25 October 2015

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

অন্যমা ও রক্তজবা

মেয়েটির পরনে শাদাশাড়ি। মেয়েটি সারাদিন উঠানের ধারে বেড়ে ওঠা জবাফুলের বন থেকে রক্তজবা তুলে তুলে কাটিয়ে দেয় সারাবেলা। মেয়েটির নাম বইয়ের মধ্যে লেখা আছে। বইয়ের নাম বলবো না। মলাট ধূসর হয়ে আছে উত্তরের দিগন্তের রূপ।
একজন মিলু কলকাতায় এসে বিপাকে পড়ে যান। তিনি একজন কবি। তার গায়ের রং ঘোর রক্তবর্ণ। তার সংসারে বিরাট অশান্তি একটার পর একটা চাকরিতে টিকতে না পারা, অভাব। এইসব চিন্তায় তার লেখালেখিই বন্ধ হয়ে যায়। এর কাছে, ওর কাছে চিঠি লিখেন চাকরির জন্য। টাকা ধার করেন। কম ভাড়ায় বাসাবাড়ির সন্ধান করেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলা, হাতে ধরা একটা বন্ধ ছাতা। ছাতার রং কালো। অর্থচিন্তায় অস্থির মিলু রাস্তা পার হচ্ছেন, আর বিদ্যুত চমকের মতো অকারণেই তার মনে পড়ে যায় অরুণিমা সান্যালের মুখ। এই মুখ ভেবে তিনি হাঁটছেন, সমস্ত নীরব কোনো শব্দ তার কানে আসছে না। নিঃশব্দে একটা ট্রাম এসে তাকে চাপা দিয়ে টেনে হিচড়ে কয়েক মিটার টেনে নিয়ে গেলো। তিনি চেতনা হারানোর আগে যে মুখটি তার চেতনায় ছিলো তা অরুণিমা সান্যালের।
শম্বুনাথ হাসপাতালে মিলুর জ্ঞান ফিরলে মনে পড়ে যায় বরিশালের সেইসব কথা। অরুণিমা সান্যালের সঙ্গে দেখা। তাকে নিয়ে কবিতা লেখা, প্রেম, তারপর ছাড়াছাড়ি এইসব নানা ঘটনা। মনে পড়ে যায় অরুণিমা সান্যাল আসলে তারই দেয়া একটা নাম, সে ছিলো মুসলিম ঘরের মেয়ে; নাম আয়েশা আক্তার।
অরুণিমার মুখ ভাবতে ভাবতে মিলু মারা যান। তার পাল্স চেক করে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেন যিনিতিনি ডাক্তার আয়েশা আক্তার, মিলুর অরুণিমা সান্যাল। শম্বুনাথে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ডাক্তার আয়েশার আন্ডারেই তিনি ছিলেন, একবারও বোঝা যায় না ইনিই অরুণিমা। ডেথ সার্টিফিকেট লেখার সময় যখন ডাক্তারের হাত কাঁপে তখন খানিকটা বোঝা যায়।
মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়। কলেজের লাইব্রেরিতে মুখোমুখি বসা মিলু গীতবিতানের ভাঁজে গুজে দেয় একটা চিরকুট। আয়েশা খুলে দেখে, তাতে লেখা তুমি অরুণিমা সান্যাল... 
ডাক্তার আয়েশার চশমার কাচে জমে উঠে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত পউষের ভোর। তার চশমাটা আমি আলতো হাতে খুলে নিয়ে শুধাই চুপিচাপ, মা, মিলুর সঙ্গে তোমার কি আর কখনোই দেখা হয়নি?
মা চুপিচাপ জানলার কাচের ওপারে তাকিয়ে দেখে ফুরিয়ে যাওয়া দিগন্তের রং।
মা, আমার গায়ের রং ঘোর রক্তবর্ণ।  
মা চুপিচাপ জানলার শার্সিতে ভেঙে যেতে দেখে পিঁপড়ের সারি, তাহাদের অগস্ত্য যাত্রা। মায়ের কি মনে পড়ে যায় অগস্ত্য মুনির কথা? আমি মায়ের হাতের একটা আঙুল সেই ছোটোবেলার মতো ডানহাতের মুঠোর মধ্যে ধারণ করি। তারপর তার পায়ের কাছে বসে বামহাতে তার কোলে তুলে দিই আমার প্রথম কবিতার বই। বইয়ের নাম, ‘পাখি ও পাপ।’ 
ডাক্তার আয়েশার পরনে শাদাশাড়ি, তার স্মৃতি এখন রক্তজবার বন।

_____________



রাজহাঁস যেভাবে মাছ হয়
তার কাছ থেকে চলে আসার পর আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ যাচ্ছিলো। সারাদিন রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই। পরিচিত লোকজন বন্ধুবান্ধবদের কাছে গিয়ে গিয়ে চাকরি খুঁজি। এক পর্যায়ে তারা আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে, ফোন ধরে না, কল কেটে দেয়। একবার চাকরি ছেড়ে দিলে আরেকটা চাকরি পাওয়া ভয়ানক কঠিন, তা আমার মতো অনেকেই জানেন। স্ক্রিপ্টরাইটার হিশেবে এক জায়গায় ভালোই শুরু করেছিলাম। ছাদের উপর গাঞ্জা টানছিলাম, আর বসের বউ ফোনে কথা বলতে বলতে ছাদে উঠে আসলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভালো আছে কিনা। আর আমার চাকরি চলে গেলো। এর আগে অবশ্য আমি নিজেই নয়টা চাকরি ছেড়েছি। তারমধ্যে একটা চাকরি ছেড়েছি ছয়দিনের মাথায়। যাই হোক এখন ফা ফা করে ঘুরে বেড়াই, আমার বুকের ভিতর বিচ্ছরি টাইপের যন্ত্রণা হতে থাকে যেনো বা কেউ হৃপিণ্ডের বোঁটায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে কুড়িতলার ছাদ থেকে ছেড়ে দিয়েছে আর আমি দ্রুত পতিত হচ্ছি মাটির দিকে, কুড়িতলা হয়ে যাছে ষাটসত্তুরআশিতলা, আকাশের দেবতা খামচে ধরে আছে আমার হৃপিণ্ড।
একদিন নিজের উপর রাগ করে কাঁধের ঝোলা থেকে বের করে আমার ভাত খাওয়ার সানকিটা আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললাম। মোবাইল ফোনটা পানবিড়ির দোকানে ছয়শোটাকায় বিক্রি করে টাকাগুলি বামহাতের মুঠোতে চেপে ধরে যখন একটা পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে আছি তখন দেখি এক ছেলে গরুদুধের বড়সরো বোতলহাতে একটা বাসায় ঢুকছে। আমার সহসা কিয়েসলোভস্কির ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেলো যে কিনা পাড়ার এক সুন্দরীর প্রেমে পড়ে দুধঅলা হয়ে গেলো। ভাবলাম একটা টিয়্যুশন জুটিয়ে নিই, ভাবলাম বাঙলাবাজারে গিয়ে আবার প্রুফরিডারের কাজ খুঁজি, ভাবলাম বেশ্যার দালালি করি, ভাবলাম ফুল বিক্রি করি।
একবার ভাবলাম লেখক হয়ে যাই, গল্প লিখি, কিন্তু গল্প লিখে কী হবে? এখনতো গল্প চলে না, এখন গল্পের নামে লোকজন নাটক লেখে, সংলাপে ঠাসা, তারা জানে না যে সংলাপবহুল গল্প সবচেদুর্বল গল্প। তারপর ভাবলাম গ্রামে চলে যাই।
আমার গ্রামের নাম কাচপুর। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপাড়ে। তার সঙ্গে বসবাসের আগে আমি থাকতাম কাকার বাড়িতে, কাচপুরে। কাচপুরে একদিন কাচপোকার মড়ক লেগেছিলো কিনা সেইকথা জানার আগে জেনেছিলাম আমার তিনবছর বয়সে আমার বাবা-মা দুজনেই শীতলক্ষ্যার বুকে অজানিত কারণে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তারপর আমাদের বাড়িঘর ছোটোকাকা দেখভালের সঙ্গে আমাকেও দেখভালের দায়িত্ব নিলেন। আমি রাতভর রাজহাঁসের কনাকনাকনা... ডাক শুনি, দরজা-জানলা খুলে কাচারি ঘরে ঘুমাই। এইভাবে কেটে যাচ্ছিলো শাদাকালো একফালি জীবন। কিন্তু হঠা আমার আঠারোবছর বয়সে একদিন মাঝরাতে আমার জীবন রঙিন হয়ে উঠলো, ছোটোকাকা কাকির সঙ্গে আমার যৌনসম্পর্ক আবিস্কার করলো। এবং আমাকে বাপান্ত করে ঘর থেকে বের করে দিলো, কাকি আমার অন্ধকার ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে নতমুখে নীরবে সায় দিলেন। অথচ কাকা বলার আগে এই সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। যাই হোক আমি অবাক হলাম না। রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথামৃত, আমার তেরোটা কবিতার খাতা আর একটা বাঙলা অভিধান আমার ঝোলাব্যাগে নিয়ে নদী পার হয়ে শহরতলীর দিকে চলে গেলাম গভীর রাতে।
তারপর বেশকবছর ঘুরেটুরে ছেড়েছুঁড়ে কিংবা বিতাড়িত হয়ে পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে দুধের বোতল হাতে ছেলেটিকে দেখে আমার প্রবল তৃষ্ণা হলো। আমি পার্শ্ববর্তী একটি চায়ের দোকানে বসে একটা দুধবেশি চায়ের কথা বলে একটা টুলের উপর বসলাম। যখনি ভাবলাম একটা ভ্রাম্যমাণ কেকের দোকান দিয়ে বসবো তখন দোকানির মাথার উপর কাঠের তাকে উপবিষ্ট একটি টেলিভিশনের স্ক্রিনে আমার চোখ আটকে গেলো। আবার দুধ! ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে একটা চ্যানেলে। গোয়ালারা তাদের গরুদের একদিনে দোয়া সমস্ত দুধ একটা দিঘিতে ঢেলে দিয়েছে। এইটা তাদের প্রতিবাদ, কারণ শহরের দুধ-কোম্পানিগুলি তাদের কাছে কম দামে দুধ কিনে চড়া দামে বিক্রি করে। আমি খবরে আরো মনোযোগী হলাম-- যখন দেখলাম ঘটনা আমাদের গ্রামের। দিঘিটা খবরে দেখাচ্ছে। আমার তৃষ্ণা ফুরিয়ে গেলো। আমি একটা বাসে উঠে পড়লাম। 
যখন গ্রামে পৌঁছলাম, গিয়ে দাঁড়ালাম দিঘিটির পাড়ে আমার ছায়া দীর্ঘ হয়ে দিঘির মাঝ বরাবর চলে গেছে, সূর্যের দীর্ঘ আলতা-রঙ আলো এসে পড়েছে শাদা দিঘির বুকে, তখন মনে হলো এই বুঝি দুধে আলতা-রঙ। আর ছায়ার নিচে এমন ধবলরঙ জীবনান্দের কবিতায়ও পাওয়া যাবে না। আমার মনে হলো এই বুঝি রূপকথার দুধের দিঘি। এই দিঘিতেই শাদাপরীর হিরণ্ময় স্নান অথবা দিঘির অতলে লুকোনো সিন্দুকে বন্দী ভ্রমরের বুকের ভিতর আছে রাজকুমারের প্রাণ। আহা রাজকুমার! নিজেকে রাজকুমার ভাবতেই ভয় হলো। আমার ঘোর কেটে গেলো। এবং তারপরেই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। একপ্রকার শয়তানি বুদ্ধিও বলা যায়। রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেছিলেন রাজহাঁস জল থেকে দুধ আলাদা করতে পারে। সূর্য প্রায় নিভে গেছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমার মনে আছে ছোটোকাকার রাজহাঁসের খামারটা দিঘির অদূরেই, এতোক্ষণে সব হাঁস আরাইলে ঢুকে গেছে। আমি চুপিচাপ গিয়ে কাকার খামারে আগুন দিলাম। আগুনের শিখা লেলিহান হওয়ার আগেই কাকা দৌড়ে এসে আরাইল ঘরের বেড়া কেটে দিলো। আর ঝাঁকে ঝাঁকে রাজহাঁস কনাকনাকনাকনা... ডেকে ডেকে বের হয়ে গেলো। দেখলাম তারা ঝাপিয়ে পড়ছে দুধভর্তি দিঘির জলে। আমি সতেরো মিনিট ধরে আরো অন্য অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখলাম রামকৃষ্ণ পরমহংসই সত্য। তারপর দুধরহিত দিঘির জলে হাঁসেরা একযোগে ডুব দিলো। আর উঠলো না। তবে চিকচিক করে লাফ দিয়ে ডুব দিতে লাগলো অজস্র মাছ। এই দিঘিতে অজ্ঞাত কারণে পূর্বে কখনো কোনো মাছ জন্মাতো না।

কাকা সহসা এসে আমাকে বুকে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো, বাবুরে আমার হাঁসগুলান মাছ হইয়া গেলো রে...


______________

No comments:

Post a Comment