পৃথিবীতে দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায় কিন্তু তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না।" জামরুল গাছের নিচ বা ঘরের ছাদ কতখানি যোগ্য জায়গা জানিনা। তবে এটুকু নিশ্চিত 'দুর্লভ অবসরেই' কুসুমের চাহনিতে গৌরব দেখেছিল তার পৃথিবী। কুসুমকে নিয়ে ইদানীং ভয় হয়। ওর চাহনিতে দ্বিধা দিতেই বলি, "তুমি বিশ্বাস করো সে সবকিছু ছেড়ে আসবে? তোমাকে নিয়ে সংসার করবে? বাবা-ভাইরা চাপ দিলে, তোমাকে ছেড়েই চলে যাবে নির্দয়ের মত। একবার ভাববেও না তোমার কথা।" কুসুমের চোখে জমে কাঁচ কিন্তু চাহনিতে দৃঢ়তা ঠিকই লেগে আছে।

একটা সময় পুরুষের ব্যাপারে শুচিবায়ুর মত ছিল আমার। ওদের সাথে কথা বলা, ওদের স্পর্শ অসহ্য লাগত। বাবা হাতে ধরলেও দশবার হাত ধুতে হত। ক্লাসের বেঞ্চিতে কিংবা রিক্সায় চড়তে গেলেই 'এর আগে কি কোন ছেলে বসেছিল?' এই চিন্তায় শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসতো। ক্লাসের ছেলেরা আমার সাথে কখনোই কথা বলত না। বলা যায় ভয় পেত- আড়ালে বলতেও শুনেছি, 'কসাই চাহনি...সীমারের চাহনি। কেউ বলতো ওসব একটা ভান। আসলে মেয়েটা সমকামী। মেয়েরা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে বলতাম 'হলে আপত্তি আছে? ভালবাসা একদল বুইড়ার শেখানো ধারা অনুযায়ী চলতে হবে? সমকামিতা মানে এই নয় মেয়ে দেখলেই চোখ চকচক করা। আমি মনগ্যামিতে বিশ্বাস করি। ভালবাসা যদি একজনকে ঘিরেই হয় সেই ভালবাসার মূল্য কি কম?" সেই থেকে মেয়েরাও এড়িয়ে চলত। আসলে আমি পুরুষদের ঠিক ঘৃণা করিনা বরং ভয় করি। হয়ত এই ভয় থেকেই সদ্য বয়ঃসন্ধি-ছোঁয়া মেয়েকে বলেছি 'ফ্রম নাউ অন, ইউ হেভ টু বি কেয়ারফুল এবাউট বয়েজ। ডোন্ট ট্রাস্ট দেম।' পরক্ষণেই মনিরকে মনে পড়ে। এবার ঘুরিয়ে বলি 'সতর্ক থাকা মানেই গুটিয়ে নেয়া নয়। পায়ে দলবে- এই ভয়ে পিঁপড়ে মাটির ভেতর বসে থাকে না। সে বাইরে বেড়োয় কিন্তু পায়ের তলা এড়িয়ে চলে।' আমি যে অনেককাল গর্তে ছিলাম।

মনির বলে আমার মানসিক সমস্যার পেছনে ছিল লতা আপা। হয়ত তাই। সেদিনের সন্ধ্যাটা খুব মনে পড়ে। কামরুল ভাইয়ের বাবা অকথ্য ভাষায় অপমান করছে আব্বাকে। পুরোটা সময় কামরুল ভাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। সেই কামরুল ভাই যাকে বড় আপা ভীষণ ভালবাসত। এর মূল্য দিতেই ছুটে এলো দাড়ি-কমাহীন কথার আঘাত। পড়ার ঘরে বসে শুনতে পারছিলাম প্রতিটা শব্দ, "তোমার...মেয়ে" নানা বিশেষণে ভূষিত করতে করতে লোকটা হাঁপিয়ে উঠছিল কিন্তু জোর এতটুকু কম ছিলনা। আমার চোখ উপচে পড়ল রাগ, ঘৃণা। ভীষণ ভদ্রলোক আব্বার উপরও এত রাগ লাগছিল। প্রচণ্ড ক্রোধে মনে হলো কয়েকটা খুন করে ফেলি। এক ঝটকায় টেবিল থেকে ফেলে দিলাম কাঁচের জগ, তারপর কাঁচের গ্লাস, কাচা পেয়ারা আর লবণ-লঙ্কাগুড়ো রাখা পিরিচটা ছুড়লাম বসার ঘরের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল কথা। দু মিনিটের মাথায় চলে গেল ওরা কিন্তু রেখে গেল ঘরভর্তি অকথ্য কথা। আট ঘণ্টা পর চলে গেল লতা আপাও। ভোরের আলোয়, উঠানের পেয়ারা গাছে আপাকে দেখে মনে হচ্ছিল একটা দোলনা। দুদিন পরে কাটা হলো পেয়ারা গাছটাও। আপার চাহনিতে ছিল অভিমান নাকি কষ্ট? ছিঁড়ে যাওয়া স্পর্শের বৃত্ত, ভাঙা স্বর্গ-খেলনা আর সেই একটা কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট...

আমার বিয়ের ঘটকালি করেছিল কুসুমের মা। আব্বা আমার জন্য পাতার বিয়ে আটকে রেখেছে তাই বাধ্য হয়ে আর জিদ করেই মত দিলাম। রাগটা বেশি পড়ল মনিরের উপর। ফুলশয্যা, মধুচন্দ্রিমা ওসব আমার হয়নি। একটা দিনও ভালো করে তাকায়নি ওর দিকে। পড়াশোনার অজুহাতে চলে গেলাম ইউরোপে। ও কখনো জোর করেনি, অভিযোগ করেনি কারো কাছে। যাওয়ার দিন শুধু বলেছিল 'অপেক্ষায় থাকব।" আমার চাহনিতে ছিল অবিশ্বাস। অপেক্ষা! নিশ্চিত কারো সঙ্গে প্রেম করবে। আরো ঘেন্না জমতো। আবার পরপর কমাস যোগাযোগ না নিলে রাগ হত; বউয়ের প্রতি দায়িত্ব নেই, খোঁজ-খবর নেই। দিব্যি অন্যদের সাথে দিন কাটাচ্ছে। রাগ করে লিখেও ছিলাম ডিভোর্সের কথা, সঙ্গে তীক্ষ্ম অভিযোগ। উত্তর এলো 'ভেবেছিলাম আমি যোগাযোগ করলে তুমি বিরক্ত হও তাই... আমি কখনো চাইনা তুমি অসুখী হও। অন্য নারীকে কামনা করে নিজের বউকে, আমার ভালবাসাকে ছোট করার কথা তুমি ভাবতে পার। আমি পারিনা।" তারপর আসিফ আবরারের কবিতার কটা লাইন " ঘুমুতে গেলে কপালে একটি মমতাময়ী হাতের অভাব অনেককাল থেকেই/ একদিন দেখবে, এই দাবিতে আমি রাজপথে নেমেছি/ আমার অনশন ভাঙাতে স্টিলের গ্লাসে ঠাণ্ডা জল হবে নগরের শ্রেষ্ঠতম রূপসীরা/ আমি তবুও তৃষ্ণায় মরে যাবো!/ সবার হাতে কি স্পর্শ থাকে।" সারারাত আমার চোখে জমল আর ভাঙল জল-কাঁচ। আমাকে ফিরতে হল মনিরের কাছে। দুই বছর পর ঢাকা এয়ারপোর্টে দুজনের দেখা। সত্যিকার অর্থে দেখা। মনে হল হারিয়ে যাওয়া আমিকেই ফিরে পেয়েছি। ওর চাহনিতে ছিল বন্ধুত্বের আশ্বাস আর আমার চাহনিতে? এক স্পর্শের বৃত্ত, একটা সম্পূর্ণ স্বর্গ-খেলনা আর ফিরে পাওয়া সেই একটা কিছু...

সামনের সোফায় বসে আছে গৌরব আর কুসুম। ওদের পেছনের দেয়ালে লতা আপার কিশোরী মুখ। মায়াভরা চোখদুটো যেন বলছে 'হ্যাঁরে তরু, রাতের বুকে তারাকেই যে মানায়।' সেই চাহনি দূরে সরিয়ে কঠিন গলায় বলি- 'এসব আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়ো! লাইফটাকে কমপ্লিকেটেড করার কোন মানে হয়?' চলতে থাকে আরো অকাট্য সব যুক্তি। গৌরব ভট্টাচার্য তুলে নেয় কুসুমের হাত, ‘তরু মাসী, আমাকে ভীরুর মতো, অপরাধীর মতো বেঁচে থাকতে বলছেন? সরে গিয়ে কুসুমকে কষ্ট দিতে পারব না। ওকে ছোট করতে পারব না।' একদিন মনির যা দেখেছিল তরুর চাহনিতে, কামরুল লতার চাহনিতে যা দেখতে পারত, আজ রাত তাই দেখল তার প্রিয়ার চাহনিতে একটি স্পর্শের বৃত্ত, সেই একটা কিছু- জীবনসঙ্গীর প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা। শুধু স্বর্গ-খেলনাটি অসম্পূর্ণ। পৃথিবীতে সবাই কি স্বর্গ-খেলনা গড়বে বলে আসে?


No comments:

Post a Comment