25 October 2015

মৌসুমী রহমান

মানুষবাঁচে তার কর্মে। এই বাঁচা ও কর্ম বলতে আমরা কি বুঝি? সেটাই প্রশ্নের বিষয়। এগুলোর অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম। মূলত এটা আপেক্ষিক ব্যাপার। আমার দৃষ্টিতে এক ব্যক্তির কাছে অন্য আর এক ব্যক্তির স্মৃতি যদি বাতায়ন খুলে দেখা নারিকেল গাছটার মতই মনের আঙ্গিনায় বারবার দৃশ্যমান হয় তবে ঐ স্মৃতির মাঝেই লোকটি বেঁচে থাকে। হতে পারে ঐ স্মৃতি কোন বিশেষ ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প, সাহিত্য, স্বাধীনতা ইত্যাদি কোন একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে লোকটি বেঁচে থাকতে পারে। এই বাঁচাটা কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করে তার কর্মে। কর্মের সৃষ্টি হয় মূল্যবোধের দ্বারা।

মূল্যবোধটা আসে একজন মানুষের ভিতর থেকে মুকুলিত হয়ে। সুস্থ বিবেকের তাড়নার ফল স্বরূপ সৃষ্টি হয় সার্থক কর্মের উস। কিন্তু সেই সুস্থ মূল্যবোধের কম্পন আর বিবেকের ঝঙ্কার আজ কোথায়? আজ আর তেমনভাবে সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তার বিষ্ময়কর সমাবেশ সহজে নজরে পড়েনা।
বর্তমানে লোক যতই বুলি আওড়াক - সভ্যতার আলোয় আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী, কিন্তু আমি বলব চোখ ধাঁধাঁনো সেই আলোর পেছন পেছন ছুটে ধেয়ে আসছে তুমুল নিকষ কালো অন্ধকার। সমূহ সর্বনাশা অনিশ্চয়তা ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমান। কারণ, আমি তো দেখছি আজকের সভ্যতা ক্ষমতা পাবার লোভ, ধনী হবার আকাঙ্ক্ষা আর যশঃ-প্রতিপত্তি বাড়ানোর উন্মাদনা কেই তাড়িয়ে বেড়ায়।
তাদের মধ্যে তোলপাড় করে তথাকথিত কালচার্ড হওয়ার জন্য; যেখানে শুধুই পাশ্চাত্য ছোঁয়া আর নকলের ছড়াছড়ি। আমার তো ধারণা, মানুষ আজকাল অত্যাধুনিক হওয়ার মরিয়া প্রচেষ্টায় তাদের দেহটাকে ও নকল করে ফেলেছে। ক্রমান্বয়ে এইভাবে মনুষত্বের সকল পরমার্থ নির্বিকারে জলাঞ্জলি দেওয়া নিশ্চয় আতঙ্কের।

আজকাল মানুষ নেতা হয় দেশের সেবা করার জন্য নয়, দেশকেই নিজের সেবায় লাগানোর জন্য, অর্থকে  নিজের আত্মার জন্য উসর্গীকৃত করার জন্য। লোকের সামনে দেশ দরদী কিন্তু আত্ম সম্মুখে অর্থ দরদী। এই ধরনের অতি দীন, হীন মনুষ্যত্ব বিবর্জিত বুদ্ধিবৃত্তির জাতীয় অনুশীলন চললে দেশটা অতি নিকট দূরে কোথায় যাবে? ভেবে দেখেছেন? দেশটা যদি যায় নরকে তবে যে সেই দেশটারই পেট ভর্তি আমরা সবাই! আমরা তাহলে আদতে কোথায় গেলাম?

আজ আমরা ভিতরের আমি আর বাইরের আমির মাধ্যে সর্বদা বৈপরীত্য লক্ষ্য করি। কিন্তু কেন? লোক ঠকানো তে, ভেজাল দেওয়াতে, কালো বাজারিতে, সু-উচ্চ অট্টালিকা বানাতে, দামি গাড়িতে ঘুরতে খুবই পছন্দ করি। এতে আমাদের আত্মা দিন দিন আরও বেশি কলুষিত হচ্ছে। এখন আর মানুষ কর্মব্যস্ত থাকেনা, থাকে উপার্জন ব্যস্ত। কর্মের সাথে অর্থের পাশাপাশি কল্যাণের যোগ থাকে। কিন্তু উপার্জনের সাথে থাকে কেবল ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের লিপ্সা। হ্যাঁ, বাঁচার জন্য অর্থের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, কিন্তু তার বৈধ মাত্রা ছেড়ে অবৈধ পথে পা বাড়ানোটাই যে রীতিমত ভয়ের কথা।

যদি ইংরেজী শেখার কথা বলি তাহলে বলতে হয় শিশু জন্মের পরপরই বাবা-মাযেন আদা-জল খেয়ে লেগে পড়েন a b c d তথা ইংরেজি বর্ণ, শব্দ, বাক্য শেখাতে। অপরদিকে মাতৃভাষাটা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারেনা, বলতে ও লিখতে গেলে তো বিকৃত হয়ই। মাতৃভাষা শিখতে এত অবহেলা কেন? ভাবতে গেলে অবাক লাগে, ভীষণ অবাক লাগে, যে ভাষার জন্য এত ত্যাগ তীতিক্ষার বন্যা বয়ে দিলাম আজ তার এই অবহেলিত রুপ! এর জন্যই কি আমরা রক্তের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সোনালী সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিলাম? বিদেশী ভাষা শিখতে হবে নিজেদেরই প্রয়োজনের তাগিদে এটা ঠিক কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে আগে যথার্থ সম্মান তো করতে হবে। সেই সাথে ভাষার প্রতি মূল্যবোধও থাকতে হবে। কারণ, সম্মানবোধের জন্ম সংস্কার থেকে, অপরদিকে মূল্যবোধের জন্ম আত্মসচেতনতা থেকে। কাজেই নিজের আত্মা থেকে যখন মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জন্মাবে তখনই প্রকৃত অর্থে ভাষাকে যথাযথ মূল্যায়িত করা হবে।আধুনিক কালে মডার্ন না হলে কি চলে? তাই আমরা সবাই মডার্ন, না-না আল্ট্রা মডার্ন হতে চাই। হায়রে মডার্ন! মডার্নের শ্রী দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রথমে সংগীত প্রিয়তার কথা বলি।

সংগীত হল মানুষের মনের প্রশান্তির খোরাক, কোন একটি বিষয়ে প্রেরণার উ, সাহ সৃষ্টির জন্য মোক্ষম হতিয়ার, নির্মল বিনোদন। আর গানের কথাগুলো হবে এমন যা একা একা লুকিয়ে নয়, সবার সামনেই বসে একসাথে শোনা যাবে। গানগুলো সুধী সমাজসহ সকল সমাজেই সমাদরে গৃহীত হবে। কিন্তু, মডার্ন গানগুলো একবার ভাল করে কান পেতে শুনে দেখুন...। সেখানে কি পান? গানের কথা না যন্ত্রের বিকট শব্দ? আর যেটুকু বা কানে আসে সেই শব্দগুলো কি বাবা, মা, ভাই, বোন, শিক্ষক সবার সামনেই শোনার মত? না তা নয়। বেশির ভাগ গানের কথাগুলো যৌন আবেদন আর অশালীন শব্দের সমন্বয়ে বাক্যের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু বিস্মিত হতে হলেও এটাই সত্যি; গানগুলো এখন শিক্ষাকেন্দ্রেও চলে।  আর বিদেশী গানের কথা নাইবা বললাম।

এবার পোষাকের কথায় আসি। এখন আমাদের সৌন্দর্য প্রিয়তা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, মেয়েরা বিশেষত এমন পোষাকে এমনভাবে সেজে পথে-ঘাটে-রাস্তায় বের হন যে বাবা তার ঊনযৌবনা কন্যার দিকে তাকাতে লজ্জাবোধ করেন। অনেক স্বামী তার স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি দিতে পারেন না। অবশ্য কটমটে পোশাক পরিহিতা ললনার দিকে কুরুচিপূর্ণ কদর্য মানসিকতা সমপন্ন বখাটে  যুবক গুলো রসালো দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করতে খুবই পছন্দ করে। যার ফলশ্রুতিতে ঘটছে ইভটিজিং থেকে শুরু করে এসিড নিক্ষেপ পর্যন্ত। এগুলো পত্রিকার পাতা খুললেই হর-হামেশাই দেখা যায়। একবারও কি মনে প্রশ্ন জাগে না? কেন এমন হয়? কাকের পেছনে ময়ূরের পুচ্ছ লাগালেই কি ময়ূর হওয়া যায়? নিজেকে আমরা কেনই বা এমন সস্তা বানাবো? জানিনা, আমার বিদ্রুপ কারও গায়ে লাগছে কিনা। কিন্তু সারাক্ষণ চারপাশ থেকে বিদ্রুপের যে অট্টরোল ছুটে আসে তা কি একবারও কানে লাগে না?

আমাদের মাঝের সাধুতা, কর্তব্য পরায়ণতা, দায়িত্ববোধ আজ বলতে গেলে তিরোহিত। আমরা আমাদের পেশাতে যেটুকু সময় ব্যয় করি সেটুকুরই বা কেন যথাযথ ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করিনা? আমাদের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকেও তো অন্তত সেটুকু করা উচিত। সময় তো আমাদের ব্যয় করতেই হয়। সেই সময়টা কাজে লাগানোই তো মহ কাজ। আমি জানি প্রতিটা মানুষের মাঝেই বিবেক লুকায়িত থাকে। থাকে মনুষ্যত্ব। কিন্তু কারও থাকে সুপ্ত, কারও থাকে জাগ্রত। আমি চাই সবার বিবেকের দুয়ারটা খুলে যাক। বিবেক যাদের ঘুমিয়ে আছে তাদেরটা জাগ্রত হউক। ভুল মানুষ না জেনে একবার করতে পারে কিন্তু জেনে বারবার করতে পারেনা। তাহলে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। সেই অপরাধ যেন আমরা না করি। প্রথমে সেই উদার আহ্বান আমরা নিজেরা নিজেকেই করি।

আমি চাই, আমাদের চিন্তার মধ্যে সাদা কথা আমাদের আমির মধ্যে মৌলিকত্ব  থাকুক। মূল্যবোধের চেতনাটা প্রতিটা ব্যক্তির কাছেই প্রখর ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হোক। অন্য সংস্কৃতির অপশক্তি যেন আমরা নিজেরই নিজেদের মূল্যবোধের উপর চাপিয়ে না নিই। বোধ করি, এখনই  সময় এসেছে নিজের ভেতরটাকে পরখ করে নেওয়ার। তাই আগে আমি যাতে নিজেই নিজেকে সম্মান করার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ নিজের মধ্যে সংগ্রহ করে মজুদ করতে পারি সে ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে । তবেই না অন্য কেউ আমাদের সম্মান করবে।

আসুন, আমরা সবাই নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি। প্রতিটা বিষয়ে আমাদের নিজেকে আমরা নিজেরা প্রশ্ন করিনা বলেই কিন্তু আমাদের এত দুরাবস্থা। আমরা আমাদেরই বিবেকের কাছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে নতুন করে আবার নিজেকে পরিশুদ্ধ করি, পরিমার্জন করি, পরিকর্ষণ করি। তাহলেই আমরা যথার্থ সংস্কৃতি সম্পন্ন, মার্জিত ও কালচার্ড হতে পারব। আর এখান থেকে যে মূল্যবোধের সৃষ্টি হবে সেটাই হবে যথার্থ মূল্যবোধ।


___________________

No comments:

Post a Comment