25 October 2015

মাসুম বিল্লাহ


নিঃসঙ্গ মিসির আলীর বাসায় হিমুর কখনো প্রয়োজন পড়েনি। এতো রাতে হিমুকে দেখে মিসির আলী খানিকটা চমকালেন, তবে সে চমকানো আড়াল করতেও সময় নিলেন না।
কথা না বলে চিঠিটি মিসির আলীর দিকে বাড়িয়ে ধরলো হিমু।
চিঠিটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পুরোটা পড়লেন মিসির আলী। চিঠি পড়া শেষ হলে মুখ খুললেন তিনি।
: হিমু, তুমি যে লজিক মানো না তা জানি। তাই তোমার চিঠিটা পড়ে অবাক হইনি।
-মিসির আলী সাহেব, প্লিজ আজ কোনো লজিক শুনতে বা মানতে ভালো লাগবে না। আপনি তারচেয়ে আমাকে একটা সমাধান বের করে দেন। আপনি তো অনেকেরই সমস্যার সমাধান দিয়েছেন, প্লিজ মিসির আলী সাহেব। 
: হিমু শান্ত হও। তোমাকে কখনো এমন অবস্থায় দেখা তো দূরে থাক, ভাবিও নি। সম্ভবত তোমার স্যারও দেখেন নি, তাই না?
- মিসির আলী সাহেব আপনি কিন্তু আসল কথা না বলে অযথা কথা বাড়াচ্ছেন।
: দুঃখের দিনেও মাথা শান্ত রাখতে হয় হিমু। তুমি কষ্ট পাচ্ছ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমিও কী কম কষ্ট পাচ্ছি। লজিকের কারণে আমার কষ্টটাও আড়াল করে রাখতে হচ্ছে।
মিসির আলীর কথা শেষ হওয়ামাত্র হিমু উঠে দাঁড়াল। কোনো কথা না বলে বাহিরে পা বাড়াল।


২.
ঢাকা শহরে মধ্য রাত।
এতো রাতে কোনো চায়ের দোকান খোলা পাওয়ার কথা না। পরিচিত কোনো চায়ের দোকানের দিকে যাওয়া যাবে না। হিমুকে এ অবস্থায় দেখার জন্য কেউ প্রস্তুত না। নানান প্রশ্ন করবে। উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করতেও ছাড়বে না অনেকে।
এই প্রথমবার হিমুর মনে হলো, এক জোড়া চটি বা স্যান্ডেল থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকা শহরের রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার মতো আর কোনো পথ নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর জীবনে প্রথমবারের মতো অবাক হলো হিম পাঞ্জাবীর পকেট নেই। পকেট না থাকার ফলে টাকাও নেই। আফসোস, আফসোস। এখন চা খাবে কি করে? পায়ে স্যান্ডেল না থাকা, পকেটহীন পাঞ্জাবীর জন্য জীবনে এই প্রথম ও শেষ বারের মতো প্রশ্ন তুলল হিমু। হায়, হিমুর মনে এ কোন ভাবনা। বিপরীত হিমুর মতো চিন্তা! শোক মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না।
এতোদিন এসব প্রশ্নের প্রয়োজন পড়েনি কারণ, হিমুর পাশে হুমায়ূন স্যার ছিলেন। হিমু তার নিজস্ব জগ থেকে ছিটকে পড়েছে বলে মনে করছে। ভাবনা পুরো শেষ হয়নি। একটা চায়ের দোকানে হারিকেনের আলো দেখা গেল। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে কেউ একজন বসে আছে বলে মনে হচ্ছে।
যে হিমু সহজে চমকায় না, সে আজ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। হলুদ পাঞ্জাবী পরা একজন যুবক বসে আছে। ঘাড় কাত করে দাঁড়িয়ে থাকা হিমুকে এক পলক দেখল হতাশ চোখে।
: ‘কে তুমি?’ অবাককণ্ঠে প্রশ্ন করল হিমু।
- ‘আমি হিমু।’ শান্ত জবাব যুবকের।
: ‘হিমু তো আমি! তুমি হিমু হলে কবে থেকে?’ একটু জোরের সাথে হিমু বলল।
- ‘আমরা সবাই হিমু স্যারের রাজত্বে! আমি হিমু। আপনি হিমু!’ জড় পদার্থের মতো কথাগুলো বলে গেল হিমুর সাজে যুবকটি। 
যুবকের কথা শুনে হিমু আর কোনো কথা বলার জন্য যুক্তি খুঁজে পেলো না। শেষে নিজেকে দ্বিতীয় হিমুর কাতারে ভেবে নিল। যুবকের কাছে প্রমান করার কিছু নেই, যে সে-ই হিমু। হিমু যুবকের পাশ ঘেঁষে বসল। এসময় রাস্তা দিয়ে একটা পুলিশের জীপ চলে গেল। জানি না, কেনো জীপ থামিয়ে হিমুদের কাছে এসে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে জীপে তুলে থানায় নিয়ে গেল না পুলিশ?
: ‘তুমি কেনো এখানে এ অবস্থায় বসে আছো?’ যুবককে প্রশ্ন করল হিমু।
-‘হমায়ূন স্যার আমাকে ফেলে একা চলে গেছেন। একা একা আমরা থাকবো কি করে? স্যার কেনো একবারও ভাবলেন না আমাদের কথা?’ হিমুকে উদ্দেশ্য করে যুবকের প্রশ্ন।
: ‘মন খারাপ করো না। হিমুরা কখনো মন খারাপ করে না।’ হিমু উদভ্রান্ত যুবককে বলল।
- ‘কিন্তু আপনার চোখে জল কেন? আমাকে মন খারাপ করতে নিষেধ করে, নিজেই কাঁদছেন। কাঁদেন, মন খুলে কাঁদেন।’ হিমুকে জড়িয়ে ধরল যুবক। এবার দু’জনই কাঁদতে লাগল। যুবক হিমুর চোখের জল দেখতে পেলো না।
হুমায়ূন আহমেদ স্যার, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন, আপনার হিমু কাঁদছে? হিমু হতে চাওয়া যুবকটিও কাঁদছে সেই সাথে। আপনার হিমুরাও কাঁদতে জানে। প্রিয় মানুষটির জন্য কাঁদতে জানে। আপনি এসে ওদের কান্না থামিয়ে দিয়ে যান, প্লিজ।


৩. 
পুরো রাতটা হিমু এই চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। যুবকটিকে অনেক বুঝিয়ে নিজ বাসায় ফেরত পাঠিয়েছে। অন্য কেউ হলে পারত না। হিমু বলেই পেরেছে। আজকের রাতটা বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের বড়। একা একা কথা বলছে হিমু। হঠা সেসময় হিমুর কথার প্রতিউত্তর দেয়ার জন্য একটা অদেখা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো হিমু।
: ‘আমার কথার জবাব কে দেয়? কে তুমি?’ জড়ানো কণ্ঠ হিমুর।
-‘আমি হিমু।’ আত্মবিশ্বাসের কণ্ঠে বলল অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটি।
: ‘আমিই হিমু।’ গলায় জোর এনে বলল হিমু।
-‘এখন আর তুমি হিমু নও। তোমার আর কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমি আর খালি পায়ে হাঁটতে পারবে না। রূপার বাসার সামনে রাত দুপুরে গিয়ে হ্যাবলার মতো হানা দিতে পারবে না। টেলিফোনে রূপার কণ্ঠস্বর শুনতে পারবে না। কোনো বিপদে রূপা আর এগিয়ে এসে তোমাকে উদ্ধার করবে না। এখন থেকে তুমি ছায়াহিমু। তোমার স্যার তোমাকে আর পরিচালিত করবে না। হাঃ হাঃ।’ হরহর করে বলে গেল অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটি।
: ‘না....’ চিকার করে উঠল হিমু।


৪.
পর দিন। কাক ডাকা ভোর। হেঁটে হেঁটে বাদলের কাছে উপস্থিত হলো হিমু। বাদলেরও মন খারাপ-তা না বললেও চলে।
: বাদল যাবি আমার সাথে?
-যাব না মানে, অবশ্যই যাবো।
: জানতে চাইলি না-কোথায় যাবো?
-না। তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাবো।
: হুম। খামটা তোর পকেটে রাখ। দেখিস হারিয়ে ফেলিস না।
-কিসের খাম, হিমু ভাইয়া?
: চিঠি। এখন আর কোনো প্রশ্ন করিস না, বাদল। চল রওয়ানা দেই।
বাদল আর কোনো কথা বলল না। চুপচাপ হিমুর সঙ্গী হলো। অবশ্য হিমুর যেকোনো কথায় বাদল সম্মতি জানায়। হিমুর মহা ভক্তদের মধ্যে বাদলের সিরিয়াল সবার উপরে।
বাদলকে সঙ্গে নিয়ে হিমু ছুটছে নুহাশ পল্লীর দিকে। হিমুর বিশ্বাস- স্যার নিজেও হিমুর অপেক্ষায় আছেন।


-------------

No comments:

Post a Comment